হিজাব: ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা কতটুকু

ড. এম আমের সরফরাজ
Published : 24 July 2016, 08:36 AM
Updated : 24 July 2016, 08:36 AM

[পাকিস্তানের সাপ্তাহিক 'দ্য ফ্রাইডে টাইমস' পত্রিকায় যুক্তরাজ্যের কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ড. এম আমের সরফরাজ The idea of the Hijab শীর্ষক এই নিবন্ধ লিখেছিলেন ১৩ জুন, ২০১৪। বাংলায় এটির অনুবাদ করেছেন ড. আবদুস সেলিম ।]

এই মুহূর্তে বিশ্বের সব মুসলমানই প্রায় সর্বত্র সবার সঙ্গেই যুদ্ধে লিপ্ত। এর কারণ, তাদের বিভ্রান্তি; যদিও এ কথা সত্যি যে প্রায় সারা বিশ্বই প্রকৃত অর্থে তাদের বিরুদ্ধে। যেখানেই তারা যাক না কেন তাদের সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভিন্ন সম্প্রদায়ের যাদেরই জিজ্ঞেস করা হোক তারাই মুসলমানদের সমস্যা বলে চিহ্নিত করে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কমবেশি 'বৈষম্যমূলক' আচরণ করা হয়– বর্ণ, নাম ও জাতীয়তার ভিত্তিতে। যেহেতু তারা বুঝতেই পারে না যে, তাদের 'আচরণ'ই এই বৈষম্যের মূল কারণ; তারা চিন্তাতীতভাবে আহত ও বিস্মিত হয়। ফলে বাস্তব ও অবাস্তব উভয় অবজ্ঞাকারীদের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা ও ক্রোধ ক্রমবর্ধমান হয়। এই দুষ্ট ঘটনাচক্র অনাগত ভবিষৎ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে বাধ্য, যদি ইতোমধ্যে কোনো আলৌকিক ঘটনা না ঘটে।

আলৌকিকতার বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায়, আমরা প্রায়ই শুনতে পাই কোনো এক ব্যক্তি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে কিংবা অন্য সব ধর্মের তুলনায় অধিকতর মানুষ ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছে, বিশেষ করে, পশ্চিমা দেশে। এই জনশ্রুতির কয়েকটি বিষয় বিবেচ্য; কারণ ধর্মান্তর, তা যে ধর্মেই হোক না কেন, সংঘটিত হয় কয়েকটি পদ্ধতিতে।

প্রথমেই উল্লেখ করা যায়, মিশনারিদের মাধ্যমে যার অন্যতম প্রধান অবকাঠামো হলো অবৈতনিক শিক্ষা ও দাতব্য স্বাস্থ্যসেবা এবং সর্বোপরি অপরাপর অর্থনৈতিক সুবিধাদি। ব্যক্তিক ধর্মান্তর ঘটে বৈবাহিক সূত্রে, কোনো একটি ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান আহরণে কিংবা কোনো আদর্শিক মডেল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। আমি নিশ্চিত নই এই মুহূর্তে এমন আদর্শিক কোনো মডেল মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে কি না। ফলে বিষয়টি বিস্ময়কর নয় যখন দেখি যুক্তরাজ্যের জেলখানায় সাজাপ্রাপ্ত মোট অপরাধীর শতকরা ৩০ জনই মুসলমান (যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার ২ শতাংশ মুসলমান)। এবং এই অপরাধীরা প্রধানত সাজা ভোগ করছে সহিংসতা, প্রতারণা, মাদক এবং মদ্যপানের অপরাধে। প্রমাণ পাওয়া যায়, জেলখানায় ইসলাম ধর্মের প্রচার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করেছি, কিন্তু যখন কোনো অমুসলমান ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য বই পড়তে চায় আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। এর মূল কারণ, মুসলমানরা ইংরেজিতে কোনো রুচিসম্মত, নিবিড় তথ্যসংবলিত গ্রন্থ রচনায় আগ্রহী হয়নি। ইসলাম নিয়ে এ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় যত বই প্রকাশিত হয়েছে তার সবই প্রায় নিম্নমানের অনুবাদ, কিংবা সেগুলো অতি মুসলিমমনা, গোষ্ঠীভিত্তিক, ধর্মীয় আচার-আচরণ বর্ণনাক্রান্ত অথবা রুচিহীন ভাষায় রচিত। ফলে ক্যারেন আর্মস্ট্রং, লিওপোল্ড উয়াইস এবং গাই ঈট্ন্-এর বই পড়া ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না।

বিষয়টি খুবই দুঃখজনক যে জন্মগত মুসলমান এখনও কোনো উচ্চমানসম্পন্ন এবং যুগোপযোগী কোরানের ইংরেজি অনুবাদ করেছে বলে দাবি করতে পারে না। মার্মাদুক পিকথাল এবং লিওপোল্ড উয়াইস-ই আমাদের ভরসা।

আমি বিশ্বাস করি, হালাল, হিজাব এবং বহুবিবাহ ছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইসলামে আছে। আমি এ-ও বিশ্বাস করি ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম, যা এমনভাবে বিন্যস্ত যেন বিশ্বের কোনো সংস্কৃতি ও সমাজের সঙ্গে কোনো সময়ই বিরোধে জড়িয়ে না পড়ে। যদি বিরোধ আদৌ হয়, তবে বুঝতে হবে, কোনো 'আনপড়' এবং বিকৃতমনা মুসলমান ধর্মীয় প্রধানের ভুল 'ফিকাহ্' বা মানবিক দর্শনের কদর্থের কারণে তা ঘটেছে।

সুসংবাদ হলো বহুবিবাহ এবং হালাল আজকাল তেমন আলোচ্য বিষয় নয়; আর তাই এই আলোচনায় এগুলো বাদ দিতে পারি। বর্তমানে পুনরুত্থিত একাধিক মুসলমান ধর্মোপদেশক এবং তাদের অন্ধ অনুসারী দ্বারা হিজাব পরার বিষয়ে যে প্রচারণা চলছে– সেই বিষয়টি নিরীক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

'হিজাব' একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ 'ঢেকে রাখা' বা 'বন্ধ করে রাখা'। আরব ভাষাতত্ত্ববিদ রাখিব বলছেন, 'আল-হিজাব' হলো এক ধরনের বাধা, যার মূল উদ্দেশ্য হলো কোনো একটি বিষয় বা বস্তুর নাগালে বাধা প্রদান করা। বর্তমানে মেয়েরা হিজাব হিসেবে যা পরে সেটি হলো এক ধরনের মস্তক-আবরণী বা এক ধরনের মুখাবরণ বা নেকাব যার সঙ্গে মস্তক-আবরণী সংযুক্ত থাকতেও পারে অথবা না-ও পারে। এটির সঙ্গে দেহাবরণীরও প্রচলন আছে।

লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, কোরানে হিজাব শব্দটির উল্লেখ কোনো ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ হিসেবে কখনও পাওয়া যায় না। কোরান পুরুষ ও নারী উভয়কেই তাদের দৃষ্টি, হাঁটা-চলা, পোশাকের এবং গোপনাঙ্গ বিষয়ে পরিমিত ও সংযত হতে উপদেশ দিয়েছে। সপ্তম শতাব্দীর নারীদের জন্য তাদের বুকের উপর 'খিম' বা শাল ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিল, বিশেষ করে, তারা যখন বাইরে বের হত। সে সময় এ-ও বলা হয়েছে, তারা যেন তাদের 'জিনাত' বা সৌন্দর্য তাদের স্বামী ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া আর কারও সামনে প্রদর্শন না করে।

মহানবী (সা.)এর স্ত্রীদের প্রতি নির্দেশ ছিল তাঁরা যেন পর্দার আড়াল থেকে আলাপচারিতা করেন এবং শরীর যেন 'জিলবার' বা কাপড়ে ঢাকা থাকে। এটি করার কারণ হলো, বাইরে গেলে যেন সহজেই বোঝা যায় তাঁরা বিশিষ্ট ঘরানার নারী। মহানবী হজরত মুহম্মদের (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) জীবনকালে মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো নারী হিজাব ব্যবহার করত না এবং পর্দা, 'দারাবাত আল-হিজাব' জাতীয় শব্দাবলী পরিবর্তনীয়ভাবে 'মুহাম্মদের স্ত্রীর' জন্য সংরক্ষিত ছিল।

হিজাব ইসলামের কোনো ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে না এবং ফলে এর কোনো ধর্মীয় গুরুত্ব বা নৈতিক মর্যাদা নেই। খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এক অ্যাসিরিয় পাঠাংশে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়– যখন ক্রীতদাসদের এবং পতিতাদের হিজাব পরা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হত। ইতিহাসে বর্ণিত আছে– গ্রিক, রোমান, জরাথুস্ত্র, ইহুদি এবং সনাতনধর্মী আরব উচ্চবংশীয় ও ধর্মযাজকরা তাদের মেয়েদের সম্মান ও উচ্চ মর্যাদার নিদর্শন রূপে শরীরের আচ্ছাদন ও পর্দার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে।

ভারতবর্ষের কোনো কোনো হিন্দু সম্প্রদায়ে এক ধরনের হিজাবের প্রচলন ছিল; যাকে বলা হত 'ঘুঙ্ঘট'। এই হিজাবের ব্যবহার ইসলাম-পূর্ব সামাজিক আচরণ। ইহুদি ধর্মে বিশ্বাস করা হত, যে নারীর চুল দৃষ্টিগোচর হবে তার স্বামী অভিশপ্ত ও ঘৃণ্য। কারণ, এমন সংসারে দারিদ্র্যের স্থায়ী আসন অনিবার্য।

একইভাবে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে বলা হত, মস্তক-আবরণহীন নারী তার নিজের মস্তককেই অবমাননা করে। ফলে তার শাস্তি হওয়া উচিৎ মাথার চুল মুণ্ডন করা। এমনকি মধ্যযুগেও ইউরোপের রাজবংশ ও উচ্চবংশীয়রা মস্তক-আবরণহীন মুখাবরণে অভ্যস্ত ছিল।

পাশ্চাত্যের কিছু খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়, আফ্রিকাতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে এখনও এর ব্যবহার লক্ষণীয়। প্রায় সব খ্রিস্টীন নানদের মধ্যে হিজাব ব্যবহারের প্রচলন আছে।

অধিকাংশ বিদ্বজ্জন একমত যে, হিজাব ব্যবহারের অনুশর্ত শুধুমাত্র মহানবী (সা.)এর স্ত্রীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এ কথা প্রমাণ করার জন্য যে, তাঁরা পবিত্র নারী। এর অন্যতম কারণ তিনি তাঁর ধর্মীয়, সরকারি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন তাঁর বাসস্থান-সংলগ্ন মসজিদে। এই মসজিদে স্বভাবতই অসংখ্য মানুষের দিনভর এবং এমনকি রাতেও অবাধ যাতায়াত ছিল। ফলে তাঁর স্ত্রীদের একান্ততার বেশ অভাব দেখা যেত। তাঁর স্ত্রীদের এবং এইসব মানুষদের অবাধ আসা-যাওয়ার মধ্যে হিজাব একটি আড়াল হিসেবে কাজ করেছে।সম্ভবত মহানবী (সা.)এর স্ত্রীদের হিজাব ব্যবহারের বিষয়টি অনেক মুসলিম নারীদেরও উদ্বুদ্ধ করেছে এই ভেবে যে, তারা তাঁর স্ত্রীদের সমতুল্য হতে পারছে; ইসলামে যাদের 'বিশ্বাসের মাতা' রূপে বিশেষায়িত করা হয়।

সে যাই হোক, মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের কয়েক দশক পরেও হিজাবের এমন ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় না। কারণ, যখন তাঁর প্রপৌত্রী বিবি সাকিনাকে (রা.) হিজাব পরার উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন উপরোক্ত বিষয়গুলোর উদাহরণ দিয়ে।

হিজাব মূলত একটি পার্শি (জরাথুস্ত্র মতে) আচরণ। জরাথুস্ত্র মতবাদের প্রসারের সঙ্গে হিজাব ব্যবহারের বিষয়টি সপ্তম শতাব্দীতে বাড়তে থাকে। সেই সময়েই কর্মজীবী নারীদের জন্য হিজাব এতই অব্যবহার্য বলে বিবেচিত হত যে, 'এক হিজাবি নারী নীরবে জানিয়ে দিয়েছিল যে, তার স্বামী এখন এতই সম্পদশালী হয়েছে যে, তার কাজ করার আর প্রয়োজন নেই'। অবশ্য পরবর্তীতে উচ্চবংশীয় আরব নারীদের মধ্যে হিজাব প্রচলিত হতে থাকে যা কালক্রমে মধ্যপ্রাচ্যের শহুরে নারীরাও ব্যবহার করতে শুরু করে। উসমানীয় (অটোমান) শাসনের সময় পদমর্যাদা এবং বিশিষ্ট জীবনযাত্রার প্রতীক রূপে হিজাব একটি মর্যাদার আসন পায়।

ভারতে হিজাব এসেছে 'পর্দা'-রূপে প্রধানত মুঘল শাসকদের মাধ্যমে– যা পরবর্তীকালে উত্তর ভারতীয় উচ্চ সমাজেও স্থান পেতে থাকে। ঐতিহাসিকরা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, মহানবী (সা.) ইসলামে ধর্মযাজক-প্রথার (Clergy) সম্ভাবনার অবসান ঘটিয়েছিলেন তাঁর সমতাবাদ এবং ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে। কিন্তু এরই বিপরীতে নব্য ধর্মপ্রধানরা হিজাবসহ আরও অনেক আঞ্চলিক আচার-আচরণ ধর্মীয় গুরুত্বে স্থাপন করে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ফায়দা চরিতার্থ করার জন্য সমাজে অনাগত সময় পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করার দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত হয়।

আধুনিক যুগে হিজাব পুনরুজ্জীবিত করার দুটি কারণ আছে বলে মনে হয়। প্রথমটি হলো, গত শতাব্দীতে মিসর, ইরান, তুরস্ক এবং মধ্য-এশীয় গণপ্রজাতন্ত্রগুলোতে ধর্মীয় আচার-আচরণের সঙ্গে হিজাবও প্রত্যাবর্তন করেছে নিষেধাজ্ঞা জারির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে। দ্বিতীয়টি হলো, কল্পিত বা বাস্তব সংকটাকুল সময়ে ধর্মীয় কৃচ্ছ্রতাসাধনের পন্থা রূপে হিজাব গ্রহণ করা। এ দুটি কারণই একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়ে। কারণ, যখন হিজাব ব্যবহার দমন করার চেষ্টা হয়, তখনই হিজাব ব্যবহারের প্রসার ঘটে; তারই সঙ্গে বাড়তে থাকে এর প্রতি কৌতূহল।

বিষয়টি যখন প্রায় ভাটার দিকে ধাবিত হচ্ছিল ঠিক তখনই ৯/১১এর ঘটনাটি ঘটে। মুসলমানরা তখনই আবার ধর্মকে বর্ম হিসেবে আঁকড়ে ধরে মানসিক প্রশান্তির আশায় এবং সেই সঙ্গে এই বিশ্বাসে যে, সৃষ্টিকর্তা তাদের উপর এইসব ঘটনার জন্য অসন্তুষ্ট। ইরানে এবং পাকিস্তানে ইমাম খোমেনী এবং জেনারেল জিয়াও তাঁদের শাসনামলে ইসলামি আদর্শ প্রচার করতে থাকে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ধর্মীয় পরিচ্ছদ।

হালাকু খান যখন বাগদাদ আক্রমন করে (মুসলিম লিখাফতের কেন্দ্রস্থল) ১২৫৮ সালে, ঠিক তখন থেকেই মুসলমানরা তাদের 'ইজতাহাদের' পথ (ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে বিবেক ও বিচারবুদ্ধির ব্যবহার) রুদ্ধ করে দেয় শুধুমাত্র আপন স্বার্থোদ্ধারের চিন্তায়। এরপর আর কখনই মুসলিম প্রভাব আর ফিরে আসেনি; কারণ, দ্বার তো এখনও কঠিনভাবে বন্ধ। ফলে যা হয়েছে তা হলো, ধর্মীয় চিন্তাচেতনা স্থবির হয়ে গেছে এবং হিজাবের মতো অর্থহীন বিষয়গুলো বর্তমানে অনাবশ্যক গুরুত্ব পাচ্ছে।

লন্ডনে আপনি প্রায়ই জিনস, আধুনিক শার্ট, মেকআপসহ ব্র্যান্ডেড হাতব্যাগ ও অলঙ্কার-পরিহিত মুসলমান তরুণী দেখতে পাবেন। এরা অনেকেই দুপুরের খাবারের সঙ্গে ধূমপানও করে। আবার একই সঙ্গে এরা অনেকেই হিজাবও পরে। ফলে এরা অনেকেই শুধু দর্শকদেরই নয়, চারপাশের সমাজের মধ্যেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এমনও আছে অনেকেই বাসা থেকে হিজাব পরে বের হয়, কিন্তু কাজের পথে সেটি খুলে ফেলে।

যদিও এ কথা সত্য এইসব মেয়েদের যে কোনো পোশাক পরার সম্পূর্ণ অধিকার আছে, কিন্তু তাদের এমন আচরণ সমাজকে শঙ্কিত করে যদি তাদের এইসব আচরণ সাংস্কৃতিক-পরিচিতি-সংকটের বহিঃপ্রকাশ হয়।

আমি নিজ রুচির স্বাধীনতায় বিশ্বাসী যতক্ষণ তা আইন ও আমার বসবাসকারী দেশের সংস্কৃতির পরিপন্থী না হয়। বর্তমানে হিজাবের অর্থ ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন। কারও কাছে হিজাব আপন সংযম, নীতিবোধ এবং স্বাধীন ইচ্ছার প্রতীক। অথচ এই একই হিজাব অন্যজনের কাছে লিঙ্গবৈষম্যের বোধ সৃষ্টি এবং নারীদের শারীরিক এবং রূপকীয়ভাবে অবদমিত করার মাধ্যম। যে জিনিসটি ঐতিহাসিকভাবে একসময় ছিল স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক সেই একই জিনিস বর্তমানে সমাজ থেকে একঘরে হওয়ার একাধিক অর্থবহ চিহ্নে পরিণত হয়েছে। হিজাব এক নির্দিষ্ট অননুমোদিত গোষ্ঠীর পরিচায়ক রূপে পরিণত হয়েছে।

হিজাব বিষয়ে আমার নিজস্ব মতামতের সঙ্গে আমার বন্ধু জাভেদ খামিদির সঙ্গে মিল আছে, আর সেটি হলো, কোরানে বর্ণিত আছে– পুরুষ ও নারীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আদান-প্রদানে উভয়কেই আদব ও নম্র আচরণে শিক্ষিত হতে হবে; যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে 'খিম' বলে সপ্তম শতাব্দীর আরব নারীদের জন্য। হিজাব পরার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই এবং এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতির বর্ণনা ও নির্দেশ শরিয়া আইনেও পাওয়া যায় না।

পশ্চিমা অনেক জাতি নিরাপত্তার প্রশ্নে এবং সম্ভবত তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষার কথা ভেবে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির কথা ভাবছে। এই সিদ্ধান্ত বেশ কিছু মুসলমান নারীগোষ্ঠীর মধ্যে প্রকাশ্য প্রতিরোধের মানসিকতা সৃষ্টি করেছে। তারা আরও অধিক সংখ্যায় জোরালোভাবে শারীরিক আচ্ছাদন ও হিজাব পরায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। আমি মনে করি, ইসলামের দর্শন ও নীতির এটি একটি ভুল ব্যাখ্যা। এদের উচিৎ হিজাব বিষয়ে এক আপেক্ষিক অবস্থান গ্রহণ করা এবং সংযমী ও পরিমিত আচরণের আশ্রয় গ্রহণ করা, বিশেষ করে, পারিপার্শ্বিক সমাজের সঙ্গে সহ-অবস্থানের জন্য।

এক সমাজে যে আচরণ সাধু ও উদ্যোগী বলে বিবেচিত হয় (যেমন মধ্যপ্রাচ্যে), অপর সমাজে তা না-ও হতে পারে। হিজাবের বিষয়ে গোপন কর্মসূচি যাদের রয়েছে তারা শুধুমাত্র ধ্বংসের আগুন উসকে দিচ্ছে আন্তঃগোষ্ঠিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ অকার্যকর করার লক্ষ্যে এবং তা চরমপন্থী সংগঠনগুলো মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করছে সেই দেশে ফিরে যেতে বা অভিবাসী হতে যাদের সঙ্গে তাদের নীতিবোধের মিল আছে। কোরান আত্মশ্লাঘা, আস্ফালন, সীমালঙ্ঘন (এমনকি ধার্মিকতায়) কিংবা নিজের এবং অন্যের জীবনযাত্রা সংকটময় করার বিরুদ্ধে উপদেশ দেয়।

আপনিই সিদ্ধান্ত নিন কোন পথটি বেছে নেবেন!

[মূল লেখার লিংক: