গ্রেট ব্রিটেনের ‘গ্রেট’ কি তবে নিভে যাচ্ছে!

Published : 24 June 2016, 12:34 PM
Updated : 24 June 2016, 12:34 PM

আপনারা যারা আজও প্রতিদিনের মতো একই রকম পৃথিবী দেখছেন, তাদের বলতেই হচ্ছে, গতকালের পৃথিবী আর আজকের পৃথিবীর মাঝে বেশ খানিকটা পার্থক্য হয়ে গেছে। কারণ গ্রেট ব্রিটেনের মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইউকের মাঝে স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের মানুষরা আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। অন্যদিকে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের মানুষরা ভোট দিয়েছেন ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে।

এর মানে হচ্ছে গ্রেট ব্রিটেন আর গ্রেট থাকছে না। কারণ স্কটল্যান্ড আবারও আরেকটি রেফারেন্ডামের আয়োজন করে নিজেরা স্বাধীন হয়ে যেতে চাইবে কিংবা যাবে বলেই মনে হচ্ছে। অর্থাৎ এক হিসাবে আজকের পর থেকে শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, ইউনাইটেড কিংডমও ভেঙ্গে গেল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী তিন মাসের মাথায় তিনি তাঁর দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।

এত সব কিছুর প্রভাবে ইংল্যান্ডের কারেন্সি ব্রিটিশ পাউন্ড গত ২৫ বছরের ইতিহাসে সবচাইতে নিচে নেমে গেছে এক রাতের ব্যবধানে। ব্রিটেনের প্রায় সকল অর্থনীতিবিদ বলছেন, এই অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে অনেক মূল্য দিতে হবে।

তাহলে ব্রিটিশরা ইইউ ছেড়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?

এক কথায় উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে বলতেই হচ্ছে ব্রিটিশরা তাদের বর্তমান রাজনীতি, অর্থনীতি এবং অভিবাসী পলিসি নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তাই তারা পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আর এই জন্য তারা ইইউকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন।

ব্রিটেনের যে রাজনৈতিক নেতা ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে লড়েছেন, তিনি একজন জিনফোবিক মানুষ। এই যেমন অভিবাসীদের বিপক্ষে এই ভদ্রলোক। তবে সবচাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে, পূর্ব লন্ডনে, যেখানকার বেশিরভাগ মানুষ অভিবাসী বা ব্রিটিশ বাংলাদেশি, তারাও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।

আমি জানি না কেন এই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশরা ইইউ ছাড়তে চাইছেন। তাদের নিশ্চয়ই নিজস্ব মত থাকতে পারে। যে মতে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেটা হচ্ছে, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মতো একই সুযোগ-সুবিধা পান না ব্রিটেনে। তাই তারা চেয়েছেন ইইউ থেকে বের হয়ে গেলে অন্তত এই বৈষম্যের হাত থেকে বেঁচে যাবেন।

অভিবাসী বিষয়ক সামান্য গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, এই ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা বুঝতে পারছেন না যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার এই ক্যাম্পেইন শেষাবধি এসে ঠেকেছিল অভিবাসী সমস্যায়। অর্থাৎ সাধারণ ব্রিটিশরা অভিবাসীদের তাদের দেশে আর দেখতে চান না এই বিষয়টাতে প্রাধান্য দিয়েই ক্যাম্পেইন চালানো হয়েছে। যিনি এই ক্যাম্পেইনের নেতা ছিলেন, তিনি নিজেও এই সূরে কথা বলে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

এই 'লিভ ক্যাম্পেইন' বিজয়ী হওয়ার পর ব্রিটেনে পুরো অভিবাসী সম্প্রদায়ের উপর নানা খড়গ নেমে আসতে পারে। বাংলাদেশি ব্রিটিশরাও এর বাইরে থাকবেন না। কেন তারা ইইউ ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিলেন সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন।

তবে ভোটের প্রাথমিক পর্যালোচনায় একটা কথা বলা হচ্ছে, আর তা হল: শিক্ষিত ব্রিটিশরা মত দিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষে। আর অল্পশিক্ষিত ভোটাররা রয়েছেন ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে। যদিও এই ভোটাভুটিতে বিপুল সংখ্যক ভোটার উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু শিক্ষিত ভোটারদের উপস্থিতি নাকি কম ছিল। আর এর ফলেই এমন একটা ফলাফল এসে গেছে যা কেউ ভাবেননি।

তবে ব্রিটেনের এই ভোটাভুটি থেকে মনে হয়, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল দেশের নাগরিকদের একটা শিক্ষা হওয়া উচিত। যারা ভোট না দিয়ে ঘরে বসে থাকেন, তাদের উচিত অবশ্যই নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করা। নইলে এই সামান্য ভুলের জন্য বড় রকম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। উদাহরণ হিসেবে সামনের আমেরিকার ইলেকশনের কথাই বলা যাক।

রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি একজন ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক মানুষ, অতীতে অনেক সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেছেন, তিনি যদি জিতে যান তাহলে হয়তো পুরো পৃথিবীর রাজনীতিতেই বিপ্লব ঘটে যাবে। কারণ এই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আমেরিকায় কোনো মুসলিমকে ঢুকতে দিবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এমনকি আইএস তাড়াতে পারমাণবিক বোমা মেরে দেওয়ারও পক্ষে! কোনো রকম আলাপ-আলোচনার ধার এই ভদ্রলোক ধারেন না।

ব্রিটেনের এই নির্বাচনের পর ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেল এই অর্থে যে, তিনিও অনেকটা জিনফোবিক মানুষ। তবে ধারণা করা হয় যে, আমেরিকার অল্পশিক্ষিত মানুষরা তাকে সাপোর্ট করছেন। শিক্ষিত মানুষরা তার এই সব বার্তা পছন্দ করছেন না। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে যে, ভোটের দিন শেষ পর্যন্ত কোন শ্রেণির মানুষ বেশি ভোট দিতে যান। ব্রিটেনের মতো ঘটনা ঘটলে হয়তো পৃথিবীকে আরেক জন নতুন 'হিটলার' দেখতে হতে পারে।

ব্রিটেনের এই নির্বাচন একই সঙ্গে গণতন্ত্রের এই দিকটিও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল যে, গণতন্ত্র এবং এর ভোটের মেকানিজম সব সময় কাঙ্ক্ষিত নাও হতে পারে। সামনের দিনগুলোতে এখন দেখার বিষয় যে, ব্রিটিশরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেন নাকি নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনলেন।

একই সঙ্গে ব্রিটেনের এই নির্বাচন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশগুলোতে কেমন প্রভাব ফেলে সেটাও হবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।

আর যাই হোক-এটি পরিষ্কার ভাবেই বলা যায়; পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে নতুন একটু অধ্যায়ের শুরু হলে আজকের সূর্যোদয়ের পর!