আইভীর উত্থান: টানেলের শেষ প্রান্তের আলো

সাইফুর রহমান তপন
Published : 12 Nov 2011, 08:25 AM
Updated : 12 Nov 2011, 08:25 AM

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর বিজয়ে খুশী হয়নি এমন লোক মনে হয় কমই আছে। যাকে চ্যালেঞ্জ করে নিজ দলের সমর্থন না পেয়েও তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন সেই শামীম ওসমানও তার বিজয়ে খুশী হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। শামীমের দাবি, 'ছোট বোনের বিজয়ে' তিনি লোকজনকে মিষ্টি খাইয়েছেন, যদিও ওই মিষ্টি কারা খেয়েছেন তাদের কোন হদিস কোন গণমাধ্যম দিতে পারেনি। আইভী 'বাপের বেটি'ই বটে!

তবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আইভী ও বিজিত শামীম ওসমানের ফটো সেশন বোধ হয় সুশীল সমাজের একটা অংশকে কষ্ট দিয়েছে। এ মহলটি নির্বাচনের আগে থেকেই শামীম ওসমানের নেতিবাচক দিকগুলো বেশ জোরালোভাবে তুলে ধরেছে এবং তাকে এমনকি আওয়ামী লীগের নরম সমর্থকদেরও কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছে যা আইভীর বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। হয়তো এ কারণেই গণভবন থেকে বেরিয়ে গণমাধ্যমকে দেওয়া আইভীর বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে সবাইকে- বিশেষ করে শামীমকে- নিয়ে তাঁর কাজ করার আকাঙ্খার কথা শোনার পর তাঁদের মুখ একটু মলিন হয়ে গেছে। অবশ্য, তাঁদের এ মনোকষ্টের দায় তাঁরা আইভীর পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, জয়ী প্রার্থীর সম্বর্ধনায় প্রত্যাখ্যাত প্রার্থীকে ডেকে প্রধানমন্ত্রী জনতার রায়কে অসম্মান করেছেন। কেউ কেউ তো এমনও মন্তব্য করেছেন, একজন পরাজিত রাজনীতিবিদ বিজয়ী রাজনীতিবিদের সাথে কাজ করার 'স্বপ্ন দেখেছেন বা সুযোগ পেয়েছেন' এমন নজির 'পৃথিবীর ইতিহাসে' নেই। মজার ব্যাপার হল, এ কথাগুলো যারা বলছেন তাঁরা বরাবরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান পক্ষসমূহ- বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- যেন নির্বাচনী ফলের দিকে না তাকিয়ে মিলেমিশে কাজ করে তার পক্ষে কথা বলে আসছেন। সবারই মনে থাকার কথা, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ যাতে ওই নির্বাচনে চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত বিএনপি-জামাত জোটকে তার প্রতিশ্রুত ডেপুটি স্পিকার পদ দেয় তার জন্য জনমত গড়ে তোলার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। এখনও তাঁরা আদর্শগত ও অন্যান্য প্রশ্নে দু'দলের ব্যবধান আইভী ও শামীমের মধ্যকার দূরত্বের চেয়ে বেশি হলেও দু'দলকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে বাধ্য করার লক্ষ্যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।

অথচ আইভী কিন্তু নিজেকে 'জনগণের প্রার্থী' বলে দাবি করলেও কখনোই নিজের দলীয় পরিচয় অস্বীকার করেন নি। নির্বাচনকালে তিনি আওয়ামী লীগ নারায়ণগঞ্জ শহর শাখার সহ-সভাপতি ছিলেন এবং বরাবরই দাবি করেছেন যে তাঁর পেছনে প্রধানমন্ত্রীর 'দোয়া' আছে। সে হিসেবে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর সাক্ষাত এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে কাজ করার অঙ্গীকার করার ঘটনাকে আইভীর প্রতিশ্রুত সংগ্রামের ধারায় কোন ব্যত্যয় বলে ধরা হলে তাঁর প্রতি সুবিচার করা হবে বলে মনে হয় না।

অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যায়, আইভীকে ঘিরে এ মহলটির একটা স্বপ্ন ছিল, যে-স্বপ্ন তারা দেখে আসছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তারা তাদের মত করে একটা নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান চান যা তাদের উন্নয়ন ভাবনাসমূহ বাস্তবায়নে বিশ্বস্ত থাকবে এবং, সর্বোপরি, রাষ্ট্রকে তাদের মত করে ঢেলে সাজাবে। বলা বাহুল্য, এ লক্ষ্য অর্জনে ইতিমধ্যে তারা যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন তা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

