জয়ের ৩০০ মিলিয়ন ডলারের তথ্যটি কোত্থেকে এল

শওগাত আলী সাগর
Published : 3 May 2016, 07:38 AM
Updated : 3 May 2016, 07:38 AM

বেগম খালেদা জিয়া যেদিন জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের একাউন্টে ৩০০ মিলিয়ন ডলার জমা আছে বলে দাবি করলেন, সেদিনই ফেসবুকে এক পোস্টে মন্তব্য করেছিলাম, ''এ ব্যাপারে জয়ের একটি ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার।''

সজীব ওয়াজেদ জয়কে ধন্যবাদ তিনি তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং বেগম খালেদা জিয়াকে একটি চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছেন। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা বেগম জিয়ার মন্তব্যটুকু আবার উদ্ধৃত করতে পারি। তিনি বলেছেন:

"এফবিআইএর একজন এজেন্টকে ঘুষ দিয়ে এক প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের ব্যাপারে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিল। সেই মামলার নথিতেই আছে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের একটি একাউন্টেই আড়াই হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন ডলার জমা আছে। এই টাকার কোথা থেকে গেছে? এই টাকার উৎস কী?"

এফবিআইএর এক এজেন্টকে ঘুষ দিয়ে জয়ের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টার মামলার নথি নিজের বক্তব্যের ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়েছেন খালেদা জিয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই মামলার প্রায় সবকটি নথি প্রকাশ্য এবং বিভিন্ন সময় সেগুলো ফেসবুকেও পোস্ট হয়েছে। কোনো কোনো নথি সজীব ওয়াজেদ জয় নিজেও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ফলে মার্কিন আদালতের নথিপত্র এখন আর গোপন নেই। বেগম খালেদা জিয়া মামলার কোন নথিতে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একাউন্টে ৩০০ মিলিয়ন ডলার আছে বলে তথ্য পেয়েছেন, তার উল্লেখ করেননি। করলে সেটি নিয়ে আমাদের আলোচনার সুবিধা হত।

এফবিআই এজেন্টকে ঘুষ দেওয়ার মামলার তিনটি নথি আমার হাতে আছে এবং সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়ার সুযোগ হয়েছে। মামলার এজাহার, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার আবেদন এবং আদালতের প্রসিডিংস। মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস থেকে আনুষ্ঠানিক একটি বিজ্ঞপ্তিও মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে। তার মধ্যে আদালতের প্রসিডিংসএর সূত্র ধরে সাংবাদিক বার্গম্যান একটি প্রতিবেদনও করেছেন। তিনটি নথির কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে জয়ের একাউন্টে ৩০০ মিলিয়ন ডলার আছে, এমন তথ্য নেই। তাহলে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের তথ্যটি কোত্থেকে এল?

আদালতে দায়ের করা এজাহারে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে:

On or about September 26, an FBI employee in the white plains R. A. entered the an FBI data base of FBI documents and retrieved an internal FBI memorandum that referred to, among, other things individual 1 and some of 300 million dollars (The FBI Memo).

মামলার এজাহারে উল্লিখিত individual 1 and some of 300 million dollars (The FBI Memo) কি জয়ের একাউন্টে ৩০০ মিলিয়ন ডলার থাকার তথ্য নির্দেশ করে? করে না। বেগম খালেদা জিয়া যদি ৩০০ মিলিয়ন ডলার-সংক্রান্ত এফবিআইর মেমোটি কী, তার সঙ্গে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সম্পর্ক কী তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন, তাহলে হয়তো-বা রাজনীতির মাঠে তিনি কিছুটা বাতাস পেতেন।

আরেকটি বিষয়, মামলার এজাহারে individual 1 কে তার কোনো উল্লেখ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে সজীব ওয়াজেদ জয় নিজে এই মামলার ক্ষতিগ্রন্ত হিসেবে আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন না করা পর্যন্ত কিন্তু কোথাও তার নাম আসেনি। জয় আদালতে এক দফা বক্তব্য উপস্থাপন করার পরই প্রসিকিউশন নথিতে individual 1 যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় সেটি পরিষ্কার করেছেন।

একটি বিষয় বুঝতে হবে। এই মামলার বাদী কিন্তু মার্কিন সরকার। মামলায় সরকারপক্ষ সজীব ওয়াজেদ জয়কে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করেছেন। আদালত সেই আবেদন গ্রহণ করেননি এবং তা না করার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। আদালত স্পষ্ট করে বলেছেন, বিচারের জন্য উপস্থাপিত মামলাটিতে অপরাধ হচ্ছে ঘুষ দেওয়া এবং সরকারি গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার জন্য ঘুষ দেওয়া। আদালত স্পষ্ট করে বলেছেন, যে তথ্য ফাঁস করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি মার্কিন সরকারের তথ্য; ঘটনাটি ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কাজেই এই মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কোনো ব্যক্তি নয়।

এ বিষয়ে প্রসিকিউশন ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভিন্ন যুক্তি থাকলেও আদালতের যুক্তি ফেলনা নয়।আদালতের সামনে বিচার্য ছিল ঘুষ দেওয়া, অপহরণ বা হত্যার ষড়যন্ত্র নয়। ফলে আদালত সজীব ওয়াজেদ জয় কিংবা প্রসিকিউশনের আবেদনটিও গ্রহণ করেননি। এতে কিন্তু কোনো অভিযোগ নাকচ হয়ে যায় না। প্রসিকিউশন তার তদন্তে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পেলে এ নিয়ে আলাদা করে মামলা বা আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে।

যাক, আমরা বরং ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যেই আমাদের আলোচনা সীমিত রাখি। আদালতের নথিতে 'individual 1 এবং ৩০০ মিলিয়ন ডলার সম্পর্কিত এফবিআইর মেমো' কথাটা উল্লেখ করা হয়েছে। এই ৩০০ মিলিয়ন ডলার যে সজীব ওয়াজেদ জয়েরই, তার উল্লেখ নেই। এমনকি এই ডলারের সঙ্গে তাঁর কোনো ধরনের যোগসূত্রের কথাও উল্লেখ নেই।

তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে, ৩০০ মিলিয়ন ডলার-সংক্রান্ত কোনো একটি বিষয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সম্পৃক্ততা এফবিআই অনুসন্ধান করেছে। সেই অনুসন্ধানে জয়ের সম্পৃক্ততা বা দোষ পাওয়া গেলে মামলার বাদীপক্ষ তথা মার্কিন সরকার জয়কে মামলার ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে আদালতে উপস্থাপনের চেষ্টা করবে কেন? প্রসিকিউশনের তো বরং জয়কে এই মামলায় কিংবা পৃথক মামলায় অভিযুক্ত করার কথা। তা না করে এফবিআই, প্রসিকিউশন জয়কে মামলায় ভিকটিম হিসেবে অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করল কেন?

আমাদের রাজনীতির একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, নেতারা যা খুশি তা-ই বলে ফেলেন, তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই কারও চরিত্রহননে বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করেন না। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও তেমনি একটি বালখিল্য আচরণ করেছেন– জয়ের একাউন্টে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার কল্পিত অভিযোগ তুলে। নেতাদের দায়িত্বশীলতার বিষয়টি কি আমরা কিছুতেই আশা করতে পারি না?