গাছেরটা খাবে, তলারটাও কুড়াবে তা হয় না!

মোস্তাফা জব্বার
Published : 9 Sept 2016, 02:32 PM
Updated : 9 Sept 2016, 02:32 PM

১৯৯৭ সালে মোবাইলের মনোপলি ভাঙার পর দেশে একটি মোবাইল বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আমার তো বটেই, দেশের কারও কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের এই মোবাইল বিপ্লবে বিদেশি টেলিকম অপারেটরদের বিরাট অবদান আছে। অবকাঠামো নির্মাণ থেকে সেবাদান পর্যন্ত তারা চমৎকার ব‌্যবসাও করতে পেরেছে।

মনোপলি ভাঙার পর থেকে বিদেশি অপারেটররা বেশ ভালোভাবেই এ দেশের মানুষকে মোবাইল সেবার আওতায় আনতে পেরেছে। এখন বাংলাদেশের মোবাইল ব‌্যবহার-উপযোগী জনসংখ‌্যার প্রায় সবার হাতেই মোবাইল সংযুক্তি রয়েছে। অনেকের আছে একাধিক সংযোগ। দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ ভূখণ্ড মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে।

ওদের দাবি অনুসারে থ্রিজি সেবাও সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। মোবাইলে নানা ধরনের সেবার ব‌্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে এবং টাকাপয়সার লেনদেন থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় তথ‌্য পাওয়ার জন‌্য মোবাইল নেটওয়ার্ক একটি বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রত‌্যন্ত গ্রাম, জনপদ বা বস্তির অতিদরিদ্র মানুষটি থেকে নাগরিক প্রাত‌্যহিকতায় মোবাইল একটি অতিপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।

মোবাইলের এই বিপ্লব প্রসঙ্গে বিদেশি টেলিকম অপারেটররা প্রধানত দুটি বিষয়ে অহংকার করে থাকে। প্রথমত, তারা দাবি করে যে, সরকারকে বিপুল রাজস্ব প্রদান করে আসছে এবং দ্বিতীয়ত, তারা বিপুল বিদেশি বিনিয়োগ করেছে।

দুটোই সত‌্য। তবে তারা একবারও স্বীকার করে না যে, তাদের বিনিয়োগের চেয়ে বড় বিনিয়োগটা বাংলাদেশের জনগণের। জনগণ তাদের জাতীয় সম্পদ– বেতার তরঙ্গ অপারেটরদের ব‌্যবহার করতে দিয়েছে বলেই 'বাতাস বেচে' তারা আমাদের পকেট খালি করতে পারে!

অন‌্যদিকে এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাদের অহংকারের দুই কারণেই কি তাদের হাতে পুরো দেশ জিম্মি হতে পারে? এমন কি হতে পারে যে, আমাদের খানাপিনা, থালাবাসন তো বটেই, চেটেপুটে হাতের কবজিও খেয়ে ফেলবে তারা? তারা গাছেরটাও খাবে, তলারটাও কুড়াবে?

তাদের কি নিজেদের হিসাব নেই যে, তাদের বিনিয়োগ টাকা-আনা-পাইতে শতকরা কত ভাগ ফেরত গেছে? আমরা সেই হিসাব করতে চাই না। তবে তারা এখন যা যা করছে সে সবের ছোট একটি খতিয়ান নেওয়া দরকার। খুব ছোট করে হলেও আমরা বিদেশি মোবাইল অপারেটরদের সব কিছু গিলে খাওয়ার 'কু-ইচ্ছা' নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।

মোবাইল অপারেটররা এখনও ভয়েস কল থেকেই সবচেয়ে বেশি রাজস্ব পায়। তবুও এটি বোধহয় ভাবার সময় হয়েছে যে, দুনিয়া থেকে একসময় মোবাইল ফোনের ভয়েস কল বিদায় নেবে। এখনই ভাইবার, হোয়াটস অ‌্যাপ ইত্যাদি যারা ব‌্যবহার করে তারা বস্তুত ভয়েস কলের ধার ধারে না। কথা বলা, ভিডিও চ‌্যাট করা বা অন‌্যান‌্য ডিজিটাল সেবার জন‌্য মানুষ মোবাইল নেটওয়ার্ক ব‌্যবহার করলেও প্রচলিত ভয়েস নেটওয়ার্ক হয়তো স্পর্শও করবে না।

গত ৫ সেপ্টেম্বর আমাদের সরকারও 'আলাপন' নামের একটি অ‌্যাপ চালু করেছে, যা দিয়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়াই ইন্টারনেটে ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা কথা বলতে পারবেন। এর উদ্ভাবক বেসিস সদস‌্য রিভ সিস্টেমসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শিগগিরই এটি সাধারণ মানুষের জন‌্যও উন্মুক্ত হচ্ছে। ফলে আমি মনে করি, তাদের নজর এখন ভয়েসের চেয়ে ইন্টারনেটে থাকা উচিত।