সবার মনে থাকার কথা, তাদের এ স্বপ্ন রূপায়নে তারা বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে হঠাৎ করেই দেশব্যাপী ঘটা করে 'যোগ্য-প্রার্থী আন্দোলন' শুরু করেন, এমনকি এক পর্যায়ে তাদের এক আইকনকে সামনে রেখে রীতিমত একটা রাজনৈতিক দল দাঁড় করানোরও প্রয়াস চালান। শেষে এ কাজে ব্যর্থ হয়ে তারা তত্ত্বাবধায়কের বেশধারী সামরিক সরকারের ওপর ভর করেন, ওই সরকারের তিন মাসের আয়ুষ্কালকে দু' বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে সংস্কারের নামে দেশে এক দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে দেন। তবে ওই মিশনও শেষমেষ ব্যর্থ হয়ে যায় যখন ওই সরকার জনরোষের আশঙ্কায় দ্রুত নির্বাচন দিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে নেয়।

যা হোক, আইভীর নির্বাচন আবারও তাদের সেই স্বপ্নকে চাড়িয়ে দেয়। তারা আইভীকে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আড়ালে তার একটা 'সুশীল' ইমেজ গড়ে তোলার চেষ্টা চালান। শুধু তা-ই নয়, তারা তাকে ভবিষ্যতে তাদের রূপকল্পের মডেল হিসেবে ব্যবহারেরও আশা পোষণ করে থাকতে পারেন। কিন্তু, মনে হচ্ছে, আইভীর কপালে শেখ হাসিনার চুমু সে-পথে দেওয়াল তুলে দিয়েছে।

আইভী রাজনীতিতে সন্ত্রাসী-গডফাদার, কালো টাকা, ধর্মব্যবসায়ীদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের কারণে তিতিবিরক্ত জনগণের মাঝে আশার আলো জাগিয়েছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঠিকই বলেছেন, শাসক দলগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষ করে নির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করার ক্ষেত্রে, যে 'সিন্ডিকেট' গড়ে উঠেছে, আইভীর নির্বাচন তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। অস্বীকার করার জো নেই, দলগুলোর মাঝে এখনও যে তৃণমূলের সাথে সংশ্লিষ্ট অল্প হলেও নেতৃবৃন্দ আছেন আইভী তাদেরকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস যুগিয়েছেন। নির্বাচনে জয়ী হতে হলে কালো টাকা ও পেশী শক্তির জোর লাগে- এ ধারণার ওপর ভর করে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রবণতা গত দু'দশক ধরে শাসক দলগুলোর মাঝে ক্রমবর্ধমান। আইভী এ ধারণার মূলেও আঘাত হেনেছেন। ভোটারদের কাছে নিজেকে মুসলমান শুধু নয়, পরহেজগার প্রমাণ করাটা তথাকথিত হেভিওয়েট প্রার্থীদের আরেকটা ফ্যাশন; নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনেও দেখা গেছে একদিকে শামীম আল্লা-আল্লা জপছেন, অন্যদিকে তৈমুর মাথায় টুপি চাপিয়ে রাখবেন না কপালের পরহেজগারি তিলকটা প্রদর্শন করবেন- এ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু আইভীকে এর কোন কিছুই করতে হয়নি; বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সাথে তিনি হাত ঝাঁকিয়েছেন- যা সত্যিই নজিরবিহীন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, জনতার আস্থা লাভ করার জন্য অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে তাদের সমস্যা-সংকট নিরসনে কাজ করাটাই বেশি জরুরি।

এদিকে, নরসিংদীর সদ্য-নিহত মেয়র লোকমান হোসেনের পরিণতি দেখে শুধু জনতার সমর্থন নিয়ে এ ধরনের নেতৃত্বের টিকে থাকার বিষয়ে একটু হলেও শংকা না জেগে পারে না। নিহত হওয়ার আগে প্রচারের অভাবে ( দলীয় লেবেল ছাড়তে পারেননি বলেই কি?) পাদপ্রদীপের আলোয় না এলেও লোকমান অনেকটা আইভীর মতোই লক্ষ জনতার সমর্থন নিয়ে ওই সিন্ডিকেট-সৃষ্ট দেওয়াল ফুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। লোকমান কি এটা শিখিয়ে গেলেন না যে শুধু জনতা সাথে থাকলেই হয় না, রাজনীতিতে জনতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে, কার্যকর কৌশলও প্রয়োজন হয়?

