‘সহিংস’ সময়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার ও নারীর ‘অহিংস’ আন্দোলন!

ফরিদা আখতার
Published : 11 Oct 2011, 02:55 PM
Updated : 11 Oct 2011, 02:55 PM

নোবেল শান্তি পুরস্কার নারীদের দেয়ার বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। তবুও এবার ২০১১ সালের শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার একসাথে তিন জন নারী পেয়েছেন, কিছুটা যেন নারী আন্দোলনেরই ফল। এঁরা হলেন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইলেন জনসন সিরলিফ, নারীনেত্রী লেমাহ গবোই এবং ইয়েমেনের সাম্প্রতিক জাগরণের নেত্রী তাওয়াক্কুল কারমান।

নোবেল পুরস্কার বেশ কয়েকটি কারণে দেয়া হয়, তবে নারী-অধিকার রক্ষার জন্য আলাদা কোন পুরস্কার নেই। বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাহিত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদিতে বহু নারী এর আগে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কাজেই নোবেল পুরস্কার  নারীদের জন্য পুরুষদের মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার। এই সকল ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান সম্পর্কে যাচাই বাছাই করা হয়। তাই কেউ যদি মনে করেন যে নারীদের নোবেল পুরস্কার পাওয়াটাই বিশাল ব্যাপার তা হবে ভুল ধারণা। নানা ক্ষেত্রে নারীদের অবদান আছে এবং সেভাবে তাঁরা স্বীকৃতও হচ্ছেন। তবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একটু ভিন্নভাবে দেখা হয়। অন্যান্য নোবেল পুরস্কার নিয়ে পেশাগতভাবে আলোচনা হলেও নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে জল্পনা-কল্পনা হয় অনেক বেশি, চেষ্টা তদবীরও হয়। এই পুরস্কার কাকে কোন অবদানের জন্য দেয়া হবে বোঝা মুশকিল। অনেক সময় এর সাথে বিশেষ রাজনীতি জড়িত হয়ে পড়ে। যদি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের সাথে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অবদানের ক্ষেত্রে ভূমিকা যোগ হয় তাহলে বিশেষভাবে দেখার বিষয় আছে। সব ক্ষেত্রে নারীদের পুরস্কার দিলেই মনে করার কোন কারণ নেই যে এটা নারী অধিকারের স্বীকৃতি হিসেবেই এসেছে। এবার ২০১১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার তিন জন নারীকে দেয়ার সময় নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে 'নারীর নিরাপত্তা ও শান্তি গড়ে তোলার কাজে পূর্ণ অংশগ্রহণে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস সংগ্রামের জন্যেই তিন নারীকে ২০১১ সালের শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে। সমাজের সর্বস্তরে উন্নয়নের ওপর প্রভাব বিস্তারে নারীরা পুরুষের সমান সুযোগ অর্জন করতে না পারলে আমরা বিশ্বে গণতন্ত্র ও স্থায়ী শান্তি অর্জন করতে পারবো না'। এই তিন নারীর অবদানকে নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেভাবেই দেখা হয়েছে। সেটা সঠিক না বেঠিক সে বিতর্কে না গিয়েই আমরা তাঁদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।

ইলেন জনসন সিরলিফ লাইবেরিয়ার ১৪ বছর গৃহযুদ্ধ শেষে ২০০৫ সালে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেণ্ট। তাঁকে লৌহ মানবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর আগে তিনি বেশ কয়েক বছর অর্থ মন্ত্রী ছিলেন, এবং যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন এবং বিশ্বব্যাঙ্কসহ  বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজে করেছেন। লাইবেরিয়ার আর একজন নোবেল জয়ী হলেন লেমা গবোই। তিনি জাতিগত এবং ধর্মীয় বিভাজন মিটিয়ে লাইবেরিয়ার দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ বন্ধে চাপ প্রয়োগ করা এবং নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণে অবদান রেখেছেন। লেমা 'উইমেন পিস আন্ড সিকিউরিটি নেটওয়ার্ক আফ্রিকা' গঠন করে পশ্চিম আফ্রিকায় ইলেনের তুলনায় বেশি পরিচিত। ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান ২০০৫ সালে 'উইমেন জার্নালিস্ট উইদাউট চেইন্স' গঠন করেন। বর্তমানে ইয়েমেনের একনায়ক প্রেসিডেণ্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ'র পদত্যাগের দাবীতে আন্দোলন করছেন, ইতিমধ্যে কয়েক দফা গ্রেফতারও হয়েছেন, আবার মুক্তি পেয়েছেন। আল জাজিরাকে দেয়া তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় কারমান জানিয়েছেন ( সমকাল, ৯ অক্টোবর, ২০১১) নোবেল পুরস্কারের নমিনেশন থেকে পুরস্কারপ্রাপ্তি পর্যন্ত কিছুই তাঁর জানা ছিল না…। টিভি নিউজে শুনে তিনি 'হা' হয়ে গিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন ইয়েমেনের নারীদের যথেষ্ট সামর্থ রয়েছে এবং বিপ্লবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের ভূমিকা তাঁরা তুলে ধরেছেন। ইয়েমেনের নারীরা বিপ্লবের প্রতিটি অংশে ভূমিকা রেখেছেন, যা পশ্চিমা দেশের অনেকেই জানেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি তিনি বলেছেন এভাবেঃ ' আমাদের বিপ্লবকে ছিনতাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে'।

কিছু পেছনের কথায় আসি। কেনিয়ার ওয়াঙ্গারি মাথাই গাছ লাগিয়ে একদিকে পরিবেশ রক্ষার কাজ করেছিলেন অন্যদিকে গরিব নারীদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন এনেছিলেন। তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল ২০০৪ সালে। তবে ওয়াঙ্গারিকে পুরস্কার দেয়ার পর তাঁর একটি বক্তব্য পশ্চিমাদের কাছে তাঁকে বিতর্কিত করে তুলেছিল। তিনি বলিষ্ঠভাবে বলেছিলেন, এইচ আইভি/এইডস আফ্রিকাকে জনশূন্য করার জন্য পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের সৃষ্ট একটি রোগ। পশ্চিমারা নাখোশ হয়েছিলেন তাঁর ওপর।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১ তারিখে ওয়াঙ্গারি মারা গেছেন। তাঁর প্রসঙ্গ এখানে আর একবার আনতে চাই এই কারণে যে তিনি ২০০৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর পরই প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে মৃত্যুর পর তাঁকে যেন কাঠের কফিনে সমাহিত করা না হয়। তাঁর মতে কাঠের কফিন বনের জন্য বড় ধরণের হুমকি। তাঁর এই বক্তব্যের কারণে কেনিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ক্ষেপে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর কথায় অটল ছিলেন। গত ৮ অক্টোবর তাঁকে সমাহিত করা হয়। কাঠের কফিনে নয়, সমাহিত করা হয়েছে কচুরীপানার দড়ি এবং বাঁশের ফ্রেমে তৈরি কফিনে। ওয়াঙ্গারির নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘটনার চেয়েও তাকে আমার 'বড় মাপের' মানুষ মনে হয়েছিল, তাঁর ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর পরিবার এবং তাঁর সংগঠন তাঁকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সমাহিত করে বিশ্বের দরবারে অনেক বেশি উচুঁ স্থানে নিয়ে গেছেন।

