লিবিয়ার ঈদ-আল-ফিতর

আবদুস সেলিমআবদুস সেলিম
Published : 4 July 2016, 05:27 AM
Updated : 3 May 2022, 03:34 AM


আলোকচিত্র: লিবিয়ায় ঈদের নামাজে অংশগ্রহণকারী

আমি লিবিয়াতে, যতদূর মনে পড়ে, চারটি ঈদ-আল-ফিতর পালন করেছি। সেখানকার ঈদ এবং আমাদের বাংলাদেশের ঈদ পালনে তেমন বেশি তফাত আমি লক্ষ্য করিনি। যেমনটা সারা মুসলিম বিশ্বে হয়, ভোর সকালে গোসল করে পরিচ্ছন্ন বা নতুন কাপড় পরে নামাজ পড়তে যাওয়া, বিশেষ করে খোলা ময়দানে। নামাজটা নিয়ম মাফিক দুই রাকাতের ছয় তকবিরের সাথে। তবে আমি লক্ষ্য করেছি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সময় যেমন তেমনি ঈদের নামাজেও মাথায় টুপি পরার রেয়াজ লিবিয়াতে নেই এবং তারা সাধারণত সুন্নত নামাজ এবং মোনাজাতে তেমন গুরুত্ব দেয় না। এমন চর্চার কথা আমি অন্যান্য আরব দেশেও আছে বলে জেনেছি।

আমরা জানি ঈদ-আল-ফিতর-এর প্রবর্তক ছিলেন মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সাঃ)। অনেকে মনে করেন ঈদ উৎসবের সূচনা মহানবীর মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরতের পর থেকে। তাঁর অতি পরিচিত সহচর আনাস বলছেন, মহানবী মদিনাতে এসে দেখেন সেখানকার সবাই নির্দিস্ট দুটি দিন উৎসব হিসেবে পালন করে। সেটা দেখে হজরত ঘোষণা করেন আল্লাহ সব মুসলিমদের জন্য দুটি দিন উৎসবের জন্য ধার্য করেছেন আর সে দুটি দিন হলো—ইদ-আল-ফিতর এবং ঈদ-আল-আযহা। এই পরম্পরাতেই সারা মুসলিম বিশ্বে এই দুটি দিন উৎসব করা হয়ে থাকে।

লিবিয়া মুসলিম দেশ হিসাবে, এবং সুন্নিপ্রধান দেশ হিসাবে আমাদের মতই ইদ-আল-ফিতর নামাজ পড়ায় অভ্যস্ত। এটি একটি সরকারি ছূটির দিন এবং সব মুসলিম দেশের মতই এক চন্দ্রমাস সিয়াম সাধনা বা রোজা রাখার পর এই উৎসব পালন করা হয়। যে তফাতটা আমার চোখে পড়েছে সেটা হলো উৎসব পালনের ধরন। আমরা যেমন ঈদে সেমাই, পায়েস ইত্যাদি মিষ্টান্ন করি তেমনি লিবিয়াতেও মিষ্টি প্রস্তুতের প্রচলন আছে এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেসব মিষ্টি তাদের দেশজ ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সাথে সাযুজ্যপুর্ণ, এবং সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। যেমন আসিদা, হালওয়া, দিব্লাহ, মগ্রুদা, বিভিন্ন ধরনের কেক, বাক্লাভা ইত্যাদি। এর ভেতর অনেক মিষ্টান্ন আরব দেশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। লিবিয়াতে অবশ্য অন্যান্য দেশের প্রভাব বেশ, বিশেষ করে ইতালির, কারণ বেশ লম্বা সময় ধরে লিবিয়া ইতালির উপনিবেশ ছিল। এছাড়া নিকটবর্তী দেশ মলটার খাদ্যাভ্যাসও তাদের খাদ্যাভ্যাসের উপর প্রভাব ফেলেছে।


আলোকচিত্র: কুজকুজ খাবার

লিবিয়াতে একটি সুস্বাদু খাবার ঈদে নিয়মিতভবে প্রস্তুত হয় যার নাম কুসকুস। এ খাবারটি পুরো আরব দেশেই প্রচলিত। এছাড়া চাল, মাংস, বাদাম, এবং সময়ে গরু বা খাসির কলিজা মিশ্রণে রুজ বিল-খালতা নামে একটি বিশেষ খাদ্য ঈদে রান্না করা হয়। আরও রয়েছে মুরগির গ্রিল এবং বিভন্ন ধরনের রুটি, যা ওই ইতালিও এবং মলটা প্রভাব-প্রসূত।
লিবিয়াতে ঈদ উৎসবে আমাদের মতোই পারিবারিক সমাবেশ, আত্মীয় পরিজন এবং বন্ধুদের বাড়িতে বেড়ানো, উপহার দেয়ানেয়া—বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের ভেতর—একটি প্রথাগত ব্যাপার। একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, লিবিয়াতে ঈদ বা বিয়ের উৎসবে যা পরিবেশন করা হয় তা আমাদের দেশের মত নয়। তারা অবশ্যই অত্যন্ত অতিথিপরায়ন এবং তারই একটি অনন্য প্রকাশ হলো একটি বিশাল প্লেটে বিভিন্ন খাবার সাজিয়ে খেতে দেয়া হয় এবং বেশ কয়েকজন একসাথে বসে এক প্লেট থেকেই খায়। তথাকথিত সভ্য দেশে এটি তেমন গ্রহণযোগ্য নয় যদিও। এছাড়া লিবিয়রা একই গ্লাসে পর্যায়ক্রমে পানীয়, বিশেষ করে চা, পান করতে পছন্দ করে। তারা মনে করে সব মুসলমান সমান সমান (কুল্লে মুসলিম সোয়াসোয়া)। আমি জেনেছি এটি সমগ্র আরব দেশেরই সংস্কৃতি।


আলোকচিত্র: রুজ বুখারি
লিবিয়াতে, তথা আরব দেশে একটি পুরাতন প্রথা প্রচলিত আছে, যা ইসলাম-পুর্ব সময় থেকেই প্রচলিত ছিল। উৎসবে, বিশেষ করে বিয়ে, জন্মদিন এবং অনেক সময়ই ঈদ উৎসবে আনন্দ প্রকাশের অনুষঙ্গ হিসাবে উলুধ্বনি দেয়া। গ্রামের দিকে লক্ষ্য করেছি ঈদ উৎসবে ঘোড়ার এবং উটের দৌড় প্রতিযোগিতার প্রচলন আছে। এটিও একটি ইসলাম-পুর্ব সংস্কৃতি।

সব মিলিয়ে ঈদ লিবিয়াতে এমন একটি উৎসব যার সাথে অনেকক্ষেত্রেই বিশ্বের সকল আরব এবং মুসলিম দেশের মিল আছে। বিষয়টি অবশ্যই মুসলিম বন্ধুত্বের একটি প্রকাশ। তবে মানতেই হবে ধর্মীয় উৎসবের সাথে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরও একটি সংযোগ থেকেই যায় যাকে অস্বীকার করা অসম্ভব, যেমন আমরা ভাবতেই পারিন না সেমাই, পায়েস, পোলাও বা বিরিয়ানি ছাড়া কোন ঈদ উৎসব হতে পারে। আবার অন্য মুসলিম দেশে এর সবগুলো নাও থাকতে পারে।