যুব ভাবনা: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম
Published : 12 August 2016, 10:45 AM
Updated : 12 August 2016, 10:45 AM

১১ জুলাই ছিল বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, 'কিশোরীদের জন্য বিনিয়োগ– আগামী প্রজন্মের সুরক্ষা'। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে আন্তর্জাতিক যুব দিবস, ১২ আগস্ট। ১৯৯৯ সাল থেকে সুচনা হওয়া এ দিবস জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বরাবরের ন্যায় পালন করে আসছে। এ বছর যুব দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হল, '২০৩০এর পথে: দারিদ্র নির্মূল এবং টেকসই (বজায়যোগ্য) ভোগ ও উৎপাদন অর্জন'।

২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই বা বজায়যোগ্য উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এ বছরের আন্তর্জাতিক যুব দিবস তরুণ-যুব গোষ্ঠীর দারিদ্র নিরসনে বজায়যোগ্য (টেকসই) উন্নয়ন করতে বজায়যোগ্য ভোগ ও উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকার প্রতি তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এখানে বজায়যোগ্য (টেকসই) ভোগ বলতে বোঝানো হয়েছে উৎপাদন এবং সেবার ব্যবহার যা মৌলিক চাহিদা পূরণের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণে নিরাপদ রক্ষাকবচকে।

পরিবেশ দূষণ ও বর্জ্য হ্রাসকরণে সকল ভোগের পরিবেশ-দক্ষতা উন্নয়ন ও ব্যক্তির পছন্দ বা বাছাইয়ের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তবে বজায়যোগ্য (টেকসই) ভোগ চয়নের ক্ষেত্রে অনেক তরুণ-যুবাগোষ্ঠী প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে থাকেন। দ্রব্য ও সেবার উচ্চমূল্য এবং তথ্যের অনুপস্থিতি এ সকল প্রতিবন্ধকতার অন্তর্ভুক্ত।

বজায়যোগ্য (টেকসই) উৎপাদনে সম্পদের কার্যকর ব্যবহারের ক্রমবৃদ্ধি সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে, বিশেষ করে যুবগোষ্ঠীর যারা দারিদ্রসীমার মধ্যে রয়েছে তাদের খাদ্য, পানি, জ্বালানিতে অধিকতর প্রবেশগম্যতা ও সামর্থ্যে ভুমিকা রাখে। যে কোনো দেশের নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতার ওপর দেশের ভবিষ্যৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করে।

আর বজায়যোগ্য ভোগে বিনিয়োগ মানে নতুন বাজার সৃষ্টি ও কাজের সুযোগ যেখানে সমাজের সকলের অন্তর্ভুক্তিকরণ ঘটে।

বর্তমানে বিশ্বে ১.৮ বিলিয়ন তরুণ-যুবা জনগোষ্ঠী রয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ১৫-২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী যুবক। বিশ্বায়নের এ সময়ে এ যুব জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত, স্পষ্টবাদী ও উন্মুক্তমনা। এ বিশাল জনগোষ্ঠী আমাদের জন্য শুধু ভবিষ্যৎই নয়, বর্তমানও বটে। তারা ইতিবাচক পরিবর্তনের শক্তিশালী বাহক।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যুবগোষ্ঠী। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়-সম্পর্কিত জনসংখ্যা বিভাগের 'বিশ্ব জনসংখ্যা সম্ভাবনা: ২০১৫ রিভিশন'এর তথ্যমতে, বর্তমানের ১৬ কোটি জনসংখ্যার ১৫-২৪ বছর বয়সী প্রায় ২০ শতাংশ যুবগোষ্ঠী। আর বাংলাদেশ সরকারের মতে, ১৮-৩৫ বছরের জনগোষ্ঠী যুবক। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি যুবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

এ বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট ও সময়পোযোগী কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার। ২০০৩ সালের জাতীয় যুবনীতির পর ২০১৫ সালে খসড়া প্রণয়নের পর এখনও সরকার চূড়ান্ত যুবনীতি প্রদান করতে পারেনি। এমনকি বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি ২০১২তেও লভ্যাংশ বিষয়ে কোনো ধারণার অবতারণা নেই। ফলে সময়ের ধারাবাহিকতায় জনসংখ্যার বয়স-কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জনসংখ্যা ও যুবনীতিতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসছে কি না তা এখনও পরিস্কার নয়।

উল্লেখ্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নীতির বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ রয়েছে যার প্রধান দেশের প্রধানমন্ত্রী। এ পরিষদ প্রয়োজনে জনসংখ্যা নীতিতে যে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের নির্দেশ প্রদান করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গত ৭-৮ বছরে এ পরিষদ কোনো সভা করেনি। এ থেকেই বোঝা যায়, জনসংখ্যা নিয়ে সরকারের তেমন মাথাব্যথা নেই।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন নির্ভর করে তার সুযোগ সৃষ্টি, সুযোগের সদ্ব্যবহার এবং তা দীর্ঘায়ন করার ওপর। এ লক্ষ্যে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল লক্ষ্য করতে পারছি না। জনসংখ্যার পরিমাণগত ও কাঠামোগত মানদণ্ডে বাংলাদেশে এমন একটি সময় পার করছে যেখানে নির্ভরশীলতার হার সবচেয়ে কম এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

এ সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ত্বরায়ণ করতে পারে। তবে সেটি নির্ভর করছে বয়স-কাঠামোর পরিবর্তনে জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সুশাসন নিশ্চিতকরণের ওপর।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হল, বাল্যবিবাহ, দ্রুত সন্তানধারণ, শ্রমবাজারে নারীদের কম অংশগ্রহণ, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্থানীয় ও পরিবর্তিত বিশ্ববাজার মাথায় রেখে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া। উদাহরণ হিসেবে বাল্যবিবাহ বা শিশু-বিবাহের কথাই বলি, বাল্যবিবাহ আমাদের যুবগোষ্ঠীর উন্নয়নে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। মেয়েদের ১৮ বছর আর ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে হলে তাকে আইনগতভাবে 'শিশু-বিবাহ' বলে। ২০১৪ সালের বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্য মতে, ২০-২৪ বছর বয়সী মেয়েদের অর্ধেকেরও বেশির (৫৯ শতাংশ) ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বাল্যবিবাহ বা শিশু-বিবাহের ফলে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষণীয়। বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েরা স্কুল বা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে যার ফলে তাদের উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ও অপরিকল্পিত গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়ছে। সে সঙ্গে তাদের সন্তানদের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হারও বেড়ে যাচ্ছে।

অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, বাল্যবিবাহের ফলে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়, কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং সংশ্লিষ্ট পরিবারটি হয়ে পড়ে দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্রের শিকার। শুধু বাল্যবিবাহ বা শিশু-বিবাহই নয়, দ্রুত সন্তান ধারণও বাংলাদেশে বেশ প্রকট। ২০১৪ সালের বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী ২০ বছরে পৌঁছানোর পূর্বেই মা হয়ে যায়। সে হিসাবে প্রতি ৩ জন কিশোরীর ১ জনই ১৯ বছরের মধ্যে মা হয়। যার ফলশ্রুতিতে শিশু-বিবাহের ন্যায় ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়।

এ থেকে উত্তরণ ঘটানো দরকার। জনমিতিক লভ্যাংশের সুযোগ পরিকল্পনামাফিক কাজে লাগাতে পারলে আগামী দিনগুলোতে পর্যাপ্ত সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে যে, জনমিতিক এ লভ্যাংশের এ সুযোগ একটি দেশে একবারই অর্জনের সুযোগ থাকে। এ হিসাবে বাংলাদেশে ২০৩৫ পর্যন্ত এ সুযোগ অব্যাহত থাকবে বলে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে। পরবর্তীতে আনুপাতিক হারে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমতে ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।

গত বছরের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫-২৪ বছর বয়সী যুব শ্রমশক্তির আকার ২০০৫-২০০৬ সালের ১০.৮ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০১৩ সালে পৌঁছেছে ১৩.৪ মিলিয়নে। নারী-পুরুষ ও শহর-গ্রাম ভেদে বেশ পার্থক্য লক্ষণীয়। বিশেষ করে শহর এলাকার তুলনায় গ্রামে ১৫-২৪ বছর বয়সী যুব শ্রমশক্তি ৩ গুণ বেশি। একই বয়সী পুরুষ শ্রমশক্তি নারীর তুলনায় প্রায় ২ মিলিয়ন বেশি।

অপরদিকে, মোট শ্রমশক্তির বিচারে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার পুরুষের তুলনায় অনেক কম। পুরুষের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার যেখানে শতকরা ৮১.৭ শতাংশ সেখানে নারীদের হার মাত্র ৩৩.৫ শতাংশ। ৮.৪ মিলিয়ন নারী মজুরিবিহীন গৃহস্থালি কর্মে নিয়োজিত যেখানে পুরুষরা হচ্ছে ২.১ মিলিয়ন। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য থাকলেও গত এক দশকে বেকারত্বের হার হ্রাসকরণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী যুব জনগোষ্ঠীর নির্ভরশীলতার হার শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি। ১৫-২৯ বছর বয়সী যুবগোষ্ঠীর ১৪.৪ শতাংশ কখনও কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায়নি। এ অবস্থায় মানবসম্পদের বিকাশে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যুব জনগোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দরকার।

জাতিসংঘের ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক ফোরামের ঘোষণা অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৬ শতাংশ ও মোট বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই। জিডিপির ২-২.৫ শতাংশের মধ্যেই বিরাজমান। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ এখনও জিডিপির ১ শতাংশের নিচে যা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।

বর্তমান বিশ্বে যুব জনগোষ্ঠী বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে যুব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে এদের মধ্যে দারিদ্র, কর্মহীনতা, পর্যাপ্ত শিক্ষাহীনতা, রোগশোক (যৌনবাহিত), কম বয়সে বাবা-মা হয়ে যাওয়া, হতাশায় আক্রান্ত হওয়া, অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া, প্রভৃতি লক্ষণীয়। এ সকল চ্যালেঞ্জ থেকে আমাদের দেশের যুবগোষ্ঠী কোনোভাবেই আলাদা নয়। ফলে দেশের সঠিক উন্নয়নে নেতৃত্বদানে দক্ষ, প্রশিক্ষিত জনবল গঠনে যুবগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের সুনজর প্রদান ও বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।

সঠিক, সময়োপযোগী কর্ম-পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নই সাসটেনবল ডেভেলপমেন্ট বা বজায়যোগ্য উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে।