প্রসঙ্গ: রিমান্ডে হাসনাত তাহমিদ ও খোঁজার লড়াই

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 5 August 2016, 07:02 PM
Updated : 5 August 2016, 07:02 PM

অবশেষে হাসনাত করিম ও তাহমিদ খানকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এদের একজন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আরেকজন প্রবাসী। না, এরা সাধারণ স্কুল-কলেজে পড়ুয়া কেউ নন। মাদ্রাসারও ধারেকাছে ছিলেন না কখনও। বাংলাদেশের ক্রিম-খাওয়া এসব উঁচুতলার মানুষরা আজ বিচারের কাঠগড়ায়। এর চেয়ে বড় সামাজিক পতন আর কী হতে পারে?

গুলশানের আর্টিজানে হামলার সঙ্গে হাসনাত জড়িত কি না তার জবাব দেবে সময়। কিন্তু ধরুন যদি কোরিয়ান ভদ্রলোক সে রাতের ও ভোরের ঘটনাবলী ক্যামেরাবন্দি না করতেন, তাহলে হাসনাত ও তাহমিদ কি ধরা পড়তেন? হাসনাতকে যখন দেখি পুরো পরিবার নিয়ে সকালবেলা হেলতে দুলতে বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন সন্দেহ তো বটেই, তাদের মানসিক ভারসাম্য নিয়েও খটকা থেকে যায়। এমন অবস্থায়ও কীভাবে একজন মানুষ ও তার পরিবারের মাথা ঠাণ্ডা থাকল?

ভিডিওটা দেখুন। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। যেন কিছুই হয়নি এমন এক ভাব নিয়ে খাবার-দাবার শেষে বেরিয়ে যাচ্ছেন তারা। কে বলবে এদের সামনেই খুন হয়েছিলেন এত জন মানুষ! বর্বরোচিত কায়দায় গলা-কাটা মানুষজনের লাশের সামনে থাকা হাসনাত ও তার পরিবার তো আসলেই এক রহস্য। কীভাবে তারা তা পারলেন!

এই হাসনাত করিমের বিরুদ্ধে কিন্তু কয়েক বছর আগেই পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল। চাকরিও গিয়েছিল তার। হিযবুত তাহরিরের মতো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার দায়ে চাকরি-খোয়ানো মানুষটিকে কেউ কিছু বলেনি। না আইন, না বিচার ব্যবস্থা, না সরকার কেউ তাকে হুমকি মনে করেনি। নিরাপদে নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করে গুলশান অব্দি পৌছে-যাওয়া হাসনাত আর সদ্য বিদেশ-ফেরত তাহমিদ যে সমাজে নিরাপদ, সেখানে এমনধারা হামলায় মানুষের প্রাণ যাবে এতে আশ্চর্যের কী আছে?

এখন দেখুন, দেশে একদল বা কয়েকশ যুবককে খোঁজার ধুম পড়েছে। তাদের ধরতে না পারলে কী হবে জানি না, তবে ধরার যে চেষ্টা শুরু হয়েছে তাতেও সমাধান নেই। হাসনাত-তাহমিদের মতো কত জন কোথায় গোপনে বা প্রকাশ্যে তৈরি হচ্ছে কে জানে! এদের মিশন দেশে হলেও চ্যানেল বা সোর্স কিন্তু দেশের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। দুনিয়ার নানা দেশে তাদের সাহায্যকারী রয়েছে। আছে অস্ত্র যোগান দেওয়ার মানুষ। তার ওপর রয়েছে দেশের ভেতরের নানা চক্রান্তকারী ও বিপথগামী দল জামায়াতের ইন্ধন।

বিরোধী দল নেই বলে রাজনীতিতে মার-খাওয়া বিএনপির একাংশের জড়িত থাকার বিষয়ও কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? না, তা নয়। এরা দেশের অনিবার্য সত্তা। চাইলে নিখোঁজদের লুকিয়েও রাখতে পারেন। বহুদিন ধরে লালন করতে পারেন। সে শক্তি বা 'তাগদ' আছে তাদের।

তাই বলছি, খোঁজাখুঁজির বিষয়টা জরুরি হলেও কতটা কাজে লাগবে বোঝা মুশকিল। সরকারি দলের দেরিতে উপলব্ধিও বিষয় একটা বটে। তারা সময়মতো লাগাম টেনে ধরেনি, দায়িত্ব নেয়নি। তাদের গদি-পাগল মন্ত্রীরা ইচ্ছেমতো কথা বলেন রাতদিন। তারা অ্যাদ্দিন একবারের জন্যও যাদের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি আজ সেই দুশমনদের ধরতে 'মরিয়া'!

