আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার কাহিনি

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 27 August 2016, 05:51 AM
Updated : 27 August 2016, 05:51 AM

গোয়েন্দাদের নিয়ে আমাদের অনেক আশা। আমরা ধরে নিই, যে কোনো নাশকতা, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, হত্যা ও ক্যুসহ সব ধরনের অপরাধমূলক ঘটনার রহস্য-উন্মোচন তারা করবে, করতে পারবে। যেমন আমাদের আশা, দেশের সব কটি জঙ্গি হামলার নেপথ্যের নায়কসহ সব লব-কুশদের তারা চিহ্নিত করবে, ধরে ফেলবে।

অন্য অনেক ঘটনায় ব্যর্থতা থাকলেও সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার রহস্য উদ্‌ঘাটনের ব্যাপারে আমাদের গোয়েন্দারা বেশ সফল। এ ব্যাপারে আরও বেশি গোয়েন্দা সাফল্যের উপর নির্ভর করছে দেশে জঙ্গিবাদের শিকড় উপড়ে ফেলার অভিযানের সাফল্য। আবার এর উপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশিদের আস্থা। আর এ সব কিছুর সঙ্গে যোগ রয়েছে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির।

তবে কবুল করা ভালো যে, গোয়েন্দারা আমাদের দেশে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ততটা আস্থাভাজন নয়। বরং বলা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে গোয়েন্দাদের 'ক্ষমাহীন' ব্যর্থতা বড় ভূমিকা রেখেছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় থেকেই দেশে ছোট হোক, বড় হোক একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ছিল। সেনাবাহিনীতে ডিজিএফআই ছাড়াও প্রতিটি ডিভিশনে, ব্রিগেডে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ছিল। পুলিশ ও বিডিআর-এরও (বর্তমানে বিজিবি) নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট ছিল। পরে তো আরও নতুন অনেক গোয়েন্দা সংস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মিত বেতন-কড়ি পান। অফিস আছে। অনেকে সরকারি বাসায় থাকেন, সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হল, গোয়েন্দারা কিছুই জানতে পারলেন না! বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁরা ঘুম থেকে ওঠা শিশুর মতো চোখ ডলতে ডলতে জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ডেও আমাদের গোয়েন্দারা কোনো তথ্য পেলেন না।

আমাদের গোয়েন্দারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা কিছুই আগাম জানতে পারলেন না। সারা দেশে ৬৩ জেলায় আধা ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ শতাধিক স্থানে একযোগে বোমাবাজি হল, সে ব্যাপারে গোয়েন্দারা কোনো আভাসই পেলেন না। দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা পর্যালোচনা করলে যেটা বুঝি– আমাদের শীর্ষ গোয়েন্দারাই আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালানে জড়িত ছিলেন!

এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ১৫ আগস্টের কথা। আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম ট্রাজিক ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। এই ঘটনাটিকেও অনেকে গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে দেখেন। ১৫ আগস্ট মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর শাহরিয়ার রশীদ, মেজর রাশেদ চৌধুরী ও অন্যরা বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশ নেন। তারা সবাই শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে চাকরি থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন। এরপরও তারা বীরদর্পে ক্যান্টনমেন্টে গেছেন। ঘোঁট পাকিয়েছেন। কিন্তু গোয়েন্দারা কিছুই জানতে, বুঝতে ও করতে পারেননি।

সেই সময় গোয়েন্দাদের 'অনন্ত ঘুম'ই বাঙালি জাতির জীবনে কাল হয়ে দেখা দেয়।
প্রশ্ন হল, আসলেই কী গোয়েন্দারা ব্যর্থ? নাকি তাদের ব্যাপারে আমরা অতি আশাবাদী? নাকি তারা নিজেরাই অপরাধী(!), ইচ্ছে করেই অনেক কিছু দেখেন না বা দেখতে চান না?

রাষ্ট্র ও তার রাজনৈতিক নিরাপত্তা দীর্ঘস্থায়ী হয় একটি সুগঠিত শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার ওপর। আর বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে বহু বিদেশি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা চক্র সবসময় সক্রিয় রয়েছে, সেখানে আমাদের নিজেদের গোয়েন্দা দপ্তরটিকে যদি বিজ্ঞানসম্মতভাবে অত্যাধুনিক করা না যায় তবে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা চক্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা করা যাবে কী করে? সরকারই বা নিরাপদ থাকবে কীভাবে? বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা প্রয়োজন।

গোয়েন্দাদের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রতিটি সংস্থার গোয়েন্দাদের মধ্যে আরও সমন্বয় খুবই জরুরি। দরকার তাদের কাজের জবাবদিহি। তাদের সাফল্যের জন্য পুরস্কার এবং ব্যর্থতার জন্য তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য থাকলে অনেক বড় ঘটনা আগে থেকেই মোকাবিলা করা সম্ভব। একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী থাকলে তারা সরকারকে সঠিক পথে চালিত করতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে সহায়তা করতে পারে।

প্রতিনিয়ত অপরাধী ও অপরাধের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা ইউনিটের ভূমিকা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। দরকার পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠা। আধুনিক যন্ত্র-প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতাও তাদের বাড়াতে হবে। আরেকটা বিষয় হল, যেসব গোয়েন্দা বাহিনী বর্তমানে দেশে আছে তাদেরও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। গোয়েন্দাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতাও বন্ধ হওয়া দরকার।

