বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট ও তৈরি পোশাকশিল্পের সুবিধা কোথায়?

মাকসুদা সুলতানা
Published : 23 Oct 2011, 03:37 PM
Updated : 23 Oct 2011, 03:37 PM

প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সেপ্টেম্বরের ৬-৭ তারিখে বাংলাদেশ সফর করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে পুরোপুরি স্বার্থ আদায় হয়নি বলে অনেক ভারতীয় মনে করছেন। যেহেতু বাংলাদেশ তিস্তা নদীর ব্যাপারে কোন সমাধানে আসতে পারেনি তাই বাংলাদেশ ট্রানজিটে রাজি হয়নি। বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিকে আজ যত বেশি আত্মরক্ষার নীতি হিসেবে চিন্তা করা হয় তার চাইতেও বেশি অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে দেখা হয়। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও পরস্পরের অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি চিন্তা করেই এগিয়ে যাবে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা, ট্রানজিট ও তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আমাদের মিডিয়ায় বেশ আলোচনা করেছেন এবং করছেন।

সুবিধাজনক কোন অবস্থান তৈরি না করেই ভারতের ভারী পণ্যবাহী যানবাহন এদেশে প্রবেশাধিকার দেওয়া উচিত হবে কিনা–এ বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার ছিলো। কারন, নিজস্ব যানবাহনের মাধ্যমে ভারতের পণ্যগুলো আনা নেওয়া করলে এদেশের অবকাঠামোগত ক্ষতির সম্ভাবনা যেমন কম থাকে, তেমনি যানবাহন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মব্যবস্থা, রফতানীমুখী উন্নয়ন ও রাজস্ব আয় সম্ভব। ভারত, নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের নিজস্ব যানবাহন, ট্রাক এবং রেলওয়ে ব্যবস্থাকে ব্যবহার করলে এদেশের যানবাহন ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। এতে করে এইসব দেশের অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মব্যবস্থা বাড়বে । ভারতের রেলওয়ে ব্যবস্থা যেমন এদেশের পণ্য সীমান্ত থেকে বহন করে আমাদের থেকে ভাড়া আদায় করে লাভবান হচ্ছে তেমনি আমাদেরও উচিত হবে বাংলাদেশের নিজস্ব যানবাহন, ট্রাক এবং রেলওয়ে ব্যবস্থাকে ভারতের পণ্য পরিবহনের উপযোগী করে এর মাধ্যমে উত্তর পূর্ব ভারতে পণ্যগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে ট্রানজিট, ট্রাফিক ও ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার রাজস্ব আয় বাড়াতে পারবে। ভারত যেমন বাংলাদেশকে তাদের দেশে যানবাহনসহ প্রবেশাধিকার দেয়নি, তেমনি আমাদেরও উচিত হবে না তাদের পণ্যবাহী ট্রাক ও যানবাহনকে এদেশে প্রবেশাধিকার দেওয়া।
চুক্তির ক্ষেত্রে সমতা ও ভারসাম্য থাকলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্ভাবনাও কম থাকে।

এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে যেসব আলোচনা হয়েছে তার মূল বিষয় ছিল ট্রানজিটকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ও একটি এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ে ব্যবস্থা তৈরি করা। এতে দু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হতো এবং মিয়ানমার ও সিঙ্গাপুরের সাথেও এদেশের ব্যবসা ও রফতানী বাণিজ্য বৃদ্ধির আশা থাকতো। এতে করে ইয়োনান প্রভিন্স ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়াকে যুক্ত করার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। এশিয়ান হাইওয়েতে বাংলাদেশকে যুক্ত করা না হলে বাংলাদেশেরই বেশি ক্ষতি হবে। অবশ্যই আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংকীর্ণ মানসিকতার পরিবর্তে এক্ষেত্রে উদার নীতির প্রতিফলন ঘটালেই আমরা লাভবান হব। তাই বাংলাদেশ ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের সফরের মধ্য দিয়ে তাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের সাথে তিনটি বড় বিষয় জড়িত । যেমন, নদীর পানি বন্টন, বানিজ্য সম্পর্ক ও পারস্পরিক সীমান্ত ব্যবস্থাপনা। ভারতেরও তেমনি তিনটি বড় বিষয় জড়িত । যেমন সন্ত্রাসবাদ, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং ট্রানজিট ও অবৈধ অভিবাসন। বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, মিজোরাম আসাম এবং ত্রিপুরা প্রায় ৪০৯৫ কিলোমিটার সীমান্ত সম্পর্ক রয়েছে। এখানে ২,৯৭৯ কি. মি. স্থল ভূমি ও ১,১১৬ কি. মি জলসীমা নদীর সীমান্তে রয়েছে। উত্তরপূর্ব ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো ট্রানজিটের মাধ্যমে যুক্ত করা গেলে ভারতের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয় দ্রব্য ও মেশিনসমূহ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে। দু'দেশের জন্যই বাণিজ্য সম্পর্কটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের তৈরি পোষাকশিল্প ভারতের বাজারে তার শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের কাচামাল হিসেবে থান কাপড় এবং সুতা আসে ভারত থেকে । চীনের পর বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করে থাকে সবচাইতে বেশি । বেশির ভাগ গার্মেন্টস মালিক মনে করেন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে লাভের চেয়ে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি । এ শিল্পকে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বাইরের দেশের পন্যের সাথে । এদেশের বাণিজ্য ব্যবস্থা অনেকটাই ভারত নির্ভর । বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে কাচামালের ক্ষেত্রে ভারত নিজেদের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারছে | সেই কারণে, ভারতে এদেশের ৪৬ টি গার্মেন্টস পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশ অধিকার পাওয়ায় দুই দেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হবে না বরং দুই দেশই লাভবান হবে| পোশাকশিল্প ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেলে সামনের বছরে ১ মিলিয়ন ডলারের উপর লাভ আশা করা যায় | এর মাধ্যমে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সহজ হবে | যখন অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু হবে তখন দুই দেশের গার্মেন্টস শিল্প যেমন আরো প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যাবে তেমনি ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সুবিধা হতে পারে |

অন্যদিকে, অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী আগামী বছর থেকে ভারত চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। ভারত পরীক্ষামূলকভাবে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করছে বলে আমরা মনে করলেও, ইতিমধ্যে ভারতের পণ্যবাহী যানবাহনের চলাচল দেখে মনে হচ্ছে বন্দরটি ব্যবহারের সুবিধা ও অনুমোদন তারা পেয়ে গিয়েছে। এদেশের বণিকশ্রেণী বাংলাদেশের বন্দরের ঘাটতি রয়েছে বলে বলেছিলেন অনেকদিন আগেই। এই দু'টো বন্দরকেও যখন ভারতের সাথে শেয়ার করে ব্যবহার করতে হবে তখন আসলে তৈরি পোষাকশিল্প লাভবান হলেও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি কতটা লাভবান হবে তা বিবেচনা করা দরকার। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতের জন্য খুলে দেয়া হলে ভারতের উপকার হয় এবং ভারত পরীক্ষামূলকভাবে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার শুরু করেছেও । কিন্তু এর ফলাফল আমরা কী দেখতে পাই? সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে বলে এলাকাবাসী মনে করলেও তা হয়নি।

পার্শ্ববর্তী বৃহত্তম দেশ হিসেবে ভারত তার সুবিধা আদায় করে নিতে চাইবে এটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের খেয়াল রাখা জরুরি তিস্তার পানি চুক্তি ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর সাথে আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থগুলোকে যাতে এক টেবিলে সমাধানের চেষ্টা করা যায়।

মাকসুদা সুলতানা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী। লেখক ও গবেষক।