আগামীতে ভাইবার বা আলাপনের মতো অসংখ‌্য সুযোগ-সুবিধা ইন্টারনেট কেন্দ্র করেই তৈরি হবে। এরই মধ্যে আমরা লক্ষ‌্য করেছি যে, প্রচলিত সেবার বাইরেও বিনোদন, শিক্ষা বা সরকারের রূপান্তরের সবটাই ইন্টারনেটকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ‌্যজনকভাবে বাংলাদেশে ইন্টারনেট তাদের ইচ্ছার বলি হয়েছে এবং হচ্ছে। তারা তাদের ইচ্ছামতো ইন্টারনেটের দাম নির্ধারণ করছে। ইচ্ছামতো প্যাকেজ বানাচ্ছে। তারা কিনছে ব্যান্ডউইদথ, আর বিক্রি করছে ডেটা।

অনেকেই হিসাব করে দেখেছেন যে, তারা ডেটা প‌্যাকেজ বানিয়ে দেশের কোটি কোটি ইন্টারনেট গ্রাহককে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সরকার দফায় দফায় ব‌্যান্ডউইদের দাম কমালেও অপারেটররা ইন্টারনেটের দাম কমায়নি। তাদের স্বেচ্ছাচারী এসব প‌্যাকেজের ক্ষেত্রে বিটিআরসির নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা। বস্তুত বিটিআরসির নির্ধারণ করার দায়িত্ব যে ইন্টারনেটের দাম কী হবে। কিন্তু বছরের পর বছর বিটিআরসি মূল‌্য নিয়ন্ত্রণে চরমভাবে ব‌্যর্থ হয়েছে। সংস্থাটি দেশের ইন্টারনেট ব‌্যবহারকারীদের স্বার্থ রক্ষায় কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না, বরং বিদেশি অপারেটরদের ইচ্ছায় পুরো দেশের ইন্টারনেট ব‌্যবহারকারীরা জিম্মি হয়ে রয়েছে।

অন‌্যদিকে, থ্রিজি নামক প্রযুক্তি প্রয়োগের কথা থাকলেও যে মানের ব‌্যান্ডউইদ ব‌্যবহারকারীদের পাওয়ার কথা– সেটি কেউ পাচ্ছে না। তারা প‌্যাকেজ তৈরি করে ৫১২ কেবিপিএসের আর আমরা গতি পাই ২ কেবিপিএস। লক্ষ‌্যণীয় যে, এসব অপারেটরের কারও ব‌্যান্ডউইদভিত্তিক আনলিমিটেড প‌্যাকেজ নেই। ফলে থ্রিজি কেবল ফেসবুক, গুগলের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ছে। কেউ পেশাদারী কাজ করার জন‌্য তারহীন ইন্টারনেটের ওপর ভরসা করতে পারছে না। সম্ভবত এদের থ্রিজি ব‌্যবসা সুরক্ষা করার জন‌্য ফোরজির নিলাম হচ্ছে না।

এই মোবাইল অপারেটররা কেবল ইন্টারনেটের গ্রাহকদেরই ঠকাচ্ছে না, তারা দেশের বিকাশমান ভ্যালু-অ্যাডেড সেবার পুরোটা গিলে খেতে চাইছে। শুরুতে তারা ভ‌্যালু-অ্যাডেড সেবার নামে পাইরেসিতেই লিপ্ত ছিল। তখন তারা গানের শিল্পী থেকে শুরু করে সৃজনশীল সঙ্গীত খাতের কপিরাইট লঙ্ঘন করে রিং টোনের ব‌্যবসা করেছে। কাউকে কোনো রয়‌্যালটি দেওয়ার কথা ভাবেনি। বস্তুত বাংলাদেশে ডিজিটাল পাইরেসির জন্ম হয়েছে তাদের হাতে।

দিনে দিনে দেশে যখন ডিজিটাল সেবাদানকারীদের জন্ম হতে থাকে তখন তারা তাদের সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগির উদ্যোগ নেয়। সে সময়েই একটি ভ‌্যাস নীতিমালা তৈরির জন‌্য বিটিআরসির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়।

আমি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম‌্যান মরহুম জিয়া আহমদ শেলীর কথা স্মরণ করতে পারি, যিনি দ্রুত নীতিমালাটি প্রণয়নের জন‌্য কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁর অকাল মৃত‌্যুর পর বিটিআরসির সব তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি অপারেটরেদের স্বেচ্ছাচারিতার কাজটি চালানোর জন‌্য বিটিআরসির এই নীরবতা সহায়ক হয়।

বিষয়টি আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভায় উত্থাপন করার পর সেই কমিটি নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত আধাআধি হারে রাজস্ব ভাগাভাগি করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কয়েক দিন আগে ভ্যাসের শেয়ার মোবাইল অপারেটররা ৫০:৫০-কে ৭০:৩০ করতে চেয়েছিল (এখানে ৭০ ওদের)। তবে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপের ফলে সেটি সরাসরি করতে না পারলেও অপারেটরদের কেউ কেউ এখনও সরকারের আদেশ অমান‌্য করে কনটেন্ট প্রদানকারীদেরকে শতকরা ২০ ভাগ দিয়ে নিজেরা ৮০ ভাগ নিয়ে নিচ্ছে।

