মানবতার প্রয়োজনে সঙ্গীত: কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

নাদির জুনাইদ
Published : 6 August 2016, 03:43 PM
Updated : 6 August 2016, 03:43 PM

১ আগস্ট 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'এর ৪৫ বছর পূর্ণ হল। বিশ্ববিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের উদ্যোগ ও অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই কনসার্ট ছিল বিশ্বের প্রথম 'বেনেফিট কনসার্ট'। বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে এ ধরনের কনসার্টের আয়োজন পরবর্তীতে নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়। কিন্তু এমন কনসার্ট প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের সহায়তা করার জন্য। সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ প্রথমবারের মতো তখন দেখেছিল কিংবদন্তীসম শিল্পীরা এক মঞ্চে সমবেত হয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করছেন। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আয়োজিত এই কনসার্ট তাই ঐতিহাসিক এবং চিরস্মরণীয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নাম।

নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। বিশ্বখ্যাত বাঙালি সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ আর ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের দুর্দশা দেখে অত্যন্ত ব্যথিত আর উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। শরণার্থীদের অর্থসাহায্য প্রদানের জন্য একটি বেনেফিট কনসার্টের আয়োজন করা যায় কি না– এ ব্যাপারে একাত্তর সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তখনকার সময় বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা ব্রিটিশ ব্যান্ড বিটলসের প্রাক্তন সদস্য জর্জ হ্যারিসনকে অনুরোধ করেন। বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতি সম্পর্কেও তাঁকে জানান তিনি।

বন্ধুর এমন অনুরোধ পাওয়ার পর জর্জ হ্যারিসন সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করেন তিনি একটি কনসার্ট আয়োজনের চেষ্টা করবেন। অন্য অনেক বিখ্যাত শিল্পীকেও তিনি অনুরোধ করবেন এতে অংশ নেওয়ার জন্য।

জর্জ হ্যারিসনের অনুরোধে সে সময়ের অনেক বরেণ্য শিল্পী কনসার্টে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসেন। এ জন্য কেউ টাকা পাননি; বরং কোনো কোনো শিল্পী নিজেদের জরুরি কাজ ফেলে বা অবসর কাটানো বাদ দিয়ে ইউরোপ থেকে গিয়ে হাজির হন আমেরিকায়।

পশ্চিমা এই শিল্পীরা কেউ বাংলাদেশে আসেননি, কিন্তু বাংলাদেশের অগণিত মানুষ তখন যে তীব্র যন্ত্রণাময় সময় অতিক্রম করছিল সেই দুঃখবোধ স্পর্শ করে তাদের। বাংলাদেশের মানুষ কোন ধর্মের কোন বর্ণের তা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাননি। মানবতাবোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সেদিন তাঁরা বাংলাদেশের বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে গিয়েছিলেন।

অনেক সাহসের পরিচয়ও সেদিন দিতে হয়েছিল এই শিল্পীদের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর পরও পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন বন্ধ হয়নি; বরং ভারত কেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করছে– সে কারণে বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যম সেদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করেছিল। পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন যেমন বাংলাদেশ নামটি মেনে নিতে পারেনি, পশ্চিমের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও তখন বাংলাদেশের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নামটি ব্যবহার করা হত। সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নাম ব্যবহার করে ঐতিহাসিক এই কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয় খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে।

কনসার্টে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক দেখতে পান তাদের দেশের সরকার পাকিস্তানিদের সমর্থন করলেও তাদের প্রিয় সঙ্গীতশিল্পীরা বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের সাহায্য করার আহ্বান জানানোর জন্য এক মঞ্চে সমবেত হয়েছেন। এই কনসার্টের কারণে বাংলাদেশ নামটি এক দিনে পরিচিত হয়ে ওঠে পশ্চিমা বিশ্বে। বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য পশ্চিমা এই শিল্পীরা তখন মার্কিন প্রশাসনের রাজনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করেননি।

এই কনসার্ট তাই কেবল একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানই ছিল না, তা হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী এক প্রতিবাদ। আর বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পীরা স্পষ্ট করেন মানবতার পক্ষে তাদের অবস্থান।

