তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র

শারমিন আহমদ
Published : 23 July 2016, 03:55 AM
Updated : 23 July 2016, 03:55 AM

মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল কাণ্ডারী, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ২৩ জুলাই, ১৯২৫। গাজীপুর জেলার, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী, শাল-গজারীর বনে ঘেরা দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই ক্ষণজন্মা বিশাল নেতা ও মানুষ তাজউদ্দীন আহমদকে ভালোমতো না জানলে বাংলাদেশের ইতিহাস জানাও অপূর্ণ রয়ে যাবে। আকাশপ্রমাণ প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি কেমন করে মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস জানা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন এই মিতভাষী, দূরদর্শী ও প্রচারবিমুখ মানুষটি তিলে তিলে কী করে নিজেকে খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন সেই ইতিহাসও।

খাঁটি মানুষ সে জন যিনি মহৎ উক্তির সঙ্গে মহৎ কাজের সমন্বয় ঘটাতে সদাসচেষ্ট থাকেন এবং আত্মমূল্যায়নের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির সংগ্রাম আজীবন অব্যাহত রাখেন। হিমালয়প্রমাণ খ্যাতি, ক্ষমতা ও সাফল্যের শিখরে উন্নীত হয়েও যিনি কোনো অখ্যাত, ক্ষুদ্র ও দীন মানুষের অব্যক্ত যন্ত্রণার খোঁজ রাখেন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আত্মত্যাগে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না– তিনিই খাঁটি, বিশুদ্ধ মানুষ।

বিশুদ্ধ পানির অভাবে যেমন চারদিকে রোগ ছড়ায় ও মৃত্যু ঘটে, তেমনি বিশুদ্ধ মানুষের অভাবে সমাজে পচন ধরে ও এক সময় সমাজেরও মৃত্যু ঘটে। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম এবং বুদ্ধিজীবীরা যদি দিকভ্রান্ত হন তখুনি ত্বরান্বিত হয় সমাজের পতন। দূরদর্শী তাজউদ্দীন আহমদ তরুণদের বিষয়টি বিশেষ করে ভাবতেন।

আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে (২০ জানুয়ারি, ১৯৭৪) আড়াই ঘণ্টার অসাধারণ বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন:

"যুবকদের সমন্ধে বঙ্গবন্ধুকে কিছু বলে যাই। কৈশোর থেকে যৌবনে যে পা দেয় তার জন্যে কী ব্যবস্থা? আগের লোকসংখ্যার জন্যে ঢাকায় যে স্কুল-কলেজ ছিল, ব্যায়ামাগার ছিল, বর্তমানে তা কি বাড়ছে না কমছে? মতিঝিল দিলকুশা এলাকায় জিপিও হয়েছে। ঐ পুরো এলাকা তো খালি ছিল। ছোটবেলায় আমরা ওখানে খেলাধুলা করেছি। একেকটা স্কুলের জন্যে একেকটা খেলার মাঠ ছিল। কলেজগুলোরও খেলার মাঠ ছিল। বর্তমানে লোক বেড়েছে, সন্তান-সন্ততি বেড়েছে, খালি জায়গায় ইমারত হয়েছে, বাড়ি-ঘর হয়েছে। মানুষের তুলনায় যেখানে মাঠ-ঘাট বৃদ্ধি পাওয়ার কথা, সেখানে কমে গেছে। আগে কলেজগুলিতে যে বিল্ডিং ছিল, সেখানে পঞ্চাশ জনের বসার স্থান ছিল। এখনও ঐ পঞ্চাশ জনেরই স্থান আছে অথচ ছাত্রসংখ্যা পঞ্চাশ জনের জায়গায় এক হাজার হয়েছে।''

''যুবকদের পড়াশোনার সাথে মন ও মননশীলতা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। পাঠাগারের সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে। খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি ঢাকা শহরের কথা বলছি– সঙ্গে সঙ্গে সব জেলা, ও মহকুমা সদর দপ্তর এবং অন্যন্য ঘনবসতি এলাকায় পাঠাগার ও খেলার মাঠ গড়ে তুলতে হবে।''

''বঙ্গবন্ধু, আপনি হুকুম দিয়ে দিন, ঢাকায় এক মাইল লম্বা আধ মাইল প্রশস্ত একটা জায়গা নিয়ে ছেলেদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করে দিন। নিষ্কলুষ আনন্দ লাভের সুযোগ করে দিন। না হলে এরা ফুটপাতে ঘুরে বেড়াবে। ঘুরে বেরালে কী হতে পারে চিন্তা করে দেখুন। হাত শুধু পকেটেই যাবে না, নানান দিকে যাবে। কাজেই যুবকদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন ভবিষ্যতে সোনার বাংলার যুবক হিসেবে তারা গড়ে ওঠে।"

তাজউদ্দীন আহমদ ইন্টারনেট প্রযুক্তির জন্ম ও বিস্ফোরন দেখে যেতে পারেননি। তাহলে হয়তো প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের শিক্ষার কথাও উল্লেখ করতেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে তিনি যা বলেছিলেন তা সর্বকালের জন্যই প্রযোজ্য। প্রকৃতির সান্নিধ্য ও বাইরে খেলাধুলা হতে বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে যে মানসিক ও শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত।

তাজউদ্দীন আহমদের ছাত্রজীবনে লেখা দিনলিপির মধ্যে ইতিহাস-অনুসন্ধানীরা খুঁজে পাবেন সময়ের চাইতে অগ্রগামী, গভীর চিন্তাশীল, রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজসেবক এক মেধাবী তরুণকে। তিনি মিশছেন সব ধর্মমতশ্রেণির মানুষের সঙ্গে। ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে তিনি যুক্ত করছেন মানবসেবার সঙ্গে। জুম্মার নামাজে তিনি ইমামতি করছেন, মাদ্রাসার সভায় সভাপতিত্ব করছেন এবং একই সঙ্গে লড়ছেন নিঃস্ব, অসহায় ও আর্ত মানুষের অধিকার রক্ষায়।

এতিমখানার দুস্থ ছাত্রদের অধিকার আদায়ের পক্ষে ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তরুণ তাজউদ্দীন রুখে দাঁড়াচ্ছেন, বন বিভাগের কর্মচারীদের ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মাসুলরুপে হাজত খাটছেন, রেল স্টেশনে পড়ে থাকা অচেনা মৃতসম এক বৃদ্ধাকে রক্ষার জন্যে ছুটছেন হাসপাতাল ও রেল কর্তৃপক্ষর কাছে, সামান্য ত্রুটি হলে নিজেকেও ছেড়ে কথা বলছেন না।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের হাতে ইসলাম ধর্মের অপব্যবহারে তিনি চিন্তা করেছিলেন এমন এক নতুন রাষ্ট্রের কথা যেখানে সব ধর্মের মানুষদের নিরাপত্তা ও সমঅধিকার থাকবে। বিজয়ী বাংলাদেশের মাটিতে, সচিবালয় প্রাঙ্গনে (২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১) তিনি যুগান্তকারী বক্তব্যে বলেছিলেন:

''শহীদের রক্তে বাংলাদেশের সবুজ মাটি লাল হয়েছে। শহীদের রক্তে উর্বর মাটিতে উৎপন্ন ফসল ভোগ করবে গরিব চাষী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ। কোনো শোষক, জালেম ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাংলাদেশকে শোষণ করতে পারবে না। বাংলাদেশ একটি বিপ্লবী জাতি। যারা প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন, তাদেরকে বৈপ্লবিক চেতনা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে এবং পুরনো দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করে সাম্যবাদী অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ কায়েম করা যখন সম্ভব হবে তখুনি বিপ্লব সম্পূর্ণ হবে।"

ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়, বরং বাংলাদেশে সব ধর্মের সমান অধিকার এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা হবে রাষ্ট্রের লক্ষ্য।

তাজউদ্দীন আহমদের বিপ্লব এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। দেশগড়ার বৈপ্লবিক কাজ করবার জন্যে প্রয়োজন হয় বিশুদ্ধ মানুষের, যারা গড়বেন সোনার সন্তান; শান্তির দেশ। তাঁর জন্মদিনে, আলোকিত পথের দিশারী নতুন শিশু জন্ম নিক, এই প্রার্থনা করি।

সহায়ক গ্রন্থ:

তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে

সম্পাদনা: সিমিন হোসেন রিমি; ঢাকা: প্রতিভাস, বাংলা ১৪০৭

তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা

শারমিন আহমদ; ঢাকা: ঐতিহ্য, ২০১৪

Last Child in the Woods

Richard Louv; USA: Workman Publishing Company, 2005