গুলশান হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গিবাদের রাজনীতি

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 21 July 2016, 11:04 AM
Updated : 21 July 2016, 11:04 AM

ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনবার পরিণতি কত বীভৎস রূপ নিতে পারে তার একটি উদাহরণ হল রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন, অচিন্ত্যনীয় ভয়াবহ সন্ত্রাসী ঘটনাটি।

গুলশানে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাস কি নিছক নৈরাজ্যবাদী সন্ত্রাস, নাকি এটি একটি বিশেষ রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিফলন? এর রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই-বা কী? জঙ্গি সন্ত্রাসীরা কি শুধু অপার্থিব লোভেই সন্ত্রাসী হামলা করছে, নাকি এ পৃথিবীতেই তারা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়? তা-ই যদি চায় তাহলে সেটি কী?

জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে এক ধরনের মতবাদ, যার সঙ্গে রাজনীতির প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাহলে গুলশান বা শোলাকিয়াতে যে জঙ্গিবাদী হামলা হল, সেগুলো কোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত? এর সূচনা হয়েছিল কীভাবে? শুরুতে এ রাজনীতির রূপটাই-বা কী ছিল?

প্রথমেই চোখ ফেরানো যাক আক্রমণকারীদের রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিকে। জঙ্গিবাদীদের রাজনৈতিক লক্ষ্য দুটি। একটি হল আশু লক্ষ্য; আরেকটি হল দূরবর্তী লক্ষ্য। আশু লক্ষ্যটি ভৌগলিক সীমার মাঝে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দূরবর্তী লক্ষ্যটি ভৌগলিক সীমার বাইরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আশু লক্ষ্যটি হল ইসলামিক স্টেট বা আইএস শরিয়া আইনকে যেভাবে ব্যাখা করে, বাংলাদেশকে সে অনুযায়ী শরিয়াভিত্তিক, ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করা। দূরবর্তী লক্ষ্যটি হল প্রথমে মুসলিমপ্রধান দেশগুলিকে একত্র করে এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বে খিলাফাহ বা খিলাফাত কায়েম।

লক্ষণীয় বিষয় হল, বাম রাজনীতির লক্ষ্য-পদ্ধতির সঙ্গে শুধুমাত্র ধারণাগুলি প্রতিস্থাপন করলে জঙ্গিবাদী রাজনীতির অদ্ভুত মিল পরিলক্ষিত হয়। যে কোনো দেশে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর আশু লক্ষ্য হল নিজ নিজ দেশে সমাজতন্ত্র এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সারা পৃথিবীতে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা।

জঙ্গিবাদী রাজনীতির কল্পনায় বিশ্ব-ইতিহাসের বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপ হচ্ছে খিলাফাহ; অন্যদিকে বাম রাজনীতির কল্পনায় কমিউনিজম হচ্ছে বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপ। এ দুই রাজনীতির ইউটোপীয় কল্পনায় খিলাফাহ এবং কমিউনিজমে মানুষ সুখে-সাচ্ছন্দ্যে বাস করবে। তাদের কোনো দুঃখ, কষ্ট, অভাব, অভিযোগ থাকবে না। বাম রাজনীতির লক্ষ্য ও কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে জঙ্গিবাদী রাজনীতির এত মিলের কারণটাই-বা কী?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে জঙ্গিবাদী রাজনীতির আদি স্বরূপটির দিকে। আমরা জানি সময়ের বিবর্তনে যে কোনো রাজনীতি তার স্বরূপ পরিবর্তন করে। কিন্তু তার বর্তমান রূপ বুঝবার জন্য তার আদি স্বরূপ বোঝা খুব জরুরি। তাহলে বুঝা যাবে দুধারার রাজনীতির সাযুজ্যের কারণগুলো।

শুরুটা হয়েছিল মিসরে হাসান আল বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব আর আমাদের এ অঞ্চলে সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর হাত ধরে। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না এটা বুঝতে পেরে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে তারা ধর্মের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের প্রক্রিয়া বের করলেন– পাশ্চাত্য যার নাম দিল 'রাজনৈতিক ইসলাম', 'ইসলামি মৌলবাদ', 'ইসলামিজম' ইত্যাদি।

'ইসলামিজম' বা 'রাজনৈতিক ইসলাম' তার আদর্শগত প্রেরণা পেল কোথা থেকে? বান্না, কুতুব আর মওদুদী, সবার আদর্শগত গুরু হলেন বর্তমান সৌদি আরবের নাজদ অঞ্চলের অষ্টাদশ শতাব্দীর ধর্মপ্রচারক এবং ইসলামিক পণ্ডিত মোহাম্মদ ইবন আবদ-আল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৯২)। তিনি ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল প্রবর্তিত হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। চার সুন্নি মাজহাবের মধ্যে সবচেয়ে কম জনগোষ্ঠী এ মাজহাবের অনুসরণ করেন। ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, চারটি মাজহাবের মধ্যে হাম্বলি মাজহাব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি রক্ষণশীল।

এ রক্ষণশীলতায় নতুন মাত্রা দেন ইবন তাইমিয়া (১২৬৩-১৩২৮)। হাম্বলি মাজহাবের উপর নির্ভর করে তিনি যেটিকে কোরান ও সুন্নাহর আদি ব্যাখ্যা মনে করেছেন, সেভাবে ইসলামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চিরকুমার ইবন তাইমিয়া সারা জীবন কোরান ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন যার জন্য ইবন তাইমিয়াকে প্রায় বার বছরের বন্দীজীবনও কাটাতে হয়।

ইবন তাইমিয়া ইসলামের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেখানে জেহাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিধর্মীরা শরিয়ার শাসন মেনে না নেওয়া পর্যন্ত জেহাদ করবার কথা বলেছেন তিনি। তাইমিয়ার সমসাময়িক মালিকি এবং শাফিয়ি মাজহাবের অনুসারী চিন্তাবিদরা ইবন তাইমিয়ার ইসলামি ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাঁর অনেক চিন্তা ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন।

কিন্তু মোহাম্মদ ইবন আবদ-আল ওয়াহাব ইবন তাইমিয়ার ইসলামের ব্যাখ্যার প্রতি শুধু আকৃষ্টই হলেন তা নয়, তিনি তাইমিয়ার রক্ষণশীল চিন্তাগুলোর আরও রক্ষণশীল বিকাশ ঘটান। ক্ষমতাশালী মোহাম্মদ বিন সৌদের সহযোগিতায় কাজটা করেন তিনি। এ সৌদ পরিবার ১৯৩২ সালে আরব ভূখণ্ডটি সৌদি আরব (নিজেদের নামে) ঘোষণা করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তারা ওয়াহাবিবাদের আলোকে রাষ্ট্রপরিচালনার উদ্যোগ নেন।

বস্তুত মোহাম্মদ ইবন আবদ-আল ওয়াহাবের সময় থেকেই সৌদ পরিবার তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আনুগত্য ওয়াহাবিবাদের প্রতি দেখিয়ে এসেছে। পরবর্তীতে তেলসম্পদ আবিষ্কৃত হবার পর থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ ব্যয় করে আসছে এ মতবাদের প্রসারের জন্য।

বান্না, কুতুব, মওদুদী যখন রাজনীতির মাঠে এলেন, সময়টা তখন উপনিবেশবাদী, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রাজনীতি হিসেবে বাম রাজনীতির বিকাশ-পর্ব। ইতোমধ্যে মিসরের মতো অতি রক্ষণশীল সমাজ থেকে উঠে আসা যুক্তরাষ্ট্র-ফেরত কুতুবের কাছে পাশ্চাত্যের সমাজ– যেখানে রাষ্ট্র ও পরিবারে নারীরা অধিক ভূমিকা পালন করতে পারেন– পাপাচারপূর্ণ সমাজ বলে প্রতীয়মান হল। কুতুব বেড়ে উঠেছিলেন এমন এক সমাজে যেখানে তিনি নারীকে অতি-অধস্তন, পরাধীন অবস্থায় দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন।

তৎকালীন সমাজব্যবস্থার নিরিখে মার্কিন নারীরা বর্তমান সময়ের থেকে অনেক পিছিয়ে। তবু তার মনে হল, সে সমাজও নারীর যৌন স্বাধীনতানির্ভর, অস্বাভাবিক। ফলে তিনি পড়াশুনা শেষ না করেই দেশে ফিরে গেলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, আজকের বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনান্য প্রান্তের মুসলিমপ্রধান দেশের ছেলেমেয়েরা যে শ্রেণিতেই বেড়ে উঠুক না কেন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অধস্তন অবস্থা দেখে বড় হয়। এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া এই তরুণরা পড়াশোনার উদ্দেশে বা অভিবাসী হয়ে পাশ্চাত্যে এসে প্রথমে যে বিষয়টাতে ধাক্কা খায় সেটি হল, তুলনামূলকভাবে নারীর অধিক স্বাধীনতা ও গতিশীলতা।

পাশ্চাত্য সমাজ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বা ভাসাভাসা ধারণা নিয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়তে চলে আসা প্রাচ্যের সমাজের এই তরুণরা দেখে নারীর চলাচলের, কর্মের, পোশাকের ও যৌনতার স্বাধীনতা; সর্বোপরি তার নিজের শরীরের উপর নিজের পূর্ণ অধিকার। নিজের দেশে রেখে আসা সমাজের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নারীর এ গতিময়তা মেলাতে পারে না তারা।

এর ফলে তাদের মনোজগতে বিচিত্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, যেটা কুতুবের মাঝেও হয়েছিল। এর একটা দিক হল, তারা একদিকে নিজেদের পাশ্চাত্যের পরিচিতি নিয়ে গর্ব বোধ করে; কিন্তু এ পরিচিতির সঙ্গে যখন নারীর স্বাধীনতা প্রশ্নটি চলে আসে, তখন প্রাচ্যের মুসলমান সমাজ থেকে আসা বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর পক্ষে এটি মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

তরুণদের এই মানসিক দ্বন্দ্বের দিকটি কাজে লাগিয়েই ওয়াহাবি ও সালাফিপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো– যারা প্রায়ই অরাজনৈতিক সংগঠনের ছদ্মাবরণে কাজ করে– অভিবাসী কমিউনিটিগুলি থেকে সদস্য সংগ্রহ করে থাকে।

বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতেও তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির সঙ্গে এ সমস্ত দেশের তরুণ সমাজের যোগাযোগের ফলে তাদের একাংশের মননে নারীর আপেক্ষিক স্বাধীনতার ভূমিকা এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির যে বিষয়টা তাদেরকে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন করে তোলে তা হল, ওই সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহ মুসলিম সমাজে নারীর অধস্তন ভূমিকা-নির্ভর পারিবারিক প্রথার অবসান ঘটাতে পারে।

জঙ্গিবাদী তরুণদের মূল ক্ষোভের জায়গাটি যে নারীদের এই আপেক্ষিক স্বাধীনতা উপর– যেটি তারা মনে করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির 'আগ্রাসনের ফল'– সেটি সেদিন গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে পুরুষদের তুলনায় নারীদের অধিক নৃশংশভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। বস্তুত, এ ক্ষোভ ও ভীতিবোধ তাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট করে।

এমনটি ঘটেছিল সাইয়্যেদ কুতুবের বেলায়। তিনি চরম রক্ষণশীল ওয়াহাবি মতবাদের মাঝে 'আসল' ইসলাম খুঁজে পান এবং বান্নাকে সঙ্গে নিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুড গঠন করেন।

এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশে অনেকটা সমসাময়িক সময়ে মওদুদীও ওয়াহাবিবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে গড়ে তুলেন জামায়াত-ই-ইসলামী। ওয়াহাবিবাদ ততদিনে আরও অধিক রক্ষণশীল সালাফিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে, বিশেষত ১৯৬০এর পরবর্তী সময় থেকে।

