গণতন্ত্র কেনাবেচা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 24 August 2016, 04:34 PM
Updated : 24 August 2016, 04:34 PM

বিশ্বের দরবারে ভারত বুক ফুলিয়ে জাহির করে– ভারতই হল বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এই গণতন্ত্রকে ছেঁড়া কাগজের মতো উড়িয়ে দেওয়ার ভারতীয় কর্মকাণ্ডের নায়িকা হয়ে উঠেছেন পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক দলের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভারতের গণতন্ত্রের মূল কথাই হল প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি মানুষের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের স্বার্থে জনগণের জন্য কাজ করবেন। এই রীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভারতের সংবিধানকে ধূলিসাৎ করেন মমতা– যিনি নিজেকে তাঁর চামচাদের দিয়ে 'সততার প্রতীক' বলে জাহির করেছিলেন– এখন বিরোধী দলের নেতাদের বিপুল অর্থ নিয়ে কিনে নিজের দল ভারী করার চেষ্টা করছেন। মমতা গণতন্ত্রের মধ্যেই একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে চাইছেন।

তাঁর নিজের ভাষায়, "পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও বামপন্থীসহ কোনো বিরোধী দল থাকবে না।"

তিনি একনায়কতন্ত্র কায়েম করার জন্য হিটলারি কায়দায় বিরোধী নির্বাচনী প্রতিনিধিদের নানা অসামাজিক প্রলোভন দেখিয়ে এবং পুলিশের সাহায্যে কিনে নিচ্ছেন।

২০১১ সালে প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পর মুখে উন্নয়নের শ্লোগান দিয়ে বিরোধী দলের এমএলএদের কেনাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। এবার তিনি আরও নিচে– পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ এবং পুরসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের টাকার ঝুলি নিয়ে কিনতে বেরিয়ে পড়েছেন।

এই অগণতান্ত্রিক ও অসামাজিক কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন এমন কয়েকজনকে যাদের বিরুদ্ধে সারদা ও নারদা দুর্নীতিতে কলকাতা হাইকোর্ট এবং শীর্ষ আদালতে একাধিক মামলা ঝুলছে।

তিনি প্রথম এক মাসের মাথায় দুজন বিধায়ককে কিনলেন। আর গত তিন সপ্তাহে তিনি কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিতি মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সদস্যদের কিনে নিলেন। এই কেনার ব্যাপারে নেতাদের পুলিশের ভয়, মিথ্যা মামলার ভয় এবং টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে দলে টেনেছেন।

এভাবে গণতন্ত্র কেনার অর্থ কী?

বিরোধীরা কি দুর্বল? না, দুর্বল নয়। তাঁরা খুনের ভয়ে এবং খানিকটা টাকার প্রলোভনে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন।

বিগত বিধানসভা নির্বাচনে মালদহে তৃণমূল কংগ্রেস একটিও আসন পায়নি। তৃণমূলের হয়ে যিনি লড়েছিলেন সেই ৮৬ বছরের বৃদ্ধ গনি খান পরিবারেরই একজন সদস্য। বিধানসভা ভোটে তিনি তাঁর ভাইপো ৪০ বছরের যুবকের কাছে হেরে ছিলেন। সেই থেকেই তাঁকে তাঁর সদ্য বিবাহিত ৩৮ বছরের স্ত্রীর মাধ্যমে প্রলোভন দেখানো হয়েছে– আপনাকে বিশাল পদ দেওয়া হবে, যেখানে আপনার স্ত্রীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা হবে।

এই অভিযোগ করেছেন মালদহ জেলা কংগ্রেসের সভানেত্রী মৌসব বেনজির নূর। তিনিও ওই পরিবারেরই একজন সদস্য।

চলতি মাসের গোড়ায় তিনি কিনেছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের কয়েকজন সদস্যকে। শুধু মালদহ-মুর্শিদাবাদ নয়, এই সপ্তাহে তিনি কিনেছেন দক্ষিণবঙ্গের আসানসোল ও দুর্গাপুর পুরসভার একাধিক নির্বাচিত সদস্যকে। এমনকী তাঁর বন্ধু এবং সহযোগী বিজেপিরও দুই সদস্যকে আসানসোল থেকে কিনে নিয়েছেন।

এরপরও দিদি বলেছেন নৈতিকতার কথা! নৈতিকতা শব্দটির অর্থ কী?

মমতা অনৈতিক কাজ করে সংবিধান ভেঙে নৈতিকতার কথা কী করে বলেন? তিনি একের পর এক যে অপকর্ম করছেন তার বিচার কে করবে? শেষ বিচারে রায় তো জনগণই শোনাবে।

একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে গিয়েছিলেন মমতার রাজনৈতিক গুরু সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। জরুরি অবস্থার সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি বিরোধী দলকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন পুলিশকে কাজে লাগিয়ে। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসকেও তিনি ব্ল্যাকমেইল করে ১৪ হাজার কংগ্রেমকর্মীকে জেলে ঢুকিয়েছিলেন।