কথাটা পাড়তে হল আইভীর বিজয়ের পর বিভিন্ন মহল কর্তৃক একটা আপ্তবাক্য জপতে দেখে। নির্বাচনে বিজয়ের পর আইভী বলেছেন, 'এ জয় জনতার'; সাথে সাথে ওই সব মহল থেকে আওয়াজ উঠেছে 'নারায়ণগঞ্জ প্রমাণ করেছে জনতা কখনও ভুল করে না'। কথাটা কি নির্বিশেষ সত্য? নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনেই শামীম প্রায় ৮০ হাজার ভোট পেয়েছেন; ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি সাংসদও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখনও কি জনতা ভুল করেনি? যদি কোন কারণে সিটি নির্বাচনে আইভী প্রার্থী না থাকতেন, তাহলে মানুষ হয়তো তৈমুর বা শামীমকে বেছে নিত। তখনও কি বলা যেত, জনতা কখনও ভুল করে না? আসলে জনতার ক্ষোভ বা আবেগ কখনোই নিজে নিজে কাঙ্খিত পরিণতি লাভ করতে পারে না, তাকে পথ করে দিতে হয়। নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আইভী সে-কাজটিই করেছেন। এমনকি দলের অভ্যন্তরে সৎ-নেতৃত্ব প্রত্যাশী কর্মী-সমর্থকদেরকেও তাঁদের আকাঙ্খা পূরণের সুযোগ করে দিয়েছেন।

নির্বাচনে তিনি সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এবং যিনি বা যারা নারায়ণগঞ্জের কাছে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির প্রতীক তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক বিজয় পেয়েছেন। কিন্তু এ বিজয়ই শেষ কথা নয়; বলা যায়, এ বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে আইভীর আসল লড়াই শুরু হল মাত্র। নারায়ণগঞ্জের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে তাঁকে অবশ্যই স্থানীয় রাজনীতির আস্তাবল পরিষ্কার করতে হবে। কেবল একটা নির্বাচনে বিজয় তা সম্ভব করতে পারে না। এ জন্য তাকে এক জটিল ও আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিতে হবে। সে পথে আপোষ ও সংঘাত দুয়েরই প্রয়োজন হবে। আমাদের ধারণা, আইভী বিষয়টা ভালই বোঝেন। এ কারণেই তিনি তার আগামী পথ চলায় প্রধানমন্ত্রীর দোয়া ও 'পরাজিত' প্রার্থীদের নিয়ে কাজ করার কথাটা গুরুত্বের সাথে বলেছেন।

লক্ষণীয়, শামীম ওসমান একাধিকবার আক্ষেপ করে বলেছেন, তাকে 'হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে'। কথাটা কিন্তু যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। তিনি চাইলেই এখন যা-ইচ্ছা-তা করতে পারছেন না। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে তিনি যত হুঙ্কার ছেড়েছেন তার সবই জনগণের মাঝে আতঙ্কের বদলে কৌতুকের, বড়জোর কৌতূহলের, জন্ম দিয়েছে। এবং এ অভূতপূর্ব পরিস্থিতি আইভী সৃষ্টি করতে পেরেছেন জনতার সমর্থন এবং প্রধানমন্ত্রীর 'দোয়া'কে পাথেয় করে।

বিগত ১/১১-এর মধ্য দিয়ে যখন অনেক কিছুর মত এটাও পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমাদেরকে আরও বহু বছর বর্তমান শাসক দলগুলোর অধীনেই চলতে হবে এবং, অন্যদিকে, স্বতন্ত্র বিকল্প শক্তি দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও সুদূরপরাহত, তখন আইভী ও লোকমানের মত নেতৃত্বের উত্থানকে টানেলের শেষ প্রান্তের আলো হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে, শুধু তাঁদের উত্থানই নয়, তাঁদের চলার পথকে মসৃণ করার কাজে সহায়তা করাটাও আজ সময়ের দাবি। দাবিটা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্যও প্রযোজ্য। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যেভাবে তথাকথিত নিরপেক্ষতার মুখোশ ফেলে জনতার আকাঙ্খার পক্ষে দাঁড়িয়েছে, আগামী দিনেও তা অব্যাহত রাখতে হবে।

সাইফুর রহমান তপন : সাংবাদিক।