বিজ্ঞান শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণ

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
Published : 4 Nov 2011, 10:27 AM
Updated : 4 Nov 2011, 10:27 AM

আমাদের দেশের বিজ্ঞান-সাহিত্য খুব একটা সন্তোষজনক নয়। অনেক কারণে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এদেশের বিজ্ঞান-সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে নি। একটি প্রধান কারণ বৈজ্ঞানিক পরিভাষার অভাব। বৈজ্ঞানিক পরিভাষা যে একেবারেই নেই তা নয়, কিন্তু যা আছে তা বড়ই সংস্কৃত-ঘেঁষা, আরোপিত এবং আড়ষ্ট মনে হয়। বৈজ্ঞানিক শব্দের এই দৈন্য কেন? আমাদের ভাষা-সাহিত্য এতো সমৃদ্ধ, কত মহত্তম সৃষ্টি আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে! কিন্তু বিজ্ঞানের জায়গায় এসে আমরা হোঁচট খাচ্ছি।

একটি উদাহরণ দেই:

১. 'একটি কাঁচের দণ্ডকে একটি রেশমি কাপড় দিয়ে ঘষে ২৬.১ নং ছবিতে দেখানো উপায়ে সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে আমরা দেখাতে পারি যে দুই ধরনের আধান রয়েছে।'

২. 'চার্জ দু' ধরনের। একটা কাঁচের রডকে সিল্ক দিয়ে ঘষে সেটা দেখানো যায়। ২৬.১ নং ছবিতে একটা সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে সেটা দেখানো হয়েছে।'

বোঝাই যায়, এই দুটি বাক্যই কোনো একটি ইংরেজি বাক্যের অনুবাদ। দ্বিতীয় বাক্যটি আক্ষরিক অনুবাদ না হয়েও চমৎকার ও ঝরঝরে বাক্য হয়েছে। আমাদের অধিকাংশ বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তক কিন্তু এরকম সহজ সাবলীল গদ্যে রচিত নয়। ডক্টর জাফর ইকবালের মতে, 'আমার ধারণা বাংলায় বিজ্ঞানের বই না লিখার কারণে এই ভাষায় আমরা ঝরঝরে ভাষায় লিখতে পারি না, যাবতীয় বিজ্ঞানের বই কটমটে এবং দুর্বোধ্য ভাষায় লিখা। বিজ্ঞানের যে তথ্যটি ইংরেজির একটা বাক্যে দিতে পারি, বাংলায় সেটা দিতে পারি না, ভেঙ্গে তিনটি বাক্যে দিতে হয়।… কিন্তু আমাদের কোনো বিকল্প পথ নেই, স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য আমাদের বাংলায় বিজ্ঞানের বই লিখতে হবে। শুধু বাংলায় নয়, সুন্দর বাংলায় ঝরঝরে বাংলায়।' (-পৃ. ৫৮-৬০, অমর একুশে গ্রন্থমেলা স্মারকপত্র ২০১০, বাংলা একাডেমী)

ড. জাফর ইকবাল খুব চমৎকারভাবে মূল সমস্যাটি চিহ্নিত করেছেন। আমি আরো যোগ করতে চাই যে, বৈজ্ঞানিক প্রতিশব্দের দুর্বোধ্যতার আরো মূলীভূত কারণ হলো এই যে এদেশে নতুন বিজ্ঞান তৈরি হয় না। জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা এবং এঁদেরই উত্তরসূরী গুটিকয়েক শিক্ষক-গবেষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশীয় গবেষণার যে ধারাটি সৃষ্টি হয়েছে তা আজ বড়ই ক্ষীয়মান। এই ধারাটি আজ যে অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে তাতে নতুন সৃষ্টিশীল গবেষণার দ্বার প্রায় বন্ধ হতে বসেছে। কাজেই এদেশীয় চলতি ভাষায় নতুন বিজ্ঞানের শব্দও তৈরি হয়নি। এই ঐতিহ্যেও, এই ধারার অভাবই আমাদের পরিভাষা সমস্যার একটি প্রধান কারণ।

