বৈশাখে বাঙালির শিকড়-সন্ধান

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 6 May 2016, 07:35 AM
Updated : 6 May 2016, 07:35 AM

বাংলাদেশের দৃশ্য, শ্রাব্য ও পাঠ্য মিডিয়ায় সম্প্রতি নতুন করে দুটি পুরোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে: ১. পহেলা বৈশাখ কি বাঙালি জাতির হাজার বছরের সংস্কৃতি? ২. নববর্ষ উৎসব কি রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়?

অস্ট্রিক, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড়, নেগ্রিটো ইত্যাদি বহু 'ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র' নৃগোষ্ঠীর মিশ্রণে বহু হাজার বছরে 'মহান' বাঙালি নৃগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং বাঙালি কোনো ভুঁইফোঁড় জাতি নয়, 'আকাশফোঁড়'ও নয়। কারণ বাঙালি জাতির আদিপিতা স্বর্গোদ্যান থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন এমন কোনো গল্প শোনা যায় না। বাঙালি কি সংকর জাতি? অবশ্যই, তবে বাঙালি শুধু নয়, পৃথিবীর তাবৎ জনগোষ্ঠী: আরব, জাপানি, ইংরেজ, জার্মান, সবাই সংকর। বাঙালির জিনে আর্য বা আরব বৈশিষ্ট্য কি আছে? থাকতে পারে, কিন্তু তার পরিমাণ নেহায়েতই মহাসাগরে 'এক ফোঁটা দিলেম শিশির'।

একাধিক জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ শুধু তাদের রক্তের মিশ্রণ নয়, তাদের সংস্কৃতি এবং ভাষারও মিশ্রণ। বাঙালি জনগোষ্ঠীর অন্যতম পূর্বপুরুষ অস্ট্রিকদের সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ পান আর হলুদ। সুদূর ফিলিপাইনে বসবাসরত অস্ট্রিকদের কিছু গোত্রে বর-কনের মধ্যে পান-সুপারি বিনিময় করে বিবাহকার্য সম্পন্ন হয় বলে শুনেছি। কিছুদিন আগেও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি বিবাহে পানের একটা ভূমিকা ছিল। শুভকাজের আগে বাঙালি হিন্দু গায়ে হলুদ মেখে স্নান করে। গায়ে হলুদ ছাড়া ইদানিং মুসলিম বা হিন্দু কোনো বিয়ের কথা ভাবাই যায় না, যদিও বছর ত্রিশেক আগেও এ আচারটি মুসলিম বিয়ের অংশ ছিল না।

বাংলায় বলা হয় 'ছেলেটি', 'শাড়িখানা'। হিন্দি বা মারাঠিতে বিশেষ্যের সঙ্গে 'টি' বা 'খানা'এর ব্যবহার নেই। বাংলায় বস্তুবাচক বিশেষ্যের পুং/স্ত্রী লিঙ্গ হয় না। হিন্দিতে 'পুলিশ', 'রেলগাড়ি' স্ত্রীলিঙ্গ। বিশেষ্যের সঙ্গে পদাশ্রিত নির্দেশক ব্যবহৃত হওয়া এবং বস্তুবাচক বিশেষ্যের লিঙ্গহীনতা সুদূর অতীতের কোনো নাম না জানা অনার্য ভাষার বৈশিষ্ট্য। বাংলা অঞ্চলে ব্যবহৃত 'হালি', 'কুড়ি' হিসেবে গণনার পদ্ধতিও অনার্য সংস্কৃতির স্মারক। অতীতের যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বাঙালি জাতির উদ্ভব তাদের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি মনে করাটা একেবারে অযৌক্তিক নয়। আরবেরা কি জাহিলিয়াত যুগের কবি ইমরুল কায়েস বা বেদুঈনদের সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে? এদিক থেকে দেখলে নববর্ষ পালন বাংলা অঞ্চলের কয়েক হাজার বছরের সংস্কৃতি, যার তুলনায় (হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম, খ্রিস্টান) ধর্মপরিবর্তন সেদিনকার ঘটনা মাত্র।

একাধিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ হলে তাদের ধর্মগুলো মিলেমিশে নতুন ধর্মের সৃষ্টি হতে পারে। ইরান থেকে আসা আর্যদের ধর্ম এবং ভারতবর্ষের বহু অনার্য ধর্মের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল 'হিন্দু ধর্ম'। আরব দেশের ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মে উপবাস রাখার প্রথা ছিল। ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই আরব বেদুঈনেরা জ্বীনে বিশ্বাস করতো। শয়তানের ধারণা আরবদের নিজস্ব নয়। 'শয়তান' শব্দটি হিব্রু ভাষা থেকে আরবি ভাষায় এসেছে। ইসলামপূর্ব জাহিলিয়া যুগে আরবেরা হজ্ব করতে এসে পশু কুরবানি দিত, মস্তক মুণ্ডন করত, সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরত। হজরত মুহম্মদ (স.) চমৎকারভাবে ইসলামের মধ্যে একাধিক প্রাচীন আরব প্রথা ও বিশ্বাসের সমন্বয় করেছিলেন, যা আরবজাতির ঐক্যের জন্যে অপরিহার্য ছিল।

কোনো সংস্কৃতির বিবর্তনের কোনো এক পর্যায়ে এতে নতুন একটি উপাদান যোগ হতে পারে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে নববর্ষের শোভাযাত্রা, ঠিক যেমন করে সুদূর অতীতে কোনো একদিন যুক্ত হয়েছিল গাজনের গান বা গম্ভীরা। 'আমার ভাইয়ের রক্তে-রাঙানো' গান গেয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির পদযাত্রা এবং শহীদমিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ সম্পূর্ণ নতুন দুটি সাংস্কৃতিক আচার যা পঞ্চাশের দশকে শুরু হয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে। পান্তা-ইলিশ খাওয়া নববর্ষ উৎসবে মাত্র এক দশক আগে যুক্ত হওয়া একটি উপাদান এবং লাল-সাদা রঙ অতিসম্প্রতি যুক্ত হওয়া একটি উপাদান।

সংস্কৃতি ও ধর্ম দেশের বাইরে থেকেও আসতে পারে। বাংলাদেশে প্রচলিত চারটি প্রধান ধর্মের তিনটির উৎস বিদেশ। 'রাষ্ট্রধর্ম' ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের উৎস আরবদেশ, হিন্দু ধর্মের উৎস ইরান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান। পাশ্চাত্য-প্রভাবিত পোষাক প্যান্ট-শার্ট-কোট-টাইয়ের উৎস শীতপ্রধান ইওরোপ। মধ্যপ্রাচ্য-প্রভাবিত বাঙালির জেল্লাবা-হিজাব-নেকাবের উৎস গ্রীষ্মপ্রধান আরবদেশ।

একটা ধর্মের রূপ কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে যে জাতির মাধ্যমে ধর্মটা প্রচারিত হয়েছিল তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের উপর। কথিত আছে যে, বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল প্রধানত সুফি সাধকদের চেষ্টায় যারা অনেকেই ছিলেন ইরানের অধিবাসী। ইরানের লোকেরা এক সময় অগ্নিউপাসক ছিল, বৌদ্ধ ছিল, খ্রিস্টান ছিল। পারসিকদের একটা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, যুগে যুগে যে ধর্মই তারা পালন করুক না কেন, তারা মাজার/কবর পূজা করত, তাবিজে বিশ্বাস করত, ধর্মীয় অনুসঙ্গে নাচগান করত। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরও ইরানিদের মধ্যে এই প্রবণতা বজায় ছিল।

সুফি ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে এই পারসিক প্রবণতা ছড়িয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তান থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ভারতবর্ষের সর্বত্র। সেখান থেকেই মাইজভাণ্ডারের গান, বায়েজিদ বোস্তামির পুকুরের কচ্ছপ, খান জাহান আলীর কুমির, বার-আউলিয়ার মাজার। শুদ্ধবাদীদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুসলমানদের অনেক আচরণ 'বেদাত' বলে মনে হতে পারে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে কেন যে, এই বেদাতের আকর্ষণেই হয়তো এদের পূর্বপুরুষেরা নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

খাজনা আদায়ে সুবিধা হবে বলে অবাঙালি মুসলমান সম্রাট আকবর হিন্দুস্তানে একটি নতুন ফসলি সন প্রবর্তন করেছিলেন। এই সনটি শুরু হত বৈশাখ মাসে এবং কোনো অজ্ঞাত কারণে সনটি 'বাংলা সন' নামে এতদাঞ্চলে এখনও কমবেশি টিকে আছে। পুরো মুঘল আমল, ইংরেজ আমল, পাকিস্তান আমলজুড়ে এই মুঘল সনটি অনুসরণ করে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান চাষবাস, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলা বা হালখাতায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই অংশ নিত।

বাংলাদেশে শুধু নয়, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি নববর্ষ উৎসব উদযাপিত হয় পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওসসহ পৃথিবীর এক বিস্তৃর্ণ এলাকায়। বাংলাদেশ ও আসামের মঙ্গোলীয় ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা বৈসাবি, বিহু, সাংগ্রাই ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করে আসছেন স্মরণাতীত কাল থেকে। এরা যদি বাঙালিদের অন্যতম পূর্বপুরুষ হয়ে থাকে, তবে বাঙালিরা এই উৎসব পালন করছে হিন্দু, বৌদ্ধ, এমনকি বাঙালি হবারও বহু আগে থেকে। সুতরাং পহেলা বৈশাখ কোনো মতেই নিছক হিন্দু সংস্কৃতি হতে পারে না।

যুগে যুগে ধর্ম আর সংস্কৃতি পরস্পরের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে। ধর্ম সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলে অবশ্যই, কিন্তু 'ধর্মের বাইরে কোনো সংস্কৃতি নেই'– এমন পরিস্থিতি প্রায় কখনও সৃষ্টি হয় না। সংস্কৃতিও যে ধর্মের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় তার প্রমাণ, আরব দেশের খ্রিস্টধর্ম আর ইওরোপের খ্রিস্টধর্ম এক নয়। মিশর, ইরান, আলজেরিয়া, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া– এই সব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলাম, কিন্তু তাদের পোষাক, খাদ্য, ঘরবাড়ির ধরন, বিবাহের রীতিনীতি কি এক? আরবের মুসলমান আর বাংলাদেশের মুসলমান কি ইফতারে এক খাবার খায়?

আলজেরিয়া-মরক্কো-তিউনিশিয়ার মুসলমান বাঙালি হিন্দুদের মতো উলু দেয়। ইথিওপিয়ায় মুসলমান মেয়েদের খৎনা করানোর প্রথা আছে। বসনিয়ার মুসলমানেরা এই প্রথাকে বীভৎস মনে করে।

পৃথিবীর অনেক দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী ধর্ম পালনের সাঙ্গে সঙ্গে ইসলাম-পূর্ব স্থানীয় সংস্কৃতি সমুন্নত রেখেছে। ইরানের মুসলমানেরা ইসলাম-পূর্ব যুগ থেকে নববর্ষ বা নওরোজ উৎসব পালন করে আসছে। রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনিভিত্তিক নাচগানকে ইন্দোনেশীয় মুসলমানেরা তাদের সংস্কৃতির অংশ বলে মনে করে। হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর বাহন গরুড় পক্ষীর নামানুসারে তারা নিজেদের এয়ারলাইন্সের নাম রেখেছে 'গাড়োরা'। আরব-পারস্য অঞ্চলে নাচগানের সংস্কৃতি বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে কীভাবে? ইরানে কীভাবে উন্নতমানের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে চলেছে?

জানতে ইচ্ছে করে, মিশরের মুসলমানেরা কি নিজেদের প্রথমত মুসলমান, তারপর আরব এবং তারপর মিশরীয় মনে করে? চীনা মুসলমান কি চীনা জাতীয়তাকেই প্রাধান্য দেয়, নাকি নিজেদের প্রথমত মুসলমান মনে করে? বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়জনিত দ্বিধা দূর করার জন্যে অন্য দেশের মুসলমানদের আচরণ ও ভাবনার মানচিত্র সামনে রাখাটা জরুরি।

শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠায় আছে: ''ইস্কুলের মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের 'ফুটবল ম্যাচ'''। এই বাক্যটির উপর ভিত্তি করে আশির দশক থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে 'বাঙালি' মানে নিছকই 'হিন্দু'। ভুলে গেলে চলবে না যে, 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের পটভূমি ভারতের বিহার অঞ্চল, বিশেষ করে ভাগলপুর জিলা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিহারে বসবাসরত বাঙালিদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু। 'বাঙালি' বলতে সে কালে এবং সে স্থানে 'হিন্দু বাঙালি' বোঝাত এবং 'মুসলমান' বলতে স্থানীয় বিহারি মুসলমান বোঝাত। 'হিন্দু' বলতে বাঙালি হিন্দু ও বিহারি হিন্দু দুই-ই বোঝাত। শরৎচন্দ্রের যুগে বিহারে বাঙালি মুসলমান ছিলই না বলতে গেলে।

একটা সময় ছিল যখন হিন্দু লেখকেরা 'বাঙালি' বলতে বাঙালি হিন্দুদেরই বোঝাতেন। ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানে এমন অনেক বাঙালি মুসলমান নিশ্চয়ই ছিলেন এবং বাংলাদেশেও এখনও হয়তো কিছু আছেন যারা নিজেদের বাঙালি নয়, বরং শুধু মুসলমান ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

উপমহাদেশে আর কোনো জাতি সম্ভবত বাংলাদেশের অধিবাসীদের মতো আত্মপরিচয়ের সংক্রামক ও ক্রনিক দ্বিধায় ভোগে না। একটি বুনিয়াদী দ্বিধা হচ্ছে: আমরা বাঙালি, নাকি বাংলাদেশি? ইংরেজি 'নেশন' শব্দটির দুটি অর্থ আছে: 'জাতি' এবং 'রাষ্ট্রজাতি'। বাংলায় 'জাতি/জাতীয়তা' শব্দেও এই দ্ব্যর্থবোধকতা আছে যা দূর করতে 'রাষ্ট্রীয়তা' শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, স্কটিশদের জাতীয়তা স্কটিশ, ব্রিটিশদের জাতীয়তা ব্রিটিশ, কিন্তু উভয় জাতির রাষ্ট্রীয়তা ব্রিটিশ। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের জাতীয়তা 'বাঙালি', কিন্তু রাষ্ট্রীয়তা 'ভারতীয়'। 'ব্রিটিশ' শব্দে 'জাতি' বোঝাতে পারে, আবার আইরিশ, স্কটিশ, ওয়েলশ, ব্রিটিশ ইত্যাদি জাতি মিলিয়ে একটি 'রাষ্ট্রজাতি'ও বোঝাতে পারে।

একইভাবে 'বাঙালি' শব্দেও জাতি এবং রাষ্ট্রজাতি উভয়ই বোঝাতে পারে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলের আগে জাতি হিসেবে আমরা বাঙালিই ছিলাম। তখন আমাদের কোনো রাষ্ট্রীয়তা ছিল না। এখন আমরা বাঙালিদের জাতীয়তা বাঙালি, রাষ্ট্রীয়তা বাঙালি, আমাদের রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবুর রহমান। গারোদের জাতীয়তা গারো, রাষ্ট্রীয়তা বাঙালি, তাদেরও রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবুর রহমান।

কিছু রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও টকসওয়ার নিজেদের বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে 'জাতি' ও 'রাষ্ট্রজাতি'– এই উভয় অর্থে 'বাংলাদেশি' শব্দটা ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। শুধু 'রাষ্ট্রজাতি' অর্থে 'বাংলাদেশি' শব্দটি ব্যবহৃত হলেও হতে পারে, 'জাতি' অর্থে কখনও নয়। জাতি গঠিত হতে হাজার বছর লেগে যায়। রাষ্ট্রের সীমানা, চরিত্র, নাম ও পিতার নাম কিছু দিন পর পর বদলাতে পারে।

যে দুটি প্রশ্ন দিয়ে বর্তমান নিবন্ধের শুরু সেগুলো মূলত রাজনৈতিক। সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রশ্নে বাংলাদেশের জনগণ কমপক্ষে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে আছে। প্রথম দল সংস্কৃতি আর ধর্ম উভয়টি ষোল আনা বজায় রাখার পক্ষপাতী। দ্বিতীয় দল শুধু ধর্ম রাখতে ইচ্ছুক, সংস্কৃতিকে তারা বেমালুম বাদ দিতে চায়। তৃতীয় সংখ্যালঘু দলটি রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে মেলাতে চায় না। তাদের কথা হচ্ছে: ধর্ম যার যার, সংস্কৃতি সবার।

পাকিস্তান আমলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছিল ক্ষমতাসীন দ্বিতীয় দলের বিরুদ্ধে প্রথম ও তৃতীয় দলের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। ১৯৭১ সালের গণহত্যা প্রথম ও তৃতীয় দলের উপর দ্বিতীয় দলের প্রতিশোধ। ১৯৯০পরবর্তী তথাকথিত 'নির্বাচনের আমলে' দ্বিতীয় দল যখন অনেকটাই ক্ষমতায় তখন প্রথম দল বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রবর্তন করে নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিয়েছিল। নববর্ষ উৎসবটি প্রথম ও তৃতীয় দলের শক্তির অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়েছে বলে দ্বিতীয় দল একে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে।

এক সময় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি বা পুষ্পার্ঘ্য-প্রদানকেও 'হিন্দুয়ানী' বলে সমালোচনা করা হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর বা ২৬ মার্চও একদিন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, কারণ এই সবগুলো উৎসব 'বাঙালিয়ানার' এক সূত্রে গাঁথা।

ভূপৃষ্ঠের টেকটোনিক প্লেটগুলোর মতো বাংলাদেশের জনখণ্ড তিনটি পরস্পরকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে এবং সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো তিন দলের কাছে নিজেদের কমবেশি গ্রহণযোগ্য রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিন জনখণ্ডের মধ্যে চলমান এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হবে সন্দেহ নেই। এতে কে জিতবে তার উপর নির্ভর করবে নিকট ভবিষ্যতে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি গঠন করা সম্ভব হবে কি না।

বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে (পিঠাভাগে) যে বানরেরই লাভ হবে তা তিন দলের হবু সদস্য ও পৃষ্ঠপোষকদের বুঝতে হবে। দ্বিতীয় দলের জয় হলেও সেই জয় দীর্ঘস্থায়ী হবে না, কারণ বানর মূলত তাদের পছন্দ করে না, নিছক আঞ্চলিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে অস্ত্রবিক্রির ফায়দা লুটবার জন্যে তাদের ব্যবহার করে।

প্রথম ও তৃতীয় দলকে জয়যুক্ত হতে হলে বাঙালি নারী-পুরুষকে তাদের সন্তানদের হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে যোগ দিতে হবে উৎসবে, শোভাযাত্রায়। দ্বিতীয় দল চায় মানুষ গৃহবন্দি থেকে কূপমণ্ডুকে পরিণত হোক যাতে তারা জনগণের মূর্খতার ফায়দা লুটতে পারে। উৎসব এদের একেবারেই 'না-পসন্দ', কারণ যে কোনো উৎসব মানুষকে মুক্তির স্বাদ দেয় এবং মুক্ত মানুষকে 'সাত পাঁচ চৌদ্দ' বোঝানো যায় না।

সুতরাং প্রতি পহেলা বৈশাখে নব আনন্দে জাগো! যুদ্ধযাত্রা বা শোভাযাত্রা, যে কোনো 'হৈহয়' যাত্রা ক্ষুদ্র-বৃহৎ-সমধর্মী-বিধর্মী নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে শক্তিশালী বাঙালি রাষ্ট্রজাতি গঠনে অনুঘটকের কাজ করবে।