শান্তির সৈনিক আইনস্টাইন–দ্বিতীয় অধ্যায়

স্বপন কুমার গায়েন
Published : 30 May 2016, 04:35 AM
Updated : 5 March 2022, 02:30 PM


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটায়
শান্তির সপক্ষে ও যুদ্ধবিরোধী এক সোচ্চার কণ্ঠস্বর হিসেবে আইনস্টাইনকে আমরা প্রথম দেখি ১৯১৪ সালে। তখন তাঁর বয়স পয়ঁত্রিশ, প্রথম সারির তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর খ্যাতি বিজ্ঞানীমহলে সুবিদিত। সুইজারল্যান্ড থেকে সদ্য ফিরে এসেছেন জন্মভূমি জার্মানীতে, ইউরোপের খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাইজার উইলহেল্ম সোসাইটি ফর ডেভেলপমেন্ট অফ সায়েন্সেসের (Kaiser Wilhelm Society for the Development of Sciences) ইনস্টিটিউট অফ ফিজিক্সের (Institute of Physics) পরিচালক হিসেবে। এ ছাড়াও বিখ্যাত রয়্যাল প্রুশিয়ান একাডেমী অফ সায়েন্সেসের (Royal Prussian Academy of Sciences) সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি এবং অলংকৃত করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিনের প্রফেসরের পদ, যে পদের সুযোগ-সুবিধা তিনি ভোগ করবেন; কিন্তু ক্লাস নেয়া বা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে তাঁর কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না।

খ্যাতি ও সম্মানের এই সুদৃঢ় আসন থেকেই তিনি প্রথম তাঁর বিশ্বজনীন শান্তিবাদের কথা বলেছেন। কৈশোর থেকেই ব্যক্তি স্বাধীনতা বিরোধী কোনো প্রভুত্ব, যুদ্ধ, সৈন্যদের মার্চ করা, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও সব ধরনের গোঁড়ামি-বিরোধী এক মনোভাব আইনস্টাইনের ভেতরে গড়ে উঠেছিল। বার্লিনে আসার আগে থেকেই বিশ্বাস ও চিন্তায় একজন বিশুদ্ধ শান্তিবাদী হলেও যতদূর জানা যায়, সে সময়ে তিনি প্রকাশ্যে কোনো ভূমিকা পালন করেন নি।

১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। শুধুমাত্র যুদ্ধরত দেশগুলিতেই যে এই যুদ্ধ ব্যাপক মৃত্যু, ধ্বংস, অনাহার ও দুর্ভিক্ষ ডেকে আনল তাই নয়, সারা বিশ্বের মানবিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সম্পর্কের বিন্যাসেও এক বিরাট বিপর্যয়ের সৃষ্টি হল। যুদ্ধের নৃশংসতা ও ভয়াবহতা গভীর রেখাপাত করল আইনস্টাইনের মনে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনের গতিই যেন বদলে দিল আংশিকভাবে। তার মানে এই নয় যে বিজ্ঞান সাধনা তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্রভূমি থেকে সরে গেল, তবে তাঁর চেতনায় এক নতুন মাত্রা যোগ হল। যুদ্ধ তাঁকে গড়ে তুলল এমন এক সচেতন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে, যাঁর জীবনের পরবর্তী অংশের অন্যতম প্রধান সাধনাই হল যুদ্ধের বিভীষিকা মুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলা।

যুদ্ধকে তাঁর মনে হয়েছে প্রবল উন্মত্ততা থেকে উদ্ভূত 'অবিশ্বাস্য কিছু'। বন্ধু পল এরেনফেস্টকে লেখা চিঠিতে তাঁর মনোভাব সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে, "বিশ্বব্যাপী এই দুর্যোগ আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসেবে আমার ওপর এক গুরুতর বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। এই 'ভয়াবহ দুঃসময়' পেরিয়ে যেতে যেতে বিশ্বাস করাই কঠিন হয়ে ওঠে যে আমরা সেই মূর্খ, পচনশীল, প্রজাতির সদস্য যা কিনা ইচ্ছার স্বাধীনতার গর্ব করে।"

আইনস্টাইনের প্রথম প্রকাশ্য রাজনৈতিক ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে কুখ্যাত "সভ্য পৃথিবীর প্রতি ইশতেহারের" (Manifesto to the Civilized World) বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। ১৯১৪ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম ভাগে প্রকাশিত এবং জার্মানীর প্রথম সারির ৯৩ জন বুদ্ধিজীবী স্বাক্ষরিত এই ইশতেহারে মূলত জার্মানীর যুদ্ধবাজ সমরনায়কদের যুদ্ধাপরাধ ঢাকার অপচেষ্টা করা হয়েছিল।

জার্মানীর যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল পশ্চিম ফ্রন্টে অধিকাংশ সৈন্য সমাবেশ করে ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রথমে ফ্রান্সকে পরাজিত করা। পরে সৈন্যদের পূর্বফ্রন্টে তাড়াতাড়ি মোতায়েন করে রাশিয়ার মোকাবেলা করা। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জার্মানী আগস্টের দুই তারিখে বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে অগ্রযাত্রার সুযোগ দাবি করে। নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বেলজিয়াম সে দাবী প্রত্যাখ্যান করায় জার্মানী আগস্টের তিন তারিখে বেলজিয়াম আক্রমণ করে। বেলজিয়াম পেরিয়ে যাবার পথে যেসব জনপদ ছিল জার্মান সৈন্যরা সেখানে ধ্বংস ও হত্যার তাণ্ডব চালায়। জার্মান সৈন্যদের বর্বরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় বেলজিয়ামের লুভেইন গ্রাম। পাঁচ দিন ধরে জার্মান সৈন্যরা গ্রামটি লুট করে, গ্রামের অধিকাংশ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং নারী ও শিশুসহ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করে। বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা লঙ্ঘন এবং জার্মান যুদ্ধযন্ত্রের নৃশংসতা বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় তোলে। সভ্য ও সংস্কৃতিবান জাতি হিসেবে জার্মানীর ভাবমূর্তি এতটাই খর্ব হয় যে সাম্রাজ্যবাদী জার্মান সরকার পর্যন্ত বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন মনে করে। "সভ্য সমাজের প্রতি ইশতেহার" সেই প্রচেষ্টার ফসল। ইশতেহারে ছয়টি নেতিবাচক বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল, যার প্রতিটি শুরু হয়েছিল, "একথা সত্য নয় যে …" দিয়ে। ইশতেহারে জার্মান যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার করা হয়েছিল, বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা লঙ্ঘনের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা ছিল,অস্বীকার করা হয়েছিল লুভেইন ধ্বংস করার অপরাধ। সর্বোপরি দাবী করা হয়েছিল "একথা সত্য নয় যে, আমাদের তথাকথিত যুদ্ধবাদের (militarism) বিরোধিতা করলে আমাদের সংস্কৃতির বিরোধিতা করা হয়না।" দাবী করা হয়েছিল, জার্মান যুদ্ধবাদ না থাকলে জার্মান সংস্কৃতি পৃথিবী থেকে লোপ পেয়ে যেত।

সে সময়ে এই বিবৃতির বিরোধিতা করা ছিল রীতিমত বিপজ্জনক। তবুও ইশতেহার প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রখ্যাত জার্মান শান্তিবাদী ফ্রিডরিখ নিকোলাই প্রতিবাদে "ইউরোপীয়দের প্রতি ইশতেহার" {Manifesto to Europeans) নামে এক পাল্টা ইশতেহার প্রণয়ন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী অধ্যাপকদের মধ্যে প্রথম বিলি করেন। মাত্র তিনজন ইশতেহারে স্বাক্ষর করেন। আইনস্টাইন তাঁদের একজন। আরেক স্বাক্ষরকারী ছিলেন বার্লিন মানমন্দিরের দীর্ঘকালীন প্রধান উইলহেলম ফরস্টার। অশীতিপর এ জ্যোতির্বিদ "সভ্য পৃথিবীর প্রতি ইশতেহারে" অন্যতম স্বাক্ষরদাতা হলেও পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়েছেন, স্বাক্ষর করেছেন পাল্টা "ইউরোপীয়দের প্রতি ইশতেহারে ।" অটো বাক নামে এক ছাত্র ছিলেন তৃতীয় স্বাক্ষরকারী।

ইশতেহারে যুদ্ধ ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে জোরাল বক্তব্যের সাথে সাথে যুদ্ধ-মুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সব "শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ইউরোপীয়দের ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি লীগ অফ ইউরোপিয়ানস" গড়ে তোলার ডাক দেয়া হয়েছিল। ইশতেহারটি যথাযথ সমর্থন পেলে তৎকালীন পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারত হয়ত; কিন্তু যাঁরা নীতিগতভাবে সমর্থন করেছিলেন, ভয়ে তাঁরাও প্রকাশ্যে এগিয়ে আসতে পারেননি। ফলে ইশতেহারটি তেমন কার্যকর হয়নি, তাৎক্ষণিকভাবে চাপা পড়ে যায় এবং প্রণীত হওয়ার দীর্ঘ সাত বছর পরে সাধারণ্যে প্রকাশিত হয়।

