“আর আমাদের ভয় নেই, মেয়েরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে”

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 23 July 2016, 08:31 AM
Updated : 23 July 2016, 08:31 AM

মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল আমার বন্ধু– সেটি আমার অহংকার। কারণ, শিরিন এক অকুতোভয় মানুষের নাম যিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পোশাক পরে এক হাতে যুদ্ধ করেন; একমাত্র নারী হিসেবে বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মানবিক গুণসম্পন্ন মেধাবী সামাজিক এই মানুষটি বন্ধু হিসেবেও যে অসাধারণ, তাঁর কাছের বন্ধুরা সবাই একবাক্যে তা স্বীকার করবেন। শিরিন এবং আমি– দুজনেই দীর্ঘদিন কচিকাঁচার মেলা করি। শিরিন ছাত্রজীবনে কুমিল্লা পূর্বাশা মেলা এবং পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার সঙ্গে যুক্ত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ২০ জুলাই সে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

শিরিনের মা এবং বাবা কচিকাঁচার মেলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। আমিও দীর্ঘসময় ধরে এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। সেই সূত্রে দীর্ঘদিন বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে মিতিল ও আমি একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের বন্ধুত্ব তাতে আরও গভীর হয়। সবচেয়ে আনন্দের কথা, আমাদের দুজনের জন্ম একই সালে, একই তারিখে; ১৯৫১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে বেইজিংয়ে আয়োজক কর্তৃপক্ষ আমাদের দুজনকে একসঙ্গে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। সেই মধুর স্মৃতি রোমন্থন করে আমরা প্রায়ই পুলকিত হতাম।

১৬ জুলাই কচিকাঁচার মেলায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রাত দশটা পর্যন্ত দুজন একসঙ্গে ছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে খেয়ে ওকে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরি। সেদিন শিরিন গাড়িতে অনেক কথা বলেছিলেন।

একটি কথা আজ আমার খুব মনে পড়ছে। মা-বাবা প্রসঙ্গে কথা বলার সময় এক পর্যায়ে বলেছিলেন, মা-বাবার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকাটা সন্তানের জন্য খুব জরুরি। তাহলে তারা ছায়াশূন্য, আলোশূন্য হয় না। অবচেতন মনে শিরিনের কি সেদিন শঙ্কা ছিল তাঁর সন্তানের জন্য। কে জানে!

শিরিন এক রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। মা সেলিনা বানু এবং বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। বাবা বিখ্যাত শ্রমিকনেতা। মা যুক্তফ্রন্টের হয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। মা-বাবার প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা তাঁর মনে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাই তাঁর এই দুঃসাহসী ভূমিকা; যা তাঁকে অবিস্মরণীয় করে রাখবে।

শিরিন যখন ছাত্র ইউনিয়নের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি তখনই বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্থানীয়ভাবে পাড়া-মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ছাত্র ইউনিয়নের পাবনা জেলা কমিটির সদস্যরা সংগঠিত হয়ে ১৮টি থানায় সফর করে স্থানীয় প্রতিরোধ কমিটিতে সংগ্রামী জনগণকে যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেন।

পরবর্তী সময়ে এই কমিটির উদ্যোগে পাবনা জেলা স্কুল মাঠে অস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হলে শিরিন তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। শুধু শিরিনই নন, মানসিকভাবে তখন সকলেই প্রস্তুত ছিলেন এক বৃহত্তম সংগ্রামের অংশগ্রহণের জন্য।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্য পাবনা শহরে প্রবেশ করে কারফিউ জারি করে। ২৬ তারিখ তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে। এর সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের উপর নেমে আসে ভয়াবহ হিংস্র অত্যাচার-নির্যাতন। পাবনা জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় পাল্টা আঘাত হানার। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ মার্চ রাতে পুলিশ লাইনে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধ শুধু পুলিশ ও মিলিটারিতে আবদ্ধ না থেকে এক সময়ে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। ঘরে ঘরে মেয়েরা তখন অস্ত্র হাতে প্রস্তুতি নিয়েছে তাদের বাধা দেওয়ার জন্য।

এমন পরিস্থিতিতে উত্তাল রণাঙ্গন শিরিনকেও অস্থির করে তোলে। ভাই জিঞ্চির বলেছিল, 'বুজি, প্রীতিলতার মতো তুমিও পার ছেলের পোশাক পরে যুদ্ধে যেতে।' কথাটা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে। বড় খালাম্মা রাফিয়া বানু প্যান্ট-শার্ট পরা শিরিনকে দেখে বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, এখন তুমি নিশ্চিন্তে যুদ্ধে যেতে পার। তোমাকে মেয়ে বলে চেনা যাচ্ছে না।'