বিজ্ঞান বইয়ের দুর্বোধ্যতার আরেকটি কারণ বিজ্ঞানের ও পাঠ্যবই রচয়িতাদের মানসিকতার স্থবিরতা। প্রমিত বাংলা ব্যবহারের প্রতি অতিমনোযোগিতায় তাঁরা অন্ধভাবে পরিভাষা ব্যবহার করতে থাকেন। তাঁরা ভুলে যান বাক্যটি পড়ে একজন শিক্ষার্থী সত্যিই কিছু বুঝবে কি-না। পেডাগজির স্থলে স্থান পায় আক্ষরিক অনুবাদের প্রতি আসক্তি। যার ফলে 'ফ্রিজ থেকে কোকটি আনো' – এই সহজ বাক্যের জায়গায় 'হিমায়ক থেকে কোমল পানীয়টি আনয়ন কর'- জাতীয় বাক্য প্রায়শ ব্যবহৃত হয়। যেমন এই বাক্যটি লক্ষ করুন:

৩. 'একটি ব্যবস্থা অ যদি একটি তাপ আধারের সংস্পর্শে থাকে, তাহলে প্রতিনিধিত্বকারী পরিসংখ্যান সমগ্রদশা বা আঁসাবঁল-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ব্যবস্থাগুলো অভিগম্য অবস্থার মধ্যে বন্টিত থাকে।' (-পরিসংখ্যান বলবিজ্ঞান, বাংলা একাডেমী, ২০০১)

এই বাক্য থেকে কী বুঝলেন?

বিজ্ঞানের বইয়ের দুর্বোধ্যতার আরেকটি কারণ আমাদের দেশের সাধারণ বিজ্ঞানশিক্ষার নিদারুন অধোগতি। স্কুলের বিজ্ঞানের পাঠ্যবইগুলো যেমন অনাকর্ষণীয়, তেমনি সাদামাটা। এছাড়া এসব বইয়ে তথ্যের অসঙ্গতি, আধুনিক রুচির অভাব দেখা যায় এবং এরা যুগের সাথে তাল মেলাতে অক্ষম। বিজ্ঞানশিক্ষা যথেষ্ট হাতে-কলমেও নয়। সাধারণ বিজ্ঞানশিক্ষার এই অধোগতির কারণে সাধারণ শিক্ষিত সমাজে 'বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞানের' অভাব দেখা যায়। ফলে বিজ্ঞানের সহজ সত্যও পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। বিজ্ঞানের বুনিয়াদী শিক্ষা দুর্বল হওয়ায় জাতীয় সমাজে এই অবনতি ঘটেছে।

আরেকটি মনোভাবের কথা বলা দরকার। এটি যুগপৎ বিজ্ঞান শিক্ষার দুর্বলতা এবং মানসিকতাজনিত সমস্যা। প্রায়শই শোনা যায়, বাংলায় বিজ্ঞান সাহিত্য 'দুর্বোধ্য'। এই 'দুর্বোধ্যতা' কিন্তু না বুঝেই 'দুর্বোধ্যতা' একদিকে, অন্যদিকে একটি ছদ্ম-উপনিবেশী মানসিকতার ফল। আমরা প্রায়শই এবং অধিকাংশই ইংরেজি বই পড়ে বিজ্ঞান শিখি, শেখাই। কাজেই ইংরেজিতে যেকোনো বিজ্ঞান-সাহিত্য আমাদের কাছে 'সহজ' মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এটা শ্রেফ মনোভাবের ব্যাপার। আমি হলফ দিয়ে বলতে পারি, স্টিফেন হকিংয়ের সাড়া জাগানো এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইটি মিলিয়ন সংখ্যক বিক্রি হয়েছে, কিন্তু বুঝেছে খুব কম মানুষই। কসমোলজির উপর একটি জনপ্রিয় বাংলা বইয়ের যেকোনো বাক্য এবং হকিংয়ের এই বইটির যেকোনো বাক্য তুলনা করলে দেখবেন হকিংয়ের ঐ বইটিও অতো সুখপাঠ্য নয়, যতোটা না সহজ মনে করা হয়েছে। এ সম্পর্কে ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী চমৎকার উপদেশ দিয়েছেন,

৪. 'কারো কারো ধারণা বিজ্ঞান একটা খুব কাঠখোট্টা রকম কঠিন জিনিস; তা নিয়ে লেখাও প্রায় সে রকমই। তবু এইটুকু বলা যায় যে, আসলে বিজ্ঞান নিয়ে লেখা মোটেই কঠিন নয় – যদি আপনার জানা থাকে আপনি কেন লিখছেন, কার জন্য লিখছেন, আর কী ধাঁচের লেখা আপনি লিখতে চান।' (-আজকের বিজ্ঞান ও বাংলাদেশ, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৬)

