অন্ধ পশ্চিম-বিদ্বেষ স্খলনের সময় এসেছে এখন

মোজাম্মেল খানমোজাম্মেল খান
Published : 22 July 2016, 02:32 PM
Updated : 22 July 2016, 02:32 PM

আজকাল আপনি আপনার বন্ধু বা পরিচিতদের সঙ্গে ড্রইংরুমে বা অন্য কোনো মজলিসে মিলিত হলে স্বাভাবিকভাবেই আলাপের বিষয়বস্তু হবে বিশ্বজুড়ে যা ঘটছে সেই ঘটনাপ্রবাহ। যদি অংশগ্রহণকারীরা সবাই মুসলিম পরিবারের হন তবে তারা পূর্বসিদ্ধান্ত নেবেন যে, পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাদের প্রো-ইসরাইল নীতির কারণে মুসলিম তরুণদের মস্তিস্কে যে মারাত্মক ঘৃণার উদ্ভব ঘটেছে তারই বহিঃপ্রকাশ এসব। তাদের অকাট্য যুক্তি এটাই যে, ঘৃণা পশ্চিমা দেশসমূহের মাটিতে বা পূর্বদেশগুলোর ভূখণ্ডে পশ্চিমের মানুষের প্রতি জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করার জন্য মুসলিম তরুণদের আত্মঘাতী সংঘর্ষে প্রেরণা যোগাচ্ছে।

পশ্চিমের প্রতি এ ড্রইংরুম-বিদ্বেষ দেশে-বিদেশে বিশেষ করে মুসলিম বংশোদ্ভূতদের পরিবারে নিরন্তর চলছে। আমাদের দেশে কাউকে বুদ্ধিজীবী বিবেচনা করা হয় না যতক্ষণ না তিনি তিনি পশ্চিমের প্রতি তুচ্ছতা-সূচক বাক্য প্রকাশ করেন। কিছু ক্ষেত্রে তাদের অসন্তুষ্টি আঙ্গুর ফল টকের মতন! যারা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের কাছে সেখানকার সব কিছুই 'কুশ্রী'।

এছাড়াও মুসলিম দেশসমূহের স্কুল বা বাড়িতে শিশুদের এমন একটা ধারণা দেওয়া হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের দুর্দশার জন্য একমাত্র দায়ী, যদিও প্রায় প্রত্যেক মাতাপিতার স্বপ্ন থাকে সেই দেশেই তাদের সন্তানদের পাঠানোর। সুতরাং মুসলিম শিশুদের মানসিকতা হয় এমন যে, যুক্তরাষ্ট্রই মুসলিম বিশ্বের জন্য 'খলনায়ক'। যদিও আমাদের গ্রহের প্রায় সব মানুষের বিশ্বাস এই যে, সে দেশটি এখনও অধ্যয়ন এবং বসতি স্থাপন করার জন্য সবচেয়ে ঈপ্সিত ভূমি।

কিন্তু বাস্তবে, পশ্চিম বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কি অশুভ? ওই সব দেশের জনগণ কি সত্যি মনুষ্যত্ব-বিবর্জিত? পশ্চিমা মূল্যবোধ কি এতটাই নিম্নমানের?

আমার ক্লাসে অনেকবার আমি আমার ছাত্রছাত্রী, যাদের কানাডায় জন্ম হয়নি, তাদেরকে বলি, 'তুমি যদি তোমার নিজের ইচ্ছায় বা তোমার বাবা-মার ইচ্ছায় এ দেশে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাক, তাহলে এদেশের সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে জেনেশুনেই এখানে এসেছ। তাই তুমি সে ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছ। যারা এই দেশে জন্মগ্রহণ করছে তাদের অভিযোগের সব নৈতিক অধিকার রয়েছে, যেহেতু তাদের কাছে পছন্দ করার বিকল্প কিছু ছিল না।'

প্রত্যেক সমাজে উভয়ই, ভালো এবং খারাপ মানুষ আছে। পশ্চিমও এর ব্যতিক্রম নয়। আমি পাশ্চাত্যে নিজের মাতৃভূমির চেয়েও বেশি দিন বসবাস করেছি। সেখানে অন্যান্য দেশের তুলনায় আরও সহনশীল, সংবেদনশীল অনেক মানুষ বাস করেন। আমার কয়েকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।

১৯৭৪ সালে, যখন বাংলাদেশ বিধ্বংসী বন্যায় প্লাবিত, আমি তখন প্রায় এক লক্ষ মানুষ অধ্যুষিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থাকতাম। শহরের বেশ কটি খ্রিস্টান মানবপ্রেমিক সংগঠন আমার উপস্থিতি জানতে পেরে আমাকে তাদের চার্চে আমন্ত্রণ জানায়, তাদেরকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার অনুরোধ জানিয়ে। আমার কাছে সেটা শোনার পর গির্জার উপাসকমণ্ডলী মুক্ত হস্তে মুক্ত মনে বাংলাদেশের মানুষের জন্য দান করেন।

এই মানবতার সেবকেরা খুব ভালো করে জানতেন যে, বাংলাদেশের জনগণ তাদের মতো খ্রিস্টান নন। সেটা তাদের দানের স্পৃহা দমাতে পারেনি।

এক বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্রিস্টান জনহিতৈষী দ্বারা পরিচালিত কসমোপলিটন ক্লাব নামের একটি ক্লাব আমিসহ দশ বিদেশি শিক্ষার্খীকে (এক তরুণ তিউনিশিয়ান দম্পতিসহ আমরা সবাই ছিলাম মুসলিম) ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের একটি ছিমছাম শহরে কয়েকটি স্থানীয় পরিবারের সঙ্গে উইকএন্ডে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। গ্রামীণ আবহের ওই শহরে ছিল প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস। আমাদেরকে মার্কিন জীবনাচারের সঙ্গে পরিচিত করাতেই ছিল সে উদ্যোগ।

আমি সুযোগ পাই এক বৃদ্ধ দম্পতির বাড়িতে থাকার। ভদ্রলোক ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক যিনি এশিয়ায় যুদ্ধ করেছিলেন। আমার সেখানে দুদিন অবস্থানকালে তাঁরা যতভাবে সম্ভব আমার বসবাস মনোরম করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা সব সময় আমার কাছে জানতে চান বাংলাদেশ ও তার জনগণ সম্পর্কে। রবিবার সকালে আমাদের সবাইকে স্থানীয় চার্চে নিয়ে গেলেন উদ্যোক্তারা। না, আমাদেরকে খ্রিস্টান ধর্ম শেখাতে নয়– আমরা ওই পরিবারগুলোর সঙ্গে থাকায় তাদের যে অনুভূতি সেটা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে।

পাদ্রী সাহেব ধর্মোপদেশ (যেখানে আমরা সম্মিলিতভাবে যাজক দ্বারা উল্লিখিত হলাম) শেষে আমাদের প্রত্যেকের হোস্ট পরিবারগেুলোকে তাদের সে সপ্তাহের সুখ বা দুঃখের ঘটনা ভাগ করতে আহ্বান জানালেন। যখন আমার হোস্ট পরিবারের পালা এল, আমার হোস্ট ভদ্রমহিলা বললেন, "এটা আমাদের জন্য বড় আনন্দের যে, মোজাম্মেল, বাংলাদেশ থেকে আসা এক যুবক, আমাদের সঙ্গে অবস্থান করছে। আমি এ আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। সে এক সুন্দর যুবক যে একটি বিস্ময়কর দেশ থেকে এসেছে।''

ওখান থেকে ফেরার আগে ওই দম্পতি বাংলাদেশে আমার পিতামাতার মেইলিং ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলেন এবং তাঁরা তাদেরকে লিখতে পারেন কি না সে বিষয়ে অনুমতি চাইলেন। পরবর্তীকালে আমি আমার বাবার কাছ থেকে জানলাম যে, ওঁরা তাঁকে লিখেছিলেন যাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি ছিল এ রকম, "আপনার পুত্রকে নিয়ে আপনার গর্ব করার যথেষ্ট কারণ আছে, যে আমেরিকাতে কঠোর পরিশ্রম করছে।"

প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই যে, আমরা ওই দশ মুসলমান তরুণের উপস্থিতির কারণে সেদিন তাদের এ ছোট সম্প্রদায়ের গির্জার পবিত্রতায় কোনো হানি ঘটেনি।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে রয়েছে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। অন্যান্য দেশের প্রতি তাদের নীতি রাজনীতিবিদদের ঠিক করেন। কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতার মসনদে আছে তার ভিত্তিতে নীতিগুলো সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। টরন্টো-১৮ নামে পরিচিত একটি সন্ত্রাসী দল, যাদের সবাই কানাডিয়ান মুসলিম, কানাডার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৯/১১ কায়দায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। কানাডার আরসিএমপি (আমেরিকান এফবিআইএর মতন) তাদের পরিকল্পনা জানতে পেরে এক অভিযানে তাদেরকে বন্দী করে সেটা বানচাল করে দেয়।

