পারসোনা, সিসি ক্যামেরা ও আইন

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 10 Oct 2011, 03:44 PM
Updated : 10 Oct 2011, 03:44 PM

আমাদের বিউটি পারলার ভাবনা: যে কোন কারণেই হোক সৌন্দর্য্য চর্চার পুরো আলোচনা-সমালোচনা সব সময় নারী কেন্দ্রিক হয়ে যায়। তা সে পোষাক হোক, গয়না হোক আর রূপচর্চাই হোক না কেন। সম্ভবত নারী নিজেও পুরো আলোচনাটা নিজের গায়ে চাপিয়ে রাখতে আগ্রহী। আধুনিক নারীরা পার্লারমুখী বেশি হন বলেও একটা প্রচারণা আছে। পুরুষরাই মূলত এমন খোঁটা দিয়ে থাকেন, তবে যে সব নারীরা রূপচর্চা বিমুখ, তারা এই সুযোগে নিজেদের খানিক জাহির করে নেন- আমি বাপু ওসব পারলার-ফার্লারে যাই না! বলাবাহুল্য, নরসুন্দর, শীল, নাপিত এগুলো আজকের পেশা নয়। এবং এই পেশাজীবিরা কেবল নারীদের জন্যই নির্ধারিত ছিলেন না কোন কালে। রাজামহারাজদের হাত-পায়ের নখ্ কর্তন, চুল ছাঁটা, নাসিকা কেশ উৎপাঠন এ সবের জন্য রাজ-নাপিত নির্ধারিত থাকতো। রানীদের জন্য থাকতো বিশাল গোসলখানা। রাজাদের জন্যও। যদি ভাবা হয়, রূপচর্চা যুগে যুগে বিলাসীদের জন্যই, তবে আরেক বিভ্রান্তি ছড়ানো হবে। গাছের গায়ে একটা পেরেক ঠুকে আয়না ঝুলিয়ে যে নাপিত বসে, তার কাছেও চুল-দাঁড়ি কেটে নিতে যায় কোন দিনমজুর। ফুটপাতের উপরও দেখা যায়, একটা আয়না, একটা চেয়ার আর একটা ছাতা নিয়ে নরসুন্দরের পসার। গলির মোড়ের সেলুনগুলো দাঁড়ি-গোঁফ-চুল কেটে-ছেঁটে দেয়ার পাশাপাশি মাথা বানিয়েও দেয়। বুঝতেই পারছেন, 'রিলাক্মেশন' চাহিদা সব শ্রেনীরই আছে। আজকাল তো শুনেছি, এলাকার সস্তা সেলুনগুলোতে বসে পুরুষেরা ফেসিয়ালও নিয়ে থাকেন। তথাপি পারলার প্রসংগ কোন এক অজ্ঞাত কারণে নারীকে ঘিরেই আবর্তিত!

কেউ কেউ বলছেন, নারীরা আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হতে গিয়ে পারলারে সময় ব্যয করে পয়সা উড়িয়ে আসেন। হালে পারসোনায় আপত্তিকর জায়গায় সিসি ক্যামেরা প্রাপ্তির ঘটনার পর 'স্পা' শব্দটি অত্যধিক জনপ্রিয় হয়েছে অনলাইন কমিউনিটিতে। স্পা কী, কীভাবে হয়, এসব নিয়ে সবার ব্যাপক উৎসাহ। এরকম উৎসাহী কেউ কেউ নেট ঘেঁটে স্পা-সেবা নেয়া নারীর অর্ধ নগ্ন ছবি প্রকাশ করে চিৎকার করছেন, দেখেন! দেখেন! এই হলো স্পা! অতিশয় বিবেকবান কেউ কেউ বলছেন, দেশে কত মানুষ না খেয়ে আছে, আর এরা হাজার টাকা খরচ করে নগ্ন হয়ে শরীরচর্চা করছে! এসব আলোচনায় সার কথা বস্তুত কমই থাকে, এবং হিডেন ক্যামেরার মত হিডেন উদ্দেশ্য থাকে নারীর নগ্নতা নিয়ে দু'চারটে রসালো কথা বলে তাড়নাকে আন্দোলিত করা। নয়তো এদের কারো কিন্তু দামি জামা-জুতো-সানগ্লাস-পারফিউম-মোবাইল-ঘড়িতে অরুচি হবে না। রেস্টুরেন্টে চড়া দামে উদর পূর্তি করতে বাধবে না। মানুষ না খেয়ে আছে বলে কি শহরের পানশালায় হুইস্কি-বিয়ার পিপাসুদের ভিড় কমে গেছে?

নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সেলুন-পারলার রয়েছে দেশ-বিদেশে। দেশের পারলারগুলোতে পুরুষদেরও যাতায়াত চোখে পড়ার মতই। পুরুষেরাও দামী পারলারে হাজার টাকার চুল ছাঁট দেন।ফেসিয়াল করেন। স্পাও করেন। সহজ কথায়, যার যার সামর্থানুয়ায়ী ফিটফাট থাকতে সব বয়সের সবা্ই চায় ।

পারসোনা ও কানিজ আলমাস: পারসোনায় সিসি ক্যামেরা প্রাপ্তির ঘটনার পর আমরা তাকিয়ে আছি প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে সন্তোষজনক ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে। তবে কানিজ আলমাস বুঝতে পারছেন না, তার বক্তব্যের অমিল-গড়মিল সন্দেহ বাড়িয়ে যাচ্ছে। মানবজমিনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বেশ দাম্ভিকতা দেখিয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, কোন বিশেষ মহল তার সাফল্যে ইর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিশেষ মহল তো বটেই। সচেতন মানুষ, সাধারণ গ্রাহকেরা অবশ্যই বিশেষ মহল। কানিজ আলমাস 'এলিট' শ্রেণীর গ্রাহকদের নাম শুনিয়ে তার যোগাযোগ ক্ষমতার প্রচ্ছন্ন আভাস দিয়েছেন। যদিও দেরি করে হলেও সাধারণ শ্রেনীর গ্রাহকদের মনে পড়েছে তার। তাই সকলকে এসএমএস করে সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন। কিন্তু কানিজ আলমাসের পাশে যাওয়ার আগে গ্রাহক নিশ্চিত হতে চায়, তিনি সিসি ক্যামেরাগুলো পারলারের ব্যক্তিগত কক্ষগুলো থেকে সরিয়েছেন কিনা।

ক্যামেরার থাকা, ক্যামেরার ঘুরে যাওয়া নিয়েও কানিজ আলমাসের বক্তব্য এলোমেলো। চুরি যাওয়া ঠেকাতে স্পা-ফেসিয়াল কক্ষে, করিডোরে ক্যামেরা বসানো নিয়ে কানিজ আলমাসের বক্তব্য খুবই অগ্রহণযোগ্য। ক্যাশ কাউন্টার, মূল প্রবেশ পথ, রিসিপশন, ওয়েটিং এরিয়া এগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় রাখা যেতে পারে। কিন্তু স্পা-ফেসিয়াল কক্ষে নারী পোষাক পরিবর্তন করে, বিশেষ পোষাক পড়ে স্পা/ফেসিয়াল বেডে শুয়ে-বসে থাকে। একটি সেবা শেষে অন্য সেবা নিতে ওই পোষাকেই করিডোর দিয়ে চলাচল করতে হয়। নারীকে এ বিশেষ পোষাকে ধারণের পরও 'কোন প্রাইভেসি লংঘণ হচ্ছে না' বলে কানিজ আলমাসের বক্তব্য রীতিমত আপত্তিকর।
গ্রাহকের মূল্যবান জিনিসপত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কানিজ আলমাস কেন আলাদা লকার ব্যবস্থা করতে অনিচ্ছুক, সেটা স্পষ্ট নয়। তার প্রতিটি শাখাই সুবিস্তৃত পরিসর নিয়ে করা। লকার ব্যবস্থা রাখা হলে, স্পা-ফেসিয়াল কক্ষে ঢোকার আগে গ্রাহক লকারে তার জিনিসপত্র রাখতে পারেন। সেই লকারকে সিসিক্যামেরার আওতায় আনা যেতে পারে।কানিজ আলমাস কেন এই যৌক্তিক পথটি বেছে নিলেন না?

সিসিক্যামেরা নিয়ে গুগলে খোঁজ করলেই জানা যাবে, যারা ক্যামেরা মনিটর-অপারেট করে থাকেন, তারা তাদের ইচ্ছে মত ক্যামেরার লেন্স ঘুরিয়ে নিতে পারেন ডানে-বামে-উপরে-নীচে। এমনকি সিসিক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্য ইন্টারনেটে বসে যে কোন জায়গা থেকে দেখা যাবে। স্মার্টফোন থেকেও এ ধরণের ক্যামেরা-ফুটেজ দেখা সম্ভব। যদি বলা হয়, টেকনিশিয়ানের ভুলে সিসিক্যামেরার ঘুরে যাওয়া নিয়ে কানিজ আলমাসের বক্তব্য একটি নির্জলা মিথ্যে, তবে তিনি নতুন কী ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন?

পারসোনার বনানী শাখায় স্পা-ই নেই জানিয়ে কানিজ আলমাস পুরো ঘটনাটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু বনানী শাখায় পুরুষদের স্পা সেবা উদ্বোধন নিয়ে বেশ জমকালো অনুষ্ঠান হয়েছিল। পুরুষদের স্পা কক্ষেও কী সিসিক্যামেরা বসানো আছে? সামাজিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ায় পুরুষদের অবশ্য এ ধরণের সংবেদনশীল বিষয়ে নারীর মত চট করে চিন্তিত হতে হয় না। তবুও তেমন হলে প্রাইভেসি লংঘনের অভিযোগ পুরুষও তুলতে পারেন। তাছাড়া নারীদের জন্য স্পা না থাকলেও বিশেষ বিশেষ ফেসিয়াল, বডি ম্যাসেজ, মেনিকিওর-পেডিকিওর আছে। এসবের জন্যও নারীকে সংক্ষিপ্ত পোষাক পড়তে হয়। তাই, নিরাপত্তার নামে সংবেদনশীল স্থানে সিসিক্যামেরা বসিয়ে নারীদের ভিডিও ফুটেজ ধারণের মত অনুচিৎ কাজের জন্য পারসোনা ও কানিজ আলমাসের যথাযথ জবাবদিহিতা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই।

সিসিক্যামেরা: বিষয়টা কেবল পারসোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে প্রকৃত সমাধান হবে না। আজকাল নারী শরীরচর্চার জন্য জিমনেসিয়াম যাচ্ছে, সাঁতার শিখতে যাচ্ছে, বড় বড় শপিং মলের ওয়াশরূমে যাচ্ছে, পোষাকের আউটলেটে কিংবা নামী টেইলরগুলোর চেইঞ্জ রূমে যাচ্ছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আজকাল সিসিক্যামেরা দেখা যায়ই। কিন্তু এর অবস্থান কতটুকু উচিৎ স্থানে হচ্ছে? আপত্তিকর স্থানে সিসিক্যামেরা রাখলে তার অপব্যবহার ঘটার আশংকাই বেশি। অন্যদিকে হিডেন ক্যামেরার আতংক তো আছেই।

আইন: পারসোনা প্রসংগে দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদনে জনৈক আইনজীবীর বক্তব্যে আইনি দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। অন্তত ওই প্রতিবেদন পড়ে বোঝা যাচ্ছিল, আমাদের সকল সচেতন প্রতিবাদ অরণ্যে রোদনই হবে। তবে এটিএন চ্যনেলে প্রচারিত প্রতিবেদনে আরেক আইনজীবীর বক্তব্য থেকে গ্রাহক আস্থা ভঙ্গের দায়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায় এমন ধারনা পাওয়া গেছে। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দণ্ডবিধির ২৯৯, ৪০৫, ৪০৯ ধারা অনুযায়ী কারো অজান্তে ভিডিও ফুটেজ ধারণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব ক্ষেত্রে কোন কারণে কেউ মামলা না করলেও পুলিশ নিজ উদ্যোগে মামলা করতে পারে। তাই সবাই পুলিশের তদন্তের দিকেই চেয়ে আছে।

হার্ডডিস্ক থেকে সমস্ত ফুটেজ মুছে দেয়ায় তদন্তরত পুলিশকে খাবি খেতে হবে না বলে সবাই বলছে। কারণ ডাটা রিকভার করা সম্ভব। আর সিসিক্যামেরা যে সফটওয়্যার দিয়ে মনিটর হতো সেটার ফিচারগুলো খতিয়ে দেখলে কোন দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে, কী দেখা হচ্ছে তাও জানা যাবে। এছাড়াও সিসিক্যামেরা কোথায় কোথায় রয়েছে তার নির্দেশিকা না থাকায় পারসোনাকে জবাবদিহি করা জরুরী।

বোঝা যাচ্ছে, দেশে সিসিক্যামেরার বহুল ব্যবহার সত্বেও সিসিক্যামেরা ব্যবহারবিধি নিয়ে আমাদের কোন নীতিমালা নেই। বস্তুত ডিজিটাল বাংলাদেশে আইসিটি ও সাইবার ল নিয়ে কার‌্যকরী কোন উদ্যোগ নেই, উদ্বেগও নেই! এতে করে কোন একটি অপ্রীতিকর ঘটনার মুখে পড়ে যথাযথ বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভুক্তভোগীরা।

একটা ছোট্ট প্রসঙ্গেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে এ্ই আলোচনায়। বিউটি পারলারগুলোতে প্রতিটি সেবামূল্য নির্ধারণে সরকারি কোন নির্দেশিকা আছে কিনা, জানা জরুরী। এখানে যে কোন সময় যে কোন সেবার দাম চড়ে যায়। সেটা কিসের ভিত্তিতে তা জানে না গ্রাহকেরা। অন্যদিকে সেবা মূল্য দেয়ার পর অর্থ রশিদের কোন গ্রাহক কপি দেয়া হয় না। মিষ্টির দোকানে গেলেও রশিদ পাওয়া যায়, এটা গ্রাহক অধিকার। পারসোনা বা অন্যান্য বিউটি পারলারগুলো এ্ই রশিদ না দিয়ে কোনভাবে সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে কিনা, সেটা সরকার নিজ প্রয়োজনেই খতিয়ে দেখবেন আশা করা যায়।

সচেতন প্রতিবাদ: পারসোনার ঘটনায় মূল ধারার গণমাধ্যম যতখানি হতাশ করেছে, ততখানি নির্ভরতা তৈরী করেছে বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্লগ, ফেসবুক। লেখালেখির মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকরণ চলছে এখনো। পারসোনার ইস্যু নিয়ে তদন্তের যতটুকু আশ্বাস পাওয়া গেছে তা হয়ত এ কারণেই। যদি এতেও ঘটনা যেনতেনভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলে, তবে বিকল্প পথ হিসেবে সচেতন সমাজের নাগরিকরা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে নিশ্চিতভাবে একটা সমাবেশে, কিংবা একটা মানব বন্ধনে একত্রিত হতে বিন্দুমাত্র দেরি করবেন না ।