জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: সংকটময় ইতিহাস

চৌধুরী শহীদ কাদেরচৌধুরী শহীদ কাদের
Published : 23 August 2016, 04:40 AM
Updated : 23 August 2016, 04:40 AM

পূর্ববঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। একসময় শুধু পূর্ববঙ্গ নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে সবচেয়ে বড় আবাসিক সুবিধাসংবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল জগন্নাথ কলেজ। মূলত ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গে জগন্নাথ কলেজের একক আধিপত্য কমতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল জগন্নাথ কলেজের অগ্রণী ভূমিকা। জগন্নাথ কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক চলে যান নবগঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের প্রায় ৫০ শতাংশ দুর্লভ ‍ও মূল্যবান বই দিয়ে দেওয়া হয় ঢাবি গ্রন্থাগারে। সবচেয়ে মজার বিষয়, নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ছিল জগন্নাথ ও ঢাকা কলেজের। মূলত এ দুই কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থীদের দিয়ে প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়েছিল বহু প্রতীক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা যে যে বর্ষে পড়ত তারা একই বর্ষে ঢাবির শিক্ষার্থী হয়ে গেল।

ভারতীয় পার্লামেন্ট আইন করে জগন্নাথ কলেজকে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে রুপান্তর করে। ঢাবি কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ কলেজের এই অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি হলের নাম রাখল 'জগন্নাথ হল'। শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে জগন্নাথ অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়ে। তিন দশক পর ১৯৪৯ সালে এ কলেজে আবার বিএ ও বিকম চালু করা হয়। জগন্নাথ ফিরে পায় তার হারানো গৌরব।

পাকিস্তান আমলে জগন্নাথ-কেন্দ্রিক স্বাধিকার আন্দোলনকে দমানো, কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করার জন্য গভর্নর মোনায়েম খাঁ জাগন্নাথ কলেজকে সরকারিকরণের চিন্তা করতে থাকেন। ১৯৬৮ সালে কমরেড মনি সিংকে গ্রেপ্তার করা হলে জগন্নাথ কলেজের ৩৫ জন অধ্যাপক এর প্রতিবাদ জানিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দেন। গভর্নর এতে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হন।

১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে সরকারি কলেজে রূপান্তরিত করা হয়। শিক্ষকরা হয়ে পড়েন সরকারের কর্মচারী।

ঘোষণা দেওয়া হয়, প্রত্যেক শিক্ষককে পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দেখাতে হবে সরকারি অভিজাত কলেজে শিক্ষকতা করার যোগ্যতা তাঁদের আছে কি না। শিক্ষকদের বেতনও কমে যায় অনেকাংশে। সরকারি বেতন স্কেলে তাঁদের বেতন নির্ধারিত হয়। অপমানে, লজ্জায় অনেকে চাকরি ছেড়ে দেন। বাংলা বিভাগের প্রধান অজিত গুহ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল লতিফ সরকারিকরণের বিরোধিতা করে ইস্তফা দেন।

ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে জগন্নাথ কলেজকে কেবল বিজ্ঞান কলেজে রূপান্তর করা হয়। এর মানবিক ও বাণিজ্য শাখাকে স্থানান্তরিত করার জন্য ১২ মাইল দূরে মহাখালীতে; সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় জিন্নাহ কলেজ (যা বর্তমানে তিতুমীর কলেজ)। যা-ই হোক তুমুল ছাত্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এক বছরের মাথায় জগন্নাথকে বিজ্ঞান কলেজ থেকে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনে।

৮ম জাতীয় সংসদের ১৮তম অধিবেশনে 'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিল ২০০৫' পাসের মধ্য দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তারিখটি ছিল ২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এর নানামুখী সমস্যা। প্রথমেই শিক্ষকদের নিয়ে বিপাকে পড়ে কর্তৃপক্ষ। তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে একীভূত করার দাবি জানান। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সে সংকট থেকে রক্ষা পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)।

