যে কারণে বিএনপির পক্ষে জামায়াত ছাড়া সম্ভব নয়

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 13 August 2016, 04:22 PM
Updated : 13 August 2016, 04:22 PM

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির অনেক নেতাই সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর আগে বিএনপির অনেকে যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়ে শুধু প্রশ্ন তোলেননি, বিএনপি-সংশ্লিষ্ট অনেক আইনজীবী যুদ্ধপরাধীদের নানাভাবে আইনগত সহায়তা প্রদান করেছেন।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও বিএনপিকে দেশে জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গিদের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে দেখা গেছে। বিএনপি-সমর্থক অনেকেই মনে করেন বা বলার চেষ্টা করেন, দেশে অতীতে যেসব জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে বা এখন হচ্ছে তা মূলত আওয়ামী লীগেরই কাজ।

জঙ্গিবাদ হল জঙ্গি রাজনৈতিক মতবাদ। জঙ্গিবাদীরা তাদের রাজনৈতিক প্রেরণা পেয়ে থাকে ইসলামের ওয়াহাবি ও সালাফিপন্থী ব্যাখ্যা থেকে। ইসলাম ধর্ম ব্যবহার করে যে রাজনীতি সেটিও গড়ে উঠেছে ওয়াহাবি ও সালাফিবাদ কেন্দ্র করেই। যেটি পাশ্চাত্যের মিডিয়ার কল্যাণে আজ সারা বিশ্বে 'রাজনৈতিক ইসলাম', 'ইসলামি মৌলবাদ', 'র‍্যাডিকেল ইসলাম', 'মিলিট্যান্ট ইসলাম', 'প্যান ইসলাম', 'ইসলামিজম' ইত্যাদি নানা প্রত্যয়ে পরিচিতি লাভ করেছে।

ধর্মের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের সূচনা-পর্বটা নিয়মতান্ত্রিক থাকলেও পরবর্তীতে সেটি আর তা থাকেনি। এই যে অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা– এটি প্রচলিত ভাষায় 'জঙ্গিবাদ' নামে পরিচিত।

এখন প্রশ্ন হল, জঙ্গিবাদী রাজনীতির যে মতাদর্শ অর্থাৎ রাজনৈতিক ইসলাম, সেটি যেসব দলের রাজনৈতিক আদর্শ, সেসব দলের সঙ্গে বিএনপির দুদশকের অধিক কালব্যাপী যে সখ্য, তা কি নিছক কৌশলগত? অর্থাৎ শুধুমাত্র আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার জন্যই? নাকি মতাদর্শগতভাবে রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শের দূরবর্তী হলেও কোনো-না-কোনো মিল থাকার ফলেই বিএনপি ওয়াহাবি ও সালাফিবাদ অনুসারী ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে?

যদি মিল থেকেই থাকে, তা হলে সে মিলের জায়গাটা কোথায়? ৯/১১-পরবর্তী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চাপ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মহলে নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেও বিএনপি কেন জনমানসে ওয়াহাবি ও সালাফিপন্থী হিসেবে পরিচিত জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকাই দলের ভবিষতের জন্য অধিক নিরাপদ মনে করে?

কেনই-বা ওয়াহাবি ও সালাফিপন্থার রাজনীতির ওপর বিএনপির এ মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা? জঙ্গিবাদ ও রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে বিএনপির যে অবস্থান তা কি জঙ্গিবাদের যে রাজনীতি তার বিকাশে সহায়ক, নাকি তার বিকাশে প্রতিবন্ধক?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে দল হিসেবে বিএনপির উৎপত্তি এবং এর রাজনৈতিক বিকাশের দিকে।

রাজনৈতিক দল বলতে আমরা যা বুঝি অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, সিপিবি, জাসদ, জামায়াত আর বিএনপি কি একই ধরনের রাজনৈতিক দল? নাকি দল হিসেবে বাকিগুলোর সঙ্গে বিএনপির একটি মোটা দাগে প্রভেদ রয়েছে? প্রভেদ থাকলে সে প্রভেদের জায়গাটা কী?

