কেকহীন জন্মদিন কীসের আলামত?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 16 August 2016, 12:57 PM
Updated : 16 August 2016, 12:57 PM

খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানানোর খুব বেশি কারণ ঘটেনি অামার জীবনে। রাজাকারদের মন্ত্রী-মিনিস্টার বানানো স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি এদেশের সচেতন মানুষের বিরাগভাজন হয়েছেন বারবার। তাঁর অামলে এমন এক জায়গায় চলে গিয়েছিলাম অামরা যেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ দেখাই যেত না। ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে অাসা সে সময়টিতে নানাভাবে অাহত করেছেন তিনি আমাদের। তাঁর এবং তাঁর আশেপাশের লোকদের বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে, জামায়াত সঙ্গে থাকা মানেই গদি লাভ। খালেদা জিয়াও ভেবে নিয়েছিলেন যে, এদেশে ককটেল-রাজনীতি হল শেষ কথা!

কী নিদারুণ মনোভাব! স্যালাইনের মতো এক চিমটি মুক্তিযুদ্ধ, এক চামচ রাজাকারি, এক খাবলা জাতীয়তাবাদ অার সবার ওপর ভারত ও সাম্প্রদায়িকতার জুজু। তাদের ধারণা ছিল এভাবেই জীবন চলে যাবে। তাঁর সঙ্গে থাকা যেসব নেতা অাজ দূরে বা গুটিয়ে অাছে তারা কোনো দল করতে এসেছিল কি অাদৌ? তাদের দরকার ছিল গদির ভাগ। সেটা পাবার পর তাদের পাওনা বুঝে নিয়ে সবাই এখন যার যার জায়গায় ফিরে গেছে।

যে কথা বলছিলাম, অাহত চেতনা অার মুক্তিযুদ্ধকে তার গুণধর বড় পুত্রটি নিহত করার অাগেই সময় রুখে দাঁড়িয়েছে।

খেয়াল করবেন, তাঁর ও বিএনপির এই দশা অাওয়ামী লীগের অান্দোলন বা কাজের ফলে হয়নি। এর দায়িত্ব নিয়েছিল সময়। বিএনপি যদিও বলে, 'ষড়যন্ত্র'– আমি বলি সময় ও প্রকৃতির মার। যারা ওয়ান-ইলেভেন এনেছিল তারা দুই নেত্রীকেই মাইনাস করতে চেয়েছিল। তখন অামি এই বলে সাবধান করেছিলাম, 'মাইনাসে মাইনাসে কিন্তু প্লাস'। সময় ও নিয়মের নিয়মে 'প্লাসে মাইনাসে মাইনাস' হয়ে বেগম জিয়া অাজ এই জায়গায়। তিনি মনে করেন বা করতেন, 'সাইলেন্ট মেজরিটি' তাঁর দলকে তুলে অানবে।

মেজরিটি অাছে বৈকি। কিন্তু মেজরের দলে ক্যাপ্টেনের বড় অভাব। কাপ্তানহীন জাহাজ চলবে কীভাবে?

তার চেয়েও বড় কথা, বিএনপির অাসল আদর্শ কী তা তারা নিজেরাও জানে না। অাওয়ামী লীগ যেমন এখন অার মুজিববাদ বলে না, তাদেরও মত বদলাতে হবে। কিন্তু তাদের তো সত্য বা সহজ কোনো ইতিহাস নেই। এতটুকু অাসার পেছনে যেসব কাহিনি প্রচলিত, মিডিয়া ওপেন হবার পর সেসব আর মানুষ পাতে নেয় না। অাসলে জামায়াতের নীতি বা পথ ভয়ানক মনে হলেও তারা টিকে থাকতে পারে, কিন্তু বিএনপির টিকতে কষ্ট হবে।

বেগম জিয়া নিজের বয়সের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। যে বয়সে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁকে ঘিরে যে কৌতূহল, তাঁকে দেখার যে অাকাঙ্ক্ষা, আজ তা অস্তাচলে। বিষয়টা নেতিবাচকভাবে দেখার অবকাশ নেই। পরিতাপের বিষয়, তাঁর সফরসঙ্গী ও নানা মুখরোচক খবরের জন্মদাতা স্বয়ং ফালু সাহেবও অাজ দলত্যাগী। এত ঘটনা-দুর্ঘটনার পরও, এত কোনঠাসা হয়েও, এমনকি পুলিশি অত্যাচারের পরও বিএনপি একটি কমিটি ঘোষণা করেছিল বটে। সে কমিটি ঘোষণার কাগজের কালি শুকোবার অাগেই মোসাদ্দেক আলী ফালু পদত্যাগ করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর শরীর ভালো নেই। এরপর অারও একজন গিয়েছেন। মওদুদ সাহেব দলে থেকেও যেন নেই। ওদিকে নাজমুল হুদা বলছেন, শেখ হাসিনাই নাকি উভয় নেত্রীর প্রতীক, কাজেই খালেদা জিয়ার দরকার পড়ে না অার!

একসময় বিএনপিতে ঢোকার জন্য, সেখানে পদ পাবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরত মানুষ। টাকা-পয়সা দিয়ে পদ বাগিয়ে নিত। এখন এ দলে কাউকে রাখলেও থাকতে চাইছেন না তারা! অাহা খালেদা জিয়া, কোথায় অাপনার সেই গর্বিত আচরণ?

