মিশুক মুনীর এবং তারেক মাসুদ একাত্তরের আদর্শের সৈনিক

শমী কায়সার
Published : 9 Sept 2011, 02:49 PM
Updated : 9 Sept 2011, 02:49 PM

ছোটবেলায় আকাশ ছুঁতে ইচ্ছে করত ভীষণ। আকাশে উড়োজাহাজ উড়ে গেলে দৌড়ে মাঠে গিয়ে উড়োজাহাজকে টা টা বলতাম আমি আর আমার ছোট ভাই। ভাবতাম বাবা উড়ে অন্য কোথাও যাচ্ছে। সবাই বলত আব্বু বিদেশে। একদিন ফিরবে। সেই একদিন আজও শেষ হল না। কিন্তু যখন ভাবি সুহৃদের (মিশুক মুনীরের ছেলে) কথা, ও কী ভাবছে? ওকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে পারবে না যে মিশুক ভাইয়া যুদ্ধে গেছে, বিদেশে গেছে; ফিরবে একদিন। ও জানে ওর বাবা ফিরবে না আর কোনো দিন। সুহৃদও আমাদের মতো ওর বাবার স্মৃতি, রেখে যাওয়া কাজ, রেখে যাওয়া ছাত্র, বন্ধুদের মাঝে বাবাকে বার বার খুঁজবে। কখনও হয়তো পাবে, কখনও হয়তো পাবে না।

মিশুক ভাইয়াকে আমি সবসময় দূর থেকে দেখেছি ওর শান্ত, সৌম্য, দৃঢ় ব্যক্তিত্ত্ব। আমাদের মাঝে ওকে একজন গুরুগম্ভীর মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করত। ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারের ঐ বিল্ডিংএ থাকতেন ড. আনিসুজ্জামান এবং শহীদ মোফাজ্জল হায়দারের পরিবার। মিশুক ভাইয়ারা থাকত দোতলায় আর আনিস চাচারা এবং সুমন ভাইয়ারা (শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিবার) থাকত তিন তলায়। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের বেড়াতে যাওয়ার প্রিয় জায়গা ছিল সেটি। সেখানেই মিশুক ভাইয়াকে দেখেছি। আমাদের ইস্কাটনের বাড়িতে ফটোগ্রাফার পাভেল রহমানের সঙ্গে মিশুক ভাইয়া বেশ কয়েকবার এসেছিল মার কাছে।

কিন্তু পরে বড় হয়ে যখন অভিনয় শুরু করি তখন মিশুক ভাইয়ার সঙ্গে কাজ করেছি দুটো নাটকে এবং সেই সময় মিশুক ভাইয়ার চিন্তা-চেতনা, ভাবনা, আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধ– সবকিছু নিয়ে তার উপলদ্ধির কথা জানলাম। তখনই আবিষ্কার করলাম মানুষটি এত রাগী নয়।

স্বল্পভাষী, লাজুক এবং দৃঢ়চেতা, বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। মুনীর চৌধুরী তার বাবা– অতি উৎসাহিত হয়ে মিশুক ভাইয়া কোনোদিনও বলত না। ওর ছোট ভাই তন্ময় ভাইয়াও সে রকমই। মিশুক মুনীর আপন আলোয়, আপন গুণে এবং জ্ঞানে আবির্ভূত হয়ে মানুষকে তার দ্যূতি ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে সে নিতান্তই একজন শহীদের সন্তান। বাবার পরিচয়কে পাশে রেখে তার একটি নিজস্ব পরিচয় সে বহন করেছে গর্বের সঙ্গে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। তাকে আমরা ফিরে পাব না ঠিকই, কিন্তু তার সাংবাদিকতা এবং কর্ম নিয়ে যে চিন্তা এবং চেতনা– আমি আশা করি তার হাতে তৈরি সাংবাদিকরা সেই চেতনা বহন করবে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করে। ব্যক্তিগত লোভ, দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা বা বেদনা মনের মাঝে সুপ্ত রেখে নির্মোহ সাংবাদিকতাই করবে।

মিশুক মুনীর ছিলেন একজন অত্যন্ত প্রচারবিমুখ মানুষ যিনি আত্মপ্রচার করেননি কখনও। আমি মনে করি তার বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার একটি উজ্জল দিক ছিল। আত্মপ্রচারের জন্য নয়, মানুষ এবং সমাজের সঠিক প্রচার করে যেন তারা। সমাজের মানুষদের যে কোনো বিচ্যুতি থেকে মুক্তি দিতে পারে।

মাটির ময়না ছবিটি আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জীবনের একটি দলিল। যা আমাদের বলে দেয় সমাজ, দর্শন, সমাজের দ্বন্দগুলোকে এবং চোখ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের চেতনার মাঝে এখনও কতটা হঠকারিতা রয়েছে। তারেক মাসুদ আমাদের একাত্তরের আদর্শের সৈনিক। যিনি যুদ্ধ করেছেন ক্যামেরা নিয়ে। তাঁর যুদ্ধ ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের মূল মন্ত্র দিয়ে প্রবাহিত করা। মন্ত্রটি তিনি গড়েছেন ছবির মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে, কথার মাধ্যমে। যিনি সবসময় মুক্ত চিন্তার যে কোনো ভাবনা, যে কোনো বয়সের মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। যিনি অনেকটা অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন নিজের অজান্তেই।

তিনি একজন নির্মাতা হিসেবেই নয়, একজন আদর্শিক সুন্দর চিন্তার মানুষ হিসেবে সবাইকে নিয়ে, সবাইকে একত্রিত করে গড়তে চেয়েছেন চলচ্চিত্র অনুরাগীদের নিয়ে একটি সুচিন্তিত সমাজ। গবেষণা ছিল তাঁর ছবির মূল প্রতিপাদ্য। তাই গবেষণা করতে গিয়ে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে তারেক ভাই ও ক্যাথরিন ছুটে বেরিয়েছেন। বাঙালি সংস্কৃতির নির্যাসকে তিনি শেকড় থেকে এনে সাধারণের জন্য প্রচার করেছেন সহজ কথায়, সঙ্গীতে আর ক্যামেরায়। আর এই ক্যামেরায় তাঁর সব সময়ের সঙ্গী ছিলেন মিশুক মুনীর। যিনি ছিলেন মূলত ক্যামেরার মানুষ।

ক্যামেরার গবেষক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই দুইজন সৃজনশীল মানুষ। এই যুগলবন্দী বন্ধুকে হারিয়ে আমরা ছিলাম নির্বাক।

ক্ষোভে, দুঃখে, বেদনায় চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে এই ভেবে যে, এই অভিশপ্ত দেশে যতদিন না যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় ততদিন আমরা থাকব অভিশপ্ত। অভিশাপ নিয়ে এভাবে চলতে হলে বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ব, আর হারাব প্রাণপ্রিয় সব আদর্শের সৈনিকদের, বন্ধুদের, পথপ্রদর্শকদের। সেই দিন আসবে কবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে এই অভিশাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে একমুঠো পবিত্র বাংলার মাটি ছিটিয়ে দিতে পারব মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের কবরে যা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ছিল?