আইএসের আগুনেই জ্বলবে তুরস্ক

বিজন সরকার
Published : 14 Sept 2011, 02:17 PM
Updated : 29 July 2016, 06:47 AM

সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরপরই আইএসের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ধারণ হয়ে যাবে। হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প গেলে আইএসকে রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সমন্বয় রেখে সিরিয়া ও ইরাক থেকে আইএসকে সরিয়ে দেওয়া হবে।

যদি হিলারি ক্লিনটন ক্ষমতায় যান, তবে সে ক্ষেত্রে আইএসকে সরাতে সময় লাগবে। আইএস বিষয়ে হিলারির সম্ভাব্য প্রশাসনের স্বতন্ত্র কোনো ভূমিকা না থাকার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে উপসাগরীয় দেশগুলোর (গালফ নেশনস) দেওয়া প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান ক্লিনটন পরিবার নিয়েছে; সেটি হিলারিকে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী নয় তো সিদ্ধান্ত পালনকারী করে রাখবে। হিলারি ক্ষমতায় গেলে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সরানোর জন্য আইএসকে ব্যবহারের শেষ চেষ্টা চলবে।

আইএসের সামরিক শক্তি এখন ক্ষয়িষ্ণু। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত কেবল রাশিয়ার হামলায় ২৮ হাজার আইএস যোদ্ধা খতম– এমনটিই জানিয়েছেন রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার ডেপুটি প্রধান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাশিয়া হামলা পরিচালনার আগে সিরিয়া ও ইরাকে আইএস, আল নুসরাসহ সব জঙ্গিসগঠনগুলোর মোট জঙ্গির সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার।

অপরদিকে পেন্টাগনের দাবি, তারাও আইএসের প্রায় ২৫ হাজার যোদ্ধাকে খতম করেছে। তবে খতমের সংখ্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে তারতম্য থাকলেও আইএসের অর্ধেক যোদ্ধা রাশিয়া, আমেরিকা ও আসাদ সরকারের বাহিনীর দ্বারা খতম হয়েছে– এ ব্যাপারে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত।

এমতাবস্থায় আইএস দ্রুতই দখলকৃত এলাকা হারাচ্ছে। আইএসের ওপর গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান আইএইচএস এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইএসের এলাকা ৩৫ হাজার বর্গমাইল ছিল। বর্তমানে এটি ২৬ হাজার ৩০০ বর্গমাইলে নেমে এসেছে। গত জুন মাসেই ইরাকের সেনাবাহিনী আইএসের হাত থেকে ফালুজাকে মুক্ত করল।

আইএসের অর্থের কয়েকটি উৎস রয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর সরকার ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে বিশাল অংকের পেট্রো ডলার অনুদানে গঠিত হয় আইএসের অর্থনীতির প্রাথমিক কাঠামো। পরবর্তীতে আইএস 'খেলাফত' সম্প্রসারণ করে দখলকৃত এলাকা থেকে ব্যাংক লুটের টাকা এবং তাদের এলাকায় বসবাসকারী ৪২ লাখ বাসিন্দার কাছে থেকে আদায়কৃত কর ও জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।

প্রসঙ্গত, আইএস সিরিয়া ও ইরাক থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যাংক থেকে লুট করেছে– এ তথ্য দিয়েছেন মার্কিনী ট্রেজারের প্রাক্তন জঙ্গি-অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ জনাথন সানজার। তুরস্ক সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়ীদের কাছে আইএস তেল বিক্রি করেও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে।

আইএস যতক্ষণ না পর্যন্ত উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য হুমকি ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারগুলো বিভিন্ন চ্যানেলে আইএসের জন্য অনুদান হিসেবে পেট্রো ডলার দিয়েছে। পরবর্তীতে আইএস যখন তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াল এবং সরকারি অনুদানের বিষয়টি পশ্চিমা গোয়েন্দাদের নজরে ও বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে চলে আসল, তখন থেকেই সরকারি পর্যায়ের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হলো। তবে এখনো উপসাগরীয় দেশগুলোর ব্যক্তি পর্যায় থেকে আইএসের জন্য অনুদান যাচ্ছে।

তুরস্কের কাছে তেল বিক্রি করে আইএস যে প্রতিদিন দেড় মিলিয়ন ডলার আয় করতো, সেই আয়ের পথটি রাশিয়ার বিমান হামলায় শেষ হয়ে যায়। আইএসের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষও আগের মতো কর দিতে পারছে না। এমতাবস্থায় আইএস সেনাদের ও অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন অর্ধেক করে দিয়েছে বলেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত করেছে। বলা যায়, আইএসের অর্থনীতি আগের মতো নেই।

আইএস রাজনৈতিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সংগঠনটি বহিরাগত ও অভ্যন্তরীণ– উভয় দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইএস তৈরির উদ্দেশ্যেই ছিল বাশার আল আসাদকে সরানো। তবে আইএস সংগঠনকে হাতে রাখা যায়নি। ফলে উপসাগরীয় দেশগুলোর ও পশ্চিমা বিশ্ব সংগঠনটির কার্যক্ষমতা নানা দিক দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। আইএসের রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতিগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি ও ডি-রেডিকালাইজেশন পদক্ষেপের ফলে সমাজে, বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মের আইএসের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়।

যখনই সিরিয়া ও ইরাকে আইএস নিজেদের কৃর্তত্ব হারাতে থাকল, তখনই সংগঠনটি প্রথাবহির্ভূত পথে নাশকতা চালাতে শুরু করল। বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানিতে যে হামলাগুলো হয়েছে, সেগুলো আইএসের নাশকতার নতুন রূপ। আইএসের 'লোন উলফ অ্যাটাক' এখন বিশ্বের শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনীর দুশ্চিন্তার কারণ। বিশ্বব্যাপী আইএসের নেটওয়ার্ক থাকায় নাশকতা যে দেশে ঘটবে সেই দেশ থেকেই আত্নঘাতী জঙ্গিকে রিক্রুট করা হয়। এতে খরচও কম। ব্রাসেলসে হামলা চালাতে আইএসের মোট খরচ হয়েছিল দশ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলার।

অধিকন্তু, নিষ্পাপ মানুষদের হত্যা করার ফলে আইএসের ভেতরেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। আইএসের অনেক যোদ্ধা, বিশেষ করে, বিদেশি সেনাদের অনেকেই এই নতুন নাশকতার রূপের কারণে আইএস ছেড়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় আইএস রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকের মতে, আইএস আগামী বছর দুয়েকের মধ্যেই তাদের দখলকৃত এলাকা হারাবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরেই আইএসের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের গৃহীত পদক্ষেপগুলো স্পষ্ট হবে। ইতোমধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার জানিয়েছেন, আইএসের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য সহযোগী দেশ ও গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। আইএস তাদের এলাকা হারালেও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া আইএসকে নির্মূল করা খুব সহজ হবে না।

জনাথন সানজার নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন:

You can defeat ISIS in ISIS-controlled territories, but you're not going to defeat ISIS itself. The ideology of Jihadism continues to evolve and continues to exist.

আইএসকে সিরিয়া ও ইরাক থেকে সরিয়ে দিলে আইএসের যোদ্ধারা কোথায় যাবে? আইএসের সব যোদ্ধাকে খতম করা সম্ভব নয়। বিদেশি যোদ্ধাদের, বিশেষ করে উন্নত বিশ্ব ও যে সব দেশের রাজনীতি আইএস-বান্ধব নয়, সেসব দেশ থেকে আগত যোদ্ধাদের দেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর এখানেই রয়েছে আসল খেলার কার্ড।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তুরস্কের মিলিটারি ক্যু আসল ক্যু নয়; এই ক্যুর মধ্যে দিয়েই আসল ক্যু শুরু হবে। তুরস্ক দীর্ঘদিন যাবৎ ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। উগ্রপন্থী প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যে পরিমাণ চতুর রাজনীতি করতে চেয়েছেন, ঠিক সেই পরিমাণ ধরাও খেয়েছেন। বলা যায়, চারপাশ থেকে তাঁকে আটকানোর নতুন জাল ফেলা হয়েছে।

তিনটি কারণে এরদোয়ানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের আন্তঃবিশ্বাস তলানিতে রয়েছে।

প্রথমত, এরদোয়ান সালাফিজম মতাদর্শের রাজনীতিবিদ এবং একজন নব্য সুলতান হিসাবেই আবির্ভূত হয়েছেন। এরদোয়ানের হাত ধরেই তুরস্কে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রসার ঘটছে। আজকের তুরস্কে যে সেক্যুলারিজম বনাব উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের চিরায়ত দ্বন্দ্ব চলছে– এটির আধুনিক নির্মাতাই এরদোয়ান। ১৯২০ সাল থেকে তুরস্কের কোনো রাষ্ট্র ধর্ম নেই; এরদোগান সেটি আনতে চাইছেন।

এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সদস্য ও পার্লামেন্টের স্পিকার ইসমাইল কারামেহন ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'তুরস্ক একটি মুসলিম দেশ। এখানে সেক্যুলার সংবিধানের কোনো স্থান থাকতে পারে না।'

ইসমাইলের ঘোষণার পরের দিনই তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলু ইসমাইলের দাবি নাকচ করে দেন। ঠিক এক মাস পরেই দাভুতোগলুকে প্রধানমন্ত্রীর পথ থেকে ইস্তফা দিতে হয়। তাঁর পদত্যাগের তিনটি কারণের মধ্যে একটি ছিল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নেতৃত্বে তুরস্কে ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান মেনে না নেওয়া। বাকি দুটি হলো সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে প্রেসিডেন্ট শাসিত শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রচেস্টাকে স্বাগত না জানানো এবং দাভুতোগলুকে অতিমাত্রায় পশ্চিমাপন্থী হিসেবে সন্দেহ করা।

আমেরিকা ও ইউরোপের রাজনৈতিক সমাজ এরদোয়ানকে একজন ইসলামিক উগ্র-বান্ধব রাজনীতিবিদ হিসাবেই গণ্য করে। এরদোয়ান যে তুরস্কের নতুন সুলতান এবং তাঁর হাত ধরেই যে তুরস্ক এই উগ্র ধর্মরাজ্যে পরিণত হচ্ছে– তা বহির্বিশ্ব ভালো করেই ওয়াকিবহাল।

দ্বিতীয়ত, শরণার্থী ইস্যু ব্যবহার করে এরদোয়ান পশ্চিমা বিশ্বকে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে ব্ল্যাক-মেইল করছেন। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অন্যান্য এলাকা থেকে শরণার্থীর স্রোত মোকাবিলার জন্য ইউরোপ বহুলাংশে তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল। শরণার্থীরা তুরস্ক হয়ে গ্রিস দিয়েই ইউরোপে প্রবেশ করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চাইছে, শরণার্থীদের তুরস্কতেই আটকে দিতে। শরণার্থী-সমস্যাকে মোকাবিলায় জন্য ইউরোপ আরো ছয় বিলিয়ন ইউরো তুরস্ককে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তুরস্কের দাবি আরও বেশি। তুরস্ক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যপদ ও শেনজেন ভিসার আওতায় যেতে চায়। এরদোয়ান যে পুরো ইউরোপে উগ্রবাদ রপ্তানি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তা কেবল পশ্চিমা গোয়েন্দারা নয়, সাধারণ জনগণও বুঝে গেছে।

তৃতীয়ত, এরদোগান ন্যাটোর সদস্যপদ কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধ লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। গত বছরের নভেম্বরের ২৪ তারিখ সিরিয়ার লাতাকিয়ার আকাশে চক্কর দেওয়া রাশিয়ার সু-২৪ বিমানটি ভুল করে তুরস্কের আকাশসীমায় প্রবেশ করার জন্য ভূপাতিত করা হয়। সেখানে সেটি ছিল মাত্র ১৭ সেকেন্ড। বিমানটি ভূপাতিত করার পর কালবিলম্ব না করে ন্যাটোর দ্বারস্থ হয় তুরস্ক। আমেরিকার বহু সামরিক ও বেসামরিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তুরস্কের দুরভিসন্ধিমূলক রাজনীতির বিষয়ে ন্যাটোর প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে সতর্ক করে দেয়।

রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করার জন্য রাশিয়ার কাছে তুরস্ক ক্ষমা না চাওয়ায় পুতিন তুরস্কের উপর রাশিয়ার পর্যটকদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ফলে তুরস্কের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার পর্যটন শিল্পে ধস নামে। ব্যবসায়ী সমাজের চাপে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান রাশিয়ার কাছে গত মাসে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। তবে, ভূ-রাজনৈতিক কারণে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের যে আন্তঃবিশ্বাস নির্ভর সম্পর্ক ছিল, সেটি আগের জায়গায় নেওয়া সম্ভব নয়। যদিও ক্যুর পরে এরদোয়ান আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়া সফরে যাচ্ছেন।

তুরস্ক যে খেলা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বহুমাত্রিকভাবে খেলতে চাইছিল, তা পশ্চিমাদের লেন্সে ঠিকই ধরা পড়ে যায়। রাশিয়াও তুরস্ককে বিশ্বাস করছে না। সৌদি আরবের পরই তুরস্ক দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাশার আল আসাদের সরে যাওয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল।

আইএস সিরিয়া ও ইরাক থেকে সরে গেলে তুরস্কে অবস্থান নেবে বলেই বিশেষজ্ঞদের মতামত। বিশেষজ্ঞদের মতামতের পিছনে অনেকগুলি বাস্তব কারণ রয়েছে।

প্রথমত, এরদোয়ান নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিরোধী দলগুলোর ওপর নির্যাতনের বুলডোজার চালিয়েছেন। গত এক দশকের মধ্যেই এরদোয়ান তুরস্ককে নানা দলে-উপদলে বিভক্ত করেছেন।

বাংলাদেশের ২১ আগস্টের মতো গত বছর এরদোগান সরকারের ছত্রছায়ায় কুর্দি ও বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বোমা হামলা করা হয়। এতে ৯৫ জন মারা যায়। আহত হয় কয়েকশ মানুষ।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়, কেবল এরদোয়ানের সমালোচনার কারণে ২০১৪ সালের আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত ১,৮২৫ মামলা দায়ের করা হয়। এসব সমালোচনার শাস্তি ন্যুনতম চার বছরের জেল। গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করা নিষিদ্ধ। বাশার আল আসাদকে সরানোর জন্য এরদোয়ান সরকার সিরিয়ান আর্মিকে অস্ত্র দিচ্ছে– এমন প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর তিন সাংবাদিকের যাবজ্জীবন জেল দেওয়া হয়েছে।

সেনাবাহিনীর ভেতরে বড় একটি অংশ এরদোয়ান উগ্র-বান্ধব রাজনীতি মানতে নারাজ। এই ক্যুটি ব্যর্থ হয়েছে, তবে ক্যুর সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে জেলে দেওয়া হয়েছে। সরকারের ভেতরে ও বাইরে বহু গোষ্ঠী অপেক্ষায় আছে এরদোগানের মতো নব্য 'সাদ্দাম হোসেন'-কে সরানোর। তুরস্কে এই অকার্যকর রাজনীতি আইএসের প্রবেশকে স্বাগতই জানাবে।

দ্বিতীয়ত, কুর্দিরা স্বাধীনতা চাইছে। কুর্দি ফ্রিডম হউক ও কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির সমান্তরালে আইএসও তুরস্কে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এরদোয়ান যত কঠোরভাবে কুর্দিদের দমন করতে চাইছেন, ঠিক ততই কুর্দি স্বাধীনতাকামীরা শক্তিশালী হচ্ছে।

তুরস্ক সিরিয়ায় বহুজাতিক বাহিনীর হামলা শুরুর পর থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে আমেরিকা সিরিয়ান কুর্দিদের সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এরদোয়ান আমেরিকাকে বলছেন, সিরিয়ার কুর্দি সংগঠন কুর্দিস পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট (YPG) ও সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (PYD) জঙ্গিসংগঠন। এ দুটি সংগঠনের সঙ্গে তুরস্কের কুর্দি স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর নীরব যোগাযোগ রয়েছে।

এরদোয়ান স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, হয় আমেরিকাকে তাঁকে বেছে নিতে হবে, না হয় কুর্দি সন্ত্রাসীদের (তাঁর ভাষায়) বেছে নিতে হবে। সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বহুজাতিক আলোচনায় তুরস্কের আপত্তির কারণে PYDকে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

তবে আমেরিকা এরদোয়ানের কথার তেমন গুরুত্ব দেয়নি। আমেরিকার প্রতিনিধি ব্রেট মেক জেনেভায় সম্মেলন চলাকালীন সিরিয়ার কুবে শহরটিকে আইএসের কাছ থেকে দখলমুক্ত করার পরপরই সেখানে যান। তাঁকে কুর্দি একজন জেনারেল গার্ড অব অনার দেন। মেক কুর্দি সেনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন।

ফলে আমেরিকা এরদোয়ানের ইচ্ছা ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সমান্তরালে নেই, এটি দৃশ্যত প্রতীয়মান হচ্ছে। বরং আমেরিকা তাঁর ভূ-রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। কেবল আমেরিকা কেন, ইউরোপের প্রতিটি দেশই কুর্দিদের স্বাধীনতার বিষয়ে সরাসরি কিছু না বললেও তাদের মৌন সমর্থনের বিষয়টি ভালো করেই বোধগম্য। ফলে তুরস্ক দেশটির স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা রাস্তা হারিয়ে সিরিয়ার মতো অস্থিতিশীলতার কাছে চলে যে এসেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তৃতীয়ত, তুরস্কের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আইএস জঙ্গিরাও অনুপ্রবেশ করেছে। তুরস্ক আইএসের প্রতিবেশি; আইএসের এলাকায় প্রবেশ করতে হলে তুরস্ক হয়েই যেতে হয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা, আইএসের বহু উপরের স্তরের সদস্য যারা বিভিন্ন সিদ্ধান্তসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে করে, তাদের অনেকেই তুরস্কে অবস্থান করছে। হামলা করে সিরিয়া ও ইরাকভিত্তিক আইএসকে ধ্বংস করে দিলেও তাদের থিংক ট্যাংক যেন ঠিক থাকে সেই উদ্দেশ্যেই। তাছাড়া, আইএসের সঙ্গে তুরস্কের বহু গোষ্ঠীর বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে; তাদের আদর্শিক, ধর্মীয়, কালচারাল এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিবিড়।

আইএসকে সিরিয়া ও ইরাক থেকে সরিয়ে দিলে আইএস যোদ্ধাদের প্রাথমিক নিরাপদ স্থান হবে তুরস্ক। আরব বিশ্বের আইএস যোদ্ধারা তুরস্কে অবস্থান করলে তাদের নিরাপত্তার ঝুঁকি কম। আইএসের মোট যোদ্ধার এক-চতুর্থাংশ সৌদি নাগরিক। যদি আইএসের সৌদি যোদ্ধারা তুরস্কে আশ্রয় নেয় এবং নাশকতা চালায়, তাহলে সেদেশের সরকারের তেমন কিছুই করার থাকবে না।

তাছাড়া, তুরস্ক থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাতে অপারেশন চালাতেও খুব সুবিধা হবে। দেশটির অভ্যন্তরীন রাজনীতিও আইএসের অনুকূলে। আইএস যদি কুর্দিদের ওপর নাশকতা চালায়, এরদোয়ান খুশি হবেন। তবে তিনি যতই জঙ্গি-বান্ধব শাসক হোন না কেন, তাঁর সরকার তাগুতি সরকার। আইএস যে কারণে বাশার আল-আসাদকে মানতে পারেনি, ঠিক একই কারণে এরদোয়ানকেও মানবে না।

এরদোয়ান যেভাবে রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকাকে নিয়ে খেলতে চাইছিলেন, তা আর সম্ভব নয়। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে যান, রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার দূরত্ব কমে আসবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। যদি তা-ই হয়, সিরিয়া ও ইরাক থেকে আইএস দ্রুতই সরে যাবে।

এমতাবস্থায় খুব সম্ভবত আইএসের দ্বিতীয় 'খেলাফত'এর স্বপ্ন হবে তুরস্ক।