মুখ বন্ধ রাখাই কি শিখতে হবে?

Published : 25 August 2016, 05:33 AM
Updated : 25 August 2016, 05:33 AM

এখন থেকে মুখ বন্ধ রাখব। চোখের সামনে হত্যা, নির্যাতন, বৈষম্য, অবিচার দেখলেও মুখ খুলব না। আর যদিও খুলি তাহলে ভালো ভালো কথা বলব। বলব, উন্নয়নের কথা, বলব পুরুষের মহত্বের কথা, বলব নারীর কর্তব্য ও কর্মের কথা।

খামোখা প্রতিবাদ করে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে, মানববন্ধন করে কী লাভ! দুদিন পর সব ফাঁকা।

চিৎকার আর প্রতিবাদ করে কি তনুর হত্যাকারীদের ধরা গেছে? মিতুর খুনের রহস্য ভেদ হয়েছে? মাইক্রোবাসে গারো তরুণী ধর্ষণের কোনো আসামীর কি শাস্তি হয়েছে এখনও? পহেলা বৈশাখে নারীর উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনার আসামীদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকিদের ধরা গেছে, না চিহ্নিত করা গেছে?

আর লেখক-প্রকাশকদের হত্যাকারীরাও তো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে এখনও। তাহলে কী লাভ চিৎকার করে সময় নষ্ট করার?

আফসানাকে হত্যা করা হয়েছে না কি তিনি পরের বাসায় গিয়ে হঠাৎ করে নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছেন– সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা, বাদ প্রতিবাদেরই বা কী আছে? প্রতিবাদ করলে কি খুব একটা লাভ হবে? কয়েকদিন পর আবার একটা ঘটনা ঘটবে আর আফসানার মৃত্যুকে আমরা ভুলে যাব। এমন কত শত অপঘাত ও অসময়ের মৃত্যুর কথা আমরা ভুলে গেছি!

ভুলে গেছি লেখক প্রকাশকদের উপর আক্রমণ ও তাদের হত্যা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর সংঘটিত হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও তাদের ভূমি দখলের ঘটনা; ভুলে গেছি চা শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের ঘটনা; সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীর উপর নির্যাতনের ঘটনা…

শিশু রাকিবের পর আবারও নারায়ণগঞ্জে পেটে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হল শিশুশ্রমিক সাগরকে। কী প্রতিবিধান হল তার? বেশ প্রতিবাদ, মানববন্ধনও তো হল তা নিয়ে। তারপর কী হল? অপরাধীরা কি ধরা পড়ল? ফলোআপটিও তো জানা হল না।

এমনিতেই নারীর ও শিশুর অপমৃত্যু বা হত্যা আমাদের কাছে ডাল-ভাত! গৃহবধূ হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি খবর তো সংবাদপত্রে ভেতরের পাতায় এক কলাম জায়গা পাওয়ার যোগ্য। এ সবের প্রতিবাদ কখনও হয়, কখনও হয় না। হলেও সেটা খুব একটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে না। আলোড়ন সৃষ্টি করে তখনই যখন সে হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে রহস্য বা ভয়াবহ নৃশংস কোনো কার্যকলাপ। প্রকৃতপক্ষে সেটাই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। লোকে শিহরিত হয়। খুব করুণ কিছু হলে মানুষজন একটু-আধটু প্রতিবাদ করবে, তারপর সব যে কে সেই!

আর হত্যারহস্য উদ্‌ঘাটন? যদি সন্দেহের তির থাকে কোনো বাহিনী বা সরকারি দলের পাতি সংগঠনের কোনো পাতি সদস্যের প্রতিও তাহলে ওই রহস্য যে তিমিরে সে তিমিরেই থাকবে! তদন্ত কমিটির রিপোর্ট-টিপোর্টও চিরদিন 'অপ্রকাশিত কবিতা' হয়ে রয়ে যাবে। তখন ধর্ষণ নাকি সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স, হত্যা নাকি আত্মহত্যা– এমন অনেক কথাবার্তাও শোনা যাবে।

আফসানার মৃত্যু আবার আমাদের সামনে এই বিষয়টি নিয়ে এল যে, আমাদের সমাজে একজন মানুষকে হত্যা করা কোনো ঘটনাই না! মন চাইলেই করা যায়! আর সেটা করে পার পাওয়া যায়ও অতি সহজে। আর হত্যা না হয়ে যদি শুধু ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে, তাহলে তো সেটা 'লঘুভাবে' দেখাই যেন বিধেয়।

আফসানা যদি আত্মহত্যাই করতেন তাহলে তো সেটা তাঁর নিজের বাড়িতেই করতে পারতেন। পরের বাড়িতে গিয়ে কেউ যদি আত্মহত্যা করে আর সে সময় ওই বাড়িতে উপস্থিত অন্য মানুষ যদি তাকে বাধা না দিয়ে বলতে থাকে: বাহবা বেশ হয়েছে! রশিটা গলায় আর একটু জোরে বাঁধ! তাহলে সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা?

এটুকু তো একটা শিশুও বোঝে যে পরের সামনে আত্মহত্যা করা যায় না। ময়না তদন্তের রিপোর্ট একটু এদিক-ওদিক হয়ে যাওয়াও আমাদের দেশে কোনো 'ব্যাপার' না। তনুর প্রথম ময়নাতদন্তে তো ধর্ষণ সম্পর্কে কোনো কথাই বলা হয়নি। আর দ্বিতীয়টিতে বলা হল সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স। যেন ভর সন্ধ্যায় টিউশনি করে তারপর সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স করে বেড়ানোই ছিল মেয়েটির কাজ।

তনু হত্যার পর পাঁচ মাসের বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনও অপরাধীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরে, এই সময়ে তো ওই এলাকার প্রতিটা মানুষকে জেরা করে ফেলা সম্ভব। আর আফসানার বেলায় খুঁজে পাওয়া যায়নি কারা তাঁকে হাসপাতালে রেখে লাপাত্তা হল, আর কোথায় বা তাঁর স্বামী রবিন?

আফসানার ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে তেমনি অন্য অপরাধের বেলাতেও শোনা যায় সন্দেহভাজন বা অভিযুক্তকে নাকি খুঁজেই পাওয়া যায় না। মনে প্রশ্ন জাগে, সিসি টিভি ফুটেজ, মোবাইলের সিম নিবন্ধন– এগুলো কি তাহলে তরকারি রেঁধে খাওয়ার জন্য?

প্রযুক্তিগত এসব সুবিধা যদি দরকারের সময় কোনো কাজেই না লাগে তাহলে ঘটা করে এত পয়সা খরচ করে এগুলোর বন্দোবস্ত করার দরকার কী? তারচেয়ে 'বাটি চালান' দিলেই তো অপরাধীকে খুঁজে পাওয়া যায়!

আসল কথা হল, আমাদের মতো আমজনতা (নাকি কাঁঠাল জনতা? মানে, যার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া হয়) মরলেই কী আর বাঁচলেই কী? এ দেশে ১৬ কোটি মানুষ আছে। তাদের মধ্যে কেউ যদি ধর্ষণ, নির্যাতন হত্যার শিকারও হয়, তাতেই বা কি? টেক ইট ইজি!

পুলিশের এত সময় আছে নাকি যে এই আমজনতার কে কী করেছে সে খোঁজ নিতে গিয়ে তারা তাদের রাতের ঘুম আর দুপুরের খিদে নষ্ট করবে? অথবা আপনার বাড়ির দরজায় পাহারা দেবে? তারা জানে, এসব মানববন্ধন-টন্ধন দুদিনের ঘটনা। একটা ঘটনার নিচে অন্যটা, এক প্যাঁচালের নিচে অন্য প্যাঁচাল চাপা পড়ে যাবেই। দেখছেন না বাবুল আক্তারের চাকরি-কেচ্ছার নিচে কীভাবে মিতু হত্যা চাপা পড়ল!

অতএব, বাজার থেকে ভেজাল সর্ষের তেল কিনে আনুন এবং সেটা বেশ করে নাকেকানে দিয়ে তারপর ঘুমান। কে কাকে খুন করল সেসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আর যদি কোনোদিন আপনি নিজেই ঘুমের মধ্যে খুন হয়ে যান তাহলে অন্যদের ঘুমাতে দিন। মরতে হয় তো মরুন চুপচাপ, ভদ্রলোকের মতো মরুন! খামোখা জনগণের সেবকদের শান্তি বিনষ্ট করবেন না।

আরেকটি কথা, নিজের 'বেয়াদপ' মুখটা বন্ধ রাখতে শিখুন। আমিও চুপচাপ থাকতে শিখে গেছি। আপনারাও শিখুন। বেফায়দা কথা বাড়িয়ে, প্রতিবাদ করে, শব্দদূষণ বাড়িয়ে একদম লাভ নেই।