মাস্টারদা সূর্যকুমার সেন: আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত আগুনচোখ

ধ্রুব সাদিকধ্রুব সাদিক
Published : 9 April 2016, 01:42 PM
Updated : 12 Jan 2022, 04:49 PM


১৯৩৪ সালের জানুয়ারির ১২ তারিখ। অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের বীরবিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনকে শারিরীকভাবে পাশবিক অত্যাচার করে অজ্ঞান করার পর অর্ধমৃত অবস্থায় মধ্যরাতে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয়েছিল। সেই রাত যত গভীর হচ্ছিলো, ব্রিটিশদের হাতুড়ী দিয়ে নির্মমভাবে অত্যাচার করার মাত্রাও যেন সমানতালে বাড়ছিলো। মাস্টারদা'র শুধু হাড়ই যে ভেঙ্গে দিয়েছিলো তাই নয়, প্রবল আক্রোশে তারা মাস্টারদা'র দাঁতও ভেঙ্গে দিয়েছিলো। তারপর অজ্ঞান মাস্টারদা'র অর্ধমৃতদেহটি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল ফাঁসিকাঠে।

অজ্ঞান মাস্টারদা সূর্যসেনের অর্ধমৃতদেহের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়ার দৃশ্যটি তাঁর শহীদ হয়ে যাওয়ার ৮৮ বছর পরও আমাদের নিউরনে ভাসলে আমাদের বুঝতে বেগ পেতে হয় না, যে, মাস্টারদা'র প্রতি ব্রিটিশরা আসলে কতটা আক্রোশ পুষে রেখেছিল। তাদের আক্রোশের ফলস্বরূপ মাস্টারদা সূর্যসেনকে মেরে ফেলার জন্য তারা হন্যে হয়েই খোঁজেনি, মৃত্যু কার্যকর করার পর সূর্যসেনের লাশ আত্মীয়দের হাতেও হস্তান্তর করা হয়নি। এমনকি হিন্দু-সংস্কার অনুযায়ী শব না-পুড়িয়ে ফাঁসি কার্যকর হয়ে যাওয়ার পর মাস্টারদা'র শব জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ ক্রুজার The Renown-এ শবটি তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়েছিল।

১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামের রাজমণি সেন ও শশীবালা সেন দম্পতির কোল আলোকিত করে জন্মলাভ করেছিলেন সূর্যকুমার সেন। রাজমণি সেন ও শশীবালা সেন দম্পতির চতুর্থ সন্তানটির গাত্রবর্ণ তামাটে হওয়ায় বাল্যকালে তাকে কালু নামেও ডাকা হতো। কিন্তু কে হায় ঘুনাক্ষরে জানতে পেরেছিলো– 'মৃত্যু কিংবা স্বাধীনতা' এই মন্ত্রে দীক্ষিত এই কালুই দুনিয়াসমান আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে মানুষজন্ম লাভ করবে!

বাবার কাছে বর্ণমালার হাতেখড়ি নেয়ার পর নোয়াপাড়া দয়াময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নোয়াপাড়া মাইনর স্কুল, চট্টগ্রামের নন্দনকাননের ন্যাশনাল স্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছেন। যদিও চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই যুক্ত হন বৈপ্লবিক সংগঠন অনুশীলন-এর সঙ্গে, সূর্যসেনকে বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মূলত পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে বিএ পড়ার সময় তাঁর শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী। ১৯১৮ সালে বিএ পাস করে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে, এবং বিপ্লবী কর্মকৌশল গতিশীল রাখা ও আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা পেশাকে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় যে বিদ্যালয়টি তিনি গড়ে তোলেন, এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করে খ্যাত হন মাস্টারদা নামে। বিদ্যালয়টি পরে অবশ্য তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠেছিল।

