বন্দুকযুদ্ধ এবং রাষ্ট্র ও সরকারের আন্তঃসম্পর্ক

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 29 June 2016, 08:48 AM
Updated : 29 June 2016, 08:48 AM

সাম্প্রতিক সময়ে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন জঙ্গি ফাহিম নিহত হবার পর তার ন্যায়বিচার পাবার মৌলিক অধিকারের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমগুলোতে তারাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন, যারা ফাহিমদের মতো জঙ্গিদের প্রধান টার্গেট। চাপাতি-বাহকদেরও যে ন্যায়বিচার পাবার অধিকার রয়েছে, সেটা বোধহয় কেবল মানবতাবাদী হলেই বলা সম্ভব। আর এখানেই জঙ্গি, ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে মানবতাবাদীদের তফাত।

পোস্টগুলোর সবচেয়ে বড় যে দুর্বলতা তা হল, রাষ্ট্র ও সরকারের মাঝে পার্থক্য ধরতে না পারা; যার ফলশ্রুতি হল রাষ্ট্রের ঘাড়ে সব কিছুর দায় চাপিয়ে সরকারকে দায়মুক্তি দেওয়া। যে কোনো দেশেই সরকারকে এড়িয়ে রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করলে সেটি একটি ভয়াবহ দিকে ইঙ্গিত করে। যারা রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা বলছেন, তারা আসলে একই সঙ্গে হয়তো সেটিতেও ইঙ্গিত করছেন। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, তারা আসলে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি আঙ্গুল তুলছেন, যদিও সরকার না বলে 'রাষ্ট্র' শব্দটি প্রায় সবাই ব্যবহার করেছেন।

বাংলাদেশের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে প্রায়ই রাষ্ট্রের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নির্বাচিত সরকারসমূহ ঔপনিবেশিক সূত্রে প্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের উপর নানা কারণে প্রায়ই খুব জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে না। রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারবার সরকারি ব্যর্থতা যে সমস্ত রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হয় সে সমস্ত রাষ্ট্রসমূহকে প্রখ্যাত পাকিস্তনি বামপন্থী তাত্ত্বিক, হামযা আলাভী 'অতি-বর্ধিত' রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের ইতিহাসে আমরা রাষ্ট্রকে বারবার সেই ভূমিকায় দেখেছি।

রাষ্ট্র ও সরকারের আন্তঃসম্পর্কের মাঝে একে অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করবার প্রচেষ্টা শুধু যে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বেই পরিলক্ষিত হয় তা নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত বিশ্বেও এ প্রবণতা প্রবল। সেখানে হোয়াইট হাউস না সিআইএ, কোনটির ক্ষমতা বেশি এ ধরনের বিতর্ক দেখা যায়। আন্তর্জাতিক বিষয়ে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউসকে পেন্টাগনের স্বার্থে প্রাধান্য দিয়েই নীতি নির্ধারণ করতে হয়। এছাড়া আমেরিকার বাজেটের একটি বড় অংশের বরাদ্দ দেওয়া হয় সামরিক বাহিনীর জন্য, যেটি ২০১৫ সালে ছিল ৫৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা কি না মূল বাজেটের ১৬ শতাংশ।

এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যে সমস্ত দেশে মার্কিনপন্থী সরকার ক্ষমতায় ছিল না তাদেরকে নানাভাবে উৎখাতের চেষ্টা করেছে। এসব প্রচেষ্টা হোয়াইট হাউসের নির্দেশে সিআইএ করেছিল, নাকি সিআইএ স্বাধীনভাবে করেছে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। হোয়াইট হাউস বলবার চেষ্টা করে এসেছে যে, এসব সিদ্ধান্ত নেবার এবং বাস্তবায়ন করবার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল না, সিআইএ স্বাধীনভাবে তার কাজ পরিচালনা করেছে। অপরদিকে, সিআইএ বলার চেষ্টা করেছে যে, তারা যা করে সেটা হোয়াইট হাউসের নির্দেশেই করে।

পাকিস্তানের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাব যে, সেখানে আইএসআই কীভাবে সরকারের ভেতরে সরকারের ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি, ঐতিহাসিকভাবেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে এবং নীতিনির্ধারণে দেশটির সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। অর্থাৎ সেখানে সরকার কর্তৃক রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত না হয়ে, রাষ্ট্র কর্তৃক সরকার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