আমাদের দেশের এই সময়ের তরুণরা কতটা জানে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আর এই মহৎ উদ্যোগে অংশ নেওয়া বিখ্যাত শিল্পীদের সম্পর্কে? আমাদের এখন দেখতে হচ্ছে দেশের কিছু তরুণের মন আচ্ছন্ন হয়েছে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস দ্বারা। ইসলামি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর অনুসারী হয়ে তারা নিরপরাধ মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করছে, হামলা করছে ঈদের জামাতে। তাদের মনে মানবিকতাবোধ বা যুক্তিশীলতা নেই; অজ্ঞতা আর অন্ধচিন্তা তাদের করে তুলেছে অনুভূতিহীন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ আর ইতিহাসের প্রতি তাদের আগ্রহ নেই, তারা ধর্মীয় জঙ্গিবাদের অনুসারী হয়ে নিরপরাধ মানুষের ওপর হামলা করতে সচেষ্ট।

যে তরুণরা ধর্মান্ধ হয়েছে তারা কি ১৯৭১ সালে পশ্চিমা শিল্পীরা কীভাবে বাংলাদেশের দুর্দশাপীড়িত মানুষদের সাহায্য করার উদ্যোগ নিয়ে মানবিকতার অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, সে কাহিনি শুনেছে কখনও? তারা কি জানে এই শিল্পীরা যেসব গান সেই কনসার্টে গেয়েছিলেন সেগুলোর কথায় কীভাবে ফুটে উঠেছিল ঈশ্বরপ্রেম আর মানুষের জন্য ভালোবাসা?

মানবতাবোধের আদর্শে নতুন প্রজন্মকে প্রাণিত করা প্রয়োজন। কারণ, দেশের তরুণদের মনে শুভত্ব চিরস্থায়ী হোক– আমরা তাই প্রত্যাশা করি। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের মতো মহৎ একটি উদ্যোগ সম্পর্কে দেশের নতুন সময়ের মানুষদের যথেষ্ট ধারণা দেওয়া তাই গুরুত্বপূর্ণ।

সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যান্ডগুলোর একটি হল ব্রিটিশ ব্যান্ড 'বিটলস'। এই ব্যান্ডদলের চার সদস্যের একজন জর্জ হ্যারিসন ছিলেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশের প্রধান ব্যক্তি। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই কনসার্ট।

বিটলস সদস্যদের একসঙ্গে থাকার স্মরণীয় বছরগুলিতে জন লেনন আর পল ম্যাককার্টনির পাশে যেন অনেকটাই আড়ালে থাকতেন জর্জ হ্যারিসন। যে কারণে জর্জ হ্যারিসনের নাম দেওয়া হয়েছিল 'কোয়ায়েট বিটল'। ১৯৭০ সালে বিটলস ভেঙ্গে যাওয়ার পর চার সদস্যই আলাদাভাবে নিজ নিজ গানের কাজ করতে থাকেন।

সেই সময় হঠাৎ অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন জর্জ হ্যারিসন। ১৯৭০ সালে তাঁর 'অল থিংস মাস্ট পাস' অ্যালবামটি ব্যাপক সাফল্য পায়। বলা হতে থাকে, একসময় বিটলস ব্যান্ড ঘিরে দর্শকদের মধ্যে যেমন আলোড়ন চোখে পড়ত, তেমনই উচ্ছ্বাস যেন হ্যারিসনকে ঘিরে শুরু হয়েছে। ভারতীয় সঙ্গীতের অনুরাগী জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে রবিশঙ্করের গভীর বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই।

একাত্তরের পুরো জুন আর জুলাইয়েরও অর্ধেক সময় হ্যারিসন বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাটান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের একজন বব ডিলান কনসার্টে অংশ নিতে সম্মত হন। প্রাক্তন বিটলস সদস্য রিঙ্গো স্টারও রাজি হন সঙ্গে সঙ্গেই। কনসার্টে অংশগ্রহণে এগিয়ে আসেন আরও দুই বিখ্যাত মার্কিন গায়ক, বিলি প্রেস্টন ও লিওন রাসেল এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারিস্টদের একজন ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পী এরিক ক্ল্যাপটন।

