ওবামাকে গালি এবং গালাগালির সংস্কৃতি

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 30 Sept 2011, 05:40 AM
Updated : 10 Sept 2016, 04:55 AM

গরিবরা বড়লোককে 'গালি' দিয়ে সুখ পায়। আর যদি কোনো বিপুল প্রতাপশালী ক্ষমতাধর কাউকে তুলনামূলক কম ক্ষমতাধর কেউ গালি দেন, তাহলে অন্যদের আনন্দের কোনো সীমা থাকে না! কারণ, ওই ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে আসলে মনে মনে অন্যরাও গালি দেন। কিন্তু ভয়ে কেউ তা প্রকাশ করেন না। যদি সাহসী কেউ প্রকাশ করে ফেলেন, তা হয়ে যায় সব বঞ্চিতজনের প্রতিধ্বনি।

সম্প্রতি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে গালি দিয়ে গোটা দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছেন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতের্তে। এই খ্যাপাটে ব্যক্তি কোনো উপদেশ শুনতে রাজি নন। ওবামা যদি তাঁর কোনো পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তা হলে "… ছেলেকে একহাত" নেবেন! মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এ ধরনের কটূক্তি করে মহাআলোড়ন তুলেছেন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট।

৬ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর লাওসে 'অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস' বা এএসইএএনয়ের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। আর সেখানেই মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল ওবামা ও দুতের্তের।

৩০ জুন প্রেসিডেন্টের আসনে বসার পর থেকেই মাদক ব্যবসা ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন দুতের্তে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের অভিযোগ, গত দুমাসে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ মেরেছে দুতের্তের পুলিশ। মাদক পাচার ও ব্যবহারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় দুই হাজারকে।

মাদক পাচার রুখতে দুতের্তের এই পদক্ষেপ কি সমর্থনযোগ্য? দুতের্তের সঙ্গে বৈঠকে কি এই প্রশ্ন তুলবেন না খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট? এক সাংবাদিকের এ প্রশ্ন শুনেই খেপে ওঠেন দুতের্তে। বলেন, "উনি নিজেকে ভাবেনটা কী! আমি আমেরিকার হাতের পুতুল নই। আমি একটি দেশের প্রেসিডেন্ট। আমি শুধু এ দেশের মানুষের কাছেই উত্তর দিতে বাধ্য। আর কারও কাছে নয়।"

সাংবাদিকদের সামনে ওবামার বিরুদ্ধে কুশব্দ ব্যবহার করতেও পিছপা হননি তিনি। বলেছেন–

"ওবামা যদি আমার কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাহলে '… ছেলে'কে দেখে নেব।"

দুতের্তের যুক্তি, ফিলিপিন্সের এই পরিস্থিতির জন্য আমেরিকাই দায়ী। মার্কিন 'ঔপনিবেশিক অত্যাচারের' ফলেই আজ খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ফিলিপিন্স। এ ঘটনার পর উভয়ের মধ্যে নির্ধারিত বৈঠকটি ভেস্তে গেছে।

তবে দুতের্তে একরোখা, "আরও মরবে। অনেকে মরবে। যতক্ষণ না শেষ মাদক পাচারকারীকে বের করা সম্ভব হবে, ততক্ষণ আমরা কাজ চালিয়ে যাব।"

তবে বারাক ওবামাই প্রথম নন। এর আগে ফিলিপিন্সে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে '… ছেলে', সাংবাদিকদের 'বেজন্মা' এবং পোপকেও নানা 'অলঙ্কারে' ভূষিত করেছেন দুতের্তে।

এ ঘটনার পর অনেকে দুতের্তের প্রশংসা করলেও অনেকে আবার তাঁকে দুষছেনও। নিজে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এভাবে গালি দেওয়াটা অনেকে অভদ্রতা হিসেবে দেখছেন। তবে অবাক বিষয়, নিন্দার চেয়ে দুতের্তের কপোলে প্রশংসাই জুটছে বেশি!

বিশ্লেষকরা গালি দেওয়াটা বড় করে দেখতে নারাজ। আসলে গালিগালাজ বা গালমন্দ হল ভাষার অন্যতম বহুল ব্যবহৃত 'অলঙ্কার'। গালিগালাজ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বটে, তবে ক্ষেত্রবিশেষে এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মানুষ যেদিন থেকে ভাষার ব্যবহার শিখেছে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে গালির ব্যবহার। এই গালিগালাজের প্রকার ও ধরন আবার সমাজভেদে ভিন্ন। এক স্থানের স্তুতিকথা অন্যস্থানে গালি হিসেবে ব্যবহারের নজির দেখা যায়। যেমন: যুক্তরাজ্যে fag মানে 'সিগারেট', কিন্তু যুক্তরাষ্টে fag বলতে 'হোমোসেক্সুয়াল পুরুষ' বোঝায়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে 'খাসি' শব্দটা অস্তিবাচক হিসেবে ব্যবহার করা হলেও মেহেরপুরে একে 'গালি' হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে, বন্ধুদের মধ্যে বা ইনফর্মাল আড্ডায় 'শালা', 'গাধা', 'কুত্তা'– এ জাতীয় শব্দ গালি মনে না হলেও বড়দের মধ্যে বা ফর্মাল কোনো বৈঠকে তা ব্যবহার করা হলে তা 'গালি' হিসেবে গণ্য করা হয়।

আবার সমাজের অশিক্ষিত মানুষের কাছে যা বুলি তা অনেক সময় শিক্ষিত মানুষের কাছে 'গালি' হিসেব চিহ্নিত। যেমন: আমাদের দেশে নিম্নবর্গীয় মানুষ 'মাগি', 'ভাতার', 'মিনসে' ইত্যাদি শব্দ সাধারণ অর্থেই ব্যবহার করে। কিন্তু এ শব্দগুলো শিক্ষিত সমাজে 'গালি' হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জেন্ডার-ভেদেও গালির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। পুরুষদের সাধারণ আড্ডায় অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়, যা নারীমহলে 'গালি' হিসেবে চিহ্নিত।

অক্ষম মানুষের নাকি ক্রোধ বা রাগ বেশি। আর রাগ-ক্রোধ প্রকাশের প্রাথমিক মাধ্যম হল গালি। গালি দিলে আনন্দ পাওয়া যায়, রাগ কমে। মনের ঝাঁঝটা বের হয়ে যায় বলে শান্তিও মেলে কিছুটা; মনটাও হালকা হয়।

সব কালে, সব সমাজেই গালি দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল বা আছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিবের ব্যবধান খুব একটা নেই। সবাই গালি দেয়। শিক্ষিতরা দেয় ইংরেজিতে, আর সাধারণরা দেয় বাংলায়, কখনও আঞ্চলিক ভাষায়।

অনেকে বলেন, গালি দেওয়াটা কোনো সংস্কৃতিবান মানুষের কাজ নয়। 'অসংস্কৃত', 'নিচু স্তরের' মানুষই গালগাল করে বেশি। তাদের কথায় স্ল্যাং বা গালির আধিক্য থাকে। তবে এখন শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে গালাগালের ব্যাপারে খুব একটা ইতর-বিশেষ নেই। যেসব শব্দ ছাপার অযোগ্য বলে গণ্য হত, সেসব আজ শরতের মেঘের মতো জননেতার মুখে, বুদ্ধিজীবীর লেখায় কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়ালে ভেসে বেড়ায়! সংবাদ মাধ্যমের ওয়েবসাইটে সংবাদ কিংবা মতামতের নিচে সাংবাদিকদের প্রতি যে কদর্যতর হুমকি দিয়ে মন্তব্য পোস্ট করা হয়, কিছুদিন আগেও যা অকল্পনীয় ছিল।

এখন এসব কুকথা মানুষ লিখে আনন্দ পাচ্ছে, বলে আনন্দ পাচ্ছে, যারা পড়ে কিংবা শোনে তারাও নিশ্চয়ই আনন্দ পায়। এসবের চাহিদা বা বাজারমূল্য যদি না-ই থাকবে, তাহলে সবাই গালাগালের প্রতি এমন উৎসাহ দেখাবে কেন?

গালি বা কুকথা যদি কোনো 'প্রোডাক্ট' হয়, তার ক্রেতা আমরা সবাই। আর যার চাহিদা আছে, কাটতি আছে, তাকে বাজার থেকে হটাবে কে? এখন তো 'সবার উপরে বাজার সত্য তাহার উপরে নাই'!

ইদানিং ব্লগ বা বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে গালাগালির ছড়াছড়ি দেখা যায়! বিশেষ করে ধর্ম বা মুক্তচিন্তা নিয়ে লেখা ব্লগগুলো যেন একেকটি গালি শিক্ষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র! গালি দেওয়ার মধ্যে যে এত সৃজনশীলতা থাকতে পারে– এসব ব্লগে ঢুঁ না মারলে জানা যায় না। এসব জায়গায় ভুল বানান, ভুল বাক্যে গালাগালের সমাহার দেখা যায়। এসব দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয়, গালির একটা স্কুল খুললে কেমন হয়? কিংবা এ বিষয়ে কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজন? তাহলে অনেক ব্যক্তিই দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনতে পারতেন!

তবে গালাগালি কারও ভালো লাগুক চাই না লাগুক, গালির কিন্তু অনেক গুণ। যেমন: গুরুজনেরা বলেন, 'ব্যবহারে বংশের পরিচয়'। যারা গালি দেয় আমরা খুব সহজে তাদের বংশ, রুচির সুন্দর পরিচয় পাই। এখনকার এই চতুরের দুনিয়ায় মানুষ চেনা বড় দায়। গালিবাজরা নিজেরাই কত ভদ্রভাবে নিজেদের চিনিয়ে দেয়।

আধুনিক মনোচিকিৎকরা বলে থাকেন, আপনি কি কথায় কথায় গালাগালি দেন? বেশ করেন! আর সুস্থ থাকতে চাইলে এই গালাগালি চালিয়ে যান। অন্যরা কী বলছে তাতে একদম কান দেবেন না। ডাক্তাররা বলছেন, আপনার এই কু-অভ্যাসটি আপনার 'সুস্থ থাকার চাবিকাঠি!'

অবাক হচ্ছেন? সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ডাক্তাররা দাবি করেছেন, যারা গালিগালাজ করে, তারা মানসিক দিক থেকে অনেক সুস্থ। অন্যদিকে যারা রেগে গেলেও গালিগালাজ দিতে পারে না, তারা মানসিকভাবে বেশ অসুস্থ। তা এমনটা কেন বলছেন তাঁরা? উত্তর খুব সোজা। ডাক্তারি ভাষায় বলতে গেলে, গালিগালাজ হল মন থেকে রাগ বের করার উপায়। গালিগালাজের মধ্যে দিয়ে মনের মধ্যে জমাটবাঁধা রাগ বেরিয়ে যায় সহজেই। এতে মানসিক শান্তি ঘটে। আর মন খুশি থাকলেই আপনি আশি ভাগ সুস্থ। আসলে সবই তো মনের বিষয়। তাই তো চিকিৎসকরা বলছেন, গালিগালাজের মতো ভালো 'স্ট্রেসবাস্টার' আর কিছু নেই। যারা তা শোনে, তাদেরও লাভ। বিনামূল্যে কিছু গালি শুনতে ও শিখতে পারল।

কাজেই গালি চলুক, চলতে থাকুক!