এ প্রভেদের জায়গাটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে রাজনৈতিক দল নিয়ে ১৯৫৪ সালে ফরাসী সমজাতত্ত্ববিদ Maurice Duverger রচিত ধ্রুপদী 'পলিটিক্যাল পার্টিজ' (Political Parties) গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে তিনি যেটি বলতে চেয়েছেন তা হল, মোটা দাগে দুভাবে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়।

এর একটি হল স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়; তৃণমূল থেকে ধীরে ধীরে নেতাকর্মীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধারার রাজনৈতিক দলগুলো হল আওয়ামী লীগ, জাসদ, সিপিবি, জামায়াত ইত্যাদি। এদের তিনি Internally Created রাজনৈতিক দল বলে অভিহিত করেছেন। এর বাইরে আরেক ধরনের রাজনৈতিক দল রয়েছে, যেগুলোকে তিনি Externally Created দল বলেছেন। এসব দল সংগঠিত হয় ক্ষমতার কেন্দ্রে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি হল এর উদাহরণ।

১৯৭৫ সালে অভ্যুত্থান পাল্টা-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় জাসদের গণবাহিনীর সহায়তায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তৎকালীন গণবাহিনীর প্রধান কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু তাহের এ অভ্যুত্থান সংগঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। যেটিকে বিএনপি পরবর্তীতে 'সিপাহী-জনতার বিপ্লব' হিসেবে আখ্যায়িত করে।

কর্নেল তাহেরের লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিপরীতে সেক্যুলার ধারায়, তাদের ভাষায় 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' আদর্শে বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

এখানে উল্লেখ্য যে, 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র ইংরেজি প্রতিশব্দ 'সেক্যুলার' নয়। আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার ইংরেজি প্রতিশব্দ সেক্যুলার ব্যবহারের ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ইউরোপীয় বাম আন্দোলনের নাস্তিক্যবাদী ধারার সঙ্গে আওয়ামী লীগকে মিলিয়ে প্রচারণা চালাবার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

সেক্যুলার ধারার বিষয়টি পরিস্কার হলেও এটি পরিস্কার নয় যে, আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসা জাসদের নেতাকর্মীরা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ ধারার কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে আসা 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' প্রত্যয়টি নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের মাধ্যম হিসেবে কেন বেছে নিল?

তবে তৎকালীন জাসদের বিভিন্ন লিটারেচার থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের সমাজতন্ত্র নয়, বরং বর্তমান উত্তর কোরিয়ার তথাকথিত সমাজতন্ত্র– যেটিকে তারা Juche Idea বা বিদেশের ওপর কোনো রকম নির্ভর না করে নিজেদের ওপর নির্ভর করেই দেশকে গড়ে তোলার চেষ্টা বলেন– সেরকম একটা কিছু জাসদ নেতৃবৃন্দ ভেবেছিলেন।

সে সময় সমাজতন্ত্রের ধারণা জনপ্রিয় হওয়ার কারণেই কার্ল মার্ক্সের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রত্যয়টি তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন ব্যাপকভাবে তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করার জন্য।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর– যাকে রাজনীতি শাস্ত্রের অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান 'বাংলাদেশ বিপ্লব' বলে অভিহিত করেছেন– আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার ধারায় জাতি গঠনের প্রয়াস পায়। এ সময় ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকার জন্য সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়।

ওয়াহাবি ও সালাফিপন্থী, মওদুদিবাদী জামায়াত এবং ধর্মভিত্তিক মুসলিম লীগ যখন নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে দিশেহারা, তখন তাদের রাজনৈতিকভাবে রক্ষা করার যিনি প্রচেষ্টা নেন, তিনি তৎকালীন ন্যাপের (ভাসানী) প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সে সময় ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের বিপরীতে তিনি মুসলিম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। এর পাশাপাশি এখন জামায়াত যেমন বলে 'আল্লাহর আইন' অর্থাৎ ভাসানীর ভাষায় তা ছিল 'হুকুমতে রব্বানিয়াত', সেটি তিনি কায়েম করার আহবান জানান। ভাসানীর এ দাবির প্রতি তৎকালীন নিষিদ্ধ সব ধর্মভিত্তিক দল সমর্থন প্রদান করে।

এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অনেকের মধ্যে একটি জনপ্রিয় ধারণা আছে যে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের ফলেই মুসলিম লীগ ক্রমশ রাজনীতি থেকে বিলীন হতে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচনে পরাজয়ের ফলে নয়, বরং ১৯৫৮ সালে কাগমারী সম্মেলনে ন্যাপের জন্মই দলটিকে ক্রমশ বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়। কারণ, ভাসানী অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মুসলিম লীগের রাজনীতিকে পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তবতায় আত্তীকৃত করে নতুনভাবে বিনির্মাণ করেছিলেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুসলিম লীগের প্রয়োজনীয়তা নিঃশেষ করে একে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়।

