জম্মু-কাশ্মীর ও উপমহাদেশের মানচিত্রে পরিবর্তন

বিজন সরকার
Published : 27 May 2016, 07:29 AM
Updated : 27 May 2016, 07:29 AM

পাক-ভারতের ভূ-রাজনৈতিক এবং প্রতিবেশিসুলভ সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীর এখনও প্রধান প্রতিবন্ধক। সমস্যাসঙ্কুল এই সীমান্ত 'লাইন অব কন্ট্রোল' বা এলওসি নামে পরিচিত। বিশ্বের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্তের মধ্যে এটি অন্যতম। এলওসির দৈর্ঘ্য ৭৪০ কিলোমিটার। পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটির মধ্যে যে চারবার যুদ্ধ হয়েছে তার তিনটিই হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে।

এ ইস্যুতে দেশ দুটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক কৌশল প্রণয়ন ও নিজেদের অনুকূলে মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তাদের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতেও জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের গত লোকসভার নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের কাশ্মীর-কেন্দ্রিক ভুল নীতির সমালোচনা করে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি বেশ সুবিধা পেয়েছে। নির্বাচনের সময় বিজেপি সংবিধানের ৩৭০ ধারাগুলি বাতিল করবে বলে বিভিন্ন পর্যায়ে পরোক্ষভাবে প্রচারণা চালিয়েছিল।

উল্লেখ্য, জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দারা দেশটির অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা আইনের অধীনে বসবাস করে। সেটি হল, সংবিধানের ৩৭০ ধারা। এ রাজ্যের সম্পত্তির মালিকানা, নাগরিকত্বসহ বেশ কিছু অধিকার ভারতের সংবিধান মোতাবেক পরিচালিত হয় না।

প্রধানমন্ত্রীর দফতর বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং জানিয়েছিলেন, মোদী সরকার ৩৭০ ধারা বাতিলের পরিকল্পনা করছেন। এ নিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে কথা বলবেন তারা, এটাও বলেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সেখানকার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছিলেন, "৩৭০ ধারার বিলুপ্তি কাশ্মীরের জন্য বিপজ্জনক হবে। এই ধারা না থাকলে কাশ্মীর আর ভারতের অংশ থাকবে না।"

জম্মু-কাশ্মীরের পিডিপি দলের নেত্রী মেহবুবা মুফতিও জিতেন্দ্র সিংয়ের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানান। এতে জম্মু-কাশ্মীর আবারও ভাগ হতে পারে বলে হুমকি দেন তিনি।

জম্মু-কাশ্মীরে এখন মোদীর বিজেপি এবং মেহবুবার পিডিপি মিলে সরকার গঠন করেছে। পিডিপির প্রতি পাকিস্তান-বান্ধব রাজনীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজেপির কোয়ালিশন সরকারে যেতে অসুবিধা হয়নি। আবার, বিজেপি ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরেও আসেনি। তারা জম্মু-কাশ্মীরের রাজনীতিকে ভারতের মূল রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে। প্রদেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে আস্থায় নিয়েই ৩৭০ ধারা বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এগিয়ে নিতে চায় বিজেপি। তবে প্রক্রিয়াটি সময়-সাপেক্ষ।

ভারতের অভ্যন্তরীন রাজনীতি কাশ্মীর ইস্যুতে দুটি ভাগে বিভক্ত। বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলি ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি চায়। তাদের অনেকের অভিযোগ, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এ ধারার অপব্যবহার করে পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীকে সহায়তা দিচ্ছে। আবার উদারপন্থী কংগ্রেস ও বাম দলগুলি এখনই এ বিষয়ে কথা বলার পক্ষে নয়।

তবে ভারতের সাধারণ জনগণের মনোভূমিতেও পরিবর্তন আসছে। বিজেপির আদর্শিক অনুপ্রেরণায় তাদের মননে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবোধ গভীরতর হচ্ছে। উদারপন্থী কংগ্রেস ও বাম দলগুলি গণমানুষের মননের পরিবর্তন রোধ করতে পারবে না বলেই মনে হয়। আসামের বিধান সভার নির্বাচনে বিজেপির জয়ের কথা ভাবুন।

আরব বিশ্বের উগ্র ইসলামিক মূল্যবোধ ও জঙ্গিবাদী তৎপরতা, প্রতিবেশি পাকিস্তানে ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার নামে ভারতবিরোধী জঙ্গি তৎপরতা, এমনকি বাংলাদেশে ভারতবিরোধী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিতাড়নের রাজনীতি ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি, শিবসেনা ও আরএসএসের মতো দলগুলিকে সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্বে জায়গা করিয়ে দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। সেদেশের প্রতি দশ জনের পাঁচ থেকে ছয় জনই এখন হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের পক্ষে। এই বাস্তবতায় সংবিধানে ৩৭০ ধারা কত দিন টিকে থাকবে, সেটি বড় প্রশ্ন।

১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী তিন বার জম্মু-কাশ্মীর সফর করলেন। এলাকাটি যে মোদী সরকারের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি তাতে প্রকাশ পেল।

গত বছরের আগস্ট মাসে জম্মু-কাশ্মীরে দেওয়া এক ভাষণে পাকিস্তানকে প্রক্সি-ওয়ার না চালাতে আহ্বান জানিয়েছিলেন মোদী। পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়াসহ (যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত) অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলি আইএসআইয়ের সহায়তায় ভারতে প্রবেশ করে যে হামলা চালায়, সেটির দিকেই মোদীর ইঙ্গিত ছিল। সফরের প্রাক্কালে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি সংখ্যাগুরু মুসলিমদের মন জয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি, ১৯৮০ এবং ১৯৯০এর দশকে কাশ্মীর ভ্যালি থেকে বিতাড়িত হিন্দু পণ্ডিতদেরকে নিজের পূর্ব পুরুষের ভিটেবাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে কাশ্মীর ইস্যুটি ঐতিহাসিকভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। সেখানে ভারতবিরোধী রাজনীতি অনেকাংশে কাশ্মীর-কেন্দ্রিক। তারা এখনও ভারত-শাসিত কাশ্মীরকে ইতিহাসের অমীমাংসিত অধ্যায় বলেই বিশ্বাস করে। তাছাড়া জম্মু-কাশ্মীরকে ভারত থেকে আলাদা করে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করার ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়ার অভিলাষও পাকিস্তানের রয়েছে।

জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থান প্রায় অভিন্ন। এমনকি দেশটির নাগরিক সমাজের আদর্শিক অবস্থানও তাই। তবে ২০১৩ সালের মে মাসে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আসিফ আলী জারদারির 'পাকিস্তান পিপলস পার্টি' এবং নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ ভারতবিরোধী কার্ড খেলেনি। অন্যদিকে, ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক ইনসাফ (পিটিআই), জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য সুবিধাবাদী এবং উগ্র ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলি ভারতবিরোধী কার্ড খেলেছে। উপজাতি-অধ্যুষিত উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ উত্তরের এলাকাগুলোতে ভারতবিরোধী কার্ড খেলে দলগুলি আশানুরূপ ফলও পেয়েছে।

কিন্তু নওয়াজ শরীফ ক্ষমতায় আসীন হয়ে জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে এমন কোনো রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেননি, যাতে পাক-ভারত আলোচনার পরিবেশের অবনতি হতে পারে। পাক-ভারত সম্পর্কের স্বাভাবিক অবস্থার প্রয়োজনীয়তা তিনি গভীরভাবেই উপলব্ধি করেছেন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জঙ্গিবাদের বিষাক্ত ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের বিকল্প নেই। বিশেষ করে, দীর্ঘদিন সামরিক-শাসিত পাকিস্তানে ধর্মের মোড়কে যে ভারতবিরোধী রাজনীতি বাজারজাতকরণ হয়েছে, তার কুফল আজ তারা নিজেরাই ভোগ করছে। সারা বিশ্বে পাকিস্তানকে এখন জঙ্গিবাদের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেই গণ্য করা হয়।

সেনাবাহিনী ও কট্টর ভারতবিরোধীদের আপত্তি উপেক্ষা করে নরেন্দ্র মোদীর অভিষেক অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন নওয়াজ শরীফ। জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়াদ নেতাদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও শরীফ সাক্ষাৎ করেননি তাদের সঙ্গে। শরীফের এই সিদ্ধান্ত পাক-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলেও পাকিস্তানের ভারতবিরোধী গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীকে তা খেপিয়ে তুলেছে।

পাক-সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফকে এ মর্মে শর্ত দেয় যে, দুটি বিষয়ে সেনাবাহিনীর উপদেশের বাইরে যাওয়া যাবে না। প্রথমটি হল, জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়ায়; দ্বিতীয়টি হল, কৌশলগত শক্তি জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্তে।

মোদীর অভিষেক অনুষ্ঠানের সপ্তাহ দুয়েক পরই নওয়াজ শরীফ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। মাত্র বিশ হাজার আন্দোলনকারী নিয়ে আইএসআইয়ের নির্দেশনায় কানাডা থেকে আমদানিকৃত ক্ল্যারিক তাহির-উল-কাদেরি এবং জামায়াতে ইসলামীর আশীর্বাদপুষ্ট ইমরান খানের নেতৃত্বে তাঁর ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দেওয়া হয়।

নওয়াজ শরীফ নিজের চাকুরি বাঁচাতে ভারতে পাকিস্তানের হাই কমিশনার আবদুল বাসিতের সঙ্গে হুরিয়ত কনফারেন্স নেতা মিরওয়াজ ওমর ফারুককে দিল্লিতে দেখা করার অনুমতি দেন। উদ্দেশ্য, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও উগ্র গোষ্ঠীকে খুশি করা। যেখানে নওয়াজ শরীফ ভারতে নিজের সফরের সময় দেখা করেননি, সেখানে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যটি বেশ পরিষ্কার।

২৬/১১ মুম্বাই হামলার প্রধান অভিযুক্ত হাফিজ সৈয়দকে ক্লিন চিট দিয়েছে পাকিস্তানের আদালত। সাইদ পাকিস্তানি সেনা-অফিসারদের সঙ্গে উপজাতীয় এলাকায় বন্যা-দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণও করেছিলেন।

এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে সচিব পর্যায়ের নির্ধারিত দ্বিপাক্ষিক মিটিং ভারত বাতিল করে দেয়। এমনকি ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানকারী মোদীর একশ ঘণ্টার যুক্তরাষ্ট্র সফরে পঞ্চাশটির মতো কর্মসূচি থাকলেও নওয়াজ শরীফের সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি ছিল না।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের সরকারপ্রধানরা কয়েক মিনিটের ভাষণের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যুটি বরাবরই উত্থাপন করে থাকেন। তারা জানেন যে, বিশ্বদরবারে ইস্যুটির তেমন গুরুত্ব নেই। কেবল দেশের ভিতরকার রাজনীতি এবং ক্ষমতার জন্য সেখানে এটি উত্থাপন করা অনস্বীকার্য হয়ে পড়ে।

আদালত হাফিজ সৈয়দকে ক্লিন চিট দেওয়ার পাঁচ দিন পর ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মুলতানের এক সমাবেশে পিপিপির তরুণ নেতা বিলাওয়াল ভারতের কাছ থেকে কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করে আনবেন বলে ঘোষণা দেন। এ সময় তার পাশে ছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি ও রাজা পারভেজ আশরাফ। ঘটনা পরস্পরায় এটি পরিষ্কার যে, কাশ্মীর ইস্যু থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিকে বের করে আনা দৃশ্যত অসম্ভব।

ভারত কূটনৈতিক দক্ষতার সঙ্গে পাক-ভারতের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বাতিল হওয়ার দায় যৌক্তিকভাবে পাকিস্তানের উপর চাপিয়েছে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাশ্মীর নিয়ে নয়, বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ এবং জলবায়ু নিয়ে উদ্বিগ্ন। জঙ্গিবাদের জন্য বিশ্ববাসীর এই উদ্বিগ্নতা ও দুশ্চিন্তার পিছনে পাকিস্তানের দায় অনেক। তাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীরা সাধারণ পরিষদে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে যাই বলুন, তা বিশ্বনেতারা শুনতেই আগ্রহী নন। বরং উল্টো কাশ্মীরে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সমর্থনের অভিযোগে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে অভিযুক্ত হচ্ছে পাকিস্তান।

বিশ্বব্যাপী আইএস, বোকো হারাম, আল-কায়েদা, তালেবানের উত্থানের ফলে বিশ্বসভ্যতা আজ হুমকির মুখে। বিশ্ব-নেতৃত্বকে তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। পাকিস্তান জঙ্গি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের চেয়েও এগিয়ে। আল-কায়েদা, তালেবান, হাক্কানি নেটওয়ার্ক, লস্কর–ই-তৈয়বার মতো ভয়ানক জঙ্গি গ্রুপগুলি পাক সেনাবাহিনীর কৌশলী স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ অবস্থায় বিশ্বসম্প্রদায় পাকিস্তানের তথাকথিত ঐতিহাসিক অমীমাংসিত বিষয় সমাধানের জন্য কেন এগিয়ে আসবে? বিশ্ববাসীর কি দায় পড়েছে?

পাক-ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ কিংবা কোনো পরাশক্তির কাছেও জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটির কৌশলগত মূল্য নেই। এমনকি পাকিস্তানের দুই বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র আমেরিকা ও চীনেরও এতে কোনো কালে আগ্রহ ছিল না।

বিশ্বের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাও আগের মতো নেই। ইচ্ছা করলেই জাতিসংঘে জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটি আলোচনার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই রাজনৈতিক শক্তি এবং গ্রহণযোগ্যতাও দেশটির নেই। জঙ্গিবান্ধব রাজনীতি ও জঙ্গি গোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়ার ফলে পাকিস্তান বিশ্বব্যাপী ইমেজ সংকটে পড়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এবং ভারতের ভিতরে গিয়ে হামলা পরিচালনা করার জন্য জঙ্গিদের সমর্থনের ফলে ইস্যুটিতে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তারা।

চীন শিনজিয়াং প্রদেশটি ১৯৪৯ সালে দখল করে নেয়। শিনজিয়াং প্রদেশের ইসলামি জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় চীনের ঘুম হারাম। তারাও বিভিন্নভাবে এই জঙ্গিবাদের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে। এর পিছনে মার্কিনিদের অর্থায়ন রয়েছে বলে চীনের অভিযোগ। চীনের কাছে কাশ্মীরেরও আরেকটি অংশ রয়েছে। তাই চীনের তেমন কোনো নৈতিক শক্তি নেই যে, ্ি ইস্যুতে পাকিস্তানকে সাহায্য করবে।

পাকিস্তান যে জম্মু-কাশ্মীরে গণভোট দাবি করে আসছে, তা বাস্তবায়িত হলে চীনের অভ্যন্তরীন বিচ্ছিন্নতাবাদিতাও উস্কানি পাবে। যে চীন ইরাকে কুর্দিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে আসছে, বাড়ির পাশে জম্মু-কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য তারা গণভোটের পক্ষে কথা বলবে, সেটি অকল্পনীয়।

একই সঙ্গে সিনো-ইন্ডিয়া সম্পর্কটিও বিবেচনায় নিতে হবে। ভারতের নর্থ ফ্রন্টে চীনের সঙ্গে সীমানা নিয়ে বিরোধ থাকলেও এই বিরোধের তুলনায় তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দু বছরে অভ্যন্তরীন বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যা হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য।

অতীতে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক বিষয় বলে জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটি এড়িয়ে গেছে। পাকিস্তান অনেক চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক ফোরামে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে তাদের পাশে পায়নি। তবে বর্তমান বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতের চাপে জম্মু-কাশ্মীরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জঙ্গি মদদ বন্ধের জন্য বয়ান দিবে, তার জন্য হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। প্রসঙ্গত, এ মাসেই মার্কিন কংগ্রেস ভারতকে ন্যাটোর সদস্যের সমান মর্যাদা দিয়ে বিল পাস করল।

ওবামার সঙ্গে এক আলোচনায় মোদী বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতি বাদ নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য বলেছেন। তা না হলে জঙ্গিবাদকে যে পরাজিত করা সম্ভব নয়, তাও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে, ভারত যে যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত কৌশলগত বন্ধু, তা আফগানিস্তানে প্রমাণিত বলে জানিয়েছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের নিরাপত্তার জন্য কতটুকু আন্তরিক, সেটির প্রমাণসাপেক্ষে ভারত তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর করতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্রও চায় ভারত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও সোচ্চার হোক। বিশ্বব্যাপী চীনের উত্থান রুখতে হলে ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখা ছাড়া তাদের কাছে বিকল্প নেই। তাছাড়া এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালায়েন্স, বিশেষ করে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীরতর। এমনকি মার্কিন নীতিনির্ধারকরাও চান আগামীতে ভারত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে আসুক।

মোদী সরকার জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে আর 'ডিফেন্সিভ' খেলবে না বলেই মনে হয়। বিজেপি, শিবসেনা এবং আরএসএসের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন ফোরামে পাক-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে রকম ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এমনকি ভারতের গণমাধ্যমের বিভিন্ন আলোচনায় পাকিস্তানকে কীভাবে একাত্তরের মতো আরেকটি শিক্ষা দেওয়া যায়, তা গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসছে।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ভারতের কৌশল প্রণয়নকারীরা মার্কিন প্রশাসনের নীতিনির্ধারকের সঙ্গে একের পর এক সভা করেছেন। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের উন্নয়নের বেলায় পাক-ভারতের ইস্যুগুলিতে তারা ভারতের অনুকূলে কী ভূমিকা রাখতে পারেন সেটিই আলোচনায় বেশি স্থান পায়। ভারতের বক্তব্য ছিল, 'ভারত চীনের চেয়ে পাকিস্তানকে নিয়েই বেশি চিন্তিত'।

ভারত পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানের ইমেজ সংকটটি ব্যবহার করছে। উত্তর কোরিয়ার মতো পাকিস্তানকে বিশ্বসম্প্রদায় থেকে আলাদা করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক বাস্তবতাও ভারতের অনুকূলে। পাকিস্তানের ক্ষমতা বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে থাকায় দেশটি ভারতের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সব সময় ব্যর্থ হচ্ছে।

ভারতের কৌশল নিরূপণকারীদের একাংশ এবং পাকিস্তান-বিরোধী রাজনৈতিক অংশটি বাংলাদেশের মতো নির্যাতিত বেলুচিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। এমনকি বিজেপির প্রাক্তন ও বর্তমান আধ্যাত্মিক নেতারা বেলুচদের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলিকে পরামর্শ দেন। পাকিস্তানেরও অভিযোগ যে, ভারতের সেনা গোয়েন্দারা বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগিতা করছে।

বেলুচিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নিপীড়ন, নির্যাতন ও শোষণের মুখে তারা অসহায়। সরকারি হিসাবেই ১৯৭০ সাল থেকে এই পর্যন্ত ১৮ হাজার বেলুচকে পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন নিরপেক্ষ রিপোর্টে বেলুচদের হারিয়ে যাওয়ার সংখ্যা সরকারি সংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। মূলত, বেলুচদের উপর থেমে থেমে গণহত্যা চলছে।

প্রসঙ্গত, হাজার বছরের পুরনো বেলুচ জাতি স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করেছিল মাত্র আট মাস। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের অংশ হয়ে যাওয়ার পর বেলুচদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে। আইএসআই বেলুচদের জাতীয়তাবাদী নেতা নওয়াব আকবর বুগতিকে গুলি করে হত্যা করে। বেলুচিস্তান পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও সেই সম্পদ বেলুচদের জন্য ব্যবহার করা হয় না। ঠিক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মতোই অবস্থা তাদের।

বেলুচিস্তান আলাদা হলে ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানেরও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা হয়। ইরানের স্বার্থটি কীভাবে রক্ষা হয় তা বিশ্লেষণ করা এই পরিসরে সম্ভব নয়।

বেলুচিস্তানে রয়েছে চীনের বিশাল ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। চীনের অর্থায়নে নির্মিত গুয়াদার সমুদ্র বন্দরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব চীনের হাতে তুলে দেওয়ায় ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায়। স্থানীয় বেলুচরা বিশ্বাস করে, চীন সেখানে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে। কৌশলগত দিকে দিয়ে গুয়াদার গুরত্ব অনেক। এটি দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগস্থলে, ইরান সীমান্তের কাছে অবস্থিত। বন্দরটি হরমুজ প্রণালীর প্রবেশদ্বার। সেই দ্বার দিয়ে তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে।

বেলুচদের প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকাংশ চীনে রপ্তানি হয়। তাদের মধ্যে চীনাবিরোধী মনোভাব প্রকট। যুক্তরাষ্ট্রকে এ পর্যন্ত বেলুচদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কোনো অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। তবে ভারতের ক্রমবর্ধমান চাপে কতদিন তারা এই অবস্থান ধরে রাখতে পারে তা-ই দেখার বিষয়।

আরেকটি নতুন বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পাওয়ার বহু ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা দক্ষিণ এশিয়ায় রয়েছে। এই বাস্তবতাগুলি পরিবর্তনশীল মেরুকরণে পাকিস্তানের জন্য যে কঠিনতর হবে, সে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।