আসেন ব্রিটিশ রক ব্যান্ড 'ব্যাডফিঙ্গার'এর সব সদস্য, জার্মান মিউজিশিয়ান ক্লাউস ভুরম্যান, মার্কিন ড্রামার জিম কেল্টনার, জিম হর্নসের নেতৃত্বে 'হলিউড হর্নস' দলের সদস্যরা, গিটারিস্ট জেসি এড ডেভিস, ডন প্রেস্টন, কার্ল রেডল এবং অন্যান্য আরও অনেক শিল্পী যাঁরা কনসার্টে বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। আর কনসার্টের প্রথম অংশে ভারতীয় সঙ্গীতপর্বে রবিশঙ্করের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন দুই বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পী, ওস্তাদ আলী আকবর খান আর আল্লাহ্ রাখা।

এতজন কিংবদন্তীসম শিল্পীর একসঙ্গে মঞ্চে উপস্থিতির কারণে এই কনসার্ট হয়ে ওঠে অবিস্মরণীয় এক আয়োজন। লিওন রাসেলের ভাষায়, এটি ছিল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত উঁচুমানের এক অভিজ্ঞতা।

৪০ হাজার দর্শকের সামনে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি কনসার্টে অংশ নেওয়ার পরিস্থিতি তাদের মতো সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যেও তৈরি করেছিল মানসিক চাপ। কনসার্টের আগে সংবাদ সম্মেলনে যখন জর্জ হ্যারিসনকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন যে, এই অনুষ্ঠানে তিনিই প্রধান তারকা হবেন আর তাই এ ব্যাপারে তিনি কেমন বোধ করছেন, তখন তিনি বলে ওঠেন, 'নার্ভাস'।

অনুষ্ঠানের আগের দিন বব ডিলান ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এসে মঞ্চের চারদিকে বিশাল সব ক্যামেরা, বহু মাইক্রোফোন দেখে অস্বস্তিতে পড়ে যান। হ্যারিসনকে তিনি জানান এত মানুষের সামনে তাঁর পক্ষে গান গাওয়া সম্ভব নয়। হ্যারিসন ডিলানকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরদিন ডিলানের মঞ্চে না আসা পর্যন্ত অনুষ্ঠানের আয়োজক আর শিল্পীদের মধ্যে সন্দেহ ছিল তিনি আদৌ মঞ্চে আসবেন কি না তা নিয়ে।

লিওন রাসেল শুরুতে ভেবেছিলেন তিনি খুব নার্ভাস থাকবেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন মঞ্চে একসঙ্গে এতজন মিউজিশিয়ানকে দেখে তিনি অনুভব করেন, তাঁর ওপর আলাদাভাবে কোনো চাপ নেই।

কনসার্ট ঘিরে পশ্চিমা বিশ্বে এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তরুণদের মধ্যে তৈরি হয় তুমুল আগ্রহ। একটি ভালো সিটের জন্য দর্শকরা ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের সামনে কয়েকদিন আগে থেকেই অপেক্ষা করতে শুরু করেন। দর্শকদের তুমুল উৎসাহ স্পষ্ট হয় অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বেই, যখন ভারতীয় শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। রবিশঙ্কর কনসার্টে আসা অসংখ্য দর্শকের উদ্দেশ্যে বলেনধ

"আমরা কোনো রাজনীতি করতে আসিনি। আমরা শিল্পী। আমরা শুধু এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে সমবেত হয়েছি। আমরা চাই আমাদের সঙ্গীত বাংলাদেশের মানুষদের তীব্র বেদনা আর মনোযন্ত্রণা অনুভব করতে আপনাদের সাহায্য করুক।"

