কূটনীতিকপাড়ায় হত্যাকাণ্ড: ষড়যন্ত্রের গোড়া কোথায়?

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 2 July 2016, 04:08 PM
Updated : 2 July 2016, 04:08 PM

ঢাকার কূটনীতিকপাড়ার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত 'হলি আর্টিজান' সকালে বেকারি এবং রাতে রেস্তোরাঁ হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল সে এলাকায় বসবাসরত বিদেশি আর তরুণদের মধ্যে। বিবিসি, সিএনএন, এবিসি, রয়টার, এপি, আল জাজিরা-– এমনসব নামি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভাষ্যকারদের কণ্ঠে এ তথ্য প্রচারিত হয়েছে বহুবার।

রমজান মাসে এশার নামাজের আজান হয়ে যাওয়ার পর পর এই শান্তির রেস্তোরাঁয় 'আল্লাহু আকবর' ধ্বনি দিয়ে যে জঙ্গিরা তলোয়ার ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়েছিল, জিম্মি করেছিল দেশি-বিদেশিদের, প্রথম লগ্নেই গ্রেনেড আক্রমণে হত্যা করেছে দুজন কর্তব্যে নিবেদিতপ্রাণ পুলিশ অফিসার ও আহত করেছে চল্লিশের অধিক পুলিশ সদস্য ও নিরীহ পথচারীকে, সেনা অভিযানের বহু পূর্বেই রেস্তোরাঁর ভেতরে জবাই করেছে বিশ জনকে– সেই রক্তাক্ত নারকীয় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়েছে প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠার পর।

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর চৌকশ প্যারা কম্যান্ডোদের সঙ্গে অন্যান্য বাহিনীর সমন্বিত ১৩ মিনিটের ঝটিকা আক্রমণে ছয়জন জঙ্গি নিহত এবং একজন জীবিত ধৃত হয়েছে বলে জানা গেছে। উদ্ধার করা গেছে তের জনকে। বিশ্বজুড়ে প্রতিরক্ষাহীন অসহায় নাগরিকদের উপর জঙ্গি আক্রমণ ও তাদের দমনে সেসব দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রতি-আক্রমণ যা আমরা টিভির পর্দায় দেখে এসেছি এতদিন, তারই অনুরূপ দৃশ্যের রিলে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বাংলাদেশে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত হয়ে বলছি, জঙ্গি আক্রমণ মোকাবেলায় আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহের পারঙ্গমতা পরাক্রমশালী দেশের বাহিনী থেকে কোনো অংশেই কম ছিল না। বেশ কয়েকজনের মূল্যবান জীবন তারা বাঁচাতে পারেননি, কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অসহায় জিম্মিদের উদ্ধারে সমর্থ হয়েছেন। দেশবাসীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ তারা পাবেন।

পুলিশের যে দুজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসার জীবন বিসর্জন দিলেন, তাঁরাও মানুষের অন্তরের ভালোবাসা পাবেন। বিশ্ববাসীর চোখে উদীয়মান বাংলাদেশ জঙ্গি মোকাবেলায় সক্ষমতার এক উজ্জ্বল নজির স্থাপন করল।

পৃথিবীজুড়ে একের পর এক এমন ভয়াবহ আক্রমণের পর বাংলাদেশেও যে তা হতে পারে সে আশঙ্কা ছিল শুধু গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের নয়, সচেতন নাগরিকদেরও। তার কারণও ছিল। যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির দণ্ড ও তা কার্যকর হবার প্রেক্ষাপটে, এই দল এবং নানা নামে সক্রিয় এই দলের জঙ্গি গোষ্ঠী যে চুপচাপ বসে থাকবে না তা তারা প্রদর্শন করছিল একের পর এক গুপ্তহত্যা ঘটিয়ে।

