পিয়েরে থেকে জাস্টিন ট্রুডো এবং বাংলাদেশ

শোয়েব সাঈদ
Published : 16 Sept 2016, 05:19 AM
Updated : 16 Sept 2016, 05:19 AM

জোসেফ ফিলিপ পিয়েরে ইভস ইলিয়ট ট্রুডো (বা সংক্ষেপে পিয়েরে ট্রুডো) কানাডার ১৫তম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ক্ষমতায় থাকা স্বাধীনচেতা এই রাজনীতিক ছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে। তাঁর এই বাংলাদেশবান্ধব ভূমিকার জন্য তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সন্মামনা দেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আজ পিয়েরে ট্রুডো নেই; তাঁর তরফে শেখ হাসিনার কাছ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করবেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র কানাডার ২৩তম প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মারা যান পিয়েরে ট্রুডো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্লোবাল ফান্ড ফিফথ রিপ্লেনিশমেন্ট (জিএফ) সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্যে কানাডা সফরে আছেন।

দৃঢ়চেতা রাজনীতিবিদ পিয়েরে ট্রুডো আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্কের পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবেই চলতে চেয়েছেন। আর তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সংগ্রামে মার্কিনিদের নীতির মাঝে হারিয়ে যেতে চাননি। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে পিয়েরে ট্রুডোর ভূমিকা মুক্তিসংগ্রামরত একটি জাতির জন্যে কেবল মানবিকই ছিল না, ছিল দুঃসময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক আশীর্বাদ।

বলাই বাহুল্য, বুদ্ধিজীবী পর্যায়ের হাতে গোনা যে কজন রাষ্ট্রনায়ক স্মরণীয় হয়ে আছেন বিশ্ব রাজনীতিতে, পিয়েরে ট্রুডো তাঁদের অন্যতম।

১৯১৯ সালের ১৮ অক্টোবর মন্ট্রিয়লে জন্ম নেন পিয়েরে ট্রুডো। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এবং কিছুদিন বিরোধী দলে থেকে আবার ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।

মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ডিগ্রিধারী পিয়েরে ট্রুডো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, প্যারিসের পলিটিক্যাল সায়েন্স ইন্সটিটিউট এবং লন্ডনের স্কুল অব ইকনোমিক্সে পড়াশুনা করেন। মার্ক্সবাদের প্রতি একদা অনুরক্ত ক্যাথলিক পিয়েরে ট্রুডো হার্ভার্ডে কাজ করেন কম্যুনিজম এবং ক্রিশ্চিয়ানিটির ওপর।

১৯৪০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত মূলত মন্ট্রিয়লে বসবাস করেন এবং একজন ইন্টেলেকচ্যুয়াল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন পিয়েরে ট্রুডো। ষাটের দশকের শুরুতে মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে লিবারেল দলে যোগ দেন এবং মন্ট্রিয়ল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান অভ্যুদয়ের পরপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন ট্রুডো। তারপর ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টোকিও থেকে ফেরার পথে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন।

পিয়েরে ট্রুডো কানাডার রাজনীতিতে 'লিজেন্ডারি ফিগার'। কানাডার সংবিধানের আধুনিকায়ন এবং কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদার গণতান্ত্রিক, মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে কানাডার মর্যাদা অন্য রকম উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সংবিধানের আধুনিকায়ন এবং কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস প্রণয়নের জন্যে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন পিয়েরে ট্রুডো।

মাল্টিকালচারিজমের চেতনায় বৈচিত্রময় জাতিগোষ্ঠীর ঐক্যতানের সত্যিকারের সহনশীলতা আর প্রগতির বর্ণিল কানাডিয়ান ধারা সৃষ্টিতে উদার পিয়েরে ট্রুডোর অবদান অবিস্মরণীয়। প্রগতিশীল আর মানবিক চিন্তা চেতনার পিয়েরে ট্রুডো দৃঢ়চিত্তের একজন রাজনীতিবিদও ছিলেন।

মস্কোতে একটি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কারণে পঞ্চাশের দশকের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরাক্রমশালী প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবিধ বিষয়ে সুসম্পর্কের পাশাপাশি স্বকীয় পররাষ্ট্রনীতির আদর্শিক ধারাটাও সম্ভাব্য মেনে চলতেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রেসিডেন্টের কাছে কাঙ্ক্ষিত বন্ধু ছিলেন না পিয়েরে ট্রুডো। সম্পর্কের এই বাস্তবতা বিষয়ে অটোয়া ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে ১৯৬৯ সালে পিয়েরে ট্রুডোর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন–

"যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী হিসেবে থাকাটা হচ্ছে হাতির সঙ্গে ঘুমানো। যতই বন্ধুভাবাপন্ন বা ভদ্র হোক না কেন প্রাণীটির প্রতিটি আকস্মিক আন্দোলন বা ক্ষুদ্র শব্দেও প্রতিক্রিয়া অবধারিত।"

