নারকীয় হত্যা ও আত্মঘাতী নির্লিপ্ততা

নাদির জুনাইদ
Published : 2 May 2016, 08:27 AM
Updated : 2 May 2016, 08:27 AM

সত্তরের দশকের সূচনায় পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সেই সহিংস সময়ে নির্মিত মৃণাল সেনের 'পদাতিক' (১৯৭৩) ছবিটির শুরুতেই একটি ভয়েস-ওভারে আমরা শুনতে পাই কলকাতার তৎকালীন সময় নিয়ে কয়েকটি কথা:

"এক একটি বছরের ফারাক, আর দেখি কলকাতা আরও দুঃসহ, আরও যন্ত্রণাময়। মনে হয় নোংরা যেন আরও বীভৎস, হতাশা আরও মরিয়া। যতবার কলকাতার মুখোমুখি হই মনে হয় এ এক নারকীয় শহর। যার শিয়রে হয়তো-বা সমূহ সর্বনাশ।"

যখন বর্তমান সময়ে আমাদের সংবাদপত্রগুলিতে উঠে আসে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক নিরীহ, নিরস্ত্র, অপ্রস্তুত মানুষদের নৃশংসভাবে কুপিয়ে বা গুলি করে হত্যা করার খবর, তখন মনে হয় তেতাল্লিশ বছর আগে অন্য দেশে তৈরি একটি চলচ্চিত্রের সেই কথাগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের সাম্প্রতিক সময়ের তেমন অমিল নেই। যদিও অন্য দেশের সেই ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাসমূহের মিল নেই, কিন্তু ছবির এই কথাগুলো প্রাসঙ্গিক শোনায়।

গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে আমাদের দেশে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় তিন লেখক আর ব্লগারকে। আর এই বছর কেবল এপ্রিল মাসেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ ছয় জনকে। এক একটি বছর এগিয়ে চলেছে আর আমাদের সময় কি আরও দুঃসহ, আরও ভীতিকর হয়ে উঠছে না? বার বার একই ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটার পরও যখন খুনি আর খুনের পরিকল্পনাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, তখন এক সমূহ বিপদের আশঙ্কায় আমাদের আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে উপায় থাকে না।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক রেজাউল করীম সিদ্দিকীকে হত্যা করার দুদিন পর গাজীপুরে হত্যার শিকার হন একজন সাবেক কারারক্ষী। এই হত্যাকাণ্ডসমূহ 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে তখন উল্লেখ করেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর এমন মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকার জনবসতিপূর্ণ এলাকা কলাবাগানে একটি অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান আর তাঁর বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে। বহু মানুষের সার্বক্ষণিক আনাগোনায় ব্যস্ত এই এলাকায় দুজনকে হত্যা করে চলে যায় খুনিরা। একজনকেও ধরা যায়নি।

কয়েক সপ্তাহ আগেই পুরনো ঢাকার সূত্রাপুরে ব্যস্ত রাস্তায় একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী নাজিমুদ্দিন সামাদকে। তখনও খুনিরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে গিয়েছিল। জুলহাজ-তনয় হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য 'টার্গেট' করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। এই মন্তব্যের পর বোঝা যায়, এই হত্যাসমূহ যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন আর তা মনে করছেন না।

সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বলছেন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এই ধরনের হত্যাকাণ্ড একের পর এক ঘটানো হচ্ছে। কিন্তু কেবল এই কথা জনগণকে বলাই কি যথেষ্ট? নির্মম এই খুনিদের গ্রেফতার করার ব্যাপারে সরকারের গোয়েন্দা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহের সাফল্য কতটুকু?

গত বছর হত্যা করা হয়েছিল বিজ্ঞান-বিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায় আর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল এমন কাউকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। আর ফয়সল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ছয় মাসেও শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। অভিজিৎ রায়ের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, "আমাদের সরকার, গোয়েন্দা বাহিনী একটা নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে আছে। ওদের খুনি ধরার ইচ্ছে নেই, সক্ষমতাও নেই। প্রতিটি খুনের পর ওরা যেভাবে কথা বলছে, তাতে করে খুনিরা আশকারা পাচ্ছে।"

গত বছর নিহত গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী নীলাদ্রি নিলয়ের স্ত্রী আশা মণি বলেছেন, "সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ যেন লেখালেখি না করে। বলা হয় অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ যেন কেউ না করে। আমার স্বামী কি ধর্মের বিরুদ্ধে লিখেছিল? কোনো প্রমাণ আছে? শুধু ঢালাও অভিযোগ। যারা খুন হচ্ছেন তারা অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করছেন, আর যারা চাপাতিতে শান দিচ্ছেন তাদের আচরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ?"

এমন ধারণা কি তৈরি হওয়া অযৌক্তিক যে, লেখক, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, প্রকাশকদের একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করার পর প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করে তাদের দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি বলেই এই খুনিরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে এবং তারা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে? মতের মিল না হলেই যারা চাপাতি দিয়ে অন্যদের কুপিয়ে হত্যা করে সেই মানুষরূপী দানবদের প্রতি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে তাদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় না আনলে এই সমাজ কি নিরাপদ আর সুস্থ থাকতে পারে?

আমরা বিশ্বাস করতে চাই, যারা একের পর এক এমন পাশবিক হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে সরকার তাদের বিচার করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কেবল বক্তব্য প্রদানই যথেষ্ট নয়, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সরকারকে এই খুনিদের প্রতি তাদের কঠোর মনোভাব জনগণের সামনে স্পষ্ট করতে হবে।

এমন ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে কথা বলার সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছেন, পুলিশ ঘরে ঘরে পাহারা দিতে পারবে না। প্রত্যেককে তাই নিরাপত্তা-বলয় তৈরি করতে হবে। মহাপরিদর্শকের এই বক্তব্য শান্তিপ্রিয় মানুষদের আশ্বস্ত করতে পারবে না। কারণ চাপাতি হাতে অতর্কিতে এগিয়ে আসা উন্মত্ত খুনিদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ কীভাবে নিরাপত্তা-বলয় তৈরি করবে? এই সমাজের কিছু মানুষের মতো দেহরক্ষী নিয়ে তো একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক, প্রকাশক, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী বা সঙ্গীতশিল্পী চলাফেরা করেন না। আর এমন প্রগতিশীল মানুষরাই এখন দানবীয় হামলার শিকার হচ্ছেন। যেমনভাবে ১৯৭১ সালেও এই দেশের পাকিস্তানপন্থী ঘাতকরা হত্যা করেছিল দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীকে।

কেন মাসের পর মাস কেটে গেলেও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত এবং গ্রেফতার করতে তাঁর বাহিনীর সদস্যরা ব্যর্থ হয়েছেন, পুলিশ মহাপরিদর্শকের বরং সেই আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া উচিৎ। তাঁর প্রশ্ন তোলা উচিৎ কীভাবে অভিজিৎ আর ফয়সল হত্যার সঙ্গে যুক্ত 'দু-একজন' দেশের বাইরে চলে গেল, আর তাদের গ্রেফতার করতে পুলিশ ব্যর্থ হল? সন্তোষজনকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও আত্মসমালোচনার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে আমরা দেখি না।

পুলিশ মহাপরিদর্শক মন্তব্য করেছেন, জুলহাজ-তনয়ের হত্যাকারীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় জনগণ যদি বেরিয়ে আসত তাহলে হয়তো দুর্বৃত্তদের আটক করা সম্ভব হত। এই কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। অন্যায় দেখলে প্রতিরোধে মানুষের এগিয়ে যাওয়া কর্তব্য। কিন্তু কেন আমাদের বর্তমান সমাজে চোখের সামনে অন্যায়কারীদের দেখলেও সাধারণ মানুষ নিষ্ক্রিয় থাকে সেটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। হত্যা করে খুনিরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়, পরে পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যায় না এমন বাস্তবতা সাধারণ মানুষের মনে কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি করবে এক গভীর ভীতি আর নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি।

প্রশিক্ষিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে খুনিদের শনাক্ত করতে পারে না, সেই খুনিদের অস্ত্র হাতে চোখের সামনে দেখলে সাধারণ পথচারীরা ভীত হয়ে পড়তেই পারে। অথচ এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটার পরই খুনিদের গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ভীত হয়ে পড়ত খুনিরা আর এই ঘৃণ্য অপরাধীদের প্রতিরোধে সাহসী হয়ে উঠত সাধারণ মানুষ। একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিও বৃদ্ধি পেত জনগণের আস্থা। এই বিষয়গুলো অনুধাবন করা কঠিন নয়।

তবে এক একটি হত্যার পর কিছুদিন প্রতিবাদ হয়, তারপর আবার যেন আত্মসুখে মগ্ন হয়ে ওঠে বর্তমান সমাজের অনেক মানুষ। ধারাবাহিক নৃশংসতার প্রতি গণমানুষের জোরালো প্রতিবাদ কেন আজ স্বল্পস্থায়ী সেই দিকগুলো নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। যে সচেতনতাবোধ সামাজিক আর রাজনৈতিক অন্যায় কী আর এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ কেন জরুরি তা বুঝতে মানুষকে সাহায্য করে, সেই জরুরি সচেতনতা নতুন সময়ের মানুষদের মধ্যে সৃষ্টি করার উপযুক্ত পরিবেশ কি এই সমাজে আমরা দেখতে পাচ্ছি?

মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বের কথা রাষ্ট্রীয়ভাবে সব সময় বলা হচ্ছে। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা এবং নীতিনির্ধারক মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সমাজের কমবয়সীরা যেন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যবোধ আর চেতনা ধারণ করতে পারে সেই দিকটি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিশ্চিত করা হচ্ছে এই সময়ে?

অন্ধবিশ্বাস, অন্যের মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা আর সামাজিক অন্যায় দেখে প্রতিবাদহীন থাকা তো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যমের বিভিন্ন অনুষ্ঠান নতুন সময়ের মানুষদের যুক্তি দিয়ে গভীরভাবে ভাবতে অনুপ্রাণিত করতে পারছে কি? নাকি পুঁথিগত লেখাপড়ার চর্চা আর গণমাধ্যমে শুধুই বিনোদন-যোগানো চাকচিক্য-সর্বস্ব অনুষ্ঠানের আধিক্য নতুন প্রজন্মের বহু মানুষকে করে তুলছে অগভীর আর অন্তঃসারশূন্য?

সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার রাজনীতির যে শাণিত রূপ অতীতে দেখা যেত, বাজার আর মুনাফার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার বিশ্বায়ন-পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদী রাজনীতির সেই উত্তাপ অনেকটাই কমে গেছে। যে ধরনের সমাজসচেতন সাংস্কৃতিক চর্চার কারণে শক্তিশালী হত প্রতিবাদী রাজনীতি, তা-ও কমজোরি হয়েছে মুনাফালোভী সময়ে। সেই সুযোগে বেড়েছে ধর্মীয় অন্ধত্ব আর আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতি।

সমাজে চিন্তাসমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা কমে যাওয়ার কারণে অনেক মানুষ আর এখন যুক্তি দিয়ে, গভীরভাবে কোনো বিষয় অনুধাবন করতে সক্ষম নন। ফলে তাদের মন সহজেই গ্রাস করছে অন্ধবিশ্বাস আর যুক্তিহীন ঘৃণা। অন্যদিকে চটুল সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারের জন্য বহু মানুষের রুচিবোধ হয়ে উঠছে অত্যন্ত কদর্য। স্থূলতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়া মানুষ নিজ দেশের ইতিহাস জানার মাধ্যমে বর্তমান সময়ের গভীর বিশ্লেষণে মোটেও আগ্রহী নয়, বরং হালকা বিনোদনে মজে থাকার মধ্যেই এদের তৃপ্তি।

এমন মানুষের সংখ্যা যখন সমাজে বাড়তে থাকে তখন নির্বিঘ্নে শোষণ আর অন্যায় টিকিয়ে রাখা খুব সহজ হয়ে যায়। কারণ অসচেতন আর অগভীর মানুষ প্রতিবাদী হতে শেখেনি। সামাজিক অন্যায় আর যুক্তিহীন আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ আর প্রতিরোধ করার পরিবর্তে আলস্য আর আত্মকেন্দ্রিকতার জীবন টিকিয়ে রাখতেই তারা আগ্রহী।

মতের সঙ্গে না মিললেই অন্য মানুষদের পাশবিকভাবে হত্যা করার প্রবণতা এবং এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের দ্রত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার এবং বহু মানুষের প্রতিবাদ তীব্রতর না হওয়ার দৃষ্টান্ত একটি সমাজের নৈতিক অধঃপতন আর নিম্নগামিতাই নির্দেশ করে।

উনিশ শতকের বিখ্যাত ইংরেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন, কোনো সমাজ যদি অপ্রথাগত আর ভিন্ন ভাবনা সহ্য করতে না পারে তাহলে সেই সমাজে নির্বোধ আর অনুভূতিহীন মানুষের সংখ্যাই বাড়তে থাকবে। যুক্তিনির্ভর আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন মত শোনার উপর মিল গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন অপ্রথাগত এবং নতুন চিন্তা কখনও না শুনে সব সময় কেবল নির্দিষ্ট কয়েকটি বক্তব্যে যদি অন্ধভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয় সে ক্ষেত্রে সমাজে আমরা দেখতে পাব কিছু অন্তঃসারশূন্য স্লোগান। আর তখন সেই সমাজে মানুষের নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হবে।

মিলের এই বক্তব্যসমূহ আমাদের সমাজে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। নিজের সংকীর্ণ স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য জোরপূর্বক অন্যের যৌক্তিক মত দমন করার প্রবণতা সমাজের জন্য শুভ হয় না।

সমাজের মঙ্গলের প্রতি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য গণতান্ত্রিক সরকারকেও নিয়মিত নিজের মনোভাব আর কাজ বিশ্লেষণ করতে হবে। সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে কিনা সেই দিকটি নিয়মিত পর্যালোচনা করা জরুরি। বিখ্যাত রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইবনে-খালদুন বলেছিলেন, যখন কোনো সরকার অনেক ক্ষমতাশালী হয়ে যায়, তখন জনগণের কল্যাণ সাধনের প্রতি সেই সরকারের আর তেমন মনোযোগ থাকে না। তারা তখন নিজেদের স্বার্থ আর সুবিধা আদায়ে বেশি প্রাধান্য দিতে থাকে। ফলে সমাজে বাড়তে থাকে শোষণ আর সামাজিক অন্যায়। যে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হয়েছিল সামাজিক অন্যায় নির্মূল করার জন্য, দেখা যায় সেই প্রতিষ্ঠানই অন্যায় প্রশ্রয় দিচ্ছে। ফলে সেই সরকার অবধারিতভাবেই হয়ে পড়ে ভঙ্গুর আর জনবিচ্ছিন্ন।

ইবনে-খালদুনের এই বক্তব্য যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের যে নিজেদের এবং সমাজের মঙ্গলের স্বার্থেই আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া দরকার এই বক্তব্য তাই মনে করিয়ে দেয়।

সংবাদপত্রে ইদানিং নিয়মিতভাবে আমাদের দেখতে হচ্ছে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াল সংবাদ। অন্ধতা, অসহিষ্ণুতা আর স্বার্থপরতার দুঃসহ অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের সমাজে। শুভত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে এই কথা কেবল মুখে বলাই যথেষ্ট নয়। যদি সত্যিই শুভত্ব, নির্মলতা আর যুক্তি এই সমাজে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাহলে ফাঁকা স্লোগান আর কপটতা বাদ দিয়ে আন্তরিকভাবে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

এই দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং সমাজের সচেতন মানুষদের। অন্যায় আর যুক্তিহীনতার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে দেখার পরও যদি আমরা নীরব থাকি, তাহলে আমাদের নির্লিপ্ততা আর ঔদাসীন্য আত্মঘাতী হয়ে আমাদের ধ্বংসই ত্বরান্বিত করবে।