তিন বছর পরে ১৯১৭ সালে নিকোলাই "যুদ্ধের জীববিজ্ঞান" (The Biology of War) শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থটি নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ড থেকে প্রকাশ করেন। বইটিতে যুদ্ধকে অভিব্যক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়| বইয়ের মুখবন্ধ হিসেবে নিকোলাই "ইউরোপীয়দের প্রতি ইশতেহার" জুড়ে দেন| আইনস্টাইনকে স্বীকৃতি দেন সহ-প্রণেতার| উল্লেখ্য যে বইটি জার্মানি থেকে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি| তবে একশ কপি জার্মানীতে গোপনে এনে বিতরণ করা হয়| যুদ্ধ শেষ হবার আগেই বইটি ফরাসী, সুইডিশ, ডেনিশ, ফিনিশ ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়| এভাবে দেরিতে হলেও আইনস্টাইন প্রথম যে ইশতেহারের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন তা সীমিত প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়|
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলি অবশ্য আইনস্টাইনের পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্যায়গুলির মধ্যে পড়ে| ১৯১৫ সালে প্রকাশ করেন "আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব" (General Theory of Relativity)| আর ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে প্রকাশ করেন ত্রিশটি গবেষণাপত্র| পাশাপাশি তিনি সক্রিয় থেকেছেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তির সপক্ষে বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করার কাজে।

এক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতির অভাব তাঁকে ক্ষুণ্ণ করেছে। তিনি নিজেই নিজের আপেক্ষিক নিষ্ক্রিয়তার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁর আত্মসমালোচনা সম্বন্ধে মে ১৮, ১৯১৮ তারিখে এক চিঠিতে নিকোলাই লেখেন:
আপনি নিজেকে অসম্মান করেন যখন আপনি বলেন স্বীকৃতি আপনার প্রাপ্য নয়| আপনি তো প্রতিবাদ করেছিলেন| আর কেউ ভুলে যায়নি "ইউরোপীয়দের প্রতি ইশতেহারের" কথা, আপনি যার সহ-প্রণেতা| আপনি অংশগ্রহণ না করলে এই ইশতেহার সম্ভবত কখনো দিনের আলো দেখতো না|[…]
আমি মনে করি আপনি আরেকটি ব্যাপারে নিজের প্রতি অবিচার করেন| আপনি বার্লিনে গবেষণা কাজে ব্যস্ত থাকেন বলে কোনভাবেই নিন্দার কিছু নেই| পরবর্তী কালের আর্কিমিডিস হিসেবে "আমার বৃত্ত থেকে সরে দাঁড়াও" বলে ভাড়াটে সৈন্যদের প্রতি চিৎকার করে ওঠার অধিকার যদি কারো থেকে থাকে সে নিশ্চিতভাবে আপনার|

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই যুদ্ধপূর্ব জার্মানীর বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন এবং প্রকাশ্যভাবে যুদ্ধবিরোধী একমাত্র দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে| সক্রিয় শান্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রয়োজনে শান্তিবাদী বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টায় ১৯১৪ সালের ১৬ই নভেম্বর তারিখে "নব পিতৃভূমি লীগ" (Bund Neues Vaterland) (সংক্ষেপে "বুন্ড") নামে এক নতুন সংগঠন গড়ে ওঠে| বুন্ডের উদ্দেশ্য ছিল শক্তিশালী শান্তি আন্দোলন গড়ে তোলা এবং যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা স্থাপন করা যা ভবিষ্যতে যুদ্ধ রোধ করবে। আইনস্টাইন ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধি, অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক, সাংবিধানিক আইনজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ব্যাংক কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী ও উদারনৈতিক ব্যক্তিবর্গ|
ব্যক্তিগতভাবে এবং বুন্ডের সদস্য হিসেবে আইনস্টাইনের তৎকালীন শান্তির পক্ষে কাজের দু'টি দিক লক্ষ করা যায়| প্রথমত যুদ্ধবিরোধী শান্তিকামী জার্মান বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, তাঁদের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখা, ও শান্তির সপক্ষে কাজে তাদের উৎসাহিত করা| অন্যদিকে জার্মানীর বাইরে নিরপেক্ষ এবং "তথাকথিত শত্রুদেশের" বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে আগের সম্পর্ক অটুট রাখা এবং নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলা| শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং যুদ্ধোত্তর শান্তি ও সম্প্রীতি গড়ার প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন|এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিনি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, এমিল ফিশার, হেনড্রিক লোরেন্টজ, হেনরিক জ্যাঙ্গার, রোমা রোঁলা, বার্ট্রান্ড রাসেল, পল এরেনফেস্ট, জর্জ বার্নার্ড শ প্রমুখের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন|
বুন্ডের প্রথমদিকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে ডাচ যুদ্ধবিরোধী কাউন্সিল আয়োজিত আন্তর্জাতিক সভায় অংশ নেয়া| নেদারল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে হেগ শহরে আয়োজিত সভায় জার্মান দলের চার সদস্যের তিনজনই ছিলেন বুন্ডের সদস্য|সভার উদ্দেশ্য ছিল মধ্যস্থতার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করার সম্ভাবনা পরীক্ষা করা| এ উদ্যোগে জার্মান পররাষ্ট্র অফিসের বেসরকারি সমর্থন ছিল| উচ্চপদস্থ কোন ডাচ সরকারি কর্মকর্তা আলোচনার জন্য বার্লিন যাবেন স্থির হয়েছিল| সংবাদমাধ্যমে একথা ফাঁস হয়ে গেলে জার্মান জাতীয়তাবাদী মহলে নিন্দার ঝড় ওঠে| জার্মান পররাষ্ট্র অফিস পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করে|

এ ধরনের বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়েই বুন্ড কাজ করে যাচ্ছিল| ১৯১৫ সালের মার্চ মাসে প্রথম এবং পরে মে মাসে জার্মানীর ছয়টি প্রভাবশালী শিল্প সংস্থা মিত্র শক্তির সাথে আপসের ভিত্তিতে আগেভাগে কোন শান্তি চুক্তি করার বিরোধিতা করে এবং যুদ্ধে অধিকৃত এলাকা সংযুক্ত করে নেয়ার জন্যে চ্যান্সেলরের কাছে আবেদন জানায়। বুন্ড এই সংযুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে আইনস্টাইনসহ একানব্বইজন বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষরিত একটি স্মারকপত্র চ্যান্সেলরকে পাঠায়| লোরেন্টজকে লেখা এক চিঠিতে আইনস্টাইন বিদ্বজনের এ ভূমিকায় তাঁর "পরম সন্তোষ" প্রকাশ করেন| অবশ্য স্মারকপত্রের সারাংশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকায় ফাঁস হয়ে গেলে জার্মান হাইকমান্ডে প্রবল উষ্মা দেখা দেয়|
যুদ্ধের প্রথম দিকে প্রশাসনযন্ত্রের বিরোধিতা এবং দমননীতির মুখেও বুন্ড কাজ চালাতে পেরেছিল| ১৯১৬র ফেব্রুয়ারী মাসে বুন্ডের কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়| তবে গোপনে ও সীমিতভাবে বুন্ড কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে|

যুদ্ধ সম্বন্ধে অভিমত
যুদ্ধ সম্বন্ধে আইনস্টাইনের অভিমত সুস্পষ্ট হয় ১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে লেখা এক প্রবন্ধে। "গ্যেটের দেশ ১৯১৪/১৯১৬" (The Land of Goethe 1914/1916) শীর্ষক দেশাত্মবোধক এক স্মারকগ্রন্থে একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য আইনস্টাইনকে অনুরোধ করা হয়। স্মারকগ্রন্থের উদ্দেশ্য ছিল জার্মান সংস্কৃতির পক্ষ সমর্থন করার জন্য মহত্তম জার্মান কবির উত্তরসূরিদের প্রবুদ্ধ করা। পরিবর্তে আইনস্টাইন এ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন যুদ্ধ সম্বন্ধে তাঁর অনুভূতি ও অভিমত প্রকাশে। স্মারকগ্রন্থ সম্পাদকমন্ডলী প্রবন্ধের অংশবিশেষ অতিমাত্রায় দেশাত্মবোধশূন্য বলে আইনস্টাইনকে পরিবর্তন করে দেয়ার অনুরোধ জানান। আইনস্টাইন রাজি হন। তবে টলস্টয় যে দেশপ্রেমকে মানসিক ব্যাধির সাথে তুলনা করেছেন সে কথা মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না।

"যুদ্ধ সম্বন্ধে আমার অভিমত" (My Opinion on the War) শিরোনামে প্রবন্ধটি স্মারকগ্রন্থে ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের মূল বক্তব্য নিম্নরূপ:
যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক শেকড়সমূহ জৈবিক ভিত্তিতে পুরুষের আগ্রাসী চারিত্র্যে নিহিত রয়েছে বলে আমি মনে করি। "সৃষ্টির সেরা" আমরাই যে শুধু এই শিরোপার পেছনে ছুটি তা নয়। কোন কোন প্রাণী, যেমন ষাঁড় ও মোরগ আমাদের টপকে যায়। এই আগ্রাসী প্রবণতা সামনে আসে যখন স্বতন্ত্র পুরুষদের পাশাপাশি রাখা হয়; এবং তা আরো প্রকট হয়ে ওঠে যখন অপেক্ষাকৃত ঘনিষ্ঠ দু'টি সমাজকে একে অপরের সাথে কাজ করতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, এবং বিশেষভাবে সতর্ক না হলে তা বেড়ে গিয়ে ঝগড়া ও খুনোখুনিতে পর্যবসিত হয়।[…]

বোধগম্য যে অধিকতর আধুনিক সংগঠিত রাষ্ট্রসমূহকে এসব আদিম পুরুষালি বৈশিষ্ট্যের অভিব্যক্তিকে সজোরে পেছনে ঠেলে এগোতে হয়েছে। তবে দুটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিবেশী হলে এবং কোন অধিজাতিক (supranational) সংস্থার অন্তর্ভুক্ত না হলে, এসব অভিব্যক্তি মাঝে মাঝে যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে তা যুদ্ধের বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। প্রসঙ্গত, যুদ্ধের তথাকথিত লক্ষ্য ও কারণসমূহ আমি অর্থহীন বিবেচনা করি, যেহেতু উত্তেজনা বাড়ানোর প্রয়োজন হলে সেগুলি সবসময় খুঁজে পাওয়া যায়।

সর্বকালের সূক্ষ্মদর্শী বুদ্ধিজীবীরা একমত যে যুদ্ধ মানব উন্নয়নের অন্যতম নিকৃষ্ট শত্রু, এবং তাকে প্রতিহত করার জন্যে করণীয় সবকিছু অবশ্যই করতে হবে। বর্তমান অকথ্য দুঃখজনক অবস্থা সত্ত্বেও আমি নিশ্চিত যে, ইউরোপে একটি অধিজাতিক সংস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে যা ইউরোপীয়দের মধ্যে যুদ্ধ প্রতিহত করবে, ঠিক যেমন করে জার্মান রাইখে ওয়ার্টেমবার্গ ও ব্যাভারিয়ার মধ্যে বর্তমানে যুদ্ধ অসম্ভব।

আইনস্টাইন মনে করতেন, শান্তির সময়ে সাধারণ নাগরিক হিসাবে যে মানুষ নিরীহ জীবন যাপন করে, সে যে যুদ্ধের সময়ে গণহত্যা করতে পারে তার মূলে রয়েছে তথাকথিত দেশপ্রেম। মানুষের মনের মন্দিরে থাকে "দেশপ্রেম" নামাঙ্কিত এক সিন্দুক। সেখানে সংরক্ষিত থাকে জান্তব ঘৃণা এবং গণহত্যার নৈতিক যৌক্তিকতা। যুদ্ধ ঘোষিত হলে সে মানুষ দায়িত্বশীলতার সাথে সেগুলো বের করে নেয় এবং ব্যবহার করে।

আমার আন্তর্জাতিকতাবাদী অনুভূতি গোপন করার কোন উদ্দেশ্য আমার নেই। কোন মানুষ বা মানবিক প্রতিষ্ঠানের সাথে আমি কতটা ঘনিষ্ঠতা বোধ করি তা শুধুমাত্র নির্ভর করে কীভাবে আমি তাদের উদ্দেশ্য ও দক্ষতার বিচার করি তার ওপর । আমি যে রাষ্ট্রের নাগরিক আমার অনুভূতির জগতে তার কোন স্থান নেই। আমার বিবেচনায় রাষ্ট্রের সাথে আমার সম্পর্ক ব্যবসায়িক; অনেকটা ব্যক্তির সাথে জীবন বীমার সম্পর্কের মত। ওপরে আমি যা বলেছি তা থেকে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না যে আমি এমন একটি দেশের নাগরিক হতে চাইব যেদেশ আমাকে খুব সম্ভবত: যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য জোর করবে না।