দশ বছর আগের এ ষড়যন্ত্র এবং দুই বছর আগে কানাডিয়ান পার্লামেন্ট ভবনে মুসলিম তরুণদের দ্বারা এক আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রেক্ষিতে, পূর্ববর্তী কনজারভেটিভ সরকার বিল সি-২৪ পাস করে। এ বিল সুচতুরভাবে মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করেই তৈরি করা। তবে বর্তমান উদারনৈতিক দলের সরকার জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বে ঐ বিল বিলোপ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালায়। ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক নতুন বিল সি-৬ পাশ করে সি-২৪এর খারাপ ধারাগুলো বিলোপ করেছে এ সরকার।

রক্ষণশীল সরকারের উপরে উল্লিখিত আইন প্রণয়নের উদ্যোগ ছাড়া (যা এখন বিলুপ্ত) কানাডায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়নি কখনও। অনেকে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের নীতির প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু আমাদের এটা ভুললে চলবে না যে, সেদিনের যুক্তরাষ্ট্রে নিক্সনদের চাইতে কেনেডিদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ঢাকার তখনকার মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের সেই বিখ্যাত টেলিগ্রামের কথাও মনে রাখতে হবে।

বছরের পর বছর হাজার হাজার মুসলিম ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন এবং তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর ছাত্রছাত্রী ছাড়া এ শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই নিজের দেশে ফেরত যাননি। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অবস্থান ভালো ক্যারিয়ার ও উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র যত না উপকৃত হয়েছে তাদের দ্বারা, তারা নিজেরাই তার চেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন।

কিন্তু যারা তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত বা অন্যত্র চলে গেছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের জীবন-পদ্ধতি বা মূল্যবোধ পছন্দ করেননি তা নয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বাঙালি, যিনি একটি খুব সুন্দর চাকরি ছেড়ে তাঁর মাতৃভূমির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে গেছেন, তিনি আমাদের সুপরিচিত ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। আমি কখনও তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতে শুনিনি।

আমি একটি শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক বছরের জন্য অনুষদ হিসেবে কাজ করার পর পেট্রোডলার আয়ের জন্য একটি আরব দেশে চলে যাই। বাবা-মায়ের পকেট থেকে একটি পয়সাও খরচ না করে আমি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা অর্জন করেছি। আমার প্রতি এ বদান্যতার জন্য দেশটির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কখনও কার্পণ্য করিনি।

১৪ জুলাই রাতে যখন ফ্রান্সের নিস শহরের হত্যাযজ্ঞের খবর আমার গাড়ির রেডিওতে এল, গাড়ি চালানো অবস্থায় পাশে বসা স্ত্রীকে বললাম, "আস, নিশ্বাস ধরে রাখি; আশা করি হত্যাকারী যেন মুসলিম না হয়।''

একই ঘটনা ঘটেছিল যখন আমরা অরল্যান্ডো হত্যাযজ্ঞের খবর পেলাম তখনও। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে একই ধরনের ঘটনা ঘটার পর কেউ যদি পশ্চিমের উদারতা ভোগ করা মানুষদের প্রতি আঙুল তুলে বলেন যে, 'মুসলমানরা এটা ঘটিয়েছে'– তাহলে তাদের কি খুব দোষ দেওয়া যায়?

পশ্চিমে মুসলমানদের দ্বারা নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কয়েকটি দৃষ্টান্তের পরও সেখানকার সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলা যেতে পার এটাই যে, তা মোটামুটি পরিমিত। হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিশোধমুলক বক্তব্যের বাইরে মোটের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া সমস্যা বোঝার স্পৃহা বলেই মনে হয়েছে।

বিপরীত চিত্রটি কল্পনা করে দেখুন তো। কোনো মুসলিম অধ্যুষিত দেশে যদি কোনো খ্রিস্টান, যিনি কোনো পশ্চিমা দেশ থেকে ঐ মুসলিম দেশে অভিবাসিত হয়েছেন, তিনি একদিনে ৫৩ বা ৮৪ জন মানুষকে হত্যা করলেন, যাদের অধিকাংশই মুসলিম। তাহলে সে দেশে খ্রিস্টানদের প্রতি প্রতিক্রিয়া কতটা হিংস্র হত সেটা সহজেই অনুমেয়।

মুসলমানদের এই কঠিন সত্যের সঙ্গে সন্ধি করার সময় এসেছে এখন।