আমাদের দেশে সাধারণভাবে পাঠকের সংখ্যাও খুবই কম। একটি ছোট উদাহরণ দেই। এ বছর জার্মানি যাবার সুযোগ হয়েছিল। জার্মানির বন শহরে গিয়ে প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম বইয়ের দোকানে। কিন্তু হা হতোস্মি, সব বইই জার্মান ভাষায়! অনেকগুলোর টাইটেল দেখে বুঝলাম ওগুলো নামকরা পপুলার সায়েন্সের বই, কিন্তু জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা। জার্মানির জনসংখ্যা আমাদের তুলনায় কত কম, অথচ সেখানে যেকোনো ইংরেজি ভাষার বাজার-চলতি বইয়ের জার্মান অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। তার কারণ সেদেশে পাঠক আছে। সেদেশের মাথাপিছু পাঠকের সংখ্যা আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। পাঠকের সংখ্যা কম মানে আমাদের পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠেনি। ফলে প্রকাশকরা তথাকথিত 'দুর্বোধ্য' বিজ্ঞানের বই প্রকাশে আগ্রহী হন না। সৌভাগ্যক্রমে, ইদানিং গণিত অলিম্পিয়াড-জাতীয় প্রতিযোগিতার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় দিব্যি গণিত ও বিজ্ঞানের বই প্রকাশিত হয়ে চলেছে।

আমাদের পরাজিত এবং অধীনস্ততার মানসিকতার আরেকটি উদাহরণ হলো পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞান-সাহিত্যকে একবাক্যে বিনা-তর্কে 'স্বাদু' সার্টিফিকেট দেওয়া। আমি অস্বীকার করব না যে, পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু লেখকের লেখা চমৎকার সুপাঠ্য। কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার হাল্কা চালের লেখা পড়ে ছুটির মনোভাব পাওয়া যায়, কিংবা দুপুরের ভাতঘুমকে আমন্ত্রণ জানানোর আগে একটু পড়ে নেওয়া যায়, কিন্তু এসব লেখা থেকে সিরিয়াস বিজ্ঞান শেখা যায় না। স্নাতক পর্যায়ের উভয় বাংলার অভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক তুলনা করে দেখুন, একই রকম 'দুর্বোধ্য'। এক্ষেত্রে একটি কথা স্বীকার করা ভালো, পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানের তুলনায় বাঙালি হিন্দু পরিবার গড়পড়তায় লেখালেখিতে বেশি আগ্রহী। স্বাভাবিকভাবেই জাতীয়-চরিত্রের এই দুর্বলতার কারণে সাবলীল লেখালেখির ধাঁচটা আমরা ধরতে পারছি না। কিন্তু তারপরও আমাদের যে একখানা বিজ্ঞান-সাহিত্য গড়ে উঠেছে তা-ও একেবারে মন্দ কিছু নয়। বাংলাদেশে বাংলা একাডেমী এককভাবে প্রচুর সংখ্যক বিজ্ঞানবিষয়ক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছে। একটি পূর্নাঙ্গ পাঁচখণ্ডের বিজ্ঞান বিশ্বকোষ প্রণয়ন একাডেমীর একটি বড় ঐতিহাসিক অর্জন। দাবী করা যেতে পারে, দুই বাংলা মিলিয়ে সর্বাধিক সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক ও প্রকাশের একক কৃতিত্ব বাংলা একাডেমীর। 'একুশে গ্রন্থমেলা' সিরিজের অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি বিজ্ঞানবিষয়ক মনোগ্রাফ (মৌলিক কণা, বৃষ্টি ও বজ্র, কৃষ্ণবিবর, সংখ্যা, জ্যামিতি ও দর্শন, ক্যান্সার, সৌরজগৎ, কৃত্রিম উপগ্রহ, সাপ) অসাধারণ সাহিত্যগুণসম্পন্ন ছিল। এ ধরনের আরো সিরিজ প্রকাশের দায়িত্ব অবিলম্বে বাংলা একাডেমীর নেওয়া উচিত।

বাংলা ভাষায় সুস্বাদু গদ্যে বিজ্ঞানের তত্ত্ব-তথ্য পরিবেশনের প্রথম কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। আপাদমস্তক একজন কবি হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞানের সত্যগুলোর যে গভীর অনুধাবন আমরা রবীন্দ্রমানসে লক্ষ করি তাতে আমরা বিস্মিত হই। তাঁর জনবোধ্য বিজ্ঞানগ্রন্থ বিশ্বপরিচয় এক অপূর্ব সৃষ্টি, এর প্রাসঙ্গিকতা আজও অমলিন। বিশ্বপরিচয় গ্রন্থই পাঠক নিজে পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন কেন বইটি আজো প্রাসঙ্গিক এবং বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান-সাহিত্য এক অনুপম উদাহরণ হয়ে আছে। বিশ্ব পরিচয়-এর ধারাবাহিকতায় আধুনিক বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে একটি টিমটিমে বিজ্ঞান-সাহিত্য সম্ভার। এই বিজ্ঞান-সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ডক্টর আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন। আল-মুতীর স্বচ্ছ গদ্যের স্বাদ-রস-গন্ধ আজো বাঙালি পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। আবিস্কারের নেশায় কিংবা তারার দেশের হাতছানি-এর মতো বই বাংলা সাহিত্যে আর আসেনি! আজো প্রকাশকদের বলতে শুনি আবিষ্কারের নেশায়-এর মতো বইয়ের লেখক কোথায়? আল-মুতীর লেখনি সত্তর-আশির দশকে বাঙালি পাঠকের মনে বুনিয়াদি বিজ্ঞান-বোধ সৃষ্টি করেছিল। সেই বিজ্ঞানবোধকে পুঁজি করেই আজকের বিজ্ঞান-লেখক এগিয়ে যাবেন। কাজেই আবিষ্কারের নেশায় বইটি তার যুগের দাবী পূরণ করেছিল ঠিকই, এখন অন্য ধরনের বইয়ের দরকার যা আমাদেরকে বিজ্ঞান শেখাবে। মানুষ শুধু স্যুপ আর জাউ খেয়ে বাঁচে না, তাকে অন্য অনেক শক্ত খাবার থেকে পুষ্টি নিতে হয়। স্যুপ আর জাউয়ের যে ভূমিকার দরকার ছিল, বিজ্ঞান-সাহিত্যের শৈশবে, তা আল-মুতী ও তাঁর সমসাময়িক লেখকেরা পূরণ করছেন। বিজ্ঞান-সাহিত্যের যেহেতু এখন যৌবন, তার পুষ্টির জন্য দরকার শক্ত খাবার। এমন সব বই লেখা উচিত যা থেকে আমরা নতুন দিনের বিজ্ঞান শিখে নিতে পারব। ইংরেজি বই পড়ে কীভাবে বিজ্ঞান শিখে নিতে হবে সেটা স্কুলের বাচ্চাদের শেখাতে হবে। এমনতরো বিজ্ঞান বইই আজ আমাদের প্রয়োজন। এ কাজে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন এবং আমাদের বিজ্ঞান-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। মুহম্মদ ইব্রাহিত (বৃষ্টি ও বজ্র), এ. এম. হারুন-অর-রশীদ (পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্ল­ব, মৌলিক কণা), জহুরুল হক (আগুনের কি গুণ), সুব্রত বড়ুয়া (বিজ্ঞানের ইতিকথা:সন্ধানী মানুষ) মু. জাফর ইকবাল (দেখা আলো, না দেখা রূপ) – এসব বই ও লেখক আমাদের সমৃদ্ধ করেছে।

সমালোচকেরা বলেন, অমুক বিজ্ঞানী বিজ্ঞান লিখতে জানেন না। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো, সমালোচক-মশাই বিজ্ঞান কীভাবে পড়তে হয় তা জানেন না। কারণ, সেই বিজ্ঞানশিক্ষার অধোগতি। চামচের মাপে জাউভাত-জাতীয় বিজ্ঞান-পরিবেশনা আজকের যুগের জন্য নয়। তাই দেখি নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞান-লেখকও তৈরি হচ্ছে -বইয়ের লেখক হিসেবে যেমন, ব্ল­গমন্ডলেও তেমন। আসিক (মহাজাগতিক আলোয় ফিরে দেখা), তানভিরুল ইসলাম (ব্ল­গ লেখক), রাজিউদ্দিন রতন (অনুজীবের কথা), অনিন্দ্য বিজয় (ডারউইন, সম্পাদিত), অভিজিৎ, রায় (আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী) প্রমুখ এ প্রজন্মের বিজ্ঞান-লেখক উল্লে­খযোগ্য অবদান রেখেছেন।