ইরানের শিরিন এবাদিও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। কিন্তু তাঁর অবদান পশ্চিমা দেশের ইচ্ছানুসারে ইরানের সরকারের বিরুদ্ধে যতখানি, জনগণের পক্ষে ততখানি কিনা, কিংবা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার আদৌ কোন ভূমিকা আছে কিনা জানা যায় নি। শিরিন এবাদিকে ২০০৩ সালে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। তিনি পেশায় আইনজীবী, ইরানে থাকেন না, লন্ডনেই থাকেন। তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, নারী ও শিশুদের অধিকারের জন্যে উল্লেখযোগ্য কিছু করেছেন বলা যাবে না। তাঁর কৃতিত্ব  হচ্ছে তিনি প্রথম মুসলিম নারী, যিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। শিরিন এবাদিকে নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবেও তেমন কেউ চিনতো না। ভারতের মুম্বাইতে ওয়ার্ল্ড সোশাল ফোরাম ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে বছর ইরাকে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব সোচ্চার। মুম্বাইয়ের গোরেগাঁও যুদ্ধ বিরোধী ও জর্জ বুশ বিরোধী স্লোগানে ছিল মুখর। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বলে শিরিন এবাদি এবং অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত জোসেফ স্টিগ্লার আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন।  শিরিনের বক্তব্য সেখানে শুনেছি এবং হতাশ হয়েছি, কারণ তাঁর কণ্ঠে জনগণের স্লোগান প্রতিধ্বনিত হয় নি, তিনি ইরান সরকারের নিপীড়নের  বিরুদ্ধেই বেশি কথা বলেছেন। কাজেই একজন নারী হিশেবে তাঁর এই পুরস্কার আমাকে খুব উজ্জীবিত করে নি, বরং নারীদের পশ্চিমাদের খপ্পরে পড়া নিয়ে উৎকন্ঠিত হয়েছি।

বাংলাদেশেও নারীদের কাজের স্বীকৃতি হিশেবে নোবেল পুরস্কার এসেছে। একেবার নিম্ন পর্যায় থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সাধনের জন্য ২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।  গ্রামীণ ব্যংকের পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের নারীরা। সে কথা অনেকে হয়তো ভুলে গেছেন। অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়াও গ্রামীণ ব্যাংকের নারীদের জন্যেও অর্ধেক পুরস্কার ছিল, যা তাঁরা নরওয়ের অসলোতে গিয়ে নিজ হাতে গ্রহণও করেছেন। অথচ তাঁদের সে কদরটুকু দেয়া হচ্ছে না। তাঁরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নন বটে, কিন্তু তাঁদের জন্য পুরস্কার হিশাবে নারীদের জন্য শান্তি পুরস্কার বাংলাদেশে এসেছে। এখন শুনছি গ্রামীণ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা থেকেও তাঁদের সরিয়ে দেয়া হতে পারে। কারণ তাঁরা লেখাপড়া জানেন না।

কাজেই নোবেল পুরস্কার নারীদের অবদানের স্বীকৃতি দেয়। এই 'অবদান' কীভাবে নির্ণয় করা হয় সেটা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু পুরস্কার নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আসলে কি কোন অবদান রাখতে পারে?  এবার নোবেল পুরুষ্কারের বেলায় 'অহিংস' পদ্ধতিতে নারী জাগরণের যে সবক দেয়া হচ্ছে তা একটু ভাবনার উদ্রেক করছে। নারীদের ওপর সহিংসতা চলতে থাকবে আর তাকে হতে হবে অহিংস! নারীর উন্নয়নের সাথে গণতন্ত্র এবং স্থায়ী শান্তির সম্পর্ক স্থাপনটাও গোলমেলে ব্যাপার। স্থায়ী শান্তি কার জন্যে? ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানের নারীদের সংগ্রামকে আমরা কীভাবে দেখবো? তাদের ওপর যে সহিংসতা চলছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া কি এখন আমাদের কর্তব্য নয়? সেখানে অহিংস হবার সুযোগ কোথায়? আমাদের নিজের দেশেই আদিবাসী নারী, শ্রমিক নারী এবং সাধারণ নারীদের জীবন এখন নিরাপত্তাহী্ন, তারা নানান সহিংসতার শিকার। হিংসা কারোরই কাম্য হতে পারে না, কিন্তু হিংসার বিপরীতে অহিংসাকে দাঁড় করানো প্রকারান্তরে হিংসাকেই বহাল রাখা নয় কি? তাহলে নোবেল পুরস্কারের সাথে অহিংসার বাণী কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা নয় কি?