বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ ও শিক্ষা ক্যাডারে অসন্তোষ

চৌধুরী শহীদ কাদেরচৌধুরী শহীদ কাদের
Published : 29 August 2016, 07:19 AM
Updated : 29 August 2016, 07:19 AM

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষাকে সর্বজনীন করার জন্য শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির উদ্যেগ নিয়েছে সরকার।

এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৬,০০০ রেজিস্ট্রার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক, কয়েক শ প্রথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে। ১৯৯টি বেসরকারি কলেজকে জাতীয়করণের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। নতুন করে ১০২টি কলেজকে জাতীয়করণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকার প্রত্যেকটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি সরকারি কলেজের পরিকল্পনা নিয়েছে। নিঃসন্দেহে এর ফলে শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন ঘটবে।

প্রশ্ন হল, সরকারের এই জাতীয়করণের ভিত্তি কি?

সেটাও শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্পষ্ট করে দিয়েছে। বলা হয়েছে, সরকারি কলেজবিহীন উপজেলা সদরের সবচেয়ে ভালো ফলা করা, অবকাঠামোগত সুযোগসুবিধা সংবলিত কলেজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কলেজের বয়স, আয়তন, সম্পত্তি, ছাত্রছাত্রী সংখ্যা, শিক্ষক সংখ্যা, উপকৃত জনগোষ্ঠী, কলেজটি থেকে অন্য সরকারি কলেজের দূরত্ব, নারী শিক্ষার্থীর অনুপাত ইত্যাদি দিকে লক্ষ রেখেই জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

কিন্তু বাস্তবে সরকার প্রথম ধাপে যে ১৯৯টি কলেজের জাতীয়করণের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তার মধ্যে অন্তত ৩০টি কলেজের ক্ষেত্রে ভয়াবহ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যেমন: তালিকায় থাকা কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহিলা কলেজ এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় শতভাগ ফেল করে রেকর্ড করেছে।

এমন কলেজকে জাতীয়করণ করা 'জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০'-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এমপিওভুক্ত হয়নি এমন কলেজকে জাতীয়করণ করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে জাতীয়করণের জন্য কোটি টাকা লেনদেনের।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার এ কে সরকার ডিগ্রী কলেজের জাতীয়করণের জন্য শিক্ষক-কর্মচারীরা অধ্যক্ষের নেতৃত্বে কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ ৫০ লাখ টাকার তহবিল গঠন করেছে ঘুষ দেওয়ার জন্য।

এ বিষয়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকষর্ণ করা হলে তিনি বলেন, "আর্থিক লেনদেন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।" (প্রথম আলো ২০ জুলাই ২০১৬)

অভিযোগ উঠেছে পুরনো, নামকরা কলেজকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত নতুন কলেজকে জাতীয়করণ করা হচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগে টাঙ্গাইলের গোপালপুরে, কুমিল্লায় হরতাল পালিত হয়েছে। সিরাজগঞ্জের তাড়াশে, মাগুরার মোহাম্মদপুরে দেখা দিয়েছে ব্যাপক অসন্তোষ।

জাতীয়করণের এত বড় প্রক্রিয়ায় সমস্যা থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। তবে অস্বচ্ছতার অভিযোগগুলো সরকারের কৃতিত্ব খাটো করছে সন্দেহ নেই।

জাতীয়করণের ফলে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল আত্মীকৃত শিক্ষকদের মর্যাদা কী হবে?

ইতোমধ্যে এটা নিয়ে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে দেখা দিয়েছে ব্যাপক অসন্তোষ। অতীতে দেখা গেছে, কলেজ জাতীয়করণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই সরকারি চাকরিজীবী হয়ে যায়। শিক্ষকরা আত্মীকৃত হয় ক্যাডার সার্ভিসে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা দেয়নি।

তবে জাতীয় সংসদে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এস এম জগলুল হায়দারের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারিকরণ করার পর সেখানকার শিক্ষকরা কোথাও বদলি হতে পারবেন না। তাদের স্ব স্ব স্কুল বা কলেজেই থাকতে হবে।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের অসন্তোষের কারণ নতুন এই কলেজগুলোর প্রায় ১২ হাজার শিক্ষক রয়েছে। যাঁরা কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ না হয়ে সরাসরি ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ আত্মীকৃত এসব শিক্ষক সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের জন্য আলাদা নীতিমালা থাকবে। এবং যাতে কর্মকমিশন কর্তৃক নিয়োগকৃত শিক্ষকদের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে সেই বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। (অধ্যায় ২৭, অনুচ্ছেদ ৮)

কিন্তু শিক্ষানীতি কার্যকরের পরে ৪৫টি কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে। এসব কলেজের শিক্ষকরা সবাই ক্যাডার সার্ভিসে অর্ন্তভুক্ত হয়েছেন। জীবনে যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার যোগ্যতা পাননি তাদের ক্যাডার সার্ভিসে আত্মীকৃত করা হয়। এখানেই আসছে অর্থ আর সরকারের সস্তা জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গ।

৩৪তম বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও যারা ক্যাডার সার্ভিসে সুপারিশ পাননি এমন প্রায় ১৫০০ জনকে সরকার ২য় শ্রেণির (যদিও বর্তমানে বেতন স্কেলে হিসাব করা হয়) পদমর্যাদায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। সেখানে কোনো পরীক্ষা ছাড়া ১২ হাজার বেসরকারি কলেজের শিক্ষক রাতারাতি কীভাবে প্রথম শ্রেণির বিসিএস ক্যাডার হয়ে যাবেন? তা কেনই বা শিক্ষা ক্যাডারের লোকজন মেনে নেবেন?