ভাসানী ন্যাপের পাশাপাশি যে দলটি আওয়ামী লীগ যাতে স্বাধীন বাংলাদেশে সফল হতে না পারে তার বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা চালায়, সেটি হল সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন জাসদ। ওই দলের সশস্ত্র সংগঠন 'গণবাহিনী'র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন আজকের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। মূলত সে সময় জাসদের ছত্রচ্ছায়াতেই জামায়াতসহ নিষিদ্ধঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের কর্মীরা মাঠে নামার সুযোগ পায়।

অর্থাৎ, স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার প্রাথমিক ক্ষেত্রটি জাসদ তৈরি করে দেয় তাদের সার্বিক রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে। এর ফলে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর আমরা দেখি, জাসদের নেতাকর্মীদের জামায়াত এবং মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে রাস্তায় একই সঙ্গে উল্লাস প্রকাশ করতে বা তাদের অভ্যুত্থানকারীদের ট্যাংকে চড়ে শ্লোগান দিতে।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রথমেই যে সংকটে পড়েন তাকে রাজনীতিশাস্ত্রের ভাষায় বলে, 'বৈধতার সংকট'। কিন্তু এ সংকটে তিনি মোটেই বিচলিত হলেন না। কারণ, তখন তাঁর সামনে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির দুজন গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের উদাহরণ। এঁদের একজন হলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ; অপরজন জুলফিকার আলী ভুট্টো।

জিয়া দেখলেন যে, সংখ্যালঘু শিয়া পটভূমি থেকে উঠে এলেও এবং ব্যক্তিজীবনে ইসলামের কোনো অনুশাসন অনুসরণ না করেও সুচতুরভাবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করে জিন্নাহ তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সব মুসলিম জনগোষ্ঠীর শুধু নেতাই হতে পারেননি, বরং সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানের 'কায়েদ-এ-আজম'ও হতে পেরেছিলেন।

আরেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভুট্টো জিন্নাহর মতো শিয়া মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে জনপ্রিয় হতে পেরেছেন ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করে। ওই সংশোধনীতে পূর্বের ইসলামিক রিপাবলিকের সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং এর পাশাপাশি আহমদিয়া জামায়াতকে (কাদিয়ানী) অমুসলিম ঘোষণা করা হয়।

জিয়া এটা পরিস্কার বুঝতে পারলেন যে, জিন্নাহ ও ভুট্টোর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারলে তাঁর যে আপাত বৈধতার সংকট রয়েছে সেটি শুধু কাটবে তা নয়, বরং জনগণের একটি বড় অংশের কাছেই তিনি জনপ্রিয় হতে পারবেন। তিনি এটাও বুঝতে পারলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সেক্যুলার ধারার অনুসারী আওয়ামী লীগ এবং জাসদের অনুসারীদের সমর্থন তিনি পাবেন না। তাই ভাসানী ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সমর্থন পেতে তিনি উদ্যোগী হলেন। এ সমর্থন পাওয়ার উদ্যোগ হিসেবে তিনি তিনটি কাজ করলেন।

প্রথমত, জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন। ফলে জামায়াত, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগের মতো দলগুলো আবার রাজনীতি করার সুযোগ পেল এবং আত্মগোপনে ও বিদেশে থাকা এসব দলের নেতাকর্মীরা দেশে ফিরে এসে প্রকাশ্যে নতুন উদ্যমে দল ও সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিল।

এরই ফলে ইসলামী ছাত্র সংঘ– যে সংগঠন ১৯৭১ সালে 'আল বদর বাহিনী' গড়ে তুলেছিল– ইসলামী ছাত্র শিবির নাম নিয়ে রাজনীতিতে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করল।

দ্বিতীয়ত, তৎকালীন ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের 'ইসলামি' রূপ দেওয়া, সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' সংযোজন এবং 'আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস' অন্তর্ভুক্ত করা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পরবর্তীতে আরেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ তাঁর নিজের 'বৈধতার সংকট' উত্তরণের উপায় হিসেবে পাকিস্তানকে অনুসরণ করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের ধারা সংবিধানে সংযোজন করেন।

তৃতীয়ত, যে আসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল, সেটি তিনি প্রতিস্থাপন করেন জিন্নাহর 'দ্বি-জাতি' তত্ত্বের বিনির্মাণ করে। যেটির তিনি নাম দেন 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'। আপাতদৃষ্টিতে একে ভূখণ্ড-ভিত্তিক Inclusive Project মনে করা হলেও ভিক্টোরিয়া রেডক্লিফ (Victoria Redclift) এবং আরও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক একে Exclusive Project বলে মনে করেন। অর্থাৎ, জাতি পুনর্গঠনের এ প্রকল্পে সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে এর বাইরে রাখা হয়েছে।

'দ্বি-জাতি' তত্ত্বের বিনির্মিত রূপ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিকাশের ফলে একটি ইউনিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। যেখানে একই রাষ্ট্রে দুটি সমান্তরাল জাতি এবং জাতীয়তাবাদ– বাঙালি ও বাংলাদেশি– পাশাপাশি অবস্থান করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রে দুটি জাতিসত্তার সমান্তরাল অবস্থান দেখা যায় না।

জিয়া তাঁর ক্ষমতা সংহত করার জন্য পরবর্তী যে উদ্যোগ নেন তা হল, দল গঠন করা। এ প্রক্রিয়ায় তিনি ভাসানীর আশীর্বাদ লাভ করেন। ফলে মশিউর রহমান জাদু মিয়ার নেতৃত্বে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল ন্যাপের নেতাকর্মীরা দল বিলুপ্ত করে জিয়ার গড়া দলে যোগ দেন। বস্তুত ভাসানী ন্যাপের নেতাকর্মীদের এ যোগদানই জিয়াকে দ্রুত শক্তিশালী রাজনৈতিক দল বিএনপি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। যে সুবিধাটি পরবর্তীতে এরশাদ বা জেনারেল মঈন পাননি, যার ফলে তাঁরা শক্তিশালী দল গঠন করতে পারেননি।

উপরের আলোচনা থেকে যে বিষয়টি পরিস্কার সেটি হল, জঙ্গিবাদের যে রাজনীতি অর্থাৎ রাজনৈতিক ইসলাম যেসব দল ও গোষ্ঠী অনুসরণ করছে তাদের সঙ্গে শুধু যে কৌশলগত কারণে বিএনপি ঐক্য করেছে তা-ই নয়, বরং আদর্শগত কিছু মৌলিক বিষয়ে তাদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। অর্থাৎ, ওয়াহাবি ও সালাফিপন্থী নিয়মতান্ত্রিক দলগুলো অথবা অনিয়মতান্ত্রিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্র ও সংবিধানের যে রূপটি দেখতে চায় তার কিছু বিষয়ের সঙ্গে বিএনপির চিন্তাধারার সামঞ্জস্য রয়েছে। বস্তুত, এ সামঞ্জস্যের ফলেই ওয়াহাবি ও সালাফিপন্থী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি নৈকট্য বজায় রাখতে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সাচ্ছ্যন্দ বোধ করে।

আর এ দীর্ঘ নৈকট্য বজায় রাখার ফলে বিএনপির যেমন এসব দলের বিশেষত জামায়াতের ওপর মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। অপরদিকে জঙ্গিবাদের যে রাজনীতি অর্থাৎ রাজনৈতিক ইসলাম তা আরও বিকশিত হয়েছে। বিএনপি তার সূচনালগ্ন থেকে মনে করে এসেছে ধর্মনিরপেক্ষ ধারার রাজনীতি, যেটিকে তারা তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করে, সেটি প্রতিরোধ করতে রাজনৈতিক ইসলামের একটি শক্তিশালী ধারা জাতীয় রাজনীতিতে থাকা উচিত। মূলত এ বিবেচনা থেকেই জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে জিয়া পুনরায় রাজনীতি করবার অনুমতি প্রদান করেন।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনিয়মতান্ত্রিক ধারা যখন বিকাশ লাভ করে তখন তাদের জঙ্গি আক্রমণের যারা শিকার হয়েছেন তাঁরা সবাই ধর্মনিরপেক্ষ, সেক্যুলার বা বাম দলগুলোর নেতাকর্মী। ফলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, জঙ্গিবাদের বিকাশ হলে আর যা-ই হোক দল হিসেবে বিএনপি তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই না, বরং ধর্মনিরপেক্ষ নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে লাভবান করতে পারে।

বস্তুত এসব বিবেচনা এবং এর পাশাপাশি ওয়াহাবি ও সালাফিপন্থী দলগুলো বিশেষত জমায়াতের ওপর মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা বিএনপিকে রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দল ও গোষ্ঠীগুলোকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করতে উৎসাহিত করেছে, যা অদূর ভবিষতেও অব্যাহত থাকবে।

সংযোজন:

রেডক্লিফের বিশ্লেষণ জানা যাবে: