ঘাতক-চক্র কি গায়েবি শক্তি

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 4 Sept 2011, 08:55 PM
Updated : 26 April 2016, 05:04 AM

২৩ এপ্রিল সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে মাথা কেটে হত্যা করা হয়েছে। অধ্যাপক সিদ্দিকী রাজশাহী শহরের শালবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেখান থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেদিনও সকাল সাড়ে আটটার ক্লাস নেওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরার জন্য। কিন্তু মাত্র কয়েক গজ না যেতেই দুই বা তিন মোটর সাইকেল আরোহী তাঁকে হত্যা করে নিরাপদে চলে যায়।

আনুমানিক সকাল সাড়ে সাতটায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। না অন্ধকারে, না আলো-আঁধারিতে– স্পষ্ট দিবালোক। এর মধ্যেই ঘাতকরা অধ্যাপক সিদ্দিকীকে হত্যা করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। শোনা যাচ্ছে, খুব কাছে থেকে না হলেও কিছুটা দূর থেকে অনেকেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখেছেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কেউ ঘাতক-দুর্বৃত্তদের ধরার জন্য ছুটে যাননি কিংবা চিৎকার-চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করার চেষ্টাও করেননি। ঘাতকরা নির্বিঘ্নে চলে যাওয়ার পরই কেবল কেউ কেউ অধ্যাপক সিদ্দিকীর উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা নিঃসাড় দেহটির কাছে গিয়েছেন।

মানুষ দেখেছে কিন্তু প্রতিবাদ করেনি, ঘাতকদের তাড়া করেনি– এটা এক অদ্ভূত ব্যাপার এবং এটা সাম্প্রতিক উপসর্গ। চোখের সামনে কাউকে মারতে দেখে, মরতে দেখে, এগিয়ে না আসার মতো অবস্থা আমাদের মধ্যে কেন তৈরি হল সেটা এক গভীর ভাবনার বিষয় বৈ কি! বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধারের জন্য, সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া আমাদের এক পুরনো সামাজিক রীতি, যুগ যুগ ধরে চলে আসা মানবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। কেন?

মানুষ কি মনে করছে যে, একজন বিপন্নকে রক্ষা করতে গিয়ে তার নিজের জীবনও বিপদাপন্ন হতে পারে? বাধা পেলে আক্রমণকারীরা যেমন বাধাদানকারীর ওপরও চড়াও হতে পারে, চাপাতির কোপ তার ঘাড়েও পড়তে পারে। আর সৌভাগ্যক্রমে সেটা যদি না-ও ঘটে তাহলে পরবর্তী সময়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করার শাস্তি (!) হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এমন হেনস্থার শিকার হতে হবে যে, পরোপকারের বাসনা চিরদিনের মতো হাওয়া হয়ে যাবে!

সম্ভবত এখন সেটাই হচ্ছে। রাজশাহীতে অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। যারা দেখেছেন, তারা ভয়ে মুখ খুলছেন না। তারা হয়তো ভাবছেন, অন্য আর সব হত্যাকাণ্ডের মতো এই হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হবে না, দোষীরা শাস্তি পাবে না। কাজেই শুধু শুধু কেন প্রত্যক্ষদর্শীর বিড়ম্বনায় জড়িয়ে পড়া!

অধ্যাপক সিদ্দিকীর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও তিনজন অধ্যাপক এ রকম হত্যার শিকার হয়েছেন। প্রথমে অধ্যাপক ইউনুস, তারপর অধ্যাপক তাহের। অধ্যাপক শফিউল ইসলাম এই ধারাবাহিকতায় তৃতীয় শিকার। সর্বশেষ সংযোজন অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী। ২০০৪ থেকে ২০১৬। বারো বছরে ৪ অধ্যাপক খুন। আগের খুনগুলোর কোনোটার হয় বিচার হয়নি, নয় হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ বিচার। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে ব্যর্থতাই বিচার না হওয়ার বড় কারণ।

আর এই বিচারহীনতার চলমান সংস্কৃতি ঘাতকদের উল্লসিত করছে, তাদের সাহস বাড়াচ্ছে এবং খুব পরিকল্পিতভাবেই ঠাণ্ডা মাথায় একটার পর একটা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে তারা। কেউ হয়তো বলতে পারেন, বারো বছরে ৪ অধ্যাপক খুন, কী এমন বড় ঘটনা? যদি প্রতি মাসে কিংবা নিদেনপক্ষে বছরে একটি অধ্যাপক খুনের ঘটনা ঘটত তাহলে না হয় বিচলিত হওয়ার কারণ থাকত। এখন এতটা বিরতি দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটছে যে, আমরা তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিচ্ছি এবং পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভূত ক্ষমতা আমরা অর্জন করতে পারছি।

২০০৪ সালে অধ্যাপক ইউনুস হত্যার পর প্রতিবাদ হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কয়েক দিন ক্লাস বন্ধ রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিরাপত্তার দাবি তোলা হয়েছে। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি। অধ্যাপক তাহের এবং অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে খুনের পরও একই ঘটনা ঘটেছে। কয়েক দিন উত্তেজনা, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। তারপর আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে যাওয়া।

এবার অধ্যাপক সিদ্দিকীকে নির্মমভাবে হত্যার পরও সব কিছু একই ধারায় চলছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করছেন। ক্ষোভে ফুঁসছেন। জীবনের নিরাপত্তার দাবিতে উদ্বিগ্ন শিক্ষকরা ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় হতাশা প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন করছেন, আর কতকাল এভাবে চলবে? আর কত শিক্ষককে এভাবে অকালে জীবন দিতে হবে? ঘাতকরা কি ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর কারও কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। অধ্যাপক সিদ্দিকীর খুনিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ শনাক্ত করতে পারবে কি না, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যাবে কি না সে প্রশ্নের জবাব জানা নেই। বিভিন্ন মহল থেকেই প্রশ্ন উঠছে, অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কারা হত্যা করল? কেন হত্যা করল? তিনি একজন নির্বিরোধ মানুষ। তাঁর কোনো ব্যক্তিগত শত্রু আছে বলে জানা যায় না।

ইদানিং ব্লগার হত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বলা হচ্ছে, মুক্তচিন্তার নামে এই ব্লগাররা পবিত্র ইসলাম ধর্মের কুৎসা রটাচ্ছে। মহানবী সম্পর্কে কটূক্তি করছে। ধর্মপ্রাণরা এসব সহ্য করতে পারছে না। তাই ব্লগারদের হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী তো ব্লগার নন। তিনি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করেন না। কারও সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনাও করেন না।

বরং যারা দীর্ঘ দিন ধরে অধ্যাপক সিদ্দিকীকে চেনেন, জানেন, তারা সবাই বলছেন, ধর্মের প্রতি তাঁর বিদ্বেষমূলক মনোভাব কখনও লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। মসজিদ-মাদ্রাসায় দানও করতেন। ধর্মের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলেননি। তারপরও কেন এমন নিপাট ভালো মানুষ অধ্যাপক সিদ্দিকীকে ঘাতকের চাপাতির আঘাতে প্রাণ দিতে হল?

শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতিবান ও মানবিক গুণসম্পন্ন করে গড়ে তোলার জন্য অধ্যাপক সিদ্দিকীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষার্থীদের লেখা নিয়ে একটি প্রকাশনাও তাঁর ছিল। নিজে ভালো সেতার বাজাতেন। গান-বাজনার চর্চা করতেন। অন্যদেরও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। ছেলেমেয়েরা যাতে বখে না যায়, দুর্বৃত্ত হিসেবে নিজেদের তৈরি না করে সে জন্য তিনি তাদের মানসিক উৎসর্ষ সাধনের চেষ্টায় নিয়োজিত রাখতেন।

পাশাপাশি, তিনি ভালো পড়াতেন। ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে পছন্দ করত। কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে তাদের ওপর নিজের বিশ্বাস বা মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তিনি কখনও করেছেন– এমন অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে কেউ করতে পারছে না। তারপরও তাঁকে খুন হতে হল। এরপর বিপন্ন ও অসহায় বোধ না করে উপায় থাকে কি?

ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা মানুষ-হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করছে, তাদের আমরা আইনের আওতায় আনতে পারছি না, এই ব্যর্থতার গ্লানি আমরা কীভাবে মোচন করব?

অধ্যাপক সিদ্দিকীর একটি 'অপরাধের' কথা তাঁর মৃত্যুর পর কেউ কেউ বলছেন। তিনি তাঁর গ্রামে একটি গানের স্কুল খুলেছিলেন। সেখানে ছেলেমেয়েদের গান শিখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের সুকুমার চিত্তবৃত্তির বিকাশের ক্ষেত্রে গান-বাজনা সহায়ক বিবেচনা করেই তিনি হয়তো এই গানের স্কুলটি করেছিলেন।

শোনা যাচ্ছে, গ্রামের কারও কারও নাকি এটা পছন্দ হয়নি। তারা সম্ভবত গান-বাজনা 'ধর্মবিরোধী' বলেই মনে করে। গ্রামে গানের স্কুল না করে যদি মাদ্রাসা তৈরি করতেন তিনি, তাহলে হয়তো বেশি বাহবা পেতেন। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের অনুরাগী ছাত্র, আধুনিক চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী সবাই যেটা করে সোয়াব হাসিল করতে চায় সে পথে না হেঁটে একটু ভিন্ন পথে হেঁটেছেন।

দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি হয়তো বুঝেছেন যে, আমাদের দেশে এখন নতুন করে মাদ্রাসা তৈরির প্রয়োজন নেই। মাদ্রাসা প্রায় প্রতি গ্রামেই আছে। গ্রামে যেটার এখন মারাত্মক অভাব সেটা হল, ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ সীমিত। ধর্মীয় অনুশাসন যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মূল্যবোধের সম্পর্ক। মানুষের মধ্য থেকে উদারতা দূর হচ্ছে। সংকীর্ণতার ঘেরাটোপে আমাদের নতুন প্রজন্ম আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। সে জন্য গ্রামে গানের স্কুল করাটা ছিল অধ্যাপক সিদ্দিকীর নবযাত্রার অঙ্গীকার।

যারা একটু আলাদা মানুষ, চিন্তা-ভাবনায় যারা একটু ভিন্ন, যারা প্রথা মেনে চলার চেয়ে একটু আলাদাভাবে বাঁচার চেষ্টা করছেন– দেখা যাচ্ছে তারাই আমাদের দেশে হত্যার শিকার হচ্ছেন। কখনও তাদের গায়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার লেবেল সেঁটে দেওয়া হয়, কখনও-বা অন্য কিছু। আমাদের রাষ্ট্র, পুলিশ প্রশাসন, ঘাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চাইতে বেশি তৎপর হত্যার শিকার ব্যক্তিদের ধর্মবিশ্বাস বা কর্মবিশ্বাস নিয়ে।

কেউ যদি তার মুক্তচিন্তা দিয়ে মানুষের, সমাজের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি করে থাকে তাহলে তাকে প্রচলিত আইনেই শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কল্পিত অভিযোগে কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করার মতো গুরুতর অপরাধ আর কিছু হতে পারে কি?

হত্যা-খুনের ঘটনা উন্নত দেশেও হয়। তবে অন্য দেশে হত্যাকারী বা খুনি-চক্রকে আড়াল করার অপচেষ্টা দেখা যায় না। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কেউ ধরা পড়বে না, খুনিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে– এমন অবস্থা যে দেশে হয় সে দেশকে কেউ সভ্য দেশ বলে মনে করে কি? মুক্তচিন্তার নামে অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করা যদি অপরাধ হয় তাহলে যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এই অপরাধের বিচার করছে তাদের অপরাধ কি আরও মারাত্মক নয়?

কিন্তু এই অপরাধী হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে না পারা তো তাদের উৎসাহিত করারই নামান্তর। কোন গোষ্ঠী, কোন উদ্দেশ্যে প্রায় অভিন্ন কায়দায় আমাদের দেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে তাদের পরিচয় নিয়ে বিতর্কে না মেতে আমাদের উচিত অবিলম্বে মানুষ-হত্যা বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।

খুনিরা নিশ্চয়ই গায়েবি বা আসমানি শক্তি নয়। এই সমাজেই তাদের বসবাস। তাদের ধরতে না পারার ব্যর্থতা কোনো বিতর্ক দিয়েই আড়াল করা যাবে না।