আমরা আশা করি, আমাদের বিজ্ঞান-সাহিত্য সকল সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে একটি বিকশিত ক্ষেত্র হিসেবে উঠে দাঁড়াবে। একটি সমৃদ্ধ বিজ্ঞান-সাহিত্য তৈরি করতে প্রথমেই চাই বিজ্ঞান শিক্ষার যথাযথ প্রচার ও প্রসার, চাই বিজ্ঞান-পাঠকের সংখ্যা, রুচি ও প্রস্তুতির প্রবৃদ্ধি ও বিকাশ, চাই বিজ্ঞান-লেখকের লেখাভ্যাসের উন্নয়ন, সাবলীল গদ্য ব্যবহার এবং সহজ পরিভাষা সৃষ্টি, চাই গুণগত মানসম্পন্ন ও চমৎকার চিত্রবহুল বিজ্ঞানগ্রন্থ প্রকাশের উপযোগী প্রকাশনালয়। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, এবং আরো জরুরি হলো বিজ্ঞান শিক্ষিত পাণ্ডুলিপি-সম্পাদক তৈরি করা। বিজ্ঞান-সাহিত্য পাঠের অনিবার্য ফল হলো চারপাশের জগৎ সম্পর্কে একটা যথাযথ ধারণা জন্মে, একটা বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞান (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'বৈজ্ঞানিক মেজাজ') তৈরি হয়। এই বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞান সমাজে বিজ্ঞানমনস্কতা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। কিন্তু জনপ্রিয় পত্রিকায় 'আপনার রাশিচক্র' বা 'এ সপ্তাহের ভাগ্য', যত গুরুত্ব সহকারে ছাপানো ও পড়া হয়, বিজ্ঞান-পাতা সম্পর্কে সেই একই মমতা দেখা যায় না। যেকোনো বিশেষ দিবসের বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের জন্য প্রথমেই বাদ পড়ে বিজ্ঞান-পাতা। এই হলো বর্তমানে আমাদের প্রিন্ট-মিডিয়ার অবস্থা। অন্যদিকে টিভি-চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞানের কোনো অনুষ্ঠান নেই, আছে টেক-সংবাদ বা প্রযুক্তি-সংবাদ।এই প্রযুক্তি-সংবাদের ফাঁকে ফাঁকে কিছুটা বিজ্ঞান-সংবাদ পরিবেশিত হয়। এমনটিই হলো বিজ্ঞান-মিডিয়ার বর্তমান হাল। কিন্তু 'ডিজিটাল বাংলাদেশের' জন্য একটি বিকশিত ও পরিশীলিত বিজ্ঞান-সাহিত্য আমাদের দরকার হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন,

৫. 'বড়ো অরণ্যে গাছতলায় শুকনো পাতা আপনি খসে পড়ে, তাতেই মাটিকে করে উর্বরা। বিজ্ঞান চর্চার দেশে জ্ঞানের টুকরো জিনিসগুলি কেবলই ঝরে ঝরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে চিত্তভূমিতে বৈজ্ঞানিক উবর্রতার জীবধর্ম জেগে উঠতে থাকে। তারই অভাবে আমাদের মন আছে অবৈজ্ঞানিক হয়ে। এই দৈন্য কেবল বিদ্যার বিভাগে নয়, কাজের ক্ষেত্রে আমাদের অকৃতার্থ করে রাখছে।' (- বিশ্বপরিচয়, পৃ-৪)

বিজ্ঞানের রসাস্বাদন আমাদের নিত্যকার অভ্যাসে পরিণত হোক, 'চিত্তভূমিতে বৈজ্ঞানিক উর্বরতা' বাড়ুক, চারপাশের জগৎ সম্পর্কে আমাদের একটা বস্তুনিষ্ট ধারণা গড়ে উঠুক – এটাই বিজ্ঞান-সাহিত্যিকের চিরকালীন আকাঙ্খা।

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী: বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।