তারুণ্যের চ্যালেঞ্জ নিল বুড়ো রাষ্ট্র

সেলিম খান
Published : 26 June 2016, 08:35 AM
Updated : 26 June 2016, 08:35 AM

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এক সময়ের প্রায় গোটা বিশ্বের শাসক ব্রিটেন রাষ্ট্র হিসেবে এখন একটি কাগুজে বাঘ। তার সঙ্গে নেই কারও যুথবদ্ধতা, নেই কারও শক্তিমত্তার পরীক্ষা দেবার প্রয়াস। কেননা একা পথ চলার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রাষ্ট্রটি এখন বিশ্বসভায় নিতান্তুই একটি সাধারণ রাষ্ট্র।

তাই এ কথা বলাই যায় যে, এখন থেকে অন্য রাষ্ট্রগুলোও এক সময়ের ক্ষমতাধর এই রাষ্ট্রের কাছ থেকে যুঝে নেবে তাদের সমস্ত পাওনা। যেমনটা ভারতীয়রা আওয়াজ তুলেছে, ঔপনিবেশিক সময়ে যে ক্ষতি তাদের করেছে ব্রিটিশরাজ তা কড়ায় গণ্ডায় আদায় করতে চায় তারা। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোও চাইবে তাদের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্কটা যুঝে নেবার পর্যায়ে পৌঁছে নিতে।

কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকতে এই রাষ্ট্রকে বিশ্বসভায় অনেক সমীহ করা হত। কিন্তু এখন থেকে ব্রিটেন নামের এই রাষ্ট্রকে আগামীর পথ চলতে হবে একা এবং সম্পূর্ণভাবেই একা। হয়তো বিশ্ব-পুঁজিবাদ তথা মুক্তবিশ্বের সদস্য থাকবার সুবাদে এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর সারিতে থাকবার কারণে ডাক পাবে বিশ্ব-পরিচালনা সংক্রান্ত দেনদরবারে। তবে সেসব দরবারে ব্রিটেনের জায়গাটা হবে ফার্স্ট বেঞ্চারের বদলে তৃতীয় কিম্বা তারও পরের সারির ছাত্র হিসেবে।

সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের পথচলা শুরু ১৭০৭ সালে। সে সময়ে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড নিয়ে একটি রাজনৈতিক ইউনিয়ন গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইউনাইটেড কিংডম। যার পোশাকি নাম হয় গ্রেট ব্রিটেন। পরে ১৮০০ সালে অ্যাক্ট অব ইউনিয়নের মাধ্যমে এই ইউনাইটেড কিংডমে যুক্ত হয় আয়ারল্যান্ড। সেই থেকে এই যুক্তরাজ্যের নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড।

ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে সংযুক্ত হবার এই প্রক্রিয়া বা নতুন এই সংযুক্ত রাষ্ট্র সম্পর্কে ইতিহাসবেত্তা সিমন শামা (Simon Schama) বলছেন, ''যারপরনাই বিরোধাত্মক সমীকরণের মধ্য দিয়ে সংযুক্ত হবার এই যাত্রা শুরু হয়েছিল বটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হল তা অবশ্যই বিশ্বপরিসরে বড় ধরনের প্রভাব রাখবে। আর এটা ছিল ইউরোপের ইতিহাসে সত্যিকার অর্থেই সব থেকে আশ্চর্য হবার মতো একটি রূপান্তর।''

তবে ১৭৬৩ সালে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক যুদ্ধ-বিগ্রহের পরিসমাপ্তি ব্রিটিশ রাজন্যের প্রাধান্যেরই জানান দেয়। এরপর একশ বছরে এই ব্রিটিশরাজই সর্বাধিক ক্ষমতাধর বিশ্বশক্তি এবং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। যার ফল দাঁড়ায়, যুুক্তরাজ্যের সংস্কৃতি এবং তার শিল্প-বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, সাংবিধানিক, শিক্ষা ও ভাষা-বাচনিক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।

এরপর ১৯২২এ এসে অ্যাংলো-আইরিশ চুক্তির মতো আয়ারল্যান্ডের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে গঠিত হয় আইরিশ ফ্রি স্টেট। তবে তাদের সঙ্গে থাকেনি উত্তর আয়ারল্যান্ড। তারা আলাদা হয়ে ফিরে যায় ইউনাইটেড কিংডমে। ফলে ১০২৭ সালে ইউনাইটেড কিংডম নাম কিছুটা পাল্টে হয় ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। যাকে সংক্ষেপে বলা হয় ব্রিটেন। তবে ১৯৪৫ সাল থেকে এই রাষ্ট্রের অফিসিয়াল নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম বা ইউকে।

বিশ্বজুড়ে নিজের এমনি প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে ব্রিটেন ও তার সাম্রাজ্য জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। মিত্রশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাতীয়তাবাদি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পরাস্ত করে হিটলারের জার্মানি, ইতালি ও জাপানকে। তবে এই জয় ছিনিয়ে আনতে গিয়ে সব থেকে বেশি মূল্য দিতে হয় ব্রিটেনকেই। যুদ্ধের দামামা আর অস্থিরতার সুযোগে তার বেশিরভাগ উপনিবেশগুলোতে জোরালো হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলন। ব্রিটেনকে খোয়াতে হয় প্রচুর আর্থিক সম্পদ।

দুইয়ে মিলে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য। পরিণতিতে ওরা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় বেশিরভাগ উপনিবেশের স্বাধীনতা। তা যে ধরনেরই হোক না কেন। তারপরও ব্রিটেনের মানসিক আধিপত্য বজায় রাখতে স্বাধীন এসব রাষ্ট্র মিলে গঠন করা হয় কমনওয়েলথ অব নেশনস। যার আলঙ্করিক প্রধান মনোনীত হন ব্রিটেনের রানি। সাম্রাজ্য হারালেও একসময়ের বিশ্ব-অধিপতি এই রাষ্ট্রের মর্যাদানির্বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর মতো বিশ্ব-সংস্থায় জায়গা দেওয়া হয় নেতৃত্ব পর্যায়ের সদস্য হিসেবে।

বিশ্বপরিসরে নেতৃত্বের জায়গা পেলেও নব্বইয়ের দশক থেকেই রাষ্ট্রটিকে অস্থির করে তোলে অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব ও জাতিগত বৈরিতা। উত্তর আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের আলাদা হবার আন্দোলন প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় রাজনৈতিক এই ইউনিয়নের অখণ্ডতা ধরে রাখবার প্রয়াসকে। ২০১৪ সালে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটে যায় স্কটিশরা। ৫৫ শতাংশ ইউকের সঙ্গে থাকবার পক্ষে ভোট দেওয়ায় নাকচ হয়ে যায় স্কটল্যান্ডের স্বাধীন হবার প্রয়াস। যদিও স্কটল্যান্ড ও ইউকের বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে যে, যুক্তরাজ্য থেকে স্কটিশদের আলাদা হবার এই প্রয়াস বাস্তবায়ন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এমনিতর নানা ধরনের নেতিবাচক রাষ্ট্রিক সমীকরণে বিপর্যস্ত 'মহা-ব্রিটেন' আবারও একটি বড় রকমের ধাক্কা খেল ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে। গেল শুক্রবারের গণভোটে দেশটির ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে না থাকবার পক্ষে।

অন্যদিকে ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ ব্রিটন সায় দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুথবদ্ধ থাকতে।

তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের সায় মেনে নিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ঘোষণা করেছেন যে, তিনি আর থাকছেন না দেশটির পরিচালনার দায়িত্বে। যদিও তিনি চাননি ব্রিটেন বেরিয়ে যাক ইইউ থেকে।

তবে ভোটের পরিসংখ্যানটি যদি আমরা যুক্তরাজ্যীয় এই দেশের বিভিন্ন সংযুক্ত রাজ্যের ভোট-ভিত্তিতে দেখি তাহলে যে বিশ্লেষণ বেরিয়ে আসে তা অনেকটা বিচিত্র বৈকি। কেননা গোটা দেশের হিসেবে এই ভোট ব্যবধান ৫২:৪৮। অন্যদিকে লন্ডনের বাসিন্দারা ভোট দিয়েছে ইউতে থাকবার পক্ষে।

ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে যেতে প্রয়াসী স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ চায় ইউরোপের পক্ষে থাকতে। ইংল্যান্ডের বাকি অংশ ও ওয়েলস বিচ্ছেদ চাইলেও লেস্টার ইইউতেই থাকতে চায়। এমন একটি ভোট সমীকরণে গোটা দেশের হিসাবে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যকে ইউরোপ ছাড়তেই হচ্ছে।

তবে সংখ্যাভিত্তিক এই ভোট-হিসাব পাল্টে দিয়েছে বিশ্ব-পরিচালনার সব হিসাব-নিকাশ। পাল্টে দিল ক্ষমতার সব সমীকরণ।

আর যুক্তরাজ্য যে আরেকটি রাজনৈতিক ইউনিয়ন হিসেবে যুক্ত থাকতে পারছে তা ইতোমধ্যেই পরিস্কার হয়ে গেছে। আলাদা হয়ে যেতে প্রয়াসী স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিয়ন সাফ বলেই দিয়েছেন, আরেকটি গণভোট ব্রিটেনকে মোকাবেলা করতে হবে। আর তা হচ্ছে স্কটল্যান্ডের আলাদা হবার গণভোট।

ইউরোপের অন্য রাষ্ট্রগুলোতেও দামামা বাজতে শুরু করেছে আলাদা হয়ে যাবার। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, জার্মানি, ইতালি, ডেনমার্ক ও তুরস্কেও দাবি উঠেছে গণভোটের। আর এসব দাবির পেছনে মূল মদদ দিচ্ছে দেশগুলোর ডানপন্থী, আরেকভাবে বলতে হয়, দেশগুলোর মূল ভূখণ্ডের কট্টর জাতীয়তাবাদী মানুষ যারা কিনা প্রধানত অভিবাসন-বিরোধী। তারা চাইছে নিজেদের রাষ্ট্রে শুধু নিজেরাই থাকতে। আর এই চাওয়ার পেছনে তাদের যুক্তি হচ্ছে, অভিবাসীরা অন্য দেশ থেকে এসেছে। অথচ তারাই কি না এসব দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভাগ বসাচ্ছে।

আরেকটি বিষয় অবশ্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হচ্ছে মুসলিম-বিদ্বেষ। ইউরোপে এই বিদ্বেষের পেছনে কাজ করছে মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে জঙ্গি তৎপরতা।

তবে নিজেদের রাষ্ট্রে নিজেদের থাকবার বাসনা কিম্বা মুসলিম-বিদ্বেষ, যা-ই কারণ হোক না কেন, ইউরোপের এই বিভক্তিতে সব থেকে বেশি লাভবান যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে সন্দেহ থাকবার কোনো কারণ নেই। এ কথা সত্যি যে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচার আর কর্তৃত্বপরায়ণতার বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছুটা হলেও কল্যাণমুখী গণতান্ত্রিকতা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে অনেকটাই নিক্তিমুখী রেখেছিল।

এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর যুথবদ্ধ শক্তি হিসেবে বৈশ্বিক সমীকরণে দরকষাকষির টেবিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থানই ছিল কার্যকর। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা, গণতন্ত্রায়ন, সুশাসন এমনসব ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জোরালো অবস্থান অনেকটাই সহায়ক ছিল বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মানুষদের জন্য।

পাশাপাশি, ইউরোপীয় যুথবদ্ধতার সাফল্য, এগিয়ে চলা প্রভৃতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও জোটবদ্ধ হবার যে প্রয়াস লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল তা-ও বড় রকমের ধাক্কা খেল এই ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়ে। যা কিনা শেষ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে আরও শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাবে মার্কিন আধিপত্য। যা বিশ্বকে আরও বেশি অনিরাপদ, যুদ্ধংদেহী ও কলহপ্রবণ করবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না।

পরিশেষে যেটা বলতেই হয়, এভাবে একটি যুথবদ্ধ আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র হিসেবে ইউরোপের এসব সদস্য সামনে কতটুকু এগুবে তারও নিয়ন্তা একমাত্র 'সময়'।