বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অভিন্ন শত্রুরা

আবুল হাসনাৎ মিল্টন
Published : 21 August 2016, 03:19 PM
Updated : 21 August 2016, 03:19 PM

পাকিস্তান সৃষ্টির সময় যে মুসলিম লীগকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পাগলের মতো সমর্থন করেছিল, সেই মুসলিম লীগের উপর তথা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর উপর থেকে বাঙালিদের মোহ কাটতেও সময় লাগেনি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসন, অত্যাচার, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির লুটপাটে বাঙালিরা দ্রুত হতাশ হয়ে পড়েছিল। এই হতাশার প্রতিফলন ঘটে ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে সংসদের উপনির্বাচনে।

টাঙ্গাইলের সেই উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা শামসুল হক। সেটা ছিল পাকিস্তানে মুসলিম লীগের প্রথম পরাজয়। এরও দুই মাস পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'-্এর জন্ম হয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হয়েছিলেন যথাক্রমে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং শামসুল হক। কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় সেই কমিটির জয়েন্ট সেক্রেটারি মনোনীত হয়েছিলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

জন্মলগ্ন থেকেই কোনো রকমের সময় নষ্ট না করে আওয়ামী লীগ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করে। পাশাপাশি তৎকালীন ছাত্রলীগও মনপ্রাণ দিয়ে সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সময়োপযোগী রাজনৈতিক দাবিগুলোতে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটছিল। তাদের সমর্থনও তাই দ্রুত বাড়ছিল। যদিও সে সময়ে আওয়ামী লীগের চলার পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না; পদে পদে পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন রকমের বাধার সৃষ্টি করেছিল।

আওয়ামী লীগের প্রথম অফিস হয়েছিল ১৫০ মোগলটুলিতে; প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংও ওখানেই হয়। প্রথম জনসভা ডাকা হয় আরমানিটোলা ময়দানে; মওলানা ভাসানী সেবারই ঢাকায় প্রথম জনসভায় বক্তৃতা করেন। তবে জনসভার শুরুতে সেটি ভণ্ডুল করার জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ গুণ্ডা পাঠিয়ে মাইক্রোফোন আর প্যান্ডেল ভেঙে দিয়েছিল। অনেক কর্মীকে মারধর করেছিল। এভাবে আওয়ামী লীগের প্রায় প্রতিটা কর্মসূচিতেই সরকার নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করছিল।

ঢাকার বাইরে মফস্বলে আওয়ামী লীগের প্রথম জনসভা হয়েছিল ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে। জনসভার দিন সকালবেলা হঠাৎ ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে জনসভার স্থান বদলে কাছের মসজিদ প্রাঙ্গনে নির্ধারণ করা হয়। সেখানে জনসভা শুরু হতেই মসজিদের ভেতরেও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়, কিন্তু জনতা ততক্ষণে উত্তাল! মসজিদের ভেতরে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে শেখ মুজিব ও ফরিদপুর আওয়ামী লীগের নেতা সালাম খানকে গ্রেপ্তার করা হল। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে মহকুমা পুলিশ অফিসার শেখ মুজিব ও সালাম খানের কাছে এসে বিনীত অনুরোধ করে সহায়তা চান। তখন বঙ্গবন্ধু উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করে যা বলার ছিল সবই বলেন। পরে মসজিদ থেকে হাজার হাজার জনতাসমেত কোর্টে এলে শেখ মুজিব ও সালাম খানকে জামিন প্রদান করা হয়।

মওলানা ভাসানী ও অন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলে শেখ মুজিব সারা দেশে আওয়ামী লীগের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করলেন। সারা দেশে তখন একধরনের প্রশাসনিক অরাজকতা চলছে, চারিদিকে খাবারের সংকট, দেশ নিয়ে শাসকদের কোনো দূরদর্শী পরিকল্পনা নেই। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে জনগণ শাসকগোষ্ঠীর উপর বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের জন্য একটি শাসনতন্ত্র, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করাসহ অন্যান্য দাবির স্বপক্ষে আওয়ামী লীগ জনমত সৃষ্টি করতে তৎপর হল। মুসলিম লীগের অত্যাচারের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানজুড়েই লোকজন আওয়ামী লীগে যোগদান করতে লাগল।

এদিকে সরকারি নির্যাতনও চলতে থাকল, শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের প্রায়ই গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হত। পুরো পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব দীর্ঘ সময় কারান্তরীণ ছিলেন। তবুও আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি। ১৯৫৩ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

সে বছরেরই মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হল। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলেই সবার ধারণা ছিল। যদিও পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। গোপালগঞ্জ আর কোটালিপাড়া– এ দুই থানা নিয়ে তাঁর নির্বাচনী এলাকা।

নির্বাচনে মুসলিম লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।

ওয়াহিদুজ্জামান ধনী প্রার্থী; অর্থ, যানবাহন, প্রশাসনের সহযোগিতা; কোনো কিছুরই অভাব নেই তাঁর। অন্যদিকে একটা মাইক্রোফোন, দুটি সাইকেল আর পরিবারের কয়েকটা বড় নৌকা ছাড়া কিছু নেই শেখ মুজিবের।

পুরো নির্বাচনী এলাকায় রাস্তাঘাট তেমন ছিল না, যাতায়াতের খুব অসুবিধা। তবু নির্বাচনী প্রচারে নেমে কয়েকটি নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা করার পর বোঝা গেল, ওয়াহিদুজ্জামানের পরাজয় নিশ্চিত। বঙ্গবন্ধু যেখানেই যান, সেখানেই সাধারণ মানুষের ঢল।

বঙ্গবন্ধু যে গ্রামেই যেতেন, জনগণ যে শুধু তাঁকে ভোট প্রদানের অঙ্গীকার করতেন তা-ই নয়; তাঁকে পান দিয়ে আপ্যায়নের পাশাপাশি নির্বাচনের খরচ হিসেবে কিছু টাকাও দিতেন এবং না নিলে রাগ করতেন। ছাত্র-যুবক কর্মীরা নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে নির্বাচনের কাজ করতে লাগলেন।

ওয়াহিদুজ্জামান এবং তাঁর দল মুসলিম লীগ যখন নির্বাচনের নিশ্চিত পরাজয় আঁচ করতে পারলেন, তখন তাঁরা ঘৃণ্য এক ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবকে নির্বাচনের মাঠে নামালেন। বঙ্গবন্ধুর নিজের ইউনিয়নে পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক জন্মগ্রহন করেছিলেন। ধর্ম বিষয়ে শামসুল হক সাহেব অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু নিজেও তাঁকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন।

নির্বাচনে মওলানা সাহেব নিজে ইউনিয়নের পর ইউনিয়নে স্পিডবোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্মসভা ডেকে ফতোয়া দিলেন যে শেখ মুজিবকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে!

মওলানা শামসুল হকের সঙ্গে আরও যোগ দিলেন শর্ষিণার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব এবং রহমতপুরের শাহ সাহেবসহ আরও অনেক মওলানা। সব হুজুরের একই ফতোয়া, "শেখ মুজিবকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না।"

এর পাশাপাশি প্রশাসনিক হয়রানি, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্বাচনের তিনদিন আগে বিভিন্ন কেন্দ্রের পরিবর্তনসহ মুসলিম লীগ প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামানের জয়ের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সরকারের পক্ষ থেকে সবকিছুই করা হল। যদিও তাতে শেষ রক্ষা হয়নি, নির্বাচনে দেখা গেল বঙ্গবন্ধু প্রায় দশ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন।

সেই নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ মুজিব উপলব্ধি করেছিলেন, 'মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে।'

মওলানা শামসুল হক পরে তাঁর ভুল বুঝতে পেরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। সেবার নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। 'ইসলাম ধর্ম শেষ হয়ে যাবে' আওয়াজ তুলেও তারা মুজিবের বিজয় ঠেকাতে পারেনি।

পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়, আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে ধর্মের এই 'ট্রাম্পকার্ড' তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সবসময় খেলে আসছে। যদিও ধর্ম নিয়ে অপপ্রচার করে আওয়ামী লীগকে 'দাবায়ে' রাখা যায়নি।

ছাত্রলীগের একজন সামান্য কর্মী হিসেবে রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনাকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আজও চলছে রাজনীতির সেই পুরনো খেলা; শুধু খেলোয়াড়ের পরিবর্তন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মতো শেখ হাসিনাকেও এত বছর পরও ইসলাম ধর্মের প্রশ্নে একইভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশে ইসলাম বিপন্ন হবে বলে অনেক হুজুরই মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। জামায়াত-শিবির ছাড়াও নানা ইসলামী দল ও পীরের মুখেও একই বুলি।

স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি রাজনীতির সেই ধারার অনুসারীরা আজও বিদ্যমান। আর এই ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও বিভিন্ন জনসভায় শেখ হাসিনাকে ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করে বহুবার বক্তব্য রেখেছেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে 'মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি হবে' ধরনের নিম্নমানের কথাবার্তাও আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনেছি।

অথচ ব্যক্তি জীবনে শেখ হাসিনা অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ একজন মানুষ। তাঁর সরকারের আমলে ইসলামসহ সব ধর্মের মানুষেরই কল্যাণ হয়। ইসলাম ধর্মের মঙ্গল বই কোনো ক্ষতি হয় না। বাংলার মানুষও এই সত্যটি আজকাল উপলব্ধি করতে পারে, পারে না শুধু পাকিস্তানি রাজনীতির এদেশীয় ধারক-বাহকরা।

পৃথিবীটা বদলাচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। তবু খালেদা জিয়ারা বদলাচ্ছেন না! আজও সেই পুরনো, বাতিল, গণধিকৃত পাকিস্তানি রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করে চলছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কী এক লজ্জার বিষয়!