পার্সোনা: রূপে অপরূপ

শামীমা বিনতে রহমান
Published : 25 June 2011, 11:16 AM
Updated : 6 Oct 2011, 06:25 AM

৭০ দশকে রেডিক্যাল নারীবাদীরা সৌন্দর্য এবং ফ্যাশনের তোয়াক্কা না করার প্রতিবাদ হিসাবে রাস্তায় ব্রা পুড়িয়েছে। ১৯৬৮ সালে মিস আ্যামেরিকান প্রতিযোগিতা এবং এরপর ভোগ(Vouge) পত্রিকা নারীকে নারীময় অর্থাৎ ফেমিনিন হিসাবে উপস্থাপনের জন্য পোশাকের ফ্যাশন, চেহারা, ফিগার ইত্যাদি বিষয়কে সামনে হাজির করতে থাকলো। রেডিক্যাল আর সোসালিস্টরা তা প্রত্যাখ্যান করলেও এসব চলতে থাকলো। প্রিয় নারী ও পুরুষ পাঠক, এসব বলছি, কারণ সম্প্রতি খুব আলোচিত পার্সোনা বিউটি পার্লারে ড্রেস চেইঞ্জিং রুমে সিসি ক্যামেরার উপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ ওঠা নিয়ে কথা বলবো বলে। এ নিয়ে সর্বাধিক প্রচারিত গণমাধ্যম প্রথম আলোর অবস্থানও বলতে চাই। তার আগে একটু সৌন্দর্য বা 'বিউটি মিথ' নিয়া কথা বলা জরুরী। কারণ বিষয়টা নারীর বিষয়। এবং স্পর্শকাতর বিষয়।

বেশ সুপরিচিত নারীবাদী সুজান ব্রাউনমিলারের পা ব্লিচ করে সৌন্দর্য বাড়ানোর অভিজ্ঞতা একটু শেয়ার করতে চাই। ইংরেজিতেই তুলে দিলাম:
As a matter of principle I stopped shaving my legs and under my
arms several years ago . . . but I look at my legs and know they are
no longer attractive, not even to me. . . . To ease my dilemma, in
the summertime I bleach my leg hair to a golden fuzz, a
compromise that enables me to avoid looking peculiar at the
beach. Sometimes I wonder if I'm the only woman in the world who
puts color into the hair on her head while she takes color out of the
hair on her legs in order to appear feminine enough for convention.
Susan Brownmiller, Femininity (1984), pp. 158-159.

৮০র দশক থেকে পাশ্চাত্যে বিউটি মিথ শুরু হয়, মধ্য, উচ্চবিত্ত কর্মজীবী নারীদের ভেতর। জারগন তৈরি হয় লিবারেটেড এন্ড ইন্ডিপেনডেন্ট 'নিউ উইমেন'। ঘরের বউয়ের মুখে, শরীরেও এর ঢেউ এসে পড়ে। নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গেও এর সম্পর্ক তৈরি হয়। Banner, Lois W. (1983) তার American beauty বইতে তর্ক তোলেন ফ্যাশন এবং প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবহার হচ্ছে, "rejection of the Victorian prohibition on sensual expression" (275). আরেক নারীবাদী Steele Valerie সোজা সাপ্টা বলেন "It is absurd to blame fashion, as such, for turning women into sexual objects" (1985). Fashion and eroticism. New York: Oxford.

বিভিন্ন সময়কার নারীবাদীদের কথাবার্তাগুলোকে হাজির করলাম এ জন্য যে শরীর, রূপের চর্চার সাথে নারীকে কেবল যৌনতার উপস্থাপন ভাবার কিছু নাই। বর্তমানের পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে ফেমিনিন করার জন্য নানা রকম ব্যবসা: প্রসাধন সামগ্রী, নানা ব্রান্ড, বডি শেইপ, চেহারা ঠিকঠাক করার জন্য বিউটি পার্লার, ফ্যাশন ম্যাগাজিন-অনেক কিছুই হচ্ছে। ব্যাপক প্রতিযোগিতা চলছে। এটা পুরা দুনিয়া জুড়েই হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই ব্যবসা দুই দশক গড়িয়ে গেছে। এখন মেয়েরা দেদারছে বিউটি পার্লারে যাচ্ছে। চুল কাটছে নানান শেইপ, ডিজাইনে, ভ্রু প্লাক করছে, ম্যাসাজ করছে, সারাদিনের কর্মব্যস্ত শরীরে-মনে প্রশান্তি আনতে স্পা করছে। এসব এত বেশি প্রাত্যাহিক আর প্রয়োজনীয় আর সাধারণ ব্যাপার যে, ঘরের বউ থেকে শুরু করে পদস্থ কর্মজীবী নারী, গার্মেন্টস কর্মী, আমার বাসার গৃহকর্মী-সেও পার্লারে গিয়ে ভ্রু প্লাক করে আসে। এসব বলার অর্থ এই যে, শহুরে, আধা শহুরে, গঞ্জের নারীরা রূপ বিষয়ে সময়ের তালেই চলছেন। কিন্তু ফেসিয়াল এবং স্পার ক্ষেত্রে পার্লারগুলোর নিয়মানুযায়ি ড্রেস চেইঞ্জ করতে হয়।

পার্সোনার বনানী আউটলেট নিয়ে সম্প্রতি এক নারী চিকিৎসক ড্রেস চেইঞ্জ করার জায়গায় সিসি ক্যামেরার উপস্থিতি নিয়ে যে আপত্তি তুলেছেন, তা নিয়ে হৈচৈ কম হয় নি। বরং হওয়াটাই যথার্থ। আরো হওয়া দরকার বলে মনে করি। কারণ, ড্রেস চেইঞ্জ করার রুমে কেন ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বা সিসি ক্যামেরা থাকবে? এইটা কমন সেন্সের প্রশ্ন: কেন থাকবে? বনানী আউটলেটের একদম শুরুর দিকে আমার যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। ওইটা যাত্রা শুরু করেছিল ডিসেম্বর, ২০১০ এ। তখনো সেখানে স্পা পুরাদমে শুরু হয় নি। স্পা করার সময় পুরা শরীরে পরে থাকা কাপড় পুরা খুলে ন্যুড হতে হয়। কারণ শরীর রিল্যাক্স করার জন্য এর ভেতর পানি এবং অন্যান্য উপকরণের স্পর্শ ঘটাতে হয়-যেটা প্রশান্তি তৈরি করে। আমি দেখেছি, পারসোনার প্রত্যেকটা আউটলেটে নারী ক্লায়েন্টদের নারীরাই ডিল করেন। কাউন্টার থেকে শুরু করে শরীর, চেহারা সম্পর্কিত যা যা বিউটিফিকেশন দরকার পড়ে, সব। নারী ও পুরুষ পাঠক, তাহলে বলেন, ফেসিয়াল করার জন্য ড্রেস চেইঞ্জ এবং স্পা করার জন্য ড্রেস চেইঞ্জের জায়গায় কেন সিসি ক্যামেরা থাকবে? যুক্তি কী? কানিজ আলমাস, পার্সোনার কর্ণধার একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?

আরো কিছু ব্যাখ্যা দেয়া আপনার জরুরী। ১৯৯৮ সালে পার্সোনা যাত্রা শুরুর পর ২০১০ সাল পর্যন্ত পার্সোনার আউটলেট হয়েছে ঢাকা শহরে ৬টা এবং চট্টগ্রামে ১টা। ঢাকায় ধানমন্ডির আউটলেটটা পার্সোনার স্থায়ী ভবন। চট্টগ্রামে পার্সোনার যে আইটলেট, তাকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সবচে বেশি জায়গা নিয়ে করা বিউটি পার্লার। সাড়ে ১৬ হাজার বর্গফুট। এক যুগের মধ্যে পার্সোনা এত সম্পত্তির মালিক হলো কী করে? আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন নাকি কানিজ আলমাস? এই সন্দেহ অন্য সন্দেহের দিকে কমনসেন্সই নিয়ে যায়: পর্ণো সাইটগুলো খুললে দেখা যায়, লোকেশন বোঝা যায় না এমন বাংলাদেশি মেয়েদের ন্যুড স্টিল ইমেজ এবং ভিডিও ফুটেইজ। বাংলাদেশে অস্বীকৃত পর্ণোগ্রাফির ব্যবসায় এসব ফুটেইজের অনেক দাম, যারা এই ব্যবসাগুলো করে তাদের কাছে। সিসি ক্যামেরা কাউন্টার এবং ওয়েটিং প্লেসে না রেখে ড্রেস চেইঞ্জ করার জায়গায় রাখা কোনভাবে, কোন যুক্তিতেই পরিস্কার না।
কিন্তু পার্সোনা প্রথম আলোতে বিবৃতি দিয়ে বলেছে,এটা 'নিছকই ভুল বোঝাবুঝির ফল'।

প্রথম আলোর অবস্থা গুলশান থানার এসআইয়ের মতো, যিনি আলামত নষ্ট করার অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছেন। কিন্তু প্রথম আলোকে তো বরখাস্ত করার কেউ নাই। তারা বিশাল এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ৪ অক্টোবর, পার্সোনার বিবৃতি প্রকাশের দিনই। পুরো রিপোর্টে কথা একটাই-'এটা ভুল বোঝাবুঝি'। বিবৃতিতেও তাই বলেছেন কানিজ আলমাস।

৩০ সেপ্টেম্বর পার্সোনার বনানী আউটলেটে খুবই স্পর্শকাতর, ব্যক্তিগততাকে অসম্মানে ফেলে নারী চিকিৎসক যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, তা নিয়ে নানান আলোচনায়, যে কথাটি এসেছে, তা হলো নারীদের দ্বারা পরিচালিত বিউটি পার্লারে কেন নারীকেই এইভাবে শিকার হতে হবে? কেন চেইঞ্জিং রুমে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা রেখে আমার আস্থা, বিশ্বাস এবং স্বস্থি ফিলিং নষ্ট করা হবে? একজন তো বলেই বসলেন, 'তাহলে আমরা যাবো কোথায়?'

আসলে এখানে ম্যানেজমেন্টে নারী প্রধান, কর্মী বাহিনী নারী-এটা আ্যাপারেন্টলি স্বস্থির ব্যাপার মনে হলেও মনে রাখতে হবে, সমাজ এবং সময়টাই কনজ্যুমারিজমের সময়। পণ্যের সময়। সিস্টেম। সিস্টেমটাই হলো টাকা বানাও। মূলে টাকা। পাঠক, ইন্টারনেটে যদি আপনি ব্রাউজ করে দেখেন, সবচে বেশি হিট হয় যেসব সাইটগুলাতে, তার একটি পর্ণোগ্রাফি সাইট। বাকি দুইটা ড্রাগস এবং ধর্ম।
পার্সোনা নিয়ে অনেক কিছুই হচ্ছে। উকিল নোটিস, তদন্ত চেয়েছেন তথ্য কমিশনার…….আরো অনেক কিছু। কিন্তু নারীর অনিচ্ছায়, নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতায় পার্সোনা যেভাবে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে, গোপনে নারীর শরীর ধারণ করেছে, তার অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিৎ। একই সঙ্গে খুঁজে বের করা দরকার রাতারাতি এতগুলা আউটলেট করার টাকা পার্সোনা কর্তৃপক্ষ কোত্থেকে পেলো? আর শুধুই কি পার্সোনা, নারীদের পোশাক বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানগুলার ট্রায়াল রুম, অন্যান্য বিউটি পার্লার কীভাবে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করছে, কোথায় করছে-স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর খুঁজে বের করার এখন দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

এই ক্যাপিটালিস্ট সোসাইটিতে শরীরের আরাম, সৌন্দর্য্যের জন্য নারী পার্লারে যাবেই। কেন যাবে না! কিন্তু আমার শরীর, মানে নারীর শরীর গোপনে ক্যামেরায় ধারণ করে, গোপনে বিক্রি করার অধিকার কারো নাই। পার্সোনার কর্মকাণ্ড নিয়ে তো তদন্ত জরুরী বলেইছি, কানিজ আলমাস একা নয়, তার সঙ্গে সম্পর্কিত চক্রকেও খুঁজে বের করা জরুরী।

শামীমা বিনতে রহমান: লেখক ও সাংবাদিক।