২৮ মার্চ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখলে রাখা পাকিস্তানি বাহিনীর ৩৬ জন সেনার সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সেখানে জনতার সঙ্গে ছিলেন শিরিন। যুদ্ধে দুজন মুক্তিসেনা শহীদ হন। অন্যদিকে, ৩৬ পাকিস্তানি সেনাই মারা যায়। সর্বত্র খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলে। ৩০ মার্চ পাবনা স্বাধীন হয়। ৩১ মার্চ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় সর্বদলীয়ভাবে। পাবনা পলিকেটনিক ইনস্টিটিউটে স্থাপিত হয় কন্ট্রোল রুম। এই রুমের আওতায় বিভিন্ন কাজের সমন্বয়ের জন্য একটি কোর কমিটি গঠন করা হয়। এর অন্যতম সদস্য ছিলেন পাবনা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বাদশা। তিনিই জেলা প্রশাসককে শিরিনের ছদ্মবেশে যুদ্ধ করার কথা জানিয়ে ছিলেন; যদিও তিনি বিভিন্ন কাজে কন্ট্রোল রুমের আওতায় কাজ করছিলেন।

তখন যুদ্ধ চলছিল নগরবাড়ী ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরে। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয় আকাশপথে। পাবনার প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ছে, বিভিন্ন দল আরও পিছিয়ে যাচ্ছে কুষ্টিয়ার দিকে। পাবনার ছাত্রনেতা ইকবালের দল জিপে করে কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গার দিকে রওনা হয়। জিন্দানের জিপে জায়গা না হওয়ায় থেকে যেতে হয় কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ার এই ক্যাম্পেই আবার দেখা হয় পাবনার তখনকার পুলিশ ইনচার্জ ও রাজনৈতিক নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশার সঙ্গে। দুজন ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে জিপে করে চুয়াডাঙ্গার ক্যাম্পে হাজির হন শিরিনরা।

গোলাবারুদের অভাবে প্রাথমিক প্রতিরোধ তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, এক দলকে পাঠানো হলো সাহায্য সংগ্রহের জন্য। সেই দলের সদস্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক কমিটিতে পৌঁছান শিরিন। এখানে দেখা হয়েছে আবদুল কুদ্দুস মাখন ও নুরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে। সেখানেই জানা যায়, পাবনায় যে সাংবাদিকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি শিরিনের ছবিসহ সাক্ষাৎকারটি ছেপেছেন 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায় (১২ এপ্রিল, ১৯৭১)। ঠিক তখন থেকে ছেলে হিসেবে যুদ্ধ করার যে সাহসী সুযোগ তিনি নিয়েছিলেন তা হারালেন।

শিরিন বানুর সঙ্গীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, আর তখন তাঁকে আশ্রয় দেন নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র। এখান থেকেই শিরিন যোগাযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তিনি আশ্বাস দেন নারীদের নিয়ে আলাদা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গঠন করার। প্রথম যে কজন নারী বিভিন্ন আশ্রয় ক্যাম্পে ঘুরে অন্য নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল গঠনের উদ্যোগ নেন, শিরিন তাদের অন্যতম।

বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে শিরিন প্রশিক্ষণ নেন। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন তখন এমপি সাজেদা চৌধুরী। ৩৬ জন নারী নিয়ে এই ক্যাম্প শুরু হয়।

কিন্তু অস্ত্রের অভাব থাকায় মহিলা গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। এর মধ্যে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্ব। ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের শেষে অন্যদের সঙ্গে দেশে ফেরেন মিতিল।

গত বছর ২৬ মার্চ যুগান্তর পত্রিকায় ছাপা হওয়া এক সাক্ষাৎকারে– যেটি আমি নিয়েছিলাম– শিরিন বলেছিলেন, "দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ অনেক বছর। কিন্তু সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, কষ্ট-যন্ত্রণায় ভরা সেই দিনগুলো আজও আমাকে উতলা করে, এখনও শক্তি ও সাহস দেয়। মনে পড়ে আমার কুষ্টিয়ার পথে দেখা এক ভাইয়ের কথা, যিনি পুরুষের সাজে যুদ্ধ করেছি জেনে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, 'আর আমাদের কোনো ভয় নেই। মেয়েরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে।'"

শিরিন বানু মিতিল আজ নেই। কিন্তু তাঁর দুঃসাহসী কাজ, সাধনা ও নিষ্ঠা এ দেশের নারীআন্দোলনের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর মানবিক ও বীরত্বপূর্ণ কর্মপ্রবাহ মেয়েদের চিরদিন উৎসাহিত করবে।