নগর পরিকল্পনায় দার্শনিক এবং কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 3 August 2016, 06:31 AM
Updated : 3 August 2016, 06:31 AM

গত শতকের মাঝামাঝির পর থেকে শুধু এই উপমহাদেশে নয়, সারা বিশ্বের দরিদ্র দেশের শহরগুলো জনস্ফীতি, অবকাঠামো ও কর্মসংস্থানের বিপুল সমস্যার ভারে ন্যুব্জ। বহুলাংশে আজও অবস্থা তেমনই। অথচ সদ্য-স্বাধীন দেশগুলোতে এসব শহর ঘিরে স্ব স্ব দেশবাসীর প্রচুর আশা-ভরসা ছিল। সুদিনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে শহরগুলোই তারা ভিড় জমায়। স্বাধীনতার পর এই প্রচণ্ড ঢেউয়ে টালমাটাল আমাদের ঢাকাও।

তৃতীয় বিশ্বের এই 'নতুন প্রাইমেট সিটি' হিসেবে পরিচিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থাও ছিল সঙ্গীন। দ্রুত জনসংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়াল, মূল-বিচ্ছিন্ন মানুষে ঠাসা অভিশপ্ত 'বস্তি-বলয়' হয়ে উঠল শহরাঞ্চল। এই 'অস্বস্তি'র বস্তি ও নানা নাগরিক দুর্ভোগ আজও ঢাকার সমার্থক হয়ে আছে।

৫০ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি হারে নগরায়ন হয়েছে বাংলাদেশে। ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ জনগণ আনুষ্ঠানিকভাবে নগরের শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। একই সময়ে সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় এই হার ১ দশমিক ১ শতাংশ।

তবে বাংলাদেশে যে হারে এগোচ্ছে, উন্নত দেশগুলো ১৯ শতকে এই হারেই অগ্রসর হয়েছিল। এসব তথ্য দিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের 'লিভারেজিং আরবানাইজেশন ইন সাউথ এশিয়া: ম্যানেজিং স্পেশাল ট্রান্সফরমেশন ফর প্রসপারিটি অ্যান্ড লিভেবিলিটি' শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশের ২১ দশমিক ৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। ২০০৯ সালে প্রায় ৬২ শতাংশ নগরের মানুষ বস্তিতে বসবাস করেছে।

বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করছে। নগরায়নের এই মাত্রা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫১ সালে বাংলাদেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশের শহরগুলোতে দ্রুত হারে নগরায়ন হচ্ছে। এতে সম্ভাবনার পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যাও তৈরি হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্বের ২৯টি মেগাসিটির মধ্যে একটি। কমপক্ষে এক কোটি লোক বাস করে, সে হিসেবে এটি মেগাসিটি। দক্ষিণ এশিয়ায় আছে ছয়টি মেগাসিটি। তবে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) করা বসবাস উপযুক্ততার সূচকে ঢাকার অবস্থান একেবারে নিচের দিকে। চলতি বছর এই সূচকে ১৪০ দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৯তম। ঢাকার পরে আছে একমাত্র দামেস্ক, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী।

অথচ ঢাকা একটা সুন্দর শহর ছিল। ১৯১১ সালের আগ পর্যন্ত ঢাকা ছিল প্রাদেশিক রাজধানী। এই রাজধানীর মর্যাদা হারানোর পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র করে নতুন এক ঢাকা গড়ে উঠেছিল। খুব বিত্তের বৈভব না থাকলেও পুরনো শহরের আভিজাত্য আর নতুন স্থাপনাগুলোর সহজ সৌন্দর্য মিলে দৃষ্টিনন্দন নগর সৃষ্টি হয়েছিল।

ঢাকা ছিল সেই সময়কার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চাভূমি। তবে প্রশাসকরা ঢাকা কেন্দ্র করে পরিকল্পনা সাজালেও দেশের অন্যান্য শহর নিয়ে সে রকম পরিকল্পনা ছিল না। সে কারণেই ঢাকার মতো আর কোনো শহর গড়ে ওঠেনি। এর অন্যতম কারণ হলো, সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান তথা এখনকার বাংলাদেশকে একটি এক নগরকেন্দ্রিক অঞ্চল হিসেবে দেখার একচোখা প্রশাসনিক রোখ।

এরও আগে মোগলদের প্রাদেশিক রাজধানী প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পর ১৬৪০ সালে পর্যটক সেবাস্টিয়ান মানরিকের ভ্রমণবৃত্তান্তে দেখা যায় এক মনোরম ঢাকার বর্ণনা। সেবাস্টিয়ান মানরিকের পর ১৬৬৬ সালে ঢাকায় আসেন পর্যটক টাভার্নিয়ার। তিনি ঢাকাকে তুলনামুলক ঘনবসতিপূর্ণ শহর বললেও, ঢাকাকে 'শান্ত' শহর বলে অভিহিত করেছেন। ঠিক সে সময়েই সে যুগে প্রশাসকরা দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করে শহরের বিস্তৃতি ঘটান।

১৬৭০ সালের দিকে টমাস বাউরি আসেন ঢাকায়। তাঁর বর্ণনায় খুব দ্রুত ঢাকার বিস্তারের বর্ণনা পাওয়া যায়। খুব অল্প সময়ে ঢাকা শহরের পরিধি দাঁড়ায় প্রায় ৬০ কিলোমিটার। তখন ঢাকা শহরের চারদিকে নিচু জলাভূমি থাকলেও উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিকে ছিল উঁচুভূমি। তবে ওই সময়ের কোনো লিখিত ইতিহাসে নগরে জলজটের কিংবা জলাবদ্ধতার বর্ণনা পাওয়া যায় না।

স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানি শাসকদের সব মনোযোগ ছিল ঢাকা কেন্দ্র করে; ঢাকার বাইরে যেতে নারাজ ছিলেন তারা। তখন এই এলাকার প্রশাসনিক, সামরিক ও আর্থিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয় ঢাকা। পাকিস্তানি শাসনামলে ঢাকা হয়ে গেল বর্ধিষ্ণু নগর।

স্বাধীনতা অর্জন করলেও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে না পারার কারণে পাকিস্তানি শাসক ও শোষকদের তৈরি কেন্দ্রীভূত ঢাকার চক্করে পড়ে আজকের ঢাকা। তাই আমরা দেখি সরকারের সচিবালয় কেন্দ্র করে ঢাকা শহরের মধ্যেই গড়ে উঠছে শিল্প এলাকা, সেরা বিপণি বিতান, বিভিন্ন বিষয়ের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়, সব ব্যাংকের কেন্দ্রীয় দপ্তর, সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর, অভিজাত থেকে নিম্নবর্গের সব ধরনের পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ও জাতীয় সংসদ।

সচিবালয় তো ররেছেই, আর সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান দপ্তর ও সরকারি, আধ-সরকারি সব বাহিনীর সদর দপ্তর, শিশুদের স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কিছুই ঢাকায় অবস্থিত।

কেউ কেউ সন্তানের লেখাপড়ার জন্যও এই শহরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। কর্মকর্তা থেকে পিয়ন প্রায় সব রকম সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে পোস্টিং ঠেকাতে নানা রকম তদবির করে থাকেন। ভালো শিক্ষক, ভালো চিকিৎসকরা ঢাকার বাইরে যেতে চান না। আবার যারা যেতে চান, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও নেই।

অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের ফলে এখনই শহর ও নগরে বসবাসকারী মানুষ নানাবিধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বিশৃঙ্খল নগর উন্নয়ন, বেকারত্ব, পরিবেশের অবনতি, মৌলিক সেবা প্রাপ্তির অভাব, অপরাধ এবং দরিদ্র জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। এ জন্য সুষম ও টেকসই নগরায়ন নিশ্চিতকল্পে উপযুক্ত নীতিমালা গ্রহণ জরুরি।

সমন্বয়ের সমস্যা নিরসনের জন্য ঢাকার মেয়রদের প্রস্তাব হলো, একটি নতুন সংস্থা সৃষ্টি। নগর উন্নয়নের জন্য সমন্বয়ের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। অতীতেও এ সমস্যার বিষয়ে বর্তমান মেয়রদের পূর্বসূরীরা বারবার উত্থাপন করেছেন। এ জন্য তাঁরা 'সিটি সরকার' সৃষ্টির প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা কোনো সরকারই গ্রহণ করেনি।

বিএনপি সরকারের আমলে এ সমস্যা নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। এ কমিটি কতটি সভা করেছে এবং এসব সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ও জনগণের অজানা। তবে বলা যায় যে, কমিটি অকার্যকরই ছিল।

এখন কমিটির পরিবর্তে বলা হচ্ছে নতুন সংস্থার কথা। নতুন সংস্থা হলেই যে সমস্যার সমাধান হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কথাও বলা হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এর অর্থ যদি হয় ক্ষমতাসীন সরকারকেই অঙ্গীকার করতে হবে, তাহলেও অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে, তা ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগের '৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নগরায়ন' বিষয়ক খসড়া উপস্থাপনায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান কমছে এবং নগর খাত তথা শিল্পের অবদান বাড়ছে। কাজেই দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকা সচল রাখতে সুষম ও টেকসই নগরায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

এ লক্ষ্যে, নগর সুশাসন, আবাসন, পরিবহন এবং নগর-দারিদ্র্য বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে '৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নগরায়ন' বিষয়ক খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।নগরায়নের জন্য নীতিমালা গ্রহণ জরুরি। নগরায়নের সুফল পেতে নগর ও শহরের উপযুক্ত ভূমি ব্যবহার নীতিমালা প্রণয়ন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ভূমি ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু ও টেকসই নগরায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের ভূমি আইন ও ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জটিল। তাই প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রশিক্ষণ সুবিধা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

জিডিপিতে নগরায়ন খাতের ক্রমবর্ধমান অবদান বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জাতীয়ভাবে এ খাতকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য জাতীয় নগরায়ন নীতিমালা গ্রহণের কথা বলছেন নগর-পরিকল্পনাবিদরা। জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালায় বর্ণিত বিষয়সমূহ ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার জন্য গ্রহণীয় হতে পারে।

বর্তমানে নগরায়ন বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে সরকারের নানা পরিকল্পনায়। আশার কথা যে, ৭ম পরিকল্পনায় সুষ্ঠু নগরায়ন নিয়ে বিশদ নীতিনির্ধারণী পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু নগরায়নের ক্ষেত্রে ঢাকা এবং সেকেন্ডারি সিটির (জেলা/উপজেলা) জন্য একই পরিকল্পনা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কেননা, দুটি শহরের ব্যাপকতাসহ নগরায়ন ধারা এক নয়।

সুষম নগরায়নের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। নগর-দারিদ্র্য বিষয়ে একটি ভুল ধারণা রয়েছে, যা শোধরানো দরকার। নগর-দরিদ্ররা গ্রামীণ দরিদ্রের চেয়ে বেশি আয় করলেও, শহরের দরিদ্র জনগণ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে পিছিয়ে আছে, যা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।

এ কারণেই আমাদের নগর পরিকল্পনার দার্শনিক এবং কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। সুষম ও টেকসই নগরায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রথমইে 'নগরায়ন রূপকল্প বা লক্ষ্য' নির্ধারণ করতে হবে যা মূলত নাগরিকবান্ধব এবং মৌলিক সেবাসমূহ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত হবে।

এই রূপকল্প নির্ধারণে শুধু রাজধানী নয়; বরং দেশকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় আনতে হবে।