কিন্তু শিক্ষা ক্যাডার এমন একটি অবহেলিত ক্যাডার যেখানে মেনে নেওয়াটাই যেন নিয়তি।

বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের পদক্রম ৮টি এবং সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে আইজিপি, যিনি জাতীয় বেতন স্কেলের ১নং গ্রেডেরও ওপরে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার।

বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের পদক্রম ৭টি এবং সর্বোচ্চ পদধাপ হচ্ছে সিনিয়র সচিব যিনি জাতীয় বেতন স্কেলের ১নং গ্রেডেরও ওপরে বিশেষ স্কেলে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন। জুডিশিয়াল সার্ভিসে সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে জেলা জজ তিনিও ১নং গ্রেডে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে থাকেন। একইভাবে প্রায় অন্য সব ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদধাপের কর্মকর্তাগণ জাতীয় বেতন স্কেলের ১নং গ্রেডে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে থাকেন।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, শিক্ষার মতো এমন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারে পদক্রম মাত্র ৪টি এবং সর্বোচ্চ পদধাপ হচ্ছে অধ্যাপক, যিনি জাতীয় বেতন স্কেলের ৪নং গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন।

একই প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদানকৃত কর্মকর্তাগণকে এভাবেই মাঝপথে থেমে যেতে হয়। বৃহৎ কয়েকটি কলেজ ছাড়া অধিকাংশ কলেজে নেই কোনো সুযোগসুবিধা। নেই তাদের কোনো বসার কক্ষ, আবাসিক সুবিধা অনেকটা স্বপ্নের মতো।

মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এমনকী স্থানীয় মাস্তানরাও সবসময় ছড়ি ঘোরায় এসব শিক্ষকদের ওপর। আবার সপ্তাহে ছয়দিন অফিস, প্রতিদিন পরীক্ষার ডিউটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতিটি খাতা দেখে পান ১১৫ টাকা (১০০ মাকর্সের), পরীক্ষায় ডিউটি দিয়ে পান প্রতি ঘণ্টায় ৪০০ টাকা। আর তারা একটি খাতা দেখে পায় বড়জোড় ৫-১০ টাকা, প্রতিঘণ্টা পরীক্ষার ডিউটির জন্য সর্বোচ্চ ৫০ টাকা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বোর্ডের খাতা পায় শুধু সিনিয়র শিক্ষকরা, যার জন্য বরাদ্দ ২৫ টাকা।

এত সব সীমাবদ্ধতার পরও তাদের মধ্যে এতদিন কোনো অসন্তোষ ছিল না। কিন্তু সরকারের সাম্প্রতিক জাতীয়করণের ফলে সৃষ্ট সমস্যায় তাদের মধ্যে ভয়াবহ অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। কোনো ধরনের যোগ্যতা ছাড়া প্রায় ১২ হাজার আত্মীকৃত সদস্যকে তারা নিজেদের পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী নন।

এমনিতেই ৭-৮ বছরের আগে এই ক্যাডারে প্রমোশন নেই। আত্মীকৃত হলে প্রমোশনে লাগবে প্রায় ১৫ বছর সময়। বর্তমানে ৩৩৫টি সরকারি কলেজের প্রায় ১৬ হাজার ক্যাডার কর্মকর্তার সঙ্গে নতুন ১২ হাজার সংযুক্ত হলে ক্যাডারটির কী অবস্থা হবে? একবার ভাবুন।

বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কারের জন্য বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীদের সম্পৃক্ত করছে। বছরের প্রথম দিন নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। কলেজ জাতীয়করণের ফলে প্রান্তিক এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বাড়ছে।

এত সব সফলতার মধ্যে সরকারের উচিত হবে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের অসন্তোষ দূর করা। এই ক্যাডারকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা।

সরকারের উচিত আত্মীকৃত শিক্ষকদের বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা। তাদের সর্বোচ্চ প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার (নবম বেতন স্কেলে) হিসেবে আত্মীকরণ করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এদের কোনো বদলির বিধান থাকবে না।

আমরা বার বার শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলছি; মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা পেশায় আসার আহবান জানাচ্ছি। কিন্তু ঢালাও জাতীয়করণ মেধাবীদের শিক্ষা পেশায় অনাগ্রহী করে তুলবে। চাকরিতে অস্বস্তি ক্লাসরুমেও প্রভাব ফেলবে।

বেসরকারি কলেজের সব শিক্ষককে ঢালাওভাবে আত্মীকরণ শিক্ষাব্যবস্থায় নৈরাজ্যের সৃষ্টি করবে। জেলা থেকে অত্যধিক দূরত্বে, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে মূল শহর থেকে বাইরে অবস্থিত এমন কলেজকে জাতীয়করণের জন্য বিবেচনা করতে হবে।

সরকারের উচিত কলেজ শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করে দেওয়া। তাদের অধিকতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সম্ভব হলে নায়েমে বুনিয়াদি ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি পিএটিসি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। উচিত তাদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো ও পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করা।

কেরানি শিক্ষক দিয়ে কেরানি প্রজন্ম গড়ে উঠবে; আলোকিত প্রজন্ম নয়।