এদেশের প্রথিতযশা কবি, অামাদের প্রিয় শামসুর রাহমানের কান টেনে দিতে বলেছিলেন অাপনি। বীরোত্তম সি অার দত্ত বলেছিলেন, কী কারণে যেন অাপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁরা, যাদের অাপনি এককালে সম্মান করতেন, সেসব বয়সী মানুষদের মুখের কাছে পা নাড়িয়ে বসেছিলেন সারাক্ষণ। অাপনি ভুলে গেলেও অামরা ভুলিনি, অাপনার অামলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষদের দুরবস্থার কথা।

কথায় কথায় ধমক দিয়ে কি অার চিরদিন চলা যায়?

একা হতে হতে ভরসাহীন খালেদা জিয়া এবার তাঁর জন্মদিনে কেক কাটেননি। এই কেক কাটা নিয়ে কত অাপত্তি, কত গুজব, কত ধরনের প্রচার! এককালের অাপোসহীন নেত্রী কারও কথা শোনেননি। এটা যদি তাঁর অাসল জন্মদিন হয়ও, তিনি নিভৃতে পালন করতে পারতেন। জাতির জনকের মহিমা ম্লান করার জন্য যে 'রক্তমাখা' কেক এতদিন কেটেছেন তিনি, তা বিএনপির পাপের বোঝা বাড়িয়েছিল। যার পরিণতি অাজ বন্যা ও গুলশান ট্র্যাজেডির অজুহাতে তাঁর কেক না-কাটা।

গুলশানের ঘটনার পর বিএনপি বলেছিল, এতে সরকারের হাত অাছে। জঙ্গিরা নাকি অাসল জঙ্গি নয়। তো কার জন্যে তিনি কেক কাটা মুলতবি করলেন? অাওয়ামী লীগের কথিত গুলশান ষড়যন্ত্রের জন্য এত বড় সেক্রিফাইস?

এই কেক ঝড়-বাদল অালোচনা-হরতাল কিছু মানত না। বছরের পর বছর তার সাইজ বড় হতে শুরু করেছিল। প্রতি বছর বাঁদর নাচের মতো বিকৃত উল্লাসে নেতা নামধারী কিছু লোকের তাণ্ডবে বিচলিত জাতির হাহাকার পৌঁছায়নি অাপনার কানে। যাঁর কারণে সংসার, যাঁর কারণে রাজ্যপাট, যাঁর কারণে এই দেশ– তাঁর মৃত্যুদিনে মিথ্যা উল্লাস– সময় এমনি এমনি ছেড়ে দেবে?

তারপরও ধন্যবাদ। অন্তত মিডিয়ায় বেহায়া কিছু নেতার ভীড়ে তাঁকে কেক কাটার ভেতর দিয়ে কোটি মানুষের বিবেক কাটতে দেখা যায়নি। অামি পজেটিভ মানুষ। অামার বিশ্বাস এমনভাবে মেনে নিতে নিতে তিনি একদিন জন্মদিনও অার পালন করবেন না।

তবে কে জানে কোথায় কোন খেলা চলছে। এর ভেতর কোনো মেরুকরণ বা ষড়যন্ত্র থেকে থাকলে অচিরেই তা টের পাব অামরা। শোনা কথা, এ নাকি একদা বীর কাদের সিদ্দিকীর পরামর্শ। এখানেও অাপনি ভুল করছেন। কাদের সিদ্দিকী যখন বাঘা সিদ্দিকী তখন অাপনার দুশমন। এখন তাঁর কথা শুনলে-বা কী অার না শুনলেই-বা কী!

ডক্টর কামাল হোসেন, এমাজউদ্দীন, ফরহাদ মজহার, জাফরউল্লাহারা বাতিল হয়ে গেছেন। কেউ তো বিক্রিত ও বিকৃত মাল ফেরত নেয় না। লীগেও এমন মালে গুদাম ভরা। তবে বড় দল তৃণমূলে গাঁও-গেরামে তাদের নেতার অভাব নেই। সবচেয়ে বড় তফাৎ শেখ হাসিনায়। একসময় নানা কৌশলে তাঁকে ফেলে এগিয়ে গেলেও চেতনা, সাহস অার মুক্তিযুদ্ধ তাঁকেই এগিয়ে রেখেছে। জীবনদৌড়ে সুশিক্ষিত তাঁর পরিবারের সন্তানরাও অাজ বুঝিয়ে দিয়েছে, দেশ তো দেশ, তারা বিলেতেও নিজেদের জায়গা করে নিতে পারে।

জানি না কী বুঝে কী কারণে এবার কেক কাটা হয়নি। এ কি সরকারের চাপ থেকে মুক্তির কৌশল না বিদেশ পাড়ি দেওয়ার জন্য? নাকি জনরোষের ভয় ও ভোটের জন্য? তার জবাব দেবে সময়। এ অব্দি শোক দিবসের শক্তিকেই বাহবা দিই। এভাবেই সে পরাভূত করুক যাবতীয় অন্যায়।

একটু সুবাতাসও মন্দ কী এমন গুমোটে!

সিডনি