উন্নয়ন, জনসম্পৃক্ততা ও বাঁশখালি ট্র্যাজেডি

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 17 April 2016, 04:44 AM
Updated : 17 April 2016, 04:44 AM

চট্টগ্রামের বাঁশখালী রক্তাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকের রক্ত ঝরেছে সেখানে। চার জন নিরীহ নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে। তারা গ্রামের মানুষ। রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো নাগরিক সুবিধা কোনোদিন পেয়েছেন কি না কে জানে! কিন্তু বুলেট পেয়েছেন। নরম কাদামাটির ঘরের দেয়াল বিদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্রীয় বুলেটে। আধপেট-খাওয়া শীর্ণ শরীর বিদ্ধ হয়েছে বুলেটে।

গ্রামের মানুষ নিজের মতো করে বাঁচে, বেঁচেছে হাজার বছর ধরে। রাষ্ট্র আছে, সরকার আছে এইসব ভাবেনি, ভাবে না অনেকে। তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে দেশের জন্য, রাষ্ট্র কী তারা অনেকেই বুঝে না। তাদের অনেকের কাছেই শেখ হাসিনা এখনও 'শেখের বেটি'। বঙ্গবন্ধুর পর আর কোনো নেতার কথাও অনেকে ভাবে না। অনেক বড় মন্ত্রী, এমপি অনেক গ্রামীণ বয়োজ্যেষ্ঠ লোকের কাছে এখনও 'ছেলে ছোকরা'।

সেই নিরীহ গ্রাম বুলেটের শব্দে কেঁপে উঠেছে। রাষ্ট্র তার ক্ষমতার জানান দিয়েছে। আহা! ক্ষমতার জানান দিলেই যেন রাষ্ট্র আরেকটু রাষ্ট্র হয়ে ওঠে! সরকারি কর্মকর্তা আর নিরাপত্তারক্ষী পুলিশের চাকরির ষোলকলা পূর্ণ হয়! কথায় কথায় 'নিরীহ মানুষের হাতে অস্ত্র ছিল, আমাদের নিরাপত্তারক্ষীদের দিকে গুলি ছুঁড়েছে' এই গল্পে চারপাশ ভরিয়ে তোলা হয়। এই দেশে সবচেয়ে অনিরাপদ বোধ হয় আমাদের নিরাপত্তারক্ষীরা!

সরকার উন্নয়ন করতে চাচ্ছেন, ভালো। কিন্তু সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের ভিতর দিয়েই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।সেটাই সত্যিকারের উন্নয়ন যেটা জনগণ অনুভব করে যে, তাতে তার নিজের, সমাজের এবং দেশের ভালো হবে। তার বিপরীতে বাঁশখালীর জনগণে আশংকায় কেঁপে উঠেছে। ভুমি, বাড়ি এবং জীবিকা হারানোর শংকা তাদের অস্থির করেছে।

শিল্প বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভূমি একটি অনিবার্য বিষয়। সরকারি কাজের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান সাপেক্ষে জমি পাওয়ার আইনি অধিকার সরকারের রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও সরকারকেই জমির নিশ্চয়তা তৈরি করতে হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো প্রকল্প, যার প্রাথমিক ক্রেতা সরকার বা সরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানি, সেইসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে প্রকল্প স্থাপনার ভূমি উন্নয়ন করে প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা অধিক সঙ্গত।

বেসরকারি কোম্পানি নিজে ভূমির সংস্থান করতে গিয়ে স্থানীয় মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারস্থ হয়, যাদের অনেকে টাউট, বাটপাড় কিংবা সমাজবিরোধী হয়ে থাকে। তাদের সম্পর্কে সমাজের আস্থা কম থাকার কারণে প্রথমেই একটি প্রকল্প জনগণের আস্থা হারায়। এছাড়া এই সমস্ত মধ্যস্বত্বভোগী সমাজবিরোধীরা মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এবং সঠিক মূল্য পরিশোধ না করে জমি আদায়ের চেষ্টা করে থাকে। যার পরিণতিতে জন-অনাস্থা এক পর্যায়ে জনরোষে রূপান্তরিত হয়।

বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো স্থাপনার সঠিক স্থান নির্বাচনের কাজটি টেকনিক্যাল বিষয় হওয়ার কারণে সঠিক ভূমি নির্ধারণের বিষয়টি সরকারের দিক থেকে হওয়াই সঙ্গত। প্রয়োজনে বিদ্যুৎ কেনার সময় ভূমির মূল্য কিংবা ভাড়া বিদ্যুতের মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা যেতে পারে।

যে কোনো শিল্প স্থাপনার ক্ষেত্রে কাঁচামালের সহজ সরবরাহের রাস্তার উন্মুক্ততা, উৎপাদিত পণ্য কিংবা সেবার সহজ পরিবহন এবং সরবরাহের পথের উন্মুক্ততা, শিল্প-কারখানার পরিবেশসম্মত অবস্থান, বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পরিবেশের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এবং তার সমাধান, জনগণের জীবনযাপনের এবং কর্মসংস্থানের ক্ষয়ক্ষতি এইসব কিছুই বিবেচনায় নিতে হবে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনও এক ধরনের শিল্প যার উৎপাদিত বিদ্যুৎ অন্য শিল্প এবং সেবা খাতের জন্য প্রাথমিক পণ্য বা ক্যাপিটাল গুড। এই ক্ষেত্রে কোম্পানি তাদের সুবিধাজনক ফ্যাক্টরগুলোই বিবেচনায় নিয়েছে বলেই মনে হয়। কিন্তু পরিবেশের উপর প্রভাব, মানুষের জীবনযাপন এবং কর্মসংস্থানের উপর প্রভাবের কথা সেই মাত্রায় বিবেচনায় নেয়নি বলেই মনে হয়।

এই সমস্ত বিষয় বিবেচনার বাইরে রেখে কাজ করতে গেলে জন-অসন্তোষ খুবই স্বাভাবিক। বাঁশখালীর ক্ষেত্রেও এসব বিষয় কেন্দ্র করে জনগণ তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বলে জানা যায়। বিবিধ রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক পক্ষের উস্কানি বা ষড়যন্ত্রের কথা সত্য ধরে নিলেও জনগণের মূল অসন্তোষের জায়গাগুলো যৌক্তিকতা হারায় না।

জনগণকে সম্পৃক্ত করে উন্নয়ন করতে পারা এক ধরনের দক্ষতা। বন্দুকবাজি করে, জনগণকে হত্যা করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতারই পরিচায়ক। গ্রামের জনগণের প্রতি রাষ্ট্র এবং তার অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর এক ধরনের তাচ্ছিল্যবোধ রয়েছে বলেই মনে হয়। কানসাটে বিদ্যুৎ আন্দোলন কিংবা ফুলবাড়িতে এশিয়া এনার্জির কয়লা খনি-বিরোধী আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তারক্ষীরা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সঠিক আচরণ করেনি। কানসাটে দুজন গ্রামীণ নারীকে নিরাপত্তারক্ষীদের ধাওয়া করার দৃশ্য এখনও অনেকের চোখে ভাসে। এক ধরনের স্থায়ী অসম্মানবোধের জায়গা থেকেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী এই আচরণ করেছে বলে ধারণা করতে কষ্ট হয় না।

মনে রাখা জরুরি যে, বাংলাদেশ এখনও একটি গ্রামময় দেশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার বসবাস গ্রামে। শিল্পের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও সরকার যে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার গৌরব করছেন তা গ্রামের কৃষকদেরই অবদান। কৃষকরাই এই দেশটিকে সোমালিয়া হতে দেয়নি।

বাঁশখালীর জনগণ তাদের জমি, বাড়ি এবং জীবিকা হারানোর আশংকাই কেবল করছেন না, তাদের একাংশ বিশ্বাস করেন যে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে এখানে সূর্য উঠবে না। অন্ধ বিশ্বাস বলে হাসাহাসি না করে তাদের এই অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। বিশ্বাস অন্ধ হলেও এটা জীবনেরই অংশ। বিশ্বাসের গাছ থাকে, পুকুর থাকে, পাহাড় থাকে, যাকে কেন্দ্র করে গল্পগাথা রূপকথা কিংবা মিথ পল্লবিত থাকে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে। আদিবাসীদের মধ্যে এই জাতীয় বিশ্বাস খুব চোখে পড়ে। সমুদ্র-উপকূলবর্তী মানুষ হিসেবে বাঁশখালীর মানুষের মধ্যে সমুদ্র এবং তার সন্নিহিত ভূমি কেন্দ্র করে বিশ্বাস ও মিথ থাকা অস্বাভাবিক নয়।

যদি বর্তমান নির্ধারিত জায়গাটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সঠিক জায়গা বলেও মনে করা হয়, তারপরও পরিবেশ দূষণ, সমুদ্র দূষণ, জনগণের পুনঃআবাসন, জীবিকার ক্ষতি এবং বিশ্বাসের ক্ষতির জায়গাগুলোর মূল্যায়ন এবং ক্ষতিপূরণ কৌশল নির্ধারণের জন্য পরিবেশবিদ, সমুদ্র বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ খুবই জরুরি। জনগণের সঙ্গে সঠিক যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের ইতিবাচক মনোভাব নির্মাণ এবং ইতিবাচক সম্মতি আদায়ের জন্য মনোবিজ্ঞানী এবং গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণও জরুরি বলে মনে করি।

এ বিষয়গুলিতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছেন। একটি প্রকল্প শুধুমাত্র টেকনিক্যাল বৈজ্ঞানিক প্রকল্প হিসেবে হাজির করে তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা খুবই হ্রস্ব দৃষ্টির পরিচায়ক। শুধুমাত্র প্রকৌশলী এবং অর্থবিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কৌশল বহু আগের পরিত্যক্ত ধারণা।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন কৌশল হিসেবে সবচেয়ে পরিবেশ দূষণকারী প্রযুক্তি এটি। রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে পরিবেশ সচেতন মানুষের আন্দোলন চলছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে বলে অনেকেই আশংকা করছেন। সুন্দরবন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার কারণে ইউনেস্কোর একটি টিম প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন।

এরই মধ্যে সরকার চীন এবং আমাদের স্থানীয় একটি কোম্পানির যৌথ অর্থায়নে বাঁশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছেন। খোদ চীন দেশেই কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, এগুলো অধিক দূষণ ছড়ায় বলে।

যুক্তরাজ্য ২০২৫ সালের মধ্যে তার সমস্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দেবে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায়। কয়লার অন্যতম ব্যবহারকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একই পথে হাঁটছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০০৯ সালে অফিস গ্রহণের পর ১৩৮টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং আরও ২০৭টি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ওবামা সরকার কয়লার বিরুদ্ধে এক ধরনের অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা সবাই জ্বালানি গ্যাসভিত্তিক এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের দিকে ঝুঁকছেন।

নবায়নযোগ্য শক্তির (Renewable Energy) প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটলেও এখনও নবায়নযোগ্য শক্তিজাত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম অনেক বেশি। তারপরও ওই সমস্ত দেশগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন যে কেউ জানেন যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ দামে সবচেয়ে সস্তা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট ব্যবহারের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসে। অপরদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সবচেয়ে পরিবেশ দূষণকারী এতেও সন্দেহ নেই। চীন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশের খেতাব পেয়েছে তার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য, যা চীন ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিচ্ছে।