বর্তমান বিশ্বে শক্তিশালী উন্নত দেশগুলো নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে অন্য মিত্র-অমিত্র সব দেশেই তাদের গুপ্তচরগিরি ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালাবেই। তাতে সবসময় বাধা দেওয়া যায় না। কিন্তু এই বিদেশি তৎপরতা যাতে দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে না পারে সে জন্য অন্য দেশগুলোরও সমান পাল্টা ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ব্যবস্থাটি বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই অত্যন্ত দুর্বল।

আমাদের এনএসআই, ডিজিএফআইসহ আরও কিছু গোয়েন্দা ইউনিট আছে। তারা বিদেশি গোয়েন্দা তৎপরতার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মোটেই গণনার যোগ্য নয়! বাংলাদেশে এখন বিদেশি তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে। এর মোকাবিলা করার জন্য সরকারকে গোয়েন্দা সংস্থা পুনর্গঠনকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আমাদের এখন একটি অত্যন্ত শক্তিশালী, দেশপ্রেমিক ও সক্ষম গোয়েন্দা সংস্থা চাই। এই গোয়েন্দারা সমাজের সর্বস্তরে সূক্ষ্ম ও গোপন অনুসন্ধান চালিয়ে সন্ত্রাসী ও তাদের ঘাঁটিগুলো চিহ্নিত করবেন। এই চিহ্নিতকরণের পরই সরকার পুলিশ ও র‌্যাবের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। অন্যদিকে ছাত্র, যুব ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত শক্তি ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দ্বারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

তাহলে এই জামায়াতি সন্ত্রাসের দানবের কবল থেকে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হবে।

পরিশেষে গোয়েন্দাদের সম্পর্কে একটি বিখ্যাত গল্প–

গোয়েন্দা বা গুপ্তচরের আসল কথা গোপন না থাকলে সমূহ সর্বনাশ। গুপ্তচরের আসল কাজ বৈষ্ণব কবিতার পিরিতির মতো। গোপন পিরিতি গোপনে রাখিবি সাধিবি মনের কাজ। ইজরাইলের গুপ্তচর বিভাগ গোপনে কাজ সারতে, শোনা যায়, খুবই পটু।
ইজরাইলের গুপ্তচর বিভাগের বড়কর্তা একদিন গোপনে ডেকে পাঠালেন অস্কার লেভাস্ট নামে একজন অধীনস্থ গুপ্তচরকে। গোপনে বললেন, "লেভাস্ট, আজই তোমাকে নিউ ইয়র্ক যেতে হবে। এই নাও প্লেনের টিকেট।" বড়কর্তা গোপনে টিকেটখানা লেভাস্টের হাতে দিলেন। বললেন, "সেখানে গিয়ে কোন হোটেলে উঠবে, তা এই গোপন খামের মধ্যে লেখা আছে। নাও।"

টিকেট এবং খাম লেভাস্ট গোপন পকেটে রেখে দিল। বড়কর্তা বললেন, "ওই হোটেলে আমাদের একজন গোয়েন্দা আছে। তার নাম অ্যাডগার ম্যাগনিন। সে যে আমাদের গোয়েন্দা-সেটা সে জানে, আমি জানি, আর এ মুহূর্তে তুমি জানলে। খুব গোপন। তুমি গিয়ে অ্যাডগার ম্যাগনিনের ডান কানের কাছে মুখ নিয়ে গোপনে ফিসফিস করে বলবে– স্কাই ইজ ব্লু অ্যান্ড ট্রিজ আর গ্রিন। তারপর অ্যাডগার গোপনে তোমাকে একটা গোপন কাজ করতে বলবে। তুমি সেটা গোপনে সেরে গোপনে চলে আসবে।ব্যস।"

বড়কর্তার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললেন লেভাস্ট। কিন্তু নিউ ইয়র্ক হোটেলে এসে একটা গোপন বিপদে পড়লেন। রিসেপশনিস্ট খাতাপত্র খুলে বললেন, আমাদের হোটেলে এখন দুজন অ্যাডগার ম্যাগনিন আছেন। একজন থাকেন তেতলায় ৪২ নম্বর রুমে। আরেকজন থাকেন ৬২ তলায় ছয় হাজার ১৩ নম্বর রুমে।

আর শুনে কাজ নেই। আগে গোপনে তেতলায় ৬২ নম্বর রুমে গিয়ে দেখা যাক। সেখানে যেতে কোনো অসুবিধা হল না। রুমের মধ্যে অ্যাডগার ম্যাগনিন আছেন। তিনি সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন লেভাস্টকে। ম্যাগনিনের ডান কানের কাছে মুখ নিয়ে গোপনে ফিসফিস করে বললেন, "স্কাই ইজ ব্লু অ্যান্ড ট্রিজ আর গ্রিন!"

শুনে ম্যাগনিন হো হো করে হাসলেন। আপনি ইসরাইলের গুপ্তচর অ্যাডগার ম্যাগনিনকে চাইছেন তো? তিনি ৬২ তলায় ছয় হাজার ১৩ নম্বর রুমে থাকেন!