এমন গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত যারাই ধরা পড়েছে, তাদের প্রায় সবার জামায়াত বা শিবির-সংশ্লিষ্টতা তা-ই প্রমাণ করে। উন্মুক্ত রাজপথে রাজনীতির নামে সহিংস কর্মকাণ্ড চালাবার সক্ষমতা তারা আগেই হারিয়ে ফেলেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনমনীয় ও সাহসী নেতৃত্ব এবং তাঁর পেছনে ১৪ দলীয় জোটে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রবল 'না' ও জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার ভ্রান্ত ও আত্মঘাতী রাজনীতির পরাজয়ের কারণে জামায়াত ও তাদের সহযোগী জঙ্গিরা দৌড়ের উপর ছিল। এদের কোমর ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল।

তাই আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের দেশীয় এজেন্ট হয়ে এরা যে গুপ্ত আক্রমণের মরণ-কামড় দেবে তাতে আশ্চর্য কী?

শুধু তাই নয়, সম্প্রতি উত্তরার দিয়াবাড়ি খালে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা গেল ওই এলাকার মানুষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী। রিভলভার ও পিস্তলের সঙ্গে অ্যাসল্ট রাইফেলের বড় ম্যাগাজিন ও গুলি পাওয়া গেলেও ভারী অস্ত্রগুলো পাওয়া যায়নি। অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, বড় ধরনের নাশকতা ঘটাবার জন্যেই এমন অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলছিল জঙ্গিরা। অল্পদিনের ব্যবধানে ঢাকার কূটনীতিপাড়ায় ঘটল তেমন নারকীয় হত্যাকাণ্ড।

সাধারণ মানুষের সহায়তা পাচ্ছে বলেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিদের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে পারছে, যেমনটা আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পেয়েছিলাম একাত্তরে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা নিয়ে। কেন কূটনীতিপাড়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত 'হলি আর্টিজান' রেস্তোরাঁর মতো স্থাপনা, যেখানে বিদেশিরা নিয়মিত যান, তার উপর বিশেষ নজরদারি ছিল না?

কাকতালীয়ভাবে হলেও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন আহমেদের গুলশান থানার এই রেস্তোরাঁয় উপস্থিত থাকায় ও তাঁর সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে তড়িৎ পাল্টা-আক্রমণে যেতে পেরেছিল পুলিশ বাহিনী। জঙ্গিদের গ্রেনেড আক্রমণে তিনি ও মহানগর ডিবির সহকারি কমিশনার রবিউল ইসলামের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে পুলিশের যে প্রতিরোধ-ব্যূহ গড়ে তোলা গেল, তার ফলেই বিদেশিদের জবাই করার পর ঘাতকরা পালিয়ে যেতে পারেনি।

জামায়াত-জঙ্গিদের সাংগঠনিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে পারলেও নাগরিকদের সুরক্ষায় যে তা যথেষ্ট নয়, তা তো খুবই স্পষ্ট। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির ছত্রচ্ছায়া শুধু নয়, খোদ আওয়ামী লীগের নানা প্রশ্রয়ে জামায়াত যে সমাজের সর্বস্তরে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে তাদের স্বীয় অবস্থান এখনও অটুট রেখেছে, তাদের অর্থ-সাম্রাজ্য বহাল তবিয়তে আছে এবং তার ফলে এখনও এই অপশক্তি দেশ ও জনগণের জন্য বড় হুমকি, তা বুঝতে পারছেন না বা ইচ্ছা করেই বুঝতে চা্ছইন না অনেকেই।

তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে নানা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তার পদ অলংকরণের পর জামায়াতি তোষণকে পদে থাকার মূল নীতি করেছেন অনেকে। সুরক্ষা পেয়ে যাচ্ছে জামায়াতি ষড়যন্ত্রকারীরা। নির্বিঘ্নে ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা আঁটতে পারছে তারা।

এর বড় উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিএনপি আমলের উপাচার্য অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজের নিয়োগকৃৎ ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমানের জামায়াত-সংশ্লিষ্টতার কথা বহুল প্রচারিত। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর মহাজোট সরকারের একেবারে শুরুতে উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পরই অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেজিস্ট্রার পদ থেকে এই ব্যক্তিকে সরিয়ে দেবেন, তাই সবাই ভেবেছিলেন।