আমার সত্যিকার বিশ্বাস যে অধিকতর পরিণত বুদ্ধির ইউরোপীয়রা সাধারণ রাজনৈতিক প্রশ্নসমূহ অবহেলা করে পাপ করেছেন। তবুও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করাকে এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর পথ বলে আমি বিবেচনা করি না। বরং আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগতভাবে এমনভাবে কাজ করা উচিত যাতে সেসব অনুভূতি, যাদের কথা আমি আগে বিশদভাবে আলোচনা করেছি, যেন সমাজের প্রতি অভিশাপ হয়ে উঠতে না পারে।

ক্ষমতার মোহ ও লোভকে আগের মতোই জঘন্য পাপ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। একই কথা ঘৃণা ও কলহপ্রিয়তা সম্বন্ধে। অতীতের অতিরিক্ত মূল্যায়ন করার বাতিক আমার নেই। তবে আমি মনে করি, এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আমরা এগোইনি, বরং নীচে নেমেছি। প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির উচিত এক্ষেত্রে নিজেকে এবং তার ব্যক্তিগত পরিবেশকে উন্নত করার জন্য জোরেসোরে কাজ করা। যেসব মারাত্মক দুর্দশা আজ আমাদের ভয়াবহভাবে জর্জরিত করছে তখন সেগুলো দূর হবে।

তবে এত কথার কী প্রয়োজন, যখন একটি বাক্যে এবং একজন ইহুদীর জন্য খুবই যথাযথ একটি বাক্যে আমি সব বলতে পারি: শুধুমাত্র শব্দে ও স্তবে নয়, আপনার প্ৰভূ যিশু খ্রীষ্টকে সম্মান করুন সর্বোপরি আপনার কর্ম দিয়ে।
আইনস্টাইনের যুদ্ধ সংক্রান্ত মতামত এতদিন বন্ধু ও সহকর্মীদের মধ্যে সীমিত ছিল ব্যক্তিগত যোগাযোগের মধ্য দিয়ে। এ প্রবন্ধের মাধ্যমে তা সাধারণ্যে প্রকাশ পায়।

অধিজাতিক প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ধারণা
বুন্ড নিষিদ্ধ হওয়ায় আইনস্টাইনের যুদ্ধবিরোধী মতামত প্রকাশের সাধারণ মাধ্যমটি বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের শেষ দুই বছর তিনি মূলতঃ চিঠিপত্রের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে বন্ধু ও সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখেন। এসব মত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা বিকশিত হয়, পরিণতি পায়। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অধিজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি আজীবন বলেছেন। ১৯১৭ সালের ২৭শে আগস্ট হেনরিক জ্যাঙ্গারকে লেখা এক চিঠিতে তিনি তেমনি এক প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা তুলে ধরেন। চিঠির প্রাসঙ্গিক অংশবিশেষের অনুবাদ নীচে দেয়া হল।
…… সম্প্রতি আমি বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ চিন্তা করেছি এবং একটি অপেক্ষাকৃত আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে উপনীত হয়েছি। আমার চিন্তাগুলি আপনার সমালোচনা মূলক বিবেচনার জন্য পেশ করছি।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, তার মানে, এই মুহূর্তে আঁতাতের অন্তর্ভুক্ত যত বেশি সংখ্যক সম্ভব রাষ্ট্র নিয়ে এবং নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে নিম্নবর্ণিত নীতিমালার ভিত্তিতে একটি শান্তিবাদী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা উচিত।
(১) চুক্তির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি সালিশ আদালত;
(২) সদস্য রাষ্ট্রগুলি কী পরিমাপে সার্বজনীন সামরিক নিবন্ধনের নীতি অবলম্বন করবে সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠান। নিজ দেশের বাইরে যৌথ সৈন্য মোতায়ন। চুক্তির অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলির মধ্যকার সম্পর্ক যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করে তার সাথে সঙ্গতি রেখে স্থায়ী সেনাবাহিনী সংকোচন;
(৩) শুল্ক নীতিতে চুক্তির অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলির মধ্যে "সবচেয়ে পছন্দের রাষ্ট্র" নীতি অবলম্বন করা, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শুল্ক বিলোপ করা;
(৪) যে কোন দেশ সংস্থার সদস্য হতে পারবে, যদি নীচের শর্তগুলি পূরণ করে:
(ক) গণতান্ত্রিক নীতিমালার ভিত্তিতে নির্বাচিত সংসদ;
(খ) সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ভর মন্ত্রীসভা (সেসব মন্ত্রীরা স্বাভাবিকভাবে নির্বাহী কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করবেন);
(৫) সংস্থার বাইরের কোন রাষ্ট্রের সাথে সামরিক জোট গঠন করা নিষিদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে;
(৬) সংস্থা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের আঞ্চলিক প্রতিরক্ষার গ্যারান্টি দেবে।
এ প্রস্তাবের সুবিধা হচ্ছে যে শুরুতে সব দেশ সংস্থার সদস্য না হলেও সংস্থাটি খুবই প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারবে। কারণ অন্য রাষ্ট্রের জায়গা দখল করার নীতি বর্জন করায় সংস্থাটি সদস্য রাষ্ট্রের আঞ্চলিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারবে। যত বেশি রাষ্ট্র সংস্থায় যোগ দেবে, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় ততই কমে যাবে।

লক্ষণীয় যে ১৯১৮ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (League of Nations) যে রূপরেখা তুলে ধরেন আইনস্টাইনের প্রস্তাবিত সংস্থার অনেক বৈশিষ্ট্যই সেখানে সন্নিহিত ছিল।

১৯১৭ সালের ক্রিসমাসের সময় থেকে শুরু করে প্রায় তিনমাস আইনস্টাইন আলসারে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে তিনি প্রুশিয়ান একাডেমির সাপ্তাহিক সভাগুলোতে পর্যন্ত যোগ দিতে পারেননি। ১৯১৮ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে সুস্থ হয়ে তিনি আবার আন্তর্জাতিকতাবাদী জার্মান বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্পর্কে একটি ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনা করেন। প্রখ্যাত জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টকে উদ্যোগে অংশগ্রহণ করার আবেদন জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। চার বছর আগে "ইউরোপীয়দের প্রতি ইশতেহার" যে উদাসীনতা ও বিরূপতার মুখোমুখি হয়েছিল সে কথা স্মরণ করে হিলবার্ট আইনস্টাইনকে তখনকার মতন বিরত থাকার পরামর্শ দেন। "উন্মত্ততার ঘূর্ণিঝড়" শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের উদ্যোগ প্রতিকূলতারই জন্ম দেবে। আইনস্টাইন মেনে নেন, এবং যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে অধিকতর সর্তকতা অবলম্বন করেন।
১৯১৮ সালের অক্টোবর মাস থেকে বুন্ড (Bund Neues Vaterland) আবার প্রকাশ্য কার্যক্রম শুরু করে এবং অক্টোবর মাসেই বার্লিনে দু'টি জনসভার আয়োজন করে। জনসভায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা; অবিলম্বে অবরোধের অবস্থা , মত প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা এবং নিরাপত্তামূলক আটক নীতির প্রত্যাহার; সব রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা; যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করা, সংবাদপত্র, বাক ও সমাবেশ করার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান; এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান (বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে) গ্রহণ করার জোর দাবী জানানো হয়। এছাড়াও বুন্ড জার্মান সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন এবং গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের দাবী জানায়। সে উদ্দেশ্যে সর্বসাধারণের গোপন, সমান ও প্রত্যক্ষ ভোটে জাতীয় পরিষদ নির্বাচিত হবে; এবং সে নির্বাচনে নারী ও সৈন্যদের পূর্ণ ভোটাধিকার থাকবে। ধারণা করা হয় আইনস্টাইন সে জনসভায় উপস্থিত ছিলেন এবং উপরোক্ত দাবীসমূহ সম্বলিত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ককে চিঠি লিখেছিলেন।

বিপ্লবীদের চাপের মুখে নভেম্বর ৯, ১৯১৮ তারিখে কাইজার উইলহেল্ম (দ্বিতীয়) পদত্যাগ করেন। সাম্রাজ্যের পতনের পর জার্মানী প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় আরো দু'দিন পরে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে আজীবন বিশ্বাসী আইনস্টাইন জার্মান সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তনকে উৎসাহের সাথে স্বাগত জানান। যুদ্ধের সময়ে বিবৃতি দেয়া ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নেয়ার ব্যাপারে যে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন তা অনেকটা শিথিল হয়ে আসে। কোন কোন উদ্যোগে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সে সময় কতগুলি চরমপন্থী অবস্থান নেয়। যেমন তারা কয়েকজন অধ্যাপককে আটক করে রাখে। পরবর্তীতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করে এবং অন্যান্য পরিবর্তনের জন্য জোর দাবী পেশ করে। ছাত্রদের মধ্যে আইনস্টাইনের জনপ্রিয়তা ছিল। এসব ক্ষেত্রে আইনস্টাইনকে মধ্যস্থতা করার অনুরোধ করা হয়েছে। আইনস্টাইন রাইখস্ট্যাগ ভবনে ছাত্রদের বিপ্লবী কমিটির সামনে বক্তব্য রেখেছেন।
প্রায় পঁচিশ বছর পরে ম্যাক্স বর্নকে লেখা চিঠিতে আইনস্টাইন বন্দী অধ্যাপকদের মুক্ত করার ব্যাপারে তাঁদের চেষ্টা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন, "কি সাদাসিধেই আমরা ছিলাম! […] আমরা কেউই বুঝতে পারিনি, বুদ্ধির তুলনায় আবেগ কত বেশী শক্তিশালী! সেকথা মনে রাখলেই আমরা ভাল করব। […]"

গণতন্ত্রের পক্ষে
সে সময় দেয়া একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আইনস্টাইন গণতান্ত্রিক আদর্শে তাঁর গভীর আস্থা সুচারুভাবে প্রকাশ করেন। বামপন্থীরা তখন শ্রমিক এবং ছাত্রদের নিয়ে একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের আহ্বান জানায়। আইনস্টাইন ১৯১৮ সালের ১৩ই নভেম্বর তারিখে বক্তব্য রাখেন সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে:
….. আমাদের সাধারণ লক্ষ্য গণতন্ত্র, জনগণের শাসন। ব্যক্তি যদি দুটি মূলনীতিকে পবিত্র বলে গ্রহণ করে তবেই শুধু সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
প্রথমতঃ ভোটের মধ্য দিয়ে জনগণের যে ইচ্ছা প্রকাশ পায় তার প্রতি স্বেচ্ছা আনুগত্য; সংখ্যাগুরুর অবস্থান ব্যক্তির নিজের ইচ্ছা ও বিবেচনার প্রতিকূল হলেও। […]

শ্রেণী শাসনের পুরাতন সমাজ বিলুপ্ত হয়েছে। তার পতন হয়েছে নিজের পাপের ভারে, আর মুক্ত করার জন্য সৈন্যদের কাজে। শ্রমিকদের সাথে সহযোগিতা করে সৈন্যরা যেসব পরিষদ গঠন করেছেন সেগুলোকে আপাতত জনগনের সংগঠন বলে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। এই সংকটের সময়ে আমাদের শর্তহীন আনুগত্য থাকবে তাদের প্রতি, এবং আমাদের সব শক্তি দিয়ে তাদের সমর্থন করতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ সব সত্যিকারের গণতন্ত্রীকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে নতুন বামপন্থী শ্রেণী স্বৈরশাসন যেন পুরানো ডানপন্থী স্বৈরশাসনের জায়গা জুড়ে না বসে। প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে হেন দুর্ভাগ্যজনক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন না যে হিংসা দিয়েই হিংসার মোকাবিলা করতে হবে; যে দেশবাসীর মগজে স্বাধীনতার ধারণা প্রবেশ করানোর জন্য সর্বহারার একনায়কতন্ত্র সাময়িকভাবে মেনে নেয়া প্রয়োজন হবে। বল শুধুই তিক্ততা, ঘৃণা ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
অতএব আমরা অবশ্যই বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারের কাছে দল স্বার্থ নির্বিশেষে অবিলম্বে গণ পরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করার জন্য শর্তহীন দাবী জানাব, এবং সরকারের নির্দেশ স্বেচ্ছায় মান্য করব । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গণপরিষদ নির্বাচিত হলে নতুন স্বৈরাচারের ভয় দূর হবে।
[…]

১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টি ও তার মিত্র দল ক্যাথলিক সেন্টার এবং জার্মান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতায় আসে। আইনস্টাইনের নৈতিক সমর্থন ছিল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রতি। মাঝেমাঝে পার্টির কোন সভায় যোগ দিলেও সম্ভবত তিনি কখনও পার্টির সদস্য পদ গ্রহণ করেননি।
(চলবে)

তথ্যসূত্র

[১] "My Opinion on the War," Einstein 1916, 30; in Collected papers of Albert Einstein (CPAE, Vol. 6, Document 20. Also reproduced in Einstein on Politics, Edited by D. E. Rowe and R. Schulmann;(Princeton University Press,2007) pp. 73-76.

[২] "Letter to Heinrich Zangger," 21 August 1917, CPAE, Vol. 10, Document372 A. Reproduced in Einstein on Politics, Edited by D. E. Rowe and R. Schulmann; (Princeton University Press,2007) pp. 77-78.
[৩] Einstein on Politics, Edited by D. E. Rowe and R. Schulmann;(Princeton University Press,2007) pp. 82 – 83.