অনুশীলন ও যুগান্তর– এই দুই ভাগে বিভক্ত তখন এই অঞ্চলের বিপ্লবীরা। কৃষ্ণনাথ কলেজের পাঠ চুকিয়ে এসে সূর্যকুমার সেন এবার যোগ দেন যুগান্তরে এবং সংগঠন হিসেবে যুগান্তরকে সক্রিয়ও করে তোলেন। মাস্টারদার যুগান্তরে যোগ দেয়ার পিছনে যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা নিহিত সেটা হলো: যুগান্তরে যোগ দিয়ে অনুশীলন ও যুগান্তরকে ঐক্যবদ্ধ করার যুগান্তকারী তাঁর চেষ্টা।জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদসভায় তাঁর বক্তৃতায় মানুষের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে এক বছরের মধ্যে তিনি কিছুটা সফলও হয়েছিলেন।

প্রায় এক যুগ চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিপ্লবীদের বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করে সূর্যসেন এবার সশস্ত্র বিদ্রোহে নামেন এবং পুলিশের অস্ত্রাগার দখলের পর অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করে পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। এর পাশাপাশি, বয়োজ্যেষ্ঠ বিপ্লবীদের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেন, চট্টগ্রামে গিয়ে বিপ্লবীরা ব্রিটিশদের আক্রমণ করবে। ফলস্বরূপ, ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেই যুদ্ধে ১৪ জন বিপ্লবী শহীদ হন।

সূর্যসেন ব্রিটিশদের কাছে ক্রমশ ভয়ানক হয়ে উঠেছিলেন। কতটা তিনি ভয়ানক হয়ে উঠেছিলেন সেটা আমরা টের পাই, ব্রিটিশদের তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করার ঘটনায়। পুরস্কার ঘোষণা করার ঘটনায় মাস্টারদা সূর্যসেন যেন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নানান পরিকল্পনায় রত থাকেন। ১৯৩২ সালের জুন মাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্তকে ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রাম কারাগার আক্রমণ করার নির্দেশ দিলে সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় এবং ১১ জন বিপ্লবী গ্রেফতার হন। তবে, ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান। পরবর্তীতে, গ্রেফতার এবং ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ না-করার জন্য গুলিবিদ্ধ বীর প্রীতিলতা সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

মাস্টারদা সূর্যসেনকে নিয়ে নানান বই এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়েছে। কিন্তু একজন আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন শিক্ষক কিভাবে সকলের মাস্টারদা তথা বিপ্লবের ঝাণ্ডাবাহক হয়েছিলেন, সেই ঘটনা হয়তো অনেকের অজানা। সূর্যসেনের অন্যতম সাথী অনন্ত সিংহ বিপ্লবী সূর্যসেনের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, 'কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ! কে জানতো সেই শীর্ন বাহু ও ততোধিক শীর্ন পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?'

স্বাধীন ভারতের স্বপ্নের জন্য তিনি জীবনভর উৎসাহ ও নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে'র কাছে মাস্টারদা সূর্যসেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বার্তাটিতে তিনি লিখেছিলেন তাঁর শেষ বাণী হলো আদর্শ ও একতা। তিনি এও বলেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।সংগঠনে যাতে বিভেদ না আসে তার জন্য তিনি একান্তভাবে আবেদন করেন। শেষ চিঠিতে মাস্টারদা লিখেছিলেন, 'আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই তো সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকেও স্মরণ করার এই তো সময়। কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমার ভাইবোনেরা, তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্র‍্যহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙ্গে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে।'

বীরের মৃত্যু হয় না। কাল থেকে কালান্তরে তাঁরা মানুষের কাছে বেঁচে থাকেন দেশমাতৃকার বীরসন্তান হিসেবে। বাংলার বীর সন্তান মাস্টারদা সূর্যসেনের পাশাপাশি আরও একজন বীরবিপ্লবী সন্তান তারকেশ্বর দস্তিদারকেও ১৯৩৪ সালের আজকের তারিখে ফাঁসিকাঠে চরিয়েছিল ব্রিটিশরা। বীর বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।