এই যে এখন খোঁজাখুঁজির ধুম পড়ে গেছে, লাখ লাখ টাকার ইনাম ঘোষণা করা হচ্ছে, তবে এরা কবে পালাল? ধরুন যদি গুলশানের ঘটনাটি না ঘটত আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মশাই তো সমানে বলে যেতেন, 'কোথাও কোনো জঙ্গি নেই।' তাদের মুখে আমরা অ্যাদ্দিন যা শুনলাম হঠাৎ করে উল্টো গীত শুনলে কি মানুষ আবার নতুন করে ভাবতে পারে না যে, আসলে কোনটা সত্য?

সত্যি কথা এই যে, এগুলো নিয়ে আর লেখা বা বলা মানে মানুষকে জোর করে কষ্ট দেওয়া। তারা এমনিতেই বিপদে আছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে আছে। ভয়ে মানুষ কোথাও যেতে পারছেনও না। আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যা থেকে মানুষ এলেও সবার মনে ভয়। অনুষ্ঠানে নৈশভোজের এক পর্যায়ে বিদ্যুৎ-বিপর্যয় ঘটলে আতঙ্কের চোটে নাকি না খেয়েই পালিয়েছেন অতিথিরা!

এমন জীবন তো সহজ বা সুন্দর নয়। অস্বাভাবিক এই সমাজে একদল মানুষকে গরু-খোঁজা খুঁজলেই কি মুক্তি মিলে যাবে?

যারা পালিয়েছে তারা যথেষ্ট ধুরন্ধর। তাদের মগজ-ধোলাই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক না কেন, এই পলায়নের কারণ বিবিধ। আন্তর্জাতিক যে কারণ সেটা দূর করার দায়িত্ব আমাদের নয়। আমরা হাজার চেষ্টা করে সবাই গিয়ে বুলেটের সামনে শুয়ে পড়লেও সিরিয়া, ইরাক বা আফগানিস্তানে হামলা ও মৃত্যু বন্ধ হবে না। কাজেই আমাদের দায় অন্য জায়গায়।

ধরুন, জন্মগতভাবে আমি হিন্দু বলে যদি তামিল-নিধনের সময় আমার মধ্যে হিন্দুত্ব কাজ করত আমিও হয়তো পালিয়ে যেতাম। আমার তা একবারের জন্যও মনে হয়নি। আমি যে এলাকায় থাকতাম বা থাকি তার আশেপাশে হিন্দু তামিলদের ছড়াছড়ি। এদের কেউ কেউ বন্ধুও ছিলেন। সবাই জানেন তামিলরা মেধাবী আর লেখাপড়া জানা মানুষ। কিন্তু দলবেঁধে তামিল টাইগারদের সমর্থন করত তারা। নিহত প্রভাকারণের পঞ্চাশতম জন্মদিনে আমাকে তার জীবনীভিত্তিক ভিডিও দেখতে পীড়াপিড়ি করলেও রাজি হইনি। কারণ তাদের আন্দোলনের সঙ্গে কথিত হিন্দুত্ববাদের সম্পর্ক নেই।

আমার কথা বাদ। বাংলাদেশে বা সারা দুনিয়ার লাখো কোটি হিন্দুর এক শতাংশও তামিল টাইগারদের জন্য কাঁদেনি। কারণ জীবনবোধ বা ভালোবাসায় বাঁচা মানুষ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ উস্কে দিতে পারে না। আমাদের দেশের কোটি কোটি মুসলমানসহ সারা বিশ্বের কোটি মুসলমানও তাই। তারা বৃহত্তর অর্থে ভাতৃত্ববোধে বিশ্বাস করলেও জঙ্গি হতে রাজি নন।

গণ্ডগোলটা আমাদের সমাজের কিছু বুদ্ধিজীবী বা সুশীলদের মাথায়। তাদের কেউ কেউ একদা বাম রাজনীতি করতেন। এখন হয়েছেন মুর্দা ফকির। তা নাকি মধ্যপ্রাচ্যের শিশু-নারী হত্যার কারণে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ইহুদিদের নির্মমতার পর কোকাকোলা পান করা ছেড়েছি। কিন্তু এরা পোশাকে-লেবাস নিয়ে টকশোতে কথার ফেনা তুলে ক্লান্ত হয়ে ঢক ঢক করে কোকাকোলা পান করেন যার পুরোটাই যায় মানবতাবিরোধীদের পকেটে।

এরা আমাদের দেশের তারুণ্যকে একবারের জন্যও বলেনি যে, মাথা উঁচু করে বাঁচার নাম স্বাধীনতা। বলেননি যে, তুমি মেধা ও বিদ্যায় বড় হলে তোমার লবিং বা কাজে মধ্যপ্রাচ্যে শিশু-হত্যা নারী-হত্যা মানুষ-হত্যা বন্ধ করার পথ তৈরি হতে পারে। সেটা না করে সেলাইহীন কাপড় (নিন্দুকেরা বলে কাফন) পরিধান করে লাভ নেই। তাদের মন ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কাঁদে। তাদের আত্মা দুনিয়ার অন্যদেশে মানুষের তেরটা বাজলেও কাঁদে না। দুনিয়ার নানা দেশে শিশু-হত্যা নারী-নির্যাতন বা ধর্ষণেও এরা নির্বিকার। এমনকি খোদ নিজের দেশে মোল্লা-পুরোহিত ও তাদের দেবদেবীর অপমানে এরা নীরব।

বুদ্ধিজীবী নামের উটকো এই মানুষগুলো কখনও রুখে দাঁড়াতে পারবেন না। পারবেন যে না সেটা আসিফ নজরুল, ফরহাদ মজহার বা আবুল মকসুদদের দেখলেই বোঝা যায়।

উল্টো আমাদের তারুণ্যের মাথা ও মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে উগ্রতার বিষ। তাদের জঙ্গি বানিয়ে ময়দানে পাঠিয়ে নিজেরা আপন সুখে গল্প বানিয়ে চলেছেন। এ যাবৎ যতগুলো টকশো দেখেছি বা লেখা পড়েছি, কোথাও আত্মশুদ্ধি বা সমালোচনার নামগন্ধ নেই। শুধু এর দোষ ওর দোষ, এর প্ররোচনা আর ওর ইন্ধন!

এই কিছুকাল আগেও মুসলমানদের হাল এমন ছিল না। প্রাচ্যে-পাশ্চাত্যে ইসলামের মহান বাণী ও ভাবনার প্রতি অনুরাগ বাড়ছিল। এখন তা শূণ্যের কোঠায় আনার জন্য ব্যগ্র আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশীয় উন্মাদনা। সঙ্গে রয়েছে জাতীয় রাজনীতি।

এদেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার করার রাজনীতি যখন ফাঁসির তোপে পড়ল তখন সে কী করবে? সুড়সুড় করে ভালো হয়ে যাবে? না জঙ্গিত্বের আড়ালে আশ্রয় খুঁজবে? আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলগতভাবে এখনও তাদের সঠিক দিক বা পথের কথা বলে না। একটি দায়সারাভাবে সরকারের সমর্থক, আরেকটি প্রচ্ছন্নভাবে মদদদাতা। এরাই আমাদের নিখোঁজ মানুষগুলোর ঠিকানা জানে।

যারা হারিয়ে গেছে তাদের সংখ্যা এখন মনে হচ্ছে অল্প। কিন্তু যারা হারিয়ে যায়নি অথচ এক পা এগিয়ে আছে তাদের সংখ্যা কি গুনেছি আমরা? আর যারা বদলে গিয়ে এ পথ জায়েজ মনে করে, তারাই কি সংখ্যায় বেশি নয়?

প্রশ্নগুলোর উত্তর না নিয়ে কিছু মানুষকে খোঁজার ভেতর আসলে কোনো সমাধান নেই। যারা গেছে যারা যাবে বা যারা যেতে পারছে না তাদের তালিকা ছোট করতে হলে অন্তরের আলো জ্বালাতে হবে। সুফিবাদের আলো কেন নিভে আসছে? কোন অপশক্তি গলিতর গলিতে বাড়িতে বাড়িতে হারমোনিয়াম-সঙ্গীত নাচ-বাজনা বন্ধ করতে চাইছে? কোন শক্তি আমাদের মাটি ও শেকড়ে বিষগাছের চারা বুনছে?

সবাই জানেন কিন্তু মানেন না বা বলেন না। উৎস বন্ধ না হলে হারানোদের যেমন ফেরানো যাবে না তেমনি আরও মানুষ মিসিংএর বিষয়টাও এড়ানো যাবে না। মানুষকে তার আত্মার সন্ধান দিতে হবে। জাগাতে হবে। কোথায় সেই বুদ্ধিবৃত্তি? দলকানা আর চাপাতি জঙ্গির ভীড়ে লুকিয়ে পালানো সত্য যারা খুঁজবেন তারাই হবেন দিশারী।

এমন এক দেশ আমাদের। শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর মুখেও তালা। তিনি আছেন মশাল নিয়ে ব্যস্ত। দেশের পশ্চাৎে আগুন দিয়ে লেজের আগুনে দেশ পোড়ানোর বিরুদ্ধে এমনকি জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও একটি কথা বলেননি। এরাই আবার বিশ্বশান্তির মোড়ল আমেরিকার খাস দোস্ত। আরে বাবা, একটা কিছু বলুন। দরকার হলে তাদের হয়েই বলুন না। আপনি কি জানেন না কখনও কখনও 'সাইলেন্ট ইজ মোর দ্যান ভায়োলেন্ট'?

কেউ কি আছেন আদৌ? শেখ হাসিনা একা লড়বেন শেষতক? না জনগণের হাতেই থাকবে শেষ দায়িত্ব?