ভ‌্যালু-অ্যাডেড সেবাদানকারীদের নানা অভিযোগ আছে এদের বিরুদ্ধে। ধারণা চুরি করা থেকে নিজেরা এ ব‌্যবসায় যুক্ত হওয়া পর্যন্ত সব কিছুতেই তারা স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে থাকে। তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বাইরেও রয়েছে নানা বিড়ম্বনা। তারা কানেকটিভিটির জন‌্য কাউকে মাসের পর মাস বসিয়ে রেখে তার ব‌্যবসার ধস নামিয়ে দেয়। কারও কারও ধারণা নিজেরাই প্রয়োগ করে ফেলে। বেসিসের ভ্যাস-বিষয়ক স্থায়ী কমিটি এসব বিষয়ে যেসব চিত্র তুলে ধরেছে তাতে অপারেটরদের হীন ব‌্যবসায়ী মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে।

সর্বশেষ যেটি তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতকে আতঙ্কিত করেছে সেটি হচ্ছে, এই বিদেশি টেলিকম অপারেটররা নিজেরা ই-কমার্স ব‌্যবসায় লিপ্ত হচ্ছে। ই-কমার্স সাইট খুলে তার মাধ‌্যমে পণ‌্য ও সেবা বিক্রি করার ফলে ওরা লাইসেন্সিংয়ের শর্ত ভাঙছে। তাদের লাইসেন্স হচ্ছে মোবাইল কানেকটিভিটি প্রদানের। ই-কমার্স ব‌্যবসা তাদের লাইসেন্সের আওতায় পড়া উচিত নয়। এমন হতে পারে যে, তারা আলাদা কোম্পানি খুলে এ ব‌্যবসায় যুক্ত হবে।

আমরা বরাবরের মতো এই বিকাশমান খাতটিও দেশীয় শিল্প হিসেবে সুরক্ষিত করতে চাই। এ জন‌্য আমরা বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহকে এ দেশের বাজারে শর্তহীনভাবে প্রবেশ করতে দিতে চাই না। ই-কমার্স আমাদের জন‌্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর ফলে আমরা যে কেবল ব‌্যবসা-বাণিজ‌্য ডিজিটাল করছি তা নয়, এ খাতে নুতন প্রজন্মের ক্ষুদ্র, মাঝারি, তরুণ ও সৃজনশীল উদ‌্যোক্তা পাচ্ছি।

মোবাইল অপারেটররা নিজেরা ই-কমার্স ব‌্যবসা করলে এর সবচেয়ে বড় চ‌্যালেঞ্জ হবে নেটওয়ার্ক নিরপেক্ষতা রক্ষা করা। অপারেটররাই যেহেতু নেটওয়ার্ক প্রদান করে সেহেতু তারা যদি নিজেদের ই-কমার্স সাইটকে নেটওয়ার্কে প্রবেশগম‌্যতা সহজ করে দেয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে নেটওয়ার্ক প্রবেশগম‌্যতার জন‌্য বাধাগ্রস্ত করে, তবে একটি অসম প্রতিযোগিতার চরম পরাকাষ্ঠা আমরা দেখতে পাব।

আমি এরই মধ্যে আমাদের ই-কমার্স ব‌্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তেমন অবস্থার মোকাবিলা কাউকে কাউকে করতে হচ্ছে। ইতোমধ‌্যে আমরা ই-কমার্স ব‌্যবসার নানাবিধ চ‌্যালেঞ্জ দূর করতে সচেষ্ট। এ জন‌্য সরকার একটি ই-কমার্স নীতিমালা গড়ে তুলছে। এ খাতের অংশীজনেরা এতে তাদের মতামত দিচ্ছে। খসড়াটি এখন আলোচনার টেবিলে।

আমি মনে করি, বিদেশি মোবাইল অপারেটরগণ যেন তাদের সীমানা ছাড়িয়ে না যায়। তাদের নেটওয়ার্ক সেবাদানের কাজটিতেই তারা মনযোগী থাকুক। তারা দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে ইন্টারনেট সেবার মান বাড়াক। বাকি সব ব‌্যবসা যাদের করা উচিত, তারা করুক। ফলে ভ‌্যালু-অ্যাডেড ব‌্যবসায় তারা যেসব জটিলতা তৈরি করেছে সেগুলো দূর করুক এবং অনুগ্রহ করে ই-কমার্স ব‌্যবসা থেকে সরে দাঁড়াক।

সার্বিকভাবে আমরা এটি বলতে চাই, বিদেশি টেলিকম অপারেটরদের কাজ হচ্ছে নেটওয়ার্ক সেবা প্রদান। তারা যদি সব ব‌্যবসাতেই যুক্ত হতে চায় এবং নিজেরাই সব নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তবে দেশের তথ‌্যপ্রযুক্তি খাতের বিশাল অংশ বিকশিত হতে পারবে না। অন‌্যদিকে, তারা যদি তারহীন ইন্টারনেটের ক্ষেত্রটি স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে না দেয়, যদি ইন্টারনেট সেবা যথাযথ না হয় এবং সেটি যদি জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না আসে, তবে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখছি সেটি স্বপ্নই থেকে যাবে।