সংবাদমাধ্যমের ওপর সেনসরশিপ চালু করে সাংবাদিকদের জেলে ঢুকিয়েছিলেন। সেই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ও ১৯৭৭ সালে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ভোটে না দাঁড়িয়ে লন্ডনে শশুরবাড়ি চলে যান। সেই থেকে একটানা ৩৪ বছর বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে শাসন করেছে।

জরুরি অবস্থার মুখে নিয়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর একনায়কতন্ত্র চালিয়েছিলেন। জোচ্চুরি করে নির্বাচন করার প্রতিবাদে বামপন্থীরা ৭২ থেকে ৭৭ বার বিধানসভা বয়কট করেছিলেন। এই পাঁচ বছরে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ঢুকেই বিরোধীদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন। তবে '৭৮ সালে তাঁর এই ঔদ্ধত্যের জবাব তিনি পেয়েছেন।

সিদ্ধার্থ রায়ের পক্ষে সেদিন কোনো মিডিয়া ছিল না। কারণ, একদিকে জরুরি অবস্থা, অন্যদিকে সব মিডিয়াই ছিল তাঁর অপশাসনের বিরুদ্ধে। তাঁর মন্ত্রিসভার ৯৫ ভাগ মন্ত্রীই ছিলেন তাঁর অত্যাচারের নীতির বিরুদ্ধে। সিদ্ধার্থ রায় অনেক চেষ্টা করেও তাঁর পক্ষে একটি শব্দও সংবাদপত্রে লেখাতে পারেননি।

অন্যদিকে মমতার রাজনৈতিক জন্মও কংগ্রেসে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গে তাঁর তফাত হল, আটটি চ্যানেল ২৪ ঘণ্টা ধরে তাঁর বন্দনা করে চলেছে।

মনে রাখতে হবে মমতাকে, জনগণকে মিডিয়া বিপথে পরিচালিত করতে পারে না। সামাজিকভাবে তারা বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে মাত্র।

১৯৪৭-২০০১ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যা ছিল না, তা আমদানি করেছেন মমতা। '৯৮ সালে যে দিন কংগ্রেস ছাড়েন, সেদিন ১০ জন সাংবাদিককে নিয়ে একটি কমিটি করেছিলেন মমতা। তাঁদের মধ্যে দুজন আর ইহলোকে নেই। এখনও আটজন আছেন। আর দিল্লিতে যাঁকে বসিয়ে রেখেছেন তিনি দিনে ১৮ ঘণ্টা বিজেপির দরজায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এঁরাই মমতার প্রধান পরামর্শদাতা। অর্থ খরচ করেই এসব পরামর্শ নিয়ে থাকেন তিনি। তা তিনি করতেই পারেন।

কিন্তু গণতন্ত্রকে ভাঙার অধিকার তাঁকে কে দিল? মমতার ঘনিষ্ঠ নেতারাই বলে থাকেন, সংবিধানের ব্যাপারে খুব একটা ধারণা তাঁর নেই।

২০১১ সালে মমতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেকার সমস্যা মুছে দেবেন। সম্প্রতি বিধানসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে দেখা গেছে, এমপ্লয়মেন্ট একচেঞ্জ থেকে পাঁচ বছরে চাকরি হয়েছে ৬৫ জনের। আর তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত একটা এমপ্লয়মেন্ট একচেঞ্জ আছে, যেখান থেকে ৫৮ জনের চাকরি হয়েছে। আর মুখে বলে যাচ্ছেন, প্রায় এক কোটি লোককে চাকরি দিয়েছেন।

মমতা কোনোদিন বেকার ছিলেন না। তাই বেকারত্বের জ্বালাও তিনি বোঝেন না।

ছাত্রজীবন থেকেই আপনি কী করেছেন, তা আপনার থেকে ভালো কেউ জানে না। আপনি বড়াই করে বলছেন, আপনি উন্নয়নের ধারক ও বাহক। কিন্তু আপনি শিল্প, কল-কারখানা হতে দেননি। আপনি এদিকে নজর না দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কেনার দিকে নজর দিয়েছেন। এটা তো গণতন্ত্রের নীতি ও রীতি নয়।

আপনি এবং আপনার প্রিয় দাদা নরেন্দ্র মোদী রোজই 'আমি', 'আমি' করে থাকেন। তাহলে তো এই বিরোধী নেতাদের আপনিই কিনেছেন লোক পাঠিয়ে। তাহলে এখন অস্বীকার করছেন কেন? এর পরিনাম যে কী হবে তা কল্পনাও করতে পারছেন না।

'সততার প্রতীক' যে আপনি নন, তা সারদা-নারদার কারণে সবাই জেনে গেছেন। তাহলে এখন আপনাকে কিসের প্রতীক বলা যায়? গণতন্ত্র ধ্বংসের প্রতীক?

বিধায়কসহ পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ পুরসভাগুলি থেকে প্রতিনিধিদের কিনে আপনি কি পশ্চিমবঙ্গ থেকে গণতন্ত্রকে তুলে দিয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা না করছেন?

পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের মানুষ এর যোগ্য জবাব দেবে। তার জন্য প্রস্তুত থাকুন।

প্রস্তুত পশ্চিমবঙ্গের মানুষও। সিদ্ধার্থ রায়ের পথে হাঁটলে আপনার পরিণতিও হবে তাঁরই মতো।