পরিবেশ নিয়ে শংকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আমরা চীনকে তাদের পরিত্যক্ত প্রযুক্তি আমাদের দেশে স্থাপন করার সুযোগ করে দিচ্ছি কি না। এমনিতেই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র অধিক পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, বিষাক্ত ভারী ধাতু মার্কারি এবং কার্বনসহ বিবিধ পার্টিকেল নিঃসরণের জন্য দায়ী, যা পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তার উপর চীন যদি তাদের দেশের বহুদিন ব্যবহৃত, বন্ধ হয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রাংশ নিয়ে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে, তাহলে দূষণ স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল নিরীক্ষা সরকারের হাতেই রাখা উচিৎ। এই সমস্ত যন্ত্রপাতির ব্যবহারের জন্য ছাড় করার (commissioning) ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করতে পারে। এর ব্যতিক্রম কিছু হলে কোম্পানিকে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে। পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় ঝুঁকি বহনের দায় কোম্পানির উপর দিতে হবে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের আগাম শর্ত হিসেবে।

প্রয়োজনে কোম্পানির জন্য বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে কোনো দুর্ঘটনা কিংবা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির ক্ষেত্রে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ কিংবা আদালতের নির্দেশের অপেক্ষা না করে জনগণের জন্য তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়।

আমাদের মতো দ্রুত প্রবৃদ্ধি-আকাঙ্ক্ষী দেশের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প নেই। স্থানীয় বিনিয়োগ এবং বিদেশি বিনিয়োগ দুই ক্ষেত্রেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিবার্য পূর্বশর্ত। তদুপরি আমাদের নিজেদের কয়লার মজুদ রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে যে, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কম কার্বন নিঃসরণের প্রযুক্তির দিকেই ঝোঁক বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে অনিঃসরিত কার্বনেরও বিক্রয়মূল্য রয়েছে।

বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা মামলায় নিজেদের মীমাংসিত সমুদ্রসীমা পাওয়ার পর ব্লু ইকোনমি (Blue Economy)এর কথা বলছে। ইতোমধ্যে বাড়ানো হচ্ছে নৌবাহিনীর সক্ষমতা, স্থাপন করা হয়েছে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে ওসানোগ্রাফি বিভাগ। কিন্তু এই ব্লু ইকোনমি শুধুমাত্র সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ এবং খনিজ সম্পদ কেন্দ্র করেই ভাবা হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। কিন্তু সমুদ্রে রয়েছে প্রচুর নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদ। সমুদ্রের স্রোত (Ocean current), সমুদ্রের জোয়ার ভাটা (Ocean Tide), সমুদ্রের ঢেউ (Ocean Wave), খোলা সমুদ্রের বাতাস (Offshore Windmill) এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ এবং গভীর সমুদ্রের পানির তাপমাত্রার পার্থক্য (Ocean Thermal Energy Conversion) ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

এক হিসাবে বলা হয় যে, এই সমস্ত প্রক্রিয়া ব্যবহার করে পৃথিবীর মোট সমুদ্রের নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্ষমতা প্রায় পনের হাজার পারমাণবিক চুল্লির সমান। বাংলাদেশ ব্লু ইকোনমির ধারণা সম্প্রসারিত করে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস হিসেবেও সমুদ্রকে ভাবতে পারে। তাহলে বাংলাদেশ ব্লু ইকোনমি (Blue Economy)এর পাশাপাশি কম কার্বন নিঃসরণের অর্থনীতির (Low Carbon Economy) দেশ হিসেবেও এগিয়ে যাবে। তাই উপকূলবর্তী এলাকায় কয়লার মতো জৈব জ্বালানিভিত্তিক (Fossil Fuel) বিদ্যুৎ প্রকল্প না করে সমুদ্রের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার কথা ভাবা যেতে পারে। এতে সমুদ্র দূষণের আশংকাও অনেকখানি কমবে।

উন্নয়ন অনিবার্য। কিন্তু জনগণ আরও বেশি। প্রত্যেকটি উন্নয়ন যেন জনগণ হৃদয় থেকে গ্রহণ করে এবং মাথা উঁচু করে ভাবে যে, আমাদের দেশ এগুচ্ছে। উন্নয়নের আগে বন্দুক ঠেলে দিলে সে উন্নয়ন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। মনে রাখতে হবে, জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক।