আপনারা কী বলতে চান?

Published : 5 July 2016, 07:24 AM
Updated : 5 July 2016, 07:24 AM

আপনারা কী বলতে চান, কী বোঝাতে চান একটু দয়া করে বলুন তো!

গুলশানে জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত জবাই করা মানুষের দেহ আমরা দেখছি। যারা এভাবে মানুষকে জবাই করেছে তাদের অবয়ব মানুষের হলেও সেটা যে আসলে পিশাচের চেহারা, তাদের হাসি যে আসলে পিশাচের হাসি সেটা বুঝতে আমাদের আর বাকি নেই। এই খুনি নরপিশাচগুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি আমাদের নেই, কারও থাকা উচিত নয়। গুলশান ট্র্যাজেডির পর আমরা অনেক গালগল্প শুনছি এবং ফেইসবুকে অনলাইনে পড়ছি।

কে আগে কত ভালো ছিল, কে কাকে চিংড়ি মাছ দিয়ে ভাত খাওয়াল, কে কাকে কফি খাওয়াল, কে সুরা বলতে পেরে আর হিজাব পরায় রেহাই পেল, দয়া করে সেসব গল্প বাদ দিন। যারা মানুষকে জবাই করতে পারে, যারা অন্তস্বত্ত্বা নারীকে জবাই করতে পারে, তারা দেশ-জাতি-পরিবার-স্বজন সকলের কলঙ্ক, তারা নরপিশাচ। তাদের পাপ কোনোভাবেই লাঘব করা যায় না। বরং বলুন এদের পিশাচ বানাল কারা, কীভাবে, কোন শয়তানে? সেই শয়তানি কারখানার কুশীলব আর নাটের গুরুদের মুখোশ উন্মোচন করুন।

আর নিজের নিজের সন্তানকে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, উগ্রতা, ধর্মান্ধতা থেকে বাঁচান, সুশিক্ষা দিন। নিজে বুঝুন এবং সন্তানকে বুঝান যে, মানুষ খুন করে, মানুষের রক্তের উপর দিয়ে বেহেশতে যাওয়া যায় না। বেহেশত, দুনিয়া কোথাও খুনির কোনো স্থান নেই।

যারা এসব গল্প ছড়াচ্ছেন তাদের উদ্দেশে বলি, যদি আজ প্যারিসে বোমা হামলার মতো ঢাকায় বোমা হামলা করে জঙ্গিরা তখন কি আপনার বলবেন যে, যার মাথায় হিজাব ছিল তার গায়ে বোমার স্প্লিন্টার লাগেনি। যার মাথায় হিজাব ছিল সে গ্রেনেড চার্জ করা সত্ত্বেও বেঁচে গেছে? ধর্মকে আর কত খেলো করবেন? নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না। বোমা বর্ষণ, ব্রাশফায়ারে, মুসলমান, অমুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান, নাসারা, জরথ্রুস্ট, নাস্তিক, আস্তিক, সদাচারী, ব্যাভিচারী, মদ্যপায়ী, দুগ্ধপায়ী সকলেই মরে, সকলের শরীর থেকেই রক্ত বের হয় এবং সকলের রক্তের রং একই রকম লাল।

গল্প-বলিয়ে পণ্ডিতরা, আপনারা কি এই মেসেজ সকলকে দিতে চান যে, হিজাব পর আর সুরা পড়, তাহলে সন্ত্রাসী হামলা থেকে বেঁচে যাবে? মুসলমান আর বাংলাদেশি হলে বাঁচবে আর সাদা চামড়া হলেই মরবে? তাহলে ইশরাত মরল কেন? তাহলে সিরিয়ায় মুসলমানরা মরছে কেন? তাহলে তুরস্কের বিমানবন্দরে হিজাব পরিহিতারা এবং মুসলমানরা মরেছে কেন?

একটা কথা জেনে রাখুন, বুঝে রাখুন, সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই, দেশ নেই। তাদের পরিচয় একটাই, তারা পিশাচ। তারা কে কার ভাই, কে কার ছেলে এটা জানার চেয়ে আগে জানুন তারা মানুষের শত্রু, মানবতার শত্রু।

কে জঙ্গি তৎপরতায় যাবার আগে মায়ের কাছে পাউরুটি খেতে চেয়েছিল, কে পোলাও খেতে চেয়েছিল, তাদের ওইসব ন্যাকামি গল্প আমরা শুনতে চাই না। আমরা শুনতে চাই যারা খুন হল, জবাই হল তাদের কথা। আর অপরাধীদের নেপথ্য লিডারের পরিচয় চাই। আমরা শুনতে চাই, বলতে চাই ভিকটিমদের কথা যাতে মানবতা জেগে ওঠে। আর শুনতে চাই, জানতে চাই কীভাবে এই বিপথুরা জঙ্গি হল, কে তাদের পিশাচ বানাল, কোথা থেকে তারা অস্ত্র পেল, ট্রেনিং পেল। তাদের পারিবারিক শিক্ষাই-বা কেমন?

হত্যাকারীরা তো ভিনগ্রহের নয়। তারা এসেছে এই সমাজেরই কারও না কারও পরিবার থেকে। কোনো না কোনো মায়ের গর্ভে তার জন্ম, কোলে-পিঠে বেড়ে ওঠা। কী শিক্ষা তাহলে আমরা তাদের দিয়েছি? যখন তারা বিপথে গেল, জঙ্গি হয়ে উঠল, ছুরি চালাতে শিখল তখন কোন নেশায়, কোন কালঘুমে মগ্ন ছিলাম আমরা? এই বিষবৃক্ষের শিকড় কত গভীরে?

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আজ সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিষবৃক্ষ ডালপালা মেলছে। ঘরে-ঘরে মগজ ধোলাইয়ের ফাঁদ পাতা হচ্ছে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলিত যে বাঙালি জাতি একদিন এক হয়ে লড়াই করেছে, জন্ম দিয়েছে স্বাধীন দেশের, লাল-সবুজ পতাকার সেই দেশে আজ সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর বিভাজন হচ্ছে। যে দেশের মনীষীরা বলেছেন, আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বড় সত্য আমরা বাঙালি; বলেছেন, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, সেদেশে আজ মন্দিরের পুরোহিত, মঠের সেবক, গির্জার ধর্মগুরুকে হত্যা করা হচ্ছে। চোখের ওপর দেশটা এমন হয়ে গেল কীভাবে?

এমন হয়ে গেল আমাদেরই ভুলে, আমাদেরই অদূরদর্শিতায় আর আমাদেরই পাপে। অন্য ধর্ম বা মতাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণা তৈরিতে পরিবার ও সমাজের ভূমিকাও কম নয়। স্বাধীনতার পর যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল তা পঁচাত্তরের পর থেমে যায়। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকরা দেশকে ধর্মান্ধতার পথে নিয়ে যায় নিজেদের গদি পাকা করার স্বার্থে। আমাদের ভুল হল, নব্বইয়ের পরও আমরা আর সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু না করে, তাকে বেগবান না করে নিজেরা প্রচার, স্বার্থ আর ক্ষমতার মোহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র হয়েছি। গান্ধারীর মতোই আমাদের চোখ আমরা নিজেরাই বেঁধে রেখেছি।

কিন্তু চোখ বন্ধ করে থাকলে তো প্রলয় বন্ধ হয় না। ধর্ম, সংস্কৃতি, সুনীতি কোনোটিরই স্বাভাবিক সুশিক্ষা আমরা সন্তানদের দিতে পারিনি। অবধারিতভাবে আমাদের সন্তানরা বিপথগামী হয়েছে, জাতির পতাকা খামচে ধরা পুরনো শকুনদের খপ্পরে গিয়ে পড়েছে আর তাদের মগজধোলাই হয়ে তারা জঙ্গিতে পরিণত হয়েছে।

আজ তাই ফাহিম, নিব্রাস, রাজীব, মুবাশ্বের, রোহানের মতো তরুণরা খুনি দানবে পরিণত হয়ে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের। নিজেরাও প্রাণ হারাচ্ছে। যে তরুণরা আজ দেশ গঠন করবে, সৃষ্টির স্বপ্নে ব্রতী হবে তারা পরিণত হচ্ছে হত্যাকারী দানবে।

এই তরুণরা তো একদিনে এক লহমায় দানবে পরিণত হয়নি। এরা যখন বিপথে যাচ্ছে, যখন সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের পাঠ নিচ্ছে তখন তাদের বাবা-মায়েরা কি চোখ বন্ধ করে ছিল? কেন তারা দেখেনি সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কার অশুভ প্রভাবে পড়েছে? কেন সুস্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করেনি তাদের?

তারা হাজার হাজার টাকা খরচ করে নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলেকে পাঠিয়ে ভেবেছে সব কর্তব্য পালন করা হয়ে গেল। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই-বা কেমন? কোচিং, প্রশ্ন ফাঁস আর অবৈধ রোজগারের ধান্ধায় মত্ত থেকে তারা দেখেনি তাদের ছাত্ররা মানুষ হচ্ছে না হত্যার যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যায়নীতি, তাদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের ভাইরাস কতটা ছড়িয়েছে সেটাও তো দেখতে হবে।

আর যে অভিভাবকরা নিজেরাই ধর্মান্ধ, নিজেরাই সাম্প্রদায়িক তাদের সন্তান তো জঙ্গি হবেই। নাস্তিকরা যখন খুন হয়েছে আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, কারণ আমি তো নাস্তিক নই। যখন ব্লগার খুন হয়েছে, ভেবেছি আমি তো ব্লগার নই। যখন সমকামীদের অধিকারকর্মী খুন হয়েছে তখনও নিশ্চিন্ত থেকেছি, কারণ আমি তো সমকামী নই, তাদের অধিকারকর্মীও নই। কিন্তু এখন যখন হত্যাযজ্ঞ হচ্ছে রেস্টুরেন্টে? যখন মরছে এবং মারছে আমাদেরই সন্তানরা?

এখনও কি আমরা নিশ্চিন্তে বসে থাকব আর সেহেরি খাওয়ার, কফি খাওয়ার গল্প শুনাব? যারা মানুষকে জবাই করছে তারা কফি খাওয়ালেই-বা কী আর না খাওয়ালেই-বা কী?

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া জঙ্গিবাদের ভাইরাস থেকে বাঁচার একটাই উপায়, মানবতার আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করুন সর্বত্র। নিজের জীবনে, সন্তানের জীবনে, স্কুলে, কলেজে, জাতীয় ও আন্তজার্তিক সকল ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার পতাকা তুলে ধরুন। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই–এই শাশ্বত সত্য তুলে ধরুন।

সেটাই একমাত্র রক্ষাকবচ।