তুমুল হাততালির মধ্য দিয়ে দর্শকরা রবিশঙ্করের উদ্বোধনী বক্তব্য স্বাগত জানান।

বহু মার্কিন তরুণ-তরুণী দেখতে পান তাদের প্রিয় শিল্পীরা তুলে ধরছেন মানবতা আর বর্বরতার পার্থক্য, তাঁরা সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য যখন তাদের দেশের সরকারকে বহু অসহায় মা আর শিশুর ক্রন্দন স্পর্শ করছে না। তিন বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পী অল্প কিছুক্ষণ তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলোর সুর ঠিকঠাক করার পরই আবার শোনা যায় তুমুল করতালির শব্দ। বোঝা যায় পশ্চিমের তরুণ দর্শকরা সিতার-সরোদ-তবলা-তানপুরার শব্দ অনেক পছন্দ করেছে। রবিশঙ্কর হাসতে হাসতে দর্শকদের উদ্দেশ্যে মাইকে বলে ওঠেন:

"ইফ ইউ অ্যাপ্রিশিয়েট দ্য টিউনিং সো মাচ, আই হোপ ইউ উইল এনজয় দ্য প্লেয়িং মোর।"

এরপর রবিশঙ্কর-আলী আকবর খান-আল্লাহ্ রাখা আর তানপুরায় কমলা চক্রবর্তীর অংশগ্রহণে বেজে ওঠে 'বাংলা ধুন'– বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের এক অনন্য সুর। বাংলার গ্রামের সবুজ প্রান্তরের সৌন্দর্য আর সারল্যভরা জীবনের ছবি সঙ্গীতের মূর্ছনায় যেন স্পষ্ট ভেসে ওঠে বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে নিউ ইয়র্কের এক ভিন্ন পরিবেশে। দর্শকরা নীরব হয়ে শোনেন সেই অসাধারণ সুর, বোঝা যায় তাদের মুগ্ধতা। চোখের সামনে তাঁরা দেখতে পান সিতার-সরোদ-তবলা-তানপুরা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই গুণী শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায়।

পরবর্তীতে জর্জ হ্যারিসনের 'হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস' গানটির সময় আরেকবার সুরের মূর্ছনা মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলেছিল সমবেত অজস্র দর্শককে। এই গানটির লিড গিটারের অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দরকার ছিল এমন একজন গিটারিস্টকে যিনি গিটারের সুর কিছুটা বিষাদমগ্ন আবার একই সঙ্গে আন্দোলিত আর অস্থির করে তুলতে পারবেন। এই কঠিন কাজটির দায়িত্ব সেদিন পালন করেন বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারিস্টদের একজন এরিক ক্ল্যাপটন। যাঁরা সেদিন সে আয়োজস উপভোগ করেছে তাঁরা জানেন, কী অসাধারণভাবে ক্ল্যাপটন এই কঠিন দায়িত্ব পালন করেছেন, কতটা মোহময় হয়ে উঠেছিল তাঁর গিটারের সুর।

দর্শকরা হ্যারিসনের অনুপম কণ্ঠে একে একে শুনতে পান তাঁর বিখ্যাত সব গান– 'ওয়াহ্ ওয়াহ্', 'মাই সুইট লর্ড', 'বিওয়ের অব ডার্কনেস', 'হিয়ার কামস দ্য সান', 'সামথিং'। তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে বার বার মুখরিত হয়ে ওঠে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন।

নার্ভাসনেস কাটিয়ে উঠে বব ডিলানও পরিবেশন করেন তাঁর দর্শকনন্দিত সব গান। হাজার হাজার দর্শক উপভোগ করেন সেই দৃশ্য– বব ডিলান তাদের সামনে দাঁড়িয়ে গাইছেন 'ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড।'

রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন, লিওন রাসেলের বিভিন্ন গানের সময়ও আনন্দে মেতে ওঠেন দর্শকরা। বিলি প্রেস্টন আর লিওন রাসেলের পিয়ানো, বিভিন্ন ধরনের গিটার, রিঙ্গো স্টার আর জিম কেল্টনারের ড্রাম আর বিভিন্ন হর্ন ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে কনসার্টে যে সঙ্গীত সৃষ্টি করা হয় তা ছিল এক কথায় চিত্তাকর্ষক।