ঔপনিবেশিক সূত্রে প্রাপ্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি একটি লম্বা সময় সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র দ্বারা সরাসরি পরিচালিত হয়েছে। ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলেও জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার আমলাতন্ত্রের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তা অনকটা প্রশ্নবোধক। বরং বর্তমান সরকারসহ সব সরকারের সময় যে বিষয়টা পরিলক্ষিত হয়েছে তা হল আমলাতন্ত্র; বিশেষত, সামরিক আমলাতন্ত্রকে সন্তষ্ট করে ক্ষমতায় থাকবার চেষ্টা।

একটি রাষ্ট্রে নানা স্টেক-হোল্ডার থাকে। কার্ল মার্কসের রাষ্ট্রের 'আপেক্ষিক স্বাধীনতা' তত্ত্বের আলোকে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ সমস্ত স্টেক-হোল্ডারদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হল, বিভিন্ন স্টেক-হোল্ডারদের মধ্যে যারা সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত এবং সুবিধাসমূহ তাদের পক্ষেই সবচেয়ে বেশি যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ, যে কোনো রাষ্ট্রেই সবচেয়ে ক্ষমতাশালী স্টেক-হোল্ডার হল সামরিক আমলাতন্ত্র। ফলে বাজেট বরাদ্দ থেকে নীতি নির্ধারণ, সব ক্ষেত্রেই যে কোনো সরকার চেষ্টা করে সামরিক আমলাতন্ত্রের মনোভাব বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে। এটি কম বেশি সব দেশেই দেখা যায়, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

তাই ফাহিম নিহত হবার পরে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলিতে সচেতন বা অসচেতনভাবে আঙুল যখন রাষ্ট্রের দিকে উঠে, তখন সেটা রাষ্ট্রের সামনে সরকারের অসহায়ত্ব তুলে ধরলেও বিষয়টির এত সরলীকৃত বিশ্লেষণের অবকাশ নেই।

ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সিদ্ধান্তগুলো এককভাবে রাষ্ট্র না সরকার নেয়, না রাষ্ট্র ও সরকার যৌথভাবে নেয় সে সম্পর্কে একজন গবেষকের পক্ষে বাইরে থেকে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। তবে সিদ্ধান্ত যে-ই নিক না কেন, এর সাফাই জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে গাইতে হয় সরকারকেই।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কি শুধু বাংলাদেশেই ঘটে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর পুলিশ প্রায় হাজার খানেক লোককে বিনা বিচারে হত্যা করে। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ৯৯০ জন, যার মধ্যে ৪২ জন নারী। ২০১৬ সালে এখন পর্যন্ত এ সংখ্যাটি হল ৪৫৭ জন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশে পুলিশ কাস্টডি এবং বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ১৯২ জন। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১২৮। বাংলাদেশে বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার এসব নানাবিধ শব্দ ব্যবহার করা হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাখঢাক না করে সরাসরি 'পুলিশের গুলিতে নিহত' এভাবেই বলা হয়।

বাংলাদেশের জনগণ এবং সিভিল সমাজ তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের ব্যাপারে যতটা সোচার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল সমাজ এবং জনগণ ততটা নয়। এর মূল কারণ ইতালির মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসির 'হেজিমনি' তত্ত্বের আলোকে ব্যাখা করা যায়। এ তত্ত্বের সার কথা হল, কোনো সরকার তার নাগরিকদের উপর শুধুমাত্র বলপ্রয়োগ করে টিকে থাকতে পারে না, যদি না সে বলপ্রয়োগের ব্যাপারে জনগণের সম্মতি থাকে বা জনগণের মাঝে সে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা থাকে। রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগ, তা বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই হোক না কেন, সে বিষয়ে জনগণের সম্মতি না থাকলে জনগণের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করতে থাকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্র, সরকার, কর্পোরেশন এবং মিডিয়ার মাঝে এক ধরনের হৃদত্যাপূর্ণ সমঝোতার সম্পর্ক থাকবার ফলে মূলধারার ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় এ ধরনের বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কদাচিৎ উল্লিখিত হয়। মাঝে সাঝে যখন কোনো একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোনো কমিউনিটিতে খুব জোরেসোরে প্রতিবাদ ওঠে তখনই মিডিয়াগুলোতে এ ধরনের সংবাদ পরিবেশিত হতে দেখা যায়।