কিন্তু অবাক বিস্ময়ের কথা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন এমন শিক্ষককুল, পরপর শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ, সিনেটে সদস্যদের সনির্বন্ধ অনুরোধ ও কখনও উচ্চকিত দাবির কোনো মূল্য না দিয়ে দীর্ঘ সাত বছরের উপর এই রেজাউর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রেখেছেন তিনি। দুই টার্মে শিক্ষক সমিতির সম্পাদক, দুবার সভাপতি ও নীল দলের আহ্বায়ক হিসেবে এবং তাঁর একজন সুহৃদ হিসেবে আমার অনুরোধও তিনি রাখেননি। সব সময় তিনি ধারণা দিয়েছেন যে, তাঁর এ কাজে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য পদে ইস্তফা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার পর আমাদের প্রকৌশল বিভাগের অধস্তন কয়েকজন কর্মকর্তা আমাকে জানান একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী যাকে জামায়াতের রোকন হিসেবে সবাই জানে, তিনি উপাচার্য মহোদয়ের খুবই ঘনিষ্ঠ এবং তার কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এমন কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পদোন্নতি আটকে আছে।

আমি আরেফিন সাহেবকে এ ব্যাপারে জানালে তিনি তাতে কোনো গুরুত্বই দেননি। জানলাম, দিন পাঁচেক আগে জামায়াতের এই রোকনকে পদোন্নতি দিয়ে প্রধান প্রকৌশলী করা হয়েছে।

পহেলা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের স্মরণিকায় জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি লেখা কোনো ভুলের কারণে ঘটেনি। রেজাউর রহমান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার পদ থেকে বরখাস্ত হলে তার কিছুই যায় আসে না। অল্পদিনের মধ্যে তিনি অবসরে যাচ্ছেন। দীর্ঘ বছর ধরে উপাচার্যের ডানহাত হয়ে প্রশাসনের শীর্ষপদে থাকার সুবাদে যা অনিণ্ট করবার তা তিনি করে ফেলেছেন। এবার বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার সুনজরে তাকে আসতে হবে।

তারেক জিয়াও বলেছে তার পিতা জিয়াউর রহমানই হলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। এটা কাকতালীয় নয় যে, রেজাউর রহমানের অপসারণ ও উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে ছাত্রলীগের আন্দোলনকে বাকস্বাধীনতার উপর আঘাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি আখ্যায়িত করার সঙ্গে কি ষড়যন্ত্রের কোনো যোগ নেই, ভাববেন নিশ্চয়ই আলোকিত মানুষেরা।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করব। রোজার এই মাসে হঠাৎ বেগম খালেদা জিয়া বিভিন্ন ইফতার অনুষ্ঠানে সরকার বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একের পর এক উগ্র হঠকারী বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি সরকারি বাহিনীকে উদ্দেশ্যে করে উস্কানিমূলক কথাও বলছেন তিনি। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তিনি এনেছেন। অনেকে খালেদা জিয়ার এমন আচরণের ভয়াবহ তাৎপর্য নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কূটনীতিক পাড়ার হত্যাকাণ্ডের পর এ বিষয়েও নজর দিতে পারেন সরকার ও দেশের সচেতন মহল।

ষড়যন্ত্রের জালে কঠিন সংকটে দেশ। কী করবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা? কী কর্তব্য আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির? শেখ হাসিনা আহবান জানিয়েছেন দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে। সে ডাকে কার্যকর সাড়া পাওয়া যাবে যদি নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের ফাটল সৃষ্টি না করে ষড়যন্ত্রের মূল হোতাদের নির্ধারকভাবে পরাজিত করার লড়াইয়ে আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটকে প্রয়োজনে আরও সম্প্রসারিত করে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গি প্রতিরোধে নেমে পড়ি– যদি জামায়াতকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার শক্ত দাবি তুলি– যদি তাদের অর্থ-সাম্রাজ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সরকারকে বাধ্য করি।

রাষ্ট্র ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখনও শক্ত অবস্থানে রয়েছে এমন জামায়াতি ও তাদের আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করার এখনই সময়।