এ মতবাদ অনুযায়ী, যাদেরকে ইসলামের শত্রু মনে করা যায় তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা ইসলামের অন্যতম অনুষঙ্গ। পাশাপাশি, হাম্বলি মাজহাব-নির্ভর হওয়া সত্ত্বেও ওয়াহাবি ও সালাফি মতবাদের কোনো মাজহাবকে স্বীকৃতি না দেবার বিষয়টি কারও কারও কাছে যৌক্তিক মনে হতে থাকে।

জামায়াত ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের কাছে সালাফিবাদ খুব দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং তারা নিজ নিজ দেশে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আশু লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে এগুবার জন্য তারা– তাদের ভাষায়– 'নাস্তিক্যবাদী' কমিউনিজম এবং ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলে মনে করে।

কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য কুতুব ও মওদুদী বাম রাজনীতির প্রতিশব্দগুলোর জায়গায় ইসলামি প্রতিশব্দ ব্যবহার করে বাম সংগঠনগুলোর আলোকে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। তারা বাম মতবাদ প্রতিহত করবার জন্য ইসলাম ধর্মকে মতবাদে রূপান্তর করেন এবং এর ধর্মীয় দিকটি উপেক্ষা করে একে মতবাদ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন।

তখন শীতল যুদ্ধের ঊষাকাল। পাশ্চাত্য তার আদর্শগত শত্রু কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করবার মোক্ষম হাতিয়ার পেল। তারা এর নাম দিল 'রাজনৈতিক ইসলাম'। ফলে পাশ্চাত্যের প্রশ্রয়ে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি হল। পাশ্চাত্য মনে করল, 'রাজনৈতিক ইসলাম' বিকাশ লাভ করলে এ সমস্ত দেশে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা বিকশিত হবে না।

লক্ষণীয় যে, পাশ্চাত্য গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ব্যক্তি এবং বাকস্বাধীনতার ধ্বজাধারী হলেও কমিউনিজম প্রতিরোধ করবার জন্য তারা এমন এক রাজনৈতিক মতবাদ ও এমনধারার রাজনৈতিক দলসমূহকে পৃষ্ঠপোষকতা করল যে মতবাদ ও দলসমূহ মানবাধিকারের আদর্শের পরিপন্থী।

শুরুতে ওয়াহাবি ও সালাফি মতাদর্শ-নির্ভর রাজনৈতিক আন্দোলন 'রাজনৈতিক' থাকলেও আফগানিস্তানের মুজাহিদ, তালেবান, আল-কায়েদা হয়ে আইএসএর হাত ধরে 'রাজনৈতিক ইসলাম' বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয়েছে সন্ত্রাস-নির্ভর, নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনে।

বাম আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাম-কর্মীদের একটি অংশ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করা যাবে না এ বক্তব্য দিয়ে মূল রাজনৈতিক দলগুলো থেকে বেরিয়ে এসে সন্ত্রাস-নির্ভর সংগঠন গড়ে তোলে। বাংলাদেশে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সর্বহারা পার্টি, পশ্চিমবঙ্গে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে নকশালবাড়ী আন্দোলন, সাবেক পশ্চিম জার্মানিতে বাদের-মানোফ, ইতালিতে রেড ব্রিগেড, জাপানে রেড আর্মি ইত্যাদি সন্ত্রাসবাদ-নির্ভর বাম আন্দোলনের বিকাশ দেখতে পাই আমরা।

সেভাবে ওয়াহাবি ও সালাফি মতাদর্শ-নির্ভর নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলির কর্মীদের একটা অংশও আফগানিস্তানের মুজাহিদ বাহিনী গঠনের সময় থেকে মুসলিমপ্রধান দেশসমূহে সন্ত্রাস-নির্ভর সংগঠন গড়ে তুলতে থাকে। তারা যে যুক্তি তুলে ধরে তা হল, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পাশ্চাত্যের মডেলের আলোকে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা 'হারাম'। কারণ এসব ব্যবস্থায় সৃষ্টিকর্তার আইনের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। সুতরাং যে ব্যবস্থা হারাম, সে ব্যবস্থায় অংশগ্রহণও হারাম। ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে, হারাম ব্যবস্থা উচ্ছেদ করতে হবে বলপ্রয়োগ করে।

অপরদিকে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলি মনে করে যে, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে হলে একই সঙ্গে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ এবং প্রয়োজন হলে সন্ত্রাস, এই দুই ধারার উপর নির্ভর করেই এগুতে হবে।

তবে ওয়াহাবি ও সালাফি মতবাদ-নির্ভর সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন এবং মার্কসবাদ ও মাওবাদ-নির্ভর সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মাঝে গুণগত তফাত রয়েছে। ওয়াহাবি ও সালাফি মতবাদ-নির্ভর রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদীরা ইসলাম ও মুসলিমের কথা বললেও তাদের মূল আক্রমণের লক্ষ্য মুসলিমরাই। গত পনের বছরে মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে এদের হাতে নিহত দেড় লাখ মানুষের বেশিরভাগই মুসলিম। Soft-target অর্থাৎ নারী, শিশুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে দুর্বল অংশে আঘাত করা এবং হামলায় নিহতের সংখ্যা যতটা সম্ভব বৃদ্ধি করাই থাকে এসব হামলার উদ্দেশ্য।

অপরদিকে, বাম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর হামলার লক্ষ্য নারী শিশুসহ সমাজের দুর্বল অংশ ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল– তাদের ভাষায় যারা তাদের শ্রেণিশত্রু মনে করে– অর্থাৎ পুলিশ, জোতদার, মজুতদার এবং ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি দলের লোকজন।

মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের উপর ভিত্তি করে যেমন বাম ধারার আন্দোলন বিকশিত হয়েছে, তেমনি 'রাজনৈতিক ইসলাম' বা 'ইসলামিজম' প্রায় পুরোটাই গড়ে উঠেছে ওয়াহাবি ও সালাফি মতবাদের উপর। এ ধারার বাইরে যে সমস্ত 'ইসলামপন্থী' দল গড়ে উঠেছে তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ওয়াহাবি ও সালাফি মতবাদ-নির্ভর জঙ্গিবাদী এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসমূহের মূল লক্ষ্য একটাই; সেটি হল, তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। পার্থক্যের জায়গাটি কেবল উপায়ের ক্ষেত্রে। এক দল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সীমিত সন্ত্রাসবাদের মিশ্রণ ঘটিয়ে সেটি করতে চায়। আরেক দল শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদের উপর নির্ভর করে লক্ষ্যে পৌঁছুতে চাচ্ছে। সুতরাং জঙ্গিবাদ শুধু সন্ত্রাস করে না, তার রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে, সে লক্ষ্য হাসিলের মাধ্যম হিসেবে সন্ত্রাসের উপর নির্ভর করে।

ওদিকে মূলধারার রাজনৈতিক দলসমূহ নিজেদের ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে পরিচয় না দিলেও রাজনীতির প্রয়োজনে নানাভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। তাদের এ কার্যকলাপও জঙ্গিবাদী রাজনীতির বিকাশে নানাভাবে সাহায্য করেছে। এ দলগুলো অনেক সময় 'ধর্ম-নির্ভর' সন্ত্রাসীদের নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে, যা আখেরে এ সমস্ত জঙ্গিদেরই লাভবান করেছে।

আমরা যদি বিশ্ব-ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, একটি বিশেষ সময়ে, বিশেষ স্থানে যে রাজনৈতিক চিন্তাধারা মতাদর্শগতভাবে জনমানসে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে, সে রাজনৈতিক দর্শন তৎকালীন সময়ে জয়লাভ করতে পেরেছে। শুধুমাত্র বলপ্রয়োগ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বা সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে কোনো রাজনৈতিক আদর্শ টিকে থাকতে পারেনি।

সুতরাং সন্ত্রাসবাদের যে রাজনীতি, তার মোকাবেলা আদর্শগতভাবে হতে হবে। সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে বা পিতামাতাকে প্যারেন্টিং-সংক্রান্ত উপদেশ দিয়ে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস মোকাবেলা সম্ভব নয়।