এরপর শুরু হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বর্ণিত ২৭(৪) ধারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন। যে ধারায় উল্লেখ ছিল, কার্যক্রম শুরুর পরবর্তী পাঁচ বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বহন করবে সরকার। পরবর্তীতে নিজস্ব আয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে চলতে হবে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামল। সরকারকে বাধ্য করল ২৭(৪) ধারা বাতিল করতে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একমাত্র অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সেটাই উল্লেখ আছে। অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ইউরোপ-আমেরিকায় খুব স্বাভাবিক বিষয় হলেও আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধা থাকবে না– এটা ভাবা যায় না, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় কলেজেও আবাসিক সুবিধা রয়েছে। ঢাকার ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা, তিতুমীর, ঢাকা কলেজ এসব কলেজের রয়েছে একাধিক আবাসিক হল।

অবিভক্ত ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় আবাসিক সুবিধাসংবলিত কলেজগুলোর একটি ছিল তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির আবাসিক হল ছিল ১১টি। ফলে অতীত ইতিহাস ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সুবিধা শিক্ষার্থীদের প্রায়শ উত্তেজিত করে তোলে। গত সাত বছরে নানা সময়ে দখলকৃত হলগুলো পুনরুদ্ধারসহ নতুন হল নির্মাণের দাবিতে উত্তাল হয়েছে জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাদের সেই আন্দোলন সফলতার মুখ দেখেনি।

কয়েকটি হল উদ্ধার করা হলেও সেখানে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ছাত্রী হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও সেটির কাজ চলছে খুবই মন্থর গতিতে। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর প্রায় ৯০ শতাংশকে থাকতে হয় ব্যাচেলর মেসে।

বর্তমানে ঢাকা শহরে চলমান জঙ্গিবিরোধী অভিযানের ফলে ব্যাচেলর মেসগুলোতে ছাত্রদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। নিরাপত্তার প্রশ্নসহ পুলিশি হয়রানির আশঙ্কায় অনেক বাড়িওয়ালাই ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দিতে চাইছে না। ফলে নিরুপায় হয়ে আবার রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রায় ২০ দিন ধরে তারা আন্দোলন করে যাচ্ছে।

ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার (পুরাতন) স্থানান্তরের পর সেটির খালি জায়গা জবিকে দেওয়ার জন্য সরকার আহবান জানানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগেই এই জায়গা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে আবার আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।

জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। কারাগারের জমিতে হল নির্মাণের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে মূলত অচল হয়ে পড়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ক্লাস, পরীক্ষাসহ সব কর্মকাণ্ড কার্যত বন্ধ। এ অবস্থায় আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট নিরসনের যে দাবি তা শতভাগ যৌক্তিক। এ জন্য মূল উদ্যোগটা নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। প্রশাসন আন্তরিক হলে হল নির্মাণ কোনো বিষয় নয়। তবে শিক্ষার্থীদেরও বুঝতে হবে, কলেজ কাঠামোয় গড়ে ওঠা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতারাতি বড় কোনো পরিবর্তনও সম্ভব নয়।

তবে প্রশাসনের উচিত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া। শুধু বড় বড় স্বপ্নেভরা গল্প শুনতে শুনতে সবাই ক্লান্ত। এখন চাই স্বপ্নের বাস্তবায়ন।

ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে এই আন্দোলনকে আর দমানো যাবে না। হয়তো সাময়িকভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবার ক্লাসে ফিরে যাবে। কিন্তু তাদের মনে যে অসন্তোষ সেটা কোনো একসময় আবার দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে! সুতরাং প্রশাসনের উচিত হল নির্মাণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। কারাগারের জমি দীর্ঘমেয়াদে লিজ পাওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হওয়া।

প্রতিদিনই রাজপথ মুখরিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের নায্য দাবি আদায়ের শ্লোগানে-শ্লোগানে। তারা দাবি করছেন, কারাগারের পরিত্যক্ত জায়গায় জাতীয় চার নেতার নামে চারটি হল নির্মাণ করা হোক।

মূলত আন্দোলন থেকে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্ম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন– প্রত্যেকটি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে জগন্নাথের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী। সুতরাং আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের দীক্ষা ইতিহাস থেকেই পেয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির উত্তরসূরিরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না; ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দেয়।

বিশ্বাস করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলে কারাগারের পরিত্যক্ত জমিতে না হোক অন্তত অন্য কোথাও শিক্ষার্থীদের মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই নিশ্চয়ই হবে।