২০১৫ সালে বাল্টিমোরে ২৫ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ফ্রেডি গ্রে নিহত হবার পর সেখানকার অধিবাসীরা ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তখন মিডিয়াতে এর ব্যাপক কভারেজ দেওয়া হয়। এছাড়া অন্যান্য সময় বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড নিয়ে সম্পাদকীয় বা টকশো মূলধারার সংবাদপত্র বা মিডিয়াগুলিতে পরিলক্ষিত হয় না।

মূলধারার কর্পোরেট মিডিয়াগুলিতে সরকারি চিন্তাধারার সঙ্গে মিলিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। এছাড়া ডেমোক্রেটিক এবং রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম বাদে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে তেমন মৌলিক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। ওখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে এ দুদলের বাইরে অন্য কোনো দলের পক্ষে উঠে আসা অনেকটাই অসম্ভব। দ্বি-দলকেন্দ্রিক মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি শাস্ত্রের অধ্যাপক লিসা ডিশের মতো অনেক চিন্তাবিদ 'দ্বি-দলীয় স্বৈরতন্ত্র' বলে মনে করেন।

এ দুদলের বাইরের অন্যান্য দলের নেতা বা ভিন্ন চিন্তাধারার বুদ্ধিজীবীদের মূলধারার কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা সংবাদপত্রে সুযোগ দেওয়া হয় না। উদাহারণস্বরূপ বলা যায় যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বামধারার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, এমআইটির ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক নোয়াম চমস্কির লেখার আনুবাদ বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূলধারার কোনো মিডিয়ায় তাঁকে সাধারণত ডাকা হয় না, তেমনি মূলধারার সংবাদপত্রগুলিতেও তিনি থাকেন অনুপস্থিত। চমস্কির মতো ভিনধারার চিন্তাবিদরা সব সময় থাকেন মূলধারার সংবাদপত্র বা মিডিয়ার বাইরে।

মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়ার এ ভূমিকা এবং অন্যান্য আরও কারণে দেশটিতে বিপুল সংখ্যক রাজনীতির ব্যাপারে উদাসীন জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এর পাশাপাশি জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ মনে করে যে, সরকার বা রাষ্ট্র যা করছে তার সবই সঠিক। অর্থাৎ রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের উপর, গ্রামসির ভাষায় এক ধরনের 'হেজিমনি' প্রতিষ্ঠা করেত সক্ষম হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বৈধ বা অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্র তার নাগরিকদের উপর বলপ্রয়োগ করলেও বেশিরভাগ নাগরিক এবং সিভিল সমাজ বলপ্রয়োগের নৈতিকতা এবং আইনগত দিক নিয়ে প্রশ্ন তোলে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জনমানসের সঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং জনগণের মননের অনেক তফাৎ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিবাসী হয়ে আসা মার্কিন জনগোষ্ঠীর মাঝে বিনা প্রশ্নে সব কিছু মেনে নেবার প্রবণতা রয়েছে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী ঠিক তার বিপরীত।

ব্রিটিশরা আসবার আগে থেকেই বাংলা ভূখণ্ড নানা বহিঃস্থ শক্তি দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষ কখনও কোনো বিদেশি শক্তির উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। এ অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে মানুষ সব সময় প্রতিবাদ করেছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। প্রতিবাদের ভাষা কখনও ছিল সরব, কখনও-বা নীরব (প্যাসিভ)।

হাজার বছরের প্রতিবাদের ঐতিহ্য এ অঞ্চলে গড়ে তুলেছে প্রতিবাদের সংস্কৃতি। যার প্রতিফলন শুধুমাত্র রাজনীতিতে নয়; গানে, কবিতায়, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে এক কথায় বাঙালির সার্বিক জীবনধারায় রয়েছে এ প্রতিবাদী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য, যা বিশ্বের অনেক জনগোষ্ঠীর মাঝে অনুপস্থিত। ফলে বাংলাদেশেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বলপ্রয়োগের হেজিমনি অর্থাৎ বলপ্রয়োগ বা বিনা বিচারে হত্যা করা হলেও জনমানসে এর কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার চিন্তা শুধু অবাস্তব নয়, অসম্ভব।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে ঐতিহ্য তা বহুত্ববাদ ধারণ করে। আর এ কারণেই এদেশের কর্পোরেট মিডিয়াগুলো তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থেই বিভিন্ন দলমতের ব্যক্তিবৃন্দকে মিডিয়ায় তুলে আনতে চেষ্টা করে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যথাক্রমে তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থান অধিকারী লিবারেটেরিয়ান এবং গ্রিন পার্টির প্রতিনিধিত্বকারী কাউকে সেখানকার মিডিয়াতে দেখা না গেলেও আমাদের দেশে এক শতাংশের কম ভোট পাওয়া রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতিনিধিদেরও মিডিয়াতে ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়।