অনুষ্ঠানের শেষ গানটি ছিল এই কনসার্টের জন্য জর্জ হ্যারিসনের লেখা বিশেষ গান– 'বাংলাদেশ'। গানের শুরুর কথাগুলো ছিল এ রকম:

"মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি, উইদ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ;

টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প, বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ।

অলদো আই কুডন্ট ফিল দ্য পেইন, আই নিউ আই হ্যাড টু ট্রাই;

নাউ আই অ্যাম আসকিং অল অব ইউ টু হেল্প আস সেইভ সাম লাইভস।"

এই মহৎ অনুষ্ঠান, আর অসাধারণ আবেগ নিয়ে গাওয়া জর্জ হ্যারিসনের 'বাংলাদেশ' গানের মাধ্যমে রাতারাতি বাংলাদেশের নাম পৌঁছে যায় বহু মানুষের কাছে। এরিক ক্ল্যাপটন পরবর্তীতে স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন:

"কনসার্টটির কথা যখন ভাবি শিল্পী হিসেবে আমরা গর্বিত বোধ করি। সেদিন আমরা কেউ পাঁচ মিনিটের জন্যও নিজেদের কথা চিন্তা করিনি, আমরা সবাই ভাবছিলাম আরও অনেক বৃহৎ একটি ঘটনা আর আমাদের দায়িত্ব নিয়ে।"

সঙ্গীতশিল্পীরা তাদের কর্তব্যবোধ, সাহস আর মহানুভবতার প্রমাণ তুলে ধরেছিলেন এই কনসার্টের মাধ্যমে। মানবতার প্রয়োজনে, এক মহান উদ্দেশ্যে সঙ্গীত ব্যবহারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় সেদিন। এরপর, ১২ আগস্ট ১৯৭১ কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত প্রায় আড়াই লাখ ডলার বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের জন্য জাতিসংঘের রিলিফ ফান্ডে প্রেরণ করা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন দেওয়া কেন প্রয়োজন, এ ব্যাপারে বিশ্বে যে সচেতনতা এই কনসার্টের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল তা ছিল অর্থসাহায্যের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে কিংবদন্তীতুল্য শিল্পীদের গান মুগ্ধ করেছিল অগণিত মানুষকে, তাদের সমবেত হওয়ার সেই শক্তি সেদিনের পর থেকে যুক্ত হয় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধের ঠিক ২০ বছর পর ১৯৯১ সালে বিটিভিতে 'ইত্যাদি' অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো দেখেছিলাম জর্জ হ্যারিসনের 'বাংলাদেশ' গানটি। এর আগে বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমে কখনও এই গান প্রচার করা হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। গানটি দেখানোর পর বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বহু দর্শক প্রথমবারের মতো জানতে পারে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ সম্পর্কে। দেশের নতুন সময়ের মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ এই কনসার্ট সম্পর্কে জানানোর ক্ষেত্রে 'ইত্যাদি'এর রচয়িতা হানিফ সংকেতের অবদান তাই গুরুত্বপূর্ণ।

মনে আছে, প্রথম যেদিন 'বাংলাদেশ' গানটি দেখি বিটিভিতে, সেদিন কী প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হয়েছিলাম! শরীরে যেন কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। পরে সমবয়সী বন্ধুরাও বলেছিল তাদেরও একই অনুভূতি হয়েছিল। এরপর কেটে গেল আরও ২৫টি বছর। এখনও যখন গানটি শুনি, মন আন্দোলিত হয় প্রতিবার। জানি, জর্জ হ্যারিসনের এই অসাধারণ গান আমার মন এভাবেই স্পর্শ করে যাবে চিরদিন। আর সবসময় গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব সেই সঙ্গীতশিল্পীদের যাঁরা একাত্তরের সংকটময় সময়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের পাশে।

আশা করি মানবতার পক্ষে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিল্পীদের সাহসী অবস্থান নেওয়ার সেই অসাধারণ দৃষ্টান্ত অনুপ্রাণিত করবে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মন।