অভ্যন্তরীন রাজনীতির ক্ষেত্রেও উদার কিন্তু দৃঢ়চিত্ত ছিলেন পিয়েরে ট্রুডো। কুবেক কানাডার একমাত্র বিচ্ছিন্নতাকামী প্রদেশ, যারা স্বাধীন হওয়ার জন্যে রেফেরেন্ডামসহ নানা প্রচেষ্টায় লিপ্ত। কুবেকবাসী হয়েও কানাডা ঐক্যের প্রতি পিয়েরে ট্রুডোর কমিটমেন্ট ফেডারেলিস্টদের প্রেরণার উৎস। বিক্ষোভকারীদের আক্রমণাত্মক আচরণের মুখে সভাস্থল ত্যাগ না করে বিক্ষোভকারীদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়া বা তাদের সঙ্গে অবস্থান করার সাহস পিয়েরে ট্রুডোর মতো একজন গণমুখী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেই সম্ভব।

পিয়েরে ট্রুডো ব্যাচলর হিসেবেই প্রধানমন্ত্রী হন এবং প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় বিয়ে করেন। ১৩ বছরের বৈবাহিক জীবনে তিন পুত্রের জনক হন। পরে পিয়েরে ট্রুডো দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন; ১৯৯১ সালে এক কন্যার জনক হন।

শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ পিয়েরে ট্রুডো তাঁর সন্তানদের পড়াশুনার দেখভাল করেছেন অনেকটাই নীরবে। বড় ছেলে জাস্টিন আজকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী, মেঝ ছেলে আলেকজান্ডার কানাডার বিখ্যাত ফিল্মমেকার। সবচেয়ে ছোটটি মাইকেল ভ্যাঙ্কুবারে স্কি করার সময় তুষার ধ্বসে মারা যান ১৯৯৮ সালে। এই দুর্ঘটনার পর পিয়েরে ট্রুডো অনেকটাই নিভৃতে চলে যান।

বাবার পথ ধরে রাজনীতিতে এসে জাস্টিন ট্রুডো সতর্ক থেকেছেন, যাতে একটা নিজস্ব স্বকীয়তায় চলতে পারেন এবং বাবার ছায়া তাঁকে গ্রাস না করে। মন্ট্রিয়লের দুটো নামকরা প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজ হচ্ছে মেরিয়ানাপলিশ (ইংরেজি) আর ব্রেবাফ (ফ্রেঞ্চ)। ব্রেবাফ থেকে পাস করে বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাকগিল থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেন জাস্টিন ট্রুডো। পরে আরেকটি ব্যাচেলর ডিগ্রি নেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

বাবা পিয়েরে ট্রুডোর মতো শিক্ষকতা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ২০০০ সালে বাবা পিয়েরে ট্রুডোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আবেগময় বক্তৃতা দিয়ে প্রথম দৃষ্টি কাড়েন মিডিয়া আর রাজনীতির বোদ্ধাদের। রাজনৈতিক পথ পরিক্রমার অবশেষে ২০০৮ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মন্ট্রিয়লের পাপিনু রাইডিং থেকে। এরপর ২০১১ এবং ২০১৫ সালের নির্বাচনেও একই নির্বাচনী এলাকা থেকে এমপি হন।

কনজারভেটিভদের পর পর তিনটি সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৬ সাল থেকে একটানা ক্ষমতায় থাকা, ২০১১ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল রূপে এনডিপির উত্থান আর লিবারেলের তৃতীয় স্থানে চলে যাওয়ার মতো কঠিন পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিলে ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে জাস্টিন ট্রুডো লিবারেলের নেতা নির্বাচিত হন। এক জরিপে দেখা যায়, জাস্টিন লিবারেলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পরপরই লিবারেলের জনপ্রিয়তা ৪৩ শতাংশে পৌঁছে যায়, যেখানে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভদের জনপ্রিয়তার সূচক ছিল মাত্র ৩০ শতাংশের ঘরে।

জাস্টিন নেতা হওয়ার পর থেকেই লিবারেলরা ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে লিবারেলের সমর্থক ইমিগ্র্যান্টরা কনজারভেটিভদের হটিয়ে একটি লিবারেল সরকারের প্রত্যাশায় আশান্বিত হয়ে ওঠেন। গত বছরের ১৯ অক্টোবরে নির্বাচনে ইমিগ্র্যান্টদের বিপুল সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি জাস্টিন ট্রুডো এবং লিবারেলের প্রতি তাদের সমর্থনেরই ইঙ্গিত দেয়। অবশেষে জাস্টিনের নেতৃত্বে লিবারেলরা আবারও ক্ষমতার ফেরে প্রায় নয় বছর পর।

জাস্টিন ট্রুডোর নির্বাচনী এলাকার ৪০ ভাগ ভোটারই ইইমিগ্র্যান্ট। হাজার হাজার বাংলাদেশি ভোটারের অকুণ্ঠ সমর্থন বরাবরই পেয়ে আসছেন জাস্টিন ট্রুডো। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বাংলাদেশিদের ভূমিকাও উল্ল্যেখযোগ্য।

এই পিতা-পুত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য!

তথ্যঋণ: https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/e/ec/INC_2009_Justin_Trudeau2.JPG