মার্কিন মিডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশি মিডিয়ার মূল পার্থক্যের জায়গাটি হল এখানেই– মার্কিন মিডিয়াতে যেমন একক কণ্ঠস্বরের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, আমাদের এখানে তেমনি বহুত্ববাদী কণ্ঠস্বর তুলে আনবার চেষ্টা করা হয়। এ চর্চার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল এটাই যে, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতির স্বাভাবিকীকরণ এ ধরনের রাষ্ট্রে গড়ে ওঠে না।

মার্কিন রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য হল ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান এ দুদলের রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমত্য। ফলে এ দুদল মৌলিক বিষয়ে একে অন্যকে সমালোচনা করে না। দুদল ক্ষমতায় থাকবার সময়েই পুলিশের গুলিতে মানুষ নিহত হয়েছে, কিন্তু বিরোধী দলে যেয়ে এক দল আরেক দলকে এ বিষয়ে দোষারোপ করে না।

অপরদিকে, বাংলাদেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মাঝে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক আদর্শ এবং নীতির ব্যাপারে ঐক্যমত্য না থাকবার কারণে তারা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সব বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান নেয়। ফলে দুদলই ক্ষমতায় থাকাকালীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে অনেক লোক নিহত হলেও যখনই তারা বিরোধী দলে গিয়েছে, তখনই তারা অপর দলের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে।

হুগো গ্রোসিয়াস, টমাস হবস, জন লক, জ্যা জ্যাক রশো, ইমানুইয়েল কান্ট প্রমুখ মনীষী রাষ্ট্র উৎপত্তির ভিত্তি হিসেবে সামাজিক চুক্তির কল্পনা করেছেন। এ চুক্তি অনুযায়ী শাসকবৃন্দ যদি আইনানুগভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন তাহলে জনগণের অধিকার রয়েছে তাদেরকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার।

বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দক্ষ হলেও গণমানসে তাদের প্রতি আস্থার সংকট রয়েছে। এটি প্রবল হয় যখন পুলিশ হেফাজতে বা রিমান্ডে নিয়ে যাবার পর কেউ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। আর সেটি যখন ঘটে তখন কিন্তু জঙ্গিদের অপরাধের এক ধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়। কেননা পুলিশের পক্ষে তখন তাকে আদালতের সামনে জঙ্গি প্রমাণ করা সম্ভব হয় না।

ফাহিমের মতো সন্দেহভাজন জঙ্গি রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হবার ঘটনায় একটি ভয়ংকর উদাহরণ তৈরি হল যা ভবিষ্যতে এ ধরনের যে কোনো বন্দীর জন্য বিপদজনক হতে পারে। তাই এখন থেকে রিমান্ডকালীন সময়ে রিমান্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির পূর্ণ আইনগত অধিকার নিশ্চিত করে আবার আদালতের সামনে হাজির করবার বিষয়টি আদালতের নিশ্চিত করা উচিত।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সোনার বাংলার মিথ তৈরি করেছিল সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণ, বঞ্চনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলবার প্রত্যয় নিয়ে। বর্তমান সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ডিজিটাল বাংলাদেশকে সোনার বাংলার আধুনিক রূপ বলেছেন। জঙ্গিবাদ এবং দুর্নীতি হচ্ছে কাল্পনিক এ সোনার বাংলার মিথকে বাস্তবে রূপ দেবার প্রধান প্রতিবন্ধক। জঙ্গিবাদ মানে হচ্ছে জঙ্গি মতবাদ। আর এ জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতি দমন করতে হলে সরকারকে যেটা নিশ্চিত করতে হবে সেটা হল সুশাসন, যা কেবলমাত্র আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব।

তথ্যসূত্র:

Alavi, Hamza. "The State in Post-Colonial Societies: Pakistan and Bangladesh," New Left Review 74 (1972): 59-81

The Washington Post
https://www.washingtonpost.com/graphics/national/police-shootings/ (Accessed June 24, 2016)

Disch, Lisa Jane.The Tyranny of the Two-Party System. New York: Columbia University Press, 2002