বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি আদর্শ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী

আশরাফ আহমেদ
Published : 1 May 2016, 07:15 AM
Updated : 12 Jan 2022, 04:49 AM


১৯০৫ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সংক্ষেপে বেগম রোকেয়ার 'সুলতানা'স ড্রিম' রচনাটি পুরো ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃত, এবং একটি বৈপ্লবিক কল্পকাহিনী বলে বিখ্যাত হয়ে আছে। পরবর্তীতে ১৯২২ সালে (রোকেয়া-রচনাবলী, পৃষ্ঠা ১০২) বেগম রোকেয়া নিজেই কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে উপন্যাসটি 'সুলতানার স্বপ্ন' নামে সর্বপ্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন।
আজ থেকে প্রায় সোয়াশ' বছর পূর্বে বিশ্বের কোনো সমাজেই নারীদের ভোটাধিকার বলে কিছু ছিল না। আজকের সংজ্ঞায় নারী-অধিকার বলে কোনো কিছু ছিল না। কোথাও ছিল না সরকারী বা বেসরকারী সংস্থায় চাকুরির অধিকার, এমন কি ক্ষেত্রবিশেষে আদালতে সাক্ষ্য দেবার অধিকার থাকলেও প্রায় ক্ষেত্রেই তা ছিল উপেক্ষিত। ভারতবর্ষে, এবং বিষেষতঃ বাংলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম সমাজে এসবের চিত্র ছিল আরো ভয়াবহ। ঢাকা যাদুঘরে রক্ষিত বলিয়াদি জমিদার পরিবারের এক কন্যার বিয়ের কাবিন নামায় স্পষ্ট করে লেখা ছিল, শাসনের প্রয়োজনে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে মুখমণ্ডল ব্যতীত শরীরের অন্যান্য স্থানে বেত্রাঘাত করিতে পারিবেন, তবে যেন তাহার কোনো দাগ না পড়ে! দেড়শত বছর আগেও যাবার প্রয়োজন নেই। মাত্র সাত আট বছর আগে প্রকাশিত নূরজাহান বোসের 'আগুনমুখার মেয়ে' আত্মজীবনীতে নারীর প্রতি পুরুষের সমাজ স্বীকৃত অত্যাচারের কথা পড়লেও ভয়ে গায়ের লোম শিউড়ে ওঠে। উল্লিখিত সমাজে নারীদের মর্যাদা ভোগ্যপণের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না।

কিন্তু বিশ্বময় পুরুষ-শাসিত সমাজের সেই কঠিন বেড়াজালের আবদ্ধে বাস করেও 'সুলতানার স্বপ্ন'-এ বেগম রোকেয়া পরুষজাতকে অকর্মণ্য, মোটাবুদ্ধি, যুদ্ধবাজ, এবং নারী-নিগৃহক আখ্যা দিতে কোনো পিছপা হননি। সেটি ছিল আমাদের যুগের তসলিমা নাসরিন থেকেও তীব্র আক্রমণাত্মক। আজকের অসহিষ্ণু বাংলাদেশে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হলে বেগম রোকেয়াকে হয়তো শারীরিকভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করে আস্তাবলে নিক্ষেপ করা হতো! কাজেই বাংলা সাহিত্যে 'সুলতানার স্বপ্ন'কে নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃত এবং একটি বৈপ্লবিক কল্পকাহিনী আখ্যায়ন যথার্থই বলা যায়।

বাংলা তথা ভারতবর্ষের নারী অধিকার নিয়ে বেগম রোকেয়া বেশ কিছু কবিতা, অনুবাদ গ্রন্থ, প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু আমার আলোচনাটি বেগম রোকেয়ার নারীবাদী আন্দোলনকে নিয়ে নয়। শুধুমাত্র সুলতানা'স ড্রিম' এবং 'সুলতানার স্বপ্ন' উপন্যাস পড়ে আমার ধারণা হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমসাময়িক বিজ্ঞান চর্চার বিষয়ে বেগম রোকেয়ার একটি স্বচ্ছ ধারণা ছিল, এবং উপন্যাসটি আসলে একটি অতি উচ্চমানের এবং আদর্শ বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। বাংলা ভাষার কোনো কোনো গবেষকের দৃষ্টিতে বেগম রোকেয়ার একটি বৈজ্ঞানিক মনের পরিচয় স্বীকৃত হলেও কেউই নারীস্থানকে সুস্পষ্টভাবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বলে আখ্যায়িত করেননি। বইটি সম্পর্কে শিখা গোষ্ঠীর আবুল হোসেন সাধনা পত্রিকায় ১৯২১ সালে লিখেছেন 'এর পাঠকগণ স্ব স্ব পরিবারের নারীগণকে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করিতে চেষ্টা করিবেন' (রোকেয়া-রচনাবলী পৃষ্ঠা ৬২৬)। মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ১৯৩২ সালে কবি আবদুল কাদির লিখেছেন 'ব্যঙ্গরসাত্মক রচনা – 'নারীস্থানের এক অদ্ভুত পরিকল্পনা' (রোকেয়া-রচনাবলী পৃষ্ঠা ৬০৩)
গোলাম মুরশিদ তাঁর 'প্রথম নারীবাদী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন' গবেষণামূলক প্রবন্ধে লিখেছেন 'বিজ্ঞান বিষয়ক গভীর আগ্রহ এবং সাধারণ জ্ঞান তাঁর চিন্তাকে সমুজ্জ্বল করেছিল। বিজ্ঞানের সুস্পষ্ট ছাপ মুদ্রিত বিশেষ করে তাঁর সুলতানার স্বপ্নে'। তিনি যেগুলোকে 'সাধারণ জ্ঞান' বলছেন, মনে রাখতে হবে সোয়া'শ বছর আগে তা মোটেও সাধারণ ছিল না। আমার নিচের আলোচনা থেকে বোঝা যাবে যে 'সুলতানা'স ড্রিম'-এর উপাদানগুলো ছিল তখনকার দিনের অতি উচ্চতর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। অন্যদিকে মুহিত হাসান লিখেছেন 'এছাড়া রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের সুলতানাস ড্রিমকেও (১৯০৫) ভিন্নধারার একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে'। যদিও এই 'ভিন্নধারার' স্বরূপটি কী সে সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেননি।
'সুলতানা'স ড্রিম' বা 'সুলতানার স্বপ্ন' উপন্যাসটি যে সার্বিক অর্থেই উঁচুদরের একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী তা বিভিন্নভাবে নিচে আমি দেখাবার চেষ্টা করেছি।

কল্পবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও সুলতানার স্বপ্ন
মার্কিন কিংবদন্তী কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভের মতে কল্পবিজ্ঞান হচ্ছে 'সাহিত্যের একটি শাখা যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে রচিত হয়' (Science fiction can be defined as that branch of literature which deals with the reaction of human beings to changes in science and technology)। এর সাথে বাঙালি ও ভারতীয় কল্পবিজ্ঞান গবেষকরা আইজ্যাক আসিমভের আরো একটি উক্তি যোগ করে থাকেন। তা হচ্ছে 'মানুষ যতক্ষণ বিজ্ঞানের যথার্থতা বা যৌক্তিকতা বুঝতে পারবে না এবং তা তাঁদের গল্পের উপযোগী করে ব্যবহার করতে পারবে না, ততক্ষণ সত্যিকারের কল্পবিজ্ঞানের জন্ম হবে না' (True science fiction could not really exist until people understood the rationalism of science and began to use it with respect to their stories) (৬,৭)। এর বাইরেও বিভিন্ন লেখক কল্পবিজ্ঞানকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সুক্ষ্মতা বিবেচনায় তাতে মতভেদ থাকলেও মোটা দাগের সংজ্ঞাটিতে কোনো পার্থক্য নেই। তাঁদের মতে কল্পবিজ্ঞান হলো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানকে কল্পনা দ্বারা প্রসারিত করে ভবিষ্যতের কাল্পনিক কোনো অবস্থাকে গল্পে রূপদান।

এভাবে কল্পবিজ্ঞান রচনার প্রথম শর্ত হচ্ছে এটি হতে হবে কাল্পনিক। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে কল্পনাটি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্যের ওপর ভিত্তি করে হতে হবে। আর অধিকাংশ লেখকের মতে কল্পবিজ্ঞানের তৃতীয় শর্তটি হতে হবে ভবিষ্যতমুখী। অর্থাৎ আজকের বৈজ্ঞানিক-কারিগরি তথ্য বা জ্ঞান ভবিষ্যতে অনেক উন্নত হয়ে বর্তমানে বিরাজমান অথবা ভবিষ্যতে উদ্ভুত যোগ্য নতুন কোনো সমস্যার সমাধানে কাল্পনিক গল্প। সেই ভবিষ্যৎটি হতে পারে যৌক্তিক বা বাস্তবসম্মতভাবে অথবা ফ্যান্টাসি বা অবাস্তবসম্মতভাবে। বিখ্যাত ফরাসী লেখক জুল ভার্ন রচিত 'এরাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ', 'টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দি সি', এবং 'ফ্রম দা আর্থ টু দা মুন', তেমনি তিনটি বাস্তবসম্মত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী যার সবগুলো কল্পনাই ভবিষ্যতে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কল্পনাটি যদি বাস্তবসম্মত না হয়, তবে সেটি হয়ে যেতে পারে আষাড়ে, আজগুবি, যাদু অথবা রূপকথার গল্প। তা হলেও সেটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হতে পারে, যেমনটি হয়েছে ইংরেজ লেখিকা মেরি ওয়োলস্টোনক্রাফট শেলী'র ফ্রাংকেস্টাইন বইটির ক্ষেত্রে, যদিও কেউ কেউ এতে দ্বিমত প্রকাশ করবেন। কিন্তু উল্লিখিত দুই ব্যক্তির লেখাগুলো ভবিষ্যতমুখীই ছিল।

অন্যদিকে বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক ও বর্তমান সময়ের বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার সবচেয়ে সোচ্চার, অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্যের মতে 'কল্পবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানকে কল্পনা দ্বারা প্রসারিত করে যে জগৎটি সৃষ্টি করা হয় সেটি একটি বিকল্প অবস্থা। দেশ-কাল বিচারে এই বিকল্পতার সময় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ বা কালোত্তীর্ণ হতে পারে'। তাঁর মতে 'বিজ্ঞান কল্পকাহিনির কাজ হলো প্রতিষ্ঠিত (বা গৃহীত) সামাজিক ও জৈবিক এবং (এমনকী) বৈজ্ঞানিক নীতি বা গঠনকে ভেঙে সেই ভিন্ন জগৎটির অবতারণা। অনেক সময়ই গল্পে আমরা এমন সমস্ত প্রক্রিয়া বর্ণনা করি যা হয়তো ভবিষ্যতেও কখনো বাস্তবায়িত হবে না (যেমন আলোর গতিবেগের বেশিতে বা অন্য একটি মহাবিশ্বে ভ্রমণ), কিন্তু লেখক যদি সেই প্রক্রিয়ার জন্য যুক্তির ভিত্তিতে কোনো নীতি প্রণয়ন করেন তাহলে সেটি (বিজ্ঞানকে ভাঙলেও) বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে'

বেগম রোকেয়ার 'সুলতানার স্বপ্ন' কি উপরে উল্লিখিত কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পুরণ করতে পেরেছিল? এক কথায় এবং জোড়ালোভাবে উত্তর হলো হ্যাঁ, এবং অবশ্যই।
প্রথমতঃ উপন্যাসটি ছিল কাল্পনিক। কল্পনাটি বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক দুই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল এবং আছে। দ্বিতীয়তঃ এটি ছিল সমসাময়িক অন্ততঃ চারটি প্রধান প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্যের ওপরে ভিত্তি করে রচিত। তৃতীয়তঃ বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক দুটি ক্ষেত্রেই বেগম রোকেয়ার কল্পনাটি ছিল ভবিষ্যতমুখী। সবচেয়ে বড় কথা হলো ভবিষ্যতের বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর কল্পনাটি ছিল যৌক্তিক বা বাস্তবসম্মত; মস্তিষ্কের লাগামহীন চিন্তা-প্রসূত নয়। ফলে আজ থেকে সোয়া'শ বছর পূর্বে ভবিষ্যতের যে যে অভূতপূর্ব ও অশ্রুতপূর্ব বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতির কথা তিনি লিখে গেছেন, বিগত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর থেকে এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা পেয়ে চলেছি আজও। এভাবে বাংলা কল্পবিজ্ঞান গবেষকদের ওপরে উল্লিখিত আইজ্যাক আসিমভের প্রিয় উদ্ধৃতিটির৬.৭ শর্তটিও পুরোপুরি পূরণ করা হয়েছে। এমন কি কল্পবিজ্ঞান লেখক দীপেন ভট্টাচার্যের আধুনিক সংজ্ঞায় 'বৈজ্ঞানিক নীতি বা গঠনকে ভেঙে সেই ভিন্ন জগৎটির অবতারনা'র কথা যা বলা হয়েছে, সুলতানা'স ড্রিম উপন্যাসটি সেই শর্তও পূরণ করেছে। ভারতের নারীশিক্ষা-উপেক্ষিত ও বঞ্চিত সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো স্কুলে না গিয়ে, আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে (সুলতানা'স ড্রিম প্রকাশের সময় তাঁর বয়স) তিনি কীভাবে তখনকার উন্নততর বিজ্ঞানের সন্ধান পেয়েছিলেন তা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এ নিয়ে গবেষণার অভাব রয়েছে।

কোনো প্রাচীন বা ঐতিহাসিক ঘটনা বা লেখার বিচার-বিশ্লেষণ করতে হলে ঠিক সেই সময়কার প্রচলিত শিক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক পটভূমির আলোকেই তা হওয়া উচিৎ। নিচের অধ্যায়গুলোর আলোচনায় আমিও তাই করার চেষ্টা করেছি, এবং প্রমাণ করেছি যে 'সুলতানা'স ড্রিম উপন্যাসটি একটি আদর্শস্থানীয় এবং অতি উঁচুমানের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। কিন্তু সেই আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে 'সুলতানা'স ড্রিম' পাণ্ডুলিপিটির ওপর জনৈক ইংরেজ পাঠকের মন্তব্যটি পড়লেও বর্তমান পাঠকরা একই ধরণের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন।

১৯০৫ সালে দুই দিনের সরকারী সফর শেষে ডেপুটি মেজিস্ট্রেট স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন বাড়ি ফিরে রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার অবর্তমানে আপনি কী করছিলেন? উত্তরে রোকেয়া 'সুলতানা'স ড্রিম' এর পাণ্ডুলিপিটি তাঁর হাতে দিয়েছিলেন। ততক্ষণাৎ পাঠশেষে স্বামী মন্তব্য করেছিলেন এ তো দেখছি এক 'ভয়ংকর প্রতিশোধ'! এরপর ইংরেজি ভাষা সংশোধনের জন্য তিনি পাণ্ডুলিপিটি ভাগলপুরের ইংরেজ কমিশনার মিস্টার ম্যাকফারসনের নিকট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বিন্দুমাত্র সংশোধন না করে মিস্টার ম্যাকফারসন ফিরতি চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন 'ইহাতে যে ভাব প্রকাশ করা হইয়াছে তাহা অত্যন্ত আনন্দপ্রদ ও স্বকীয়, এবং তা লেখা হয়েছে নির্ভুল ইংরেজিতে। … আমি ভাবছি ভবিষ্যতের কোনো এক সময়ে আমরা বায়ু-পথে কীরূপে ভ্রমন করিব তিনি তাহার অগ্রিম বার্তাই দিয়াছেন। এই ব্যাপারে তাহার পরামর্শটি (কল্পনাটি – লেখক) সবচেয়ে অসাধারণ'। (বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল, বেগম রোকেয়া পৃ-২৯২)

উপন্যাসটি ইংরেজি ও বাংলায় পাশাপাশি রেখে পড়লে বোঝা যায় যে বাংলা লেখায় পরিবর্তন ও পরিবর্ধনগুলো সম্ভবতঃ তিনি পাঠক প্রতিক্রিয়াকে মাথায় রেখে কখনো কখনো একটি কম্প্রোমাইজ বা মাঝামাঝি অবস্থানে আনতে চেয়েছেন। মনে রাখতে হবে উপন্যাসটি তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন তাঁর স্বামীর জীবিতাবস্থায় এবং বাংলায় অনুবাদ/লিখেছিলেন তাঁর স্বামীর মৃত্যুর অনেক পরে। এই অধ্যায়ের শেষদিকে আমরা লক্ষ করেছি তাঁর বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান, সাহিত্য চর্চা এবং সর্বোপরি নারী-অধিকার বিষয়ক বক্তব্যের একটি শক্ত অবলম্বন ছিল তাঁর স্বামী। তাঁর অবর্তমানে সেই ভিত্তি কিছুটা শিথিল হয়ে থাকলে লেখাতেও এর প্রতিফলন ঘটবে, এটিই স্বাভাবিক। এতে সাহিত্য হিসেবে উপন্যাসটির কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে কিনা তা আলাদাভাবে আলোচনা হতে পারে। তবে বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো ইংরেজি লেখাটিতেই অধিকতর যুক্তিযুক্ত এবং যথেষ্ট বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কাজেই আমার আলোচনাটি আমি মূল ইংরেজিতে লেখা 'সুলতানা'স ড্রিম' অবলম্বনেই করব।


'সুলতানা'স ড্রিম' এবং 'সুলাতানার স্বপ্ন'র প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে পুরুষের কর্তৃত্বকে খর্ব করা। কারণ পুরুষরা ১) অকর্মণ্য, ২) অলস, ৩) হীন-নৈতিক বা লো মোরাল, ৪) কথা বলে বেশি, কাজ করে কম, ৫) মোটাবুদ্ধি, ৬) নারীর মেধা ও মূল্য বুঝতে অক্ষম হয়ে তাদের পদানত করে রাখে, এবং ৭) শান্তির সহজ উপায় থাকলেও যুদ্ধ বাঁধিয়ে প্রাণ ও সম্পদ ধ্বংস করে। অন্য, কিন্তু প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে নারীরা নিন্দনীয় এসব সমস্যার উর্ধে থাকলেও পুরুষের পদানত থাকার ফলে পৃথিবীর এবং মানব জাতির কোনো উপকারেই আসতে পারছে না। এর একমাত্র সমাধান পুরুষের কঠিন শৃঙ্খল ভেঙে নারীজাতির মুক্তি। বেগম রোকেয়া আদর্শ বা ইউটোপিয়ান সেই মুক্তিটি এনেছেন তাঁর কল্পনায়, কিন্তু পুরোপুরি ভবিষ্যতের বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে।

মূল আলোচনায় যাবার আগে গল্পের সারসংক্ষেপটি জেনে নেয়া যাক। স্বপ্নে লেখিকার সাথে বন্ধু সিস্টার সারা'র কথোপকথন এবং লেডি-ল্যান্ড বা নারীস্থান নামের দেশটি ভ্রমণ করছেন। সেই দেশে পথেঘাটে কোনো পুরুষ নেই, কারণ তাদেরকে পর্দার আড়ালে, 'পুরুষ-মহলে' আবদ্ধ রাখা হয়েছে। ওরা লাজুক, ভালো কিছু করতে পারে না কিন্তু সময়মতো রান্না করে এবং ঘরদোর পরিষ্কার করে রাখে। ফলে দেশে কোনো অপরাধ নেই, মেয়েরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও কাজ করতে পারে। শিক্ষা ও বিজ্ঞানই সব সমস্যার সমাধান, এই মতবাদে বিশ্বাসী রাজ্যের রানীর উৎসাহ ও আদেশে মেয়েদের জন্য অসংখ্য স্কুল ও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলো। একটিতে সূর্যালোক ও সূর্যতাপের গবেষণা এবং নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করে ঘরবাড়ি আলোকিত এবং রান্নার কাজ সহজ করা হলো। এতে কালি, ধুল বা ঝুলের সৃষ্টি হয় না বলে ঘরবাড়ি পরিষ্কার ও আলোকিত থাকে। অপর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একটি পানি-বেলুন নির্মান করে আকাশ থেকে পানি সংগ্রহ ও সঞ্চিত করে প্রয়োজনে দেশকে খরার হাত থেকে দেশ বাঁচিয়ে পর্যাপ্ত কৃষি-ফলন বাড়াল। দেশটি পরিষ্কার ও ঝকঝকে থাকে, সর্বত্র থাকে মনোমুগ্ধকর ফুলের বাগান। সেই দেশে বাল্য-বিবাহ নেই, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী নেই, নেই প্রসূতির বা শিশু-মৃত্যু। সত্যবাদিতা, ভালোবাসা ও মানবতাই সেই দেশের ধর্ম। মহিলা বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উড়োজাহাজ বা বিমানে অল্প সময়ে অধিক দূরত্ব অতিক্রম করা যায়, ফলে কোনো সড়ক বা রেল দূর্ঘটনা ঘটে না।
তা পুরুষদের কীভাবে গৃহবন্দি করা হলো? না, কোনো বলপ্রয়োগ করে নয়, বুদ্ধি দিয়ে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে বিরোধ দেখা দিলে কৌশলের পরিবর্তে ক্ষমতার অধিকারী পুরুষরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে করে দেশকে সক্ষম-পুরুষ-শুন্য করে দিল। এবার মেয়েরা এগিয়ে আসল। ওরা যেহেতু অচেনা পুরুষের সামনে আসবে না, রয়ে যাওয়া পুরুষদের ঘরের ভেতরে ঢুকে থাকতে বলা হলো। মহিলা বিজ্ঞানীরা তখন 'ঘনীভূত সূর্যালোক'কে শত্রুসেনাদের ওপর বর্ষণ করলে ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল, কিন্তু একটিও প্রাণসংহার হলো না। সেই যে অন্দরমহলে স্থান নিল, নারীস্থান দেশের পুরুষরা আর ঘরের বাইরে আসতে পারল না। নারীস্থানটি এক ইউটোপিয়ান বা আদর্শ সমাজে পরিণত হলো যেখানে কেউ কোনো খুঁত খুঁজে পাবে না।

গল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপকরণগুলো হচ্ছে সূর্যের আলো ও তাপ, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, বিমানে আকাশ-ভ্রমণ, এবং বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটান। এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও আবিষ্কারগুলোকে ভিত্তি করে মহিলা কল্পবিজ্ঞানীরা পুরুষকে গৃহবন্দি করার মত সামাজিক-প্রযুক্তি (সোশ্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং) ছাড়াও বৈদ্যুতিক-প্রযুক্তি, উড়োজাহাজ-প্রযুক্তি, আবহাওয়া-প্রযুক্তি, যুদ্ধ-প্রযুক্তি, গৃহস্থালী-প্রযুক্তি এবং কৃষি-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেন। এর বাইরে আরো রয়েছে: ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধ করে মহামারী নিয়ন্ত্রণ, যদিও এর বৈজ্ঞানিক কোনো উপাদান বইটিতে নেই। তিনি যেসব বৈজ্ঞানিক উপাদান ব্যবহার করেছেন সেগুলোর প্রায় সবই ছিল প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তত্ত্ব ও তথ্যের ওপর নির্মিত।

মানুষ মূলতঃ তিন প্রকারে কোনো জ্ঞান আহরণ করে থাকে। দেখে, শুনে, এবং পড়ে। বিজ্ঞানের যে সব তথ্যকে তিনি উপন্যাসটিতে কাজে লাগিয়েছেন অথচ এর অধিকাংশই তিনি যে স্বচক্ষে সেসব অবলোকন করেন নি, তাঁর সময়ে বিরাজমান বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অবস্থা বিবেচনা করে অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানের ছাত্রী না হয়েও তিনি বিজ্ঞানের ভবিষ্যতমুখী যে সব উৎকর্ষের কথা বলেছেন, তাঁর সময়ের বিচারে তা শুধু ক্ষণজন্মা, চিন্তাশীল দার্শনিক এবং অত্যন্ত মেধাবী কোনো ব্যক্তির ভাবনায়ই উদ্রেক হওয়া সম্ভব। কলকাতা তথা ভারতবর্ষে তখন জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়-এর প্রচেষ্টায় আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার মাত্র উন্মেষ ঘটছে। তাঁদের বা তখনকার অন্য কোনো বিজ্ঞানীর সাথে রোকেয়ার সাক্ষাৎ ঘটেছিল কিনা জানা যায় না। খুব সম্ভবতঃ না, কারণ সম্ভ্রান্ত মুসলমান পর্দানশীন মহিলা হিসেবে পরপুরুষের সামনে যাওয়া তাঁর বারণ ছিল, এবং রংপুরে পিত্রালয়ে এবং বইটি প্রথম প্রকাশকাল পর্যন্ত বিহারের ভাগলপুরে স্বামীগৃহ ছাড়া তাঁর অন্য কোথাও যাওয়া হয়েছিল বলেও জানা যায় না।

কিন্তু আমরা জানি যে বিবাহের পূর্বে তাঁর স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন বিলাতে আধুনিক কৃষি-বিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত হয়ে 'ফেলো অব রয়াল সোসাইটি অব এগ্রিকালচার' হয়েছিলেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক হলেও রোকেয়ার শিক্ষা, সাহিত্যচর্চা এবং নারী অধিকার নিয়ে লেখালেখিতে তাঁর স্বামীর যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা কাজ করেছিল তা প্রায় সব জীবনীকাররাই স্বীকার করেছেন। এই তথ্য থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে তাঁর স্বামীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া সেই যুগে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্য সম্বলিত সব ধরনের পত্রপত্রিকারও তিনি বুভুক্ষু পাঠক ছিলেন বলে ধরে নিতে পারি। শুধু পাঠ নয়, বিষয়গুলো তিনি আত্মস্থও করেছিলেন। অন্যথায় যে কৃতিত্বের সাথে কঠিন বিজ্ঞানকে তিনি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও যুদ্ধবিদ্যার সাথে একীভূত করেছেন তা অসম্ভব হতো।
উল্লিখিত সব বৈজ্ঞানিক তথ্যকে তিনি কল্পনা দ্বারা এমনভাবে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন যা দ্বারা পুরুষকে শৃংখলাবদ্ধ করে নারীজাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার অভীষ্ট পুরণ হয়। ফলে তাঁর কল্পনালব্ধ বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি প্রযুক্তি গল্পের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে তাঁর বর্ণিত বিজ্ঞানকে মোটেই কাল্পনিক মনে হয় না। আর সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে তিনি বিজ্ঞানের যে যে উৎকর্ষের কথা বলেছেন তার প্রায় সবকটির প্রমাণই হাতেনাতে আমরা পেয়েছি এবং পেয়ে চলেছি বইটি প্রকাশের কয়েক দশক পর থেকে।

বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি
অন্তর্জালে প্রাপ্ত বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো বাতি জ্বালিয়ে বিদ্যুতের ব্যবহারিক নমুনা প্রদর্শিত হয় কলকাতায় ১৮৭৯ সালে। সেই সময়ে কলকাতার রাস্তায় সন্ধ্যায় গ্যাসের বাতি জ্বালানো হত এবং সূর্য ওঠার সাথে সাথে নিভিয়ে দেয়া হত। বৈদ্যুতিক বাতির উপকারিতা গ্যাসের বাতি থেকে বেশি হলেও জনসাধারণের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে গ্যাস কোম্পানীগুলোর বিরোধিতার জন্য পরবর্তী দশ বছরেও ভারতবাসী বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুফল বঞ্চিত ছিল। ১৮৮৯ সালে হ্যারিসন রোড নামে কলকাতার একটি মাত্র রাস্তায় কয়লা বা তেল (ফুয়েল) পুড়িয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের বাতি বসান গিয়েছিল। বিদ্যুৎ নিয়ে ভারতে এরপরের প্রধান ঘটনা হলো ১৮৯৭ সালে দার্জিলিং-এ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন। এই সময়কালে এবং পরবর্তীতে কোনো কোনো সরকারী ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপিত হলেও বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের কোনো ব্যবহার ছিল না। তা সত্ত্বেও এ কথা ধরে নেয়া যায় যে একটি বোতামে টিপ দিয়ে বিদ্যুতের বাতি জ্বালানো ও নেভানোর কথা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জানা হয়ে গিয়েছিল। নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও এও ধরে নেয়া যায় যে কোনো কোনো ভবনে বিদ্যুতের পাখাও চালু হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষে বিদ্যুতের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা গেল এরপরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হলো প্রথমবারের মতো ট্রামগাড়ি চালানোর জন্য বোম্বেতে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল।

দেখা যাচ্ছে 'সুলতানা'স ড্রিম' লেখার আগে স্বচক্ষে দেখে, কারো কাছ থেকে শুনে অথবা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে বেগম রোকেয়ার সামনে বিদ্যুতের ব্যবহারের চারটি তথ্য ছিলোঃ ১) বাতি জ্বালানো, ২) পাখা চালানো, (৩) বোতাম বা সুইচ টিপে বাতি বা পাখা চালানো, এবং ট্রাম গাড়ি চালানো। এই তিনটি জ্ঞানকে ভিত্তি করেই তিনি ভবিষ্যতের জন্য দুইটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রের কল্পনা করেছেন। একটি হচ্ছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত লাঙ্গল, এবং অপরটি বায়ুযান বা বিমান বা উড়োজাহাজ। নারীস্থানের কৃষিকাজের বর্ণনায় সিস্টার সারা জানাচ্ছেন 'আমাদের জমিগুলি কর্ষিত হয় বিদ্যুৎ দ্বারা, যাহা অন্যান্য গতিশীল (যান্ত্রিক) কাজেরও শক্তি যোগায়, এবং আমরা আমাদের বায়ুযানের কাজেও ইহাকে (বিদ্যুতকে) কাজে লাগাই'। আবার উড়োজাহাজ বা বিমানের গঠন ও কার্যপ্রণালী বর্ণনায় রোকেয়া বলছেন 'তিনি (সিস্টার সারা) তখন দুইটি পাখা (ফলা বা ব্লেড) বায়ুযানটিতে সংযুক্ত করিলেন, যাহা বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত হয় বলিয়া বলিলেন'। তিনি বলে চলেছেন 'আমরা ভালোমতো বসিবার পর তিনি একটি বোতামে স্পর্শ করিলেন, এবং সাথে সাথে পাখাগুলি ঘুরিতে শুরু করিল যাহার গতি প্রতি মহূর্তেই বাড়িয়া চলিল'।

১৯০৩ সালে প্রথম সফল উড্ডয়নে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমানের ইঞ্জিনটি চালু বা স্টার্ট করা হয়েছিল একটি শুষ্ক-ব্যাটারি ও ৪ অশ্বশক্তির একটি তেলের-ইঞ্জিন দ্বারা১০। কিন্তু বেগম রোকেয়ার বায়ুযানটি চালু ও চালিত হয়েছিল বিদ্যুৎ দ্বারা। এই বিবেচনায় বেগম রোকেয়ার কল্পবিজ্ঞান তখনকার বাস্তবতার চেয়ে অন্ততঃ একশত বছর এগিয়েছিল। পৃথিবীকে বায়ুদুষণের হাত থেকে বাঁচাতে প্রায় দুই দশক অনেক চ্যাঁচামেচির পর বৃহৎ স্থলযান-কোম্পানীগুলো তেল-পোড়ানো ইঞ্জিন পরিহার করে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে সম্প্রতি মনযোগী হয়েছে। কিন্তু বৈদ্যুতিক শক্তি দ্বারা বিমান চালানোর ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। মাত্র গত সপ্তাহের একটি খবরে দেখলাম জার্মানীর একটি কোম্পানি বিদ্যুৎ শক্তি চালিত বিমানে মাত্র কুড়ি মাইলের মতো পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছে।


বেগম রোকেয়া তাঁর বায়ুযানে বিদ্যুৎ চালু করেছিলেন একটি 'বোতাম স্পর্শ' করে। বাংলাদেশে আজ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ থাকার ফলে একটি বোতাম বা সুইচে টিপ দিয়ে বাতি জ্বালানো বা পাখা চালানোতে কোনো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ১৯০৫ সালে যেখানে ভারতবর্ষের কোনো বাসস্থানেই (খুব সম্ভবতঃ) কোনো বিদ্যুতের সংযোগই হয়নি, তখনকার খুব কম লোকই বোতাম টিপে বিদ্যুৎ চালু করার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না। তখনকার বিচারে বেগম রোকেয়ার এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানটিই শুধু ছিল না, তিনি কল্পবিজ্ঞান ভাবনায় এই বোতাম টিপার বিষয়টিকে অন্ততঃ একশ বছর এগিয়ে দিয়েছিলেন। বৈদ্যুতিক (ইলেক্ট্রিক্যাল) প্রযুক্তিকে তিনি বৈদ্যুতিন (ইলেক্ট্রনিক) প্রযুক্তিতে রূপান্তরের কল্পনা করেছিলেন। পাঠক লক্ষ করুন কোনো সুইচ বা বোতামে 'টিপ' না দিয়ে, শুধু 'স্পর্শ' করেই বাতি, পাখা, গাড়ি, চুলা বা টেলিভিশন চালু করার পদ্ধটিটা বৈদ্যুতিন প্রযুক্তিতে অতি সম্প্রতিই চালু হয়েছে।

একই ভাবে বিদ্যুৎ দ্বারা লাঙ্গল চালানোর বৈজ্ঞানিক কল্পনাটিও বেগম রোকেয়ার প্রখর দূরদৃষ্টি এবং কল্পনাশক্তিরই পরিচয় দেয়। তাঁর সময়ে বা পরবর্তী কয়েক দশকেও পৃথিবীর কোথাও বিদ্যুৎ-চালিত লাঙ্গলের কোনো প্রচলন ছিল বলে জানা যায় না।

বিমান ভ্রমণ
সুলতানা'স ড্রিম-এ যে নারীনেত্রী-রানীকে বেগম রোকেয়া মহতী বলে জ্ঞান করেছিলেন, সেই নারীকে দেখতে বেগম রোকেয়া আকাশ-ভ্রমণ করলেন। সেই 'বায়ুযান' নির্মানের বর্ণনা তিনি কিছুটা বিষদভাবেই দিয়েছেন। 'তিনি (সিস্টার সারা) চৌকোণা একটি তক্তার ওপর স্ক্রুর সাহায্যে দুইটি আসন বসাইলেন'। এরপর তাহাতে দুটো 'মসৃণকৃত ও কোমল হাইড্রোজেন (এর) বল (গোলক – লেখক) জুড়িয়া দিলেন। কারণ হাইড্রোজেন-ভর্তি বলগুলো 'মাধ্যাকর্ষণ এর শক্তিকে অতিক্রম করিতে ব্যবহার করা হয়'। আবার (আকাশ-যানের) 'ওজন বুঝে (হাইড্রোজেন) বলের ধারণক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি হইয়া থাকে'। 'এরপর তিনি পাখার ন্যায় দুইটি পাত বাঁধিলেন যেইগুলি বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত হয় বলিয়া তিনি বললেন। আমরা (আসনদুটিতে) আরাম করিয়া বসিবার পর তিনি একটি বোতামে স্পর্শ করিলেন এবং পাতগুলি মুহূর্ত হইতে মুহূর্তে দ্রুততার সহিত ঘুরিতে লাগিলো। প্রথমে আমরা পাঁচ থেকে ছয় ফুট উচ্চে উত্থিতো হইলাম এবং তারপর উড়িয়া গেলাম। এবং আমরা যে চলিতে শুরু করিয়াছি আমি তাহা বুঝিয়া উঠিবার পূর্বেই আমরা রানীর বাগানে পৌঁছিয়া গেলাম
আজ থেকে সোয়া'শ বছর আগের কথা বাদ দিলাম, আজকের বাংলা সাহিত্য চর্চাকারীদের কয়জন হাইড্রোজেন যে বাতাসের একটি উপাদান, তা নিশ্চিত করে বলতে পারবেন? শুধু তাই নয়, বাতাসের তিনটি প্রধান উপাদানের মধ্যে হাইড্রোজেন যে সবচেয়ে হালকা, সেই তথ্যও বেগম রোকেয়ার জানা ছিল। আর হালকা বলেই হাইড্রোজেন-এর বল (গোলক – লেখক) মাধ্যাকর্ষণের শক্তিকে উপেক্ষা করে ওপরে উঠে যেতে পারে– তেমন বৈজ্ঞানিক চিন্তা করার শক্তিও বেগম রোকেয়ার ছিল।

আমাদের আজকের জ্ঞানে উড়োজাহাজ বা হেলিকপ্টারে চড়ে আকাশ-ভ্রমণ কোনো অতি সাধারণ ব্যপার। অধিকাংশ লোকই একে বিশেষ জ্ঞান বলে বিবেচনা করবে না। ১৯০৫ সালের অনেক আগে যখন এধরনের বিমানের অস্তিত্ব বা ধারণাই ছিল না, তখন বেলুনের সাহায্যে আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা ইউরোপ ও আমেরিকার লোকদের হয়েছিল। বিমান জাতীয় কোনো যন্ত্রের সাহায্যে পাখির মতো আকাশে ওড়ার ঘটনা সুলতানা'স ড্রিম' প্রকাশের মাত্র দুই বছর আগে, ১৯০৩ সালে মানুষ প্রথম ঘটিয়েছিল১০। সেই সময় সাইকেলের দুই কারিগর ভাই অলিভার রাইট এবং উইলভার রাইট একটি যন্ত্র বানিয়েছিলেন। এর সাহায্যে তাঁরা ১৯০৩ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ১০ ফুট উচ্চতায় উঠে ২০০ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন, এবং পাঁচজন সেই উড্ডয়ন প্রত্যক্ষ করেছিলেন১০। কিন্তু প্রায় ১৯০৭ সালের আগে এই আবিষ্কারের কথা বিজ্ঞানীরা তো নয়ই, এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকার সাধারণ সংবাদপত্রগুলোও বিশ্বাস করেনি১০। এরপর আরো অনেক বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী আবিষ্কার ও উন্নতির পর নিয়মিতভাবে ১৯১৪ সালে বিমান-ভ্রমণটি চালু হয়। সেবছর টনি জেনাস নামে এক বৈমানিক ২৩ মাইল দূরত্ব অতিক্রমের একটি বাণিজ্যিক উড্ডয়নের সূচনা করেছিলেন আমেরিকার ফ্লোরিডা রাজ্যে।

বিমান এবং আকাশ ভ্রমণের এই ইতিহাসটুকু মনে রাখলে বিজ্ঞানী অথবা কারিগর না হয়েও বেগম রোকেয়া যে সমকালীন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সংবাদ ও তথ্যের কী পরিমাণ খবর রাখতেন তা সম্যক অনুমান করা যায়। অবশ্য সেই সময় প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের বাইরে নিছক কাল্পনিক কারিগরি কাহিনীর কথাও তখন জানা ছিল। আরব্য উপন্যাসের এক কদাকার বৃদ্ধ কারিগর কাঠের একটি কালো ঘোড়া বানিয়েছিল যেটি আকাশে উড়তে পারতো। বিভিন্ন কলকব্জার সাহায্যে উন্নততর যন্ত্র বানানোর কোনো না কোনো তথ্য সম্পর্কেও বেগম রোকেয়ার জ্ঞান ছিল। তাই বায়ূুযানটি বানানোর বর্ণনা তিনি একজন অভিজ্ঞ কারিগরের মতই দিতে পেরেছেন।

এখন আসা যাক তাঁর বায়ূুযানে স্থাপিত দুটি পাখা বা পাত বা ব্লেড-এর কথায়। একটি বোতামে স্পর্শ করাতে পাখা দুটো ঘুরতে থাকল এবং এই ঘুর্ণনের ফলেই বায়ুযানটি মাটি ছেড়ে আকাশে উড়তে পারল। ১৯০৩ সালে নির্মিত এবং প্রথম সফলভাবে উড্ডয়ন করা রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমানে আমরা ঘুর্ণায়মান পাখার অস্তিত্বও দেখতে পাই। এ পর্যন্ত রোকেয়ার বায়ুযানের গঠনে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমানের কারিগরি দিকটির সাথে কিছুটা সাদৃশ্য দেখতে পাই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার হলো ১৯০৩ সালে আকাশে উড়লেও রাইট ভ্রাতৃগণের বিমানের কারিগরি বৃত্তান্ত ১৯০৮ সালের আগে বিস্তারিত কোথাও প্রকাশিত হয় নাই। বেগম রোকেয়া যদি রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমানের গঠনের কথা সুলতানা'স ড্রিম লেখার আগেই জেনে থাকতেন, তবে এব্যপারে যথেষ্ট ওয়াকেবহাল কোনো বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানীদলের সাথে নিশ্চয়ই তাঁর যোগাযোগ ছিল। অথবা কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে তিনি তা জেনেছিলেন। এই সূত্রে 'সুলতানা'স ড্রিম'-এ উল্লিখিত তাঁর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলছেন 'আমি (তাঁহাদের) বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গিয়াছি যেইখানে আমাকে তাহাদের কয়েকটি কারখানা, গবেষণাগার, এবং মানমন্দির (ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে) দেখানো হয়'। রোকেয়ার জীবনীপাঠ থেকে আমরা জানি যে তিনি উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের বহু স্থানে প্রচুর ভ্রমণও করেছিলেন

সৌররশ্মি ও সৌরতাপ
পাঠক লক্ষ করুন ১৯০৫ সালে সুলতানা'স ড্রিম গল্পটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন সূর্যের আলো দিয়ে ঘরবাড়ি আলোকিত ও রান্নাবান্না করার ধারণাটি ছিল সাধারণ জ্ঞানের অনেক উর্ধে। দরজা জানালা খোলা রেখে সূর্যালোকে ঘরকে আলোকিত করা অথবা সিন্দাবাদ নাবিকের কাল্পনিক বিশালাকৃতি পাখির পায়ে আকাশ ভ্রমণ করা কোনো বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না। কোনো বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ছাড়া যদিও সম্পূর্ণ কাল্পনিকভাবে কেউ কেউ সূর্যের আলো দিয়ে ঘর এবং বহুতল বাড়ির বিভিন্ন ঘর সূর্যের আলোয় ভরিয়ে তুলতে এবং আকাশ ভ্রমণ করতে পারতেন, নিচের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হবে যে বেগম রোকেয়া তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা ধারণাকে অবলম্বন করেই সুলতানা'স ড্রিম গল্পটি রচনা করেছিলেন, মস্তিষ্কের লাগামহীন কল্পনা থেকে নয়। বিজ্ঞানের উৎকর্ষ নিয়ে তিনি ভবিষ্যতের যে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা যে কোনোভাবেই অলীক ছিল না এর প্রমাণ বইটি প্রকাশের পর শতাধিক বছর থেকেই আমরা পেয়ে আসছি।
তিনি লিখেছেন 'রান্নাঘরটিতে আমি কোনো ধোঁয়া অথবা চিমনি দেখিতে পাইলাম না – এটি ছিল পরিষ্কার ও উজ্জ্বল-আলোকিত'। তিনি রান্নাঘরের (সহজেই ধরে নিতে পারি তিনি সারা বাড়ির কথাই বুঝিয়েছেন কারণ ঝুল বা কালি উৎপাদনকারী আগুন তাঁরা জ্বালাতেন না) অন্ধকার দূরীকরণের জন্য আলো এবং রান্নার চুল্লির তাপ সংগ্রহ করেছেন 'ঘনীভূত সূর্যের আলো ও তাপ থেকে'। আরো লিখেছেন 'এবং শীতকালে আমরা সূর্যতাপে ঘর গরম রাখি'। সূর্যের আলো ও তাপ তিনি ঘরের ভেতরে নিয়ে এসেছেন একটি নল দিয়েঃ 'অতঃপর কী প্রকারে সৌরকর একটি নলের ভিতর দিয়া আইসে, সেই নলটা তিনি আমাকে দেখাইলেন'।
পাঠক লক্ষ করুন যে 'ঘনীভূত আলো ও তাপ' এবং নল দিয়ে সেই তাপ ও আলোকে ঘরে নিয়ে আসা – এই দুটি ধারণাই অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। ছোট্ট একটি আতস (লেন্স) কাঁচের সাহায্যে সূর্যরশ্মিকে তীব্র ও তীক্ষ্ণ করে কাগজ বা শুকনা খড়কূটায় আগুন জ্বালানোর অভিজ্ঞতা (রোকেয়া তাঁর বাংলা গল্পটিতে তা উল্লেখও করেছেন) আমাদের অনেকেরই ধারণায় থাকলেও সেটি এখনো একটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। ধারণা করি তিনি একেই ঘনীভূত সূর্যের আলো ও তাপ' বুঝিয়েছেন। এরপর এখানে আরো দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমটি হচ্ছে নল দিয়ে সূর্যালোক ও তাপ ঘরের ভেতরে নিয়ে আসা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে আলো থেকে রান্নার চুল্লির তাপ সংগ্রহ।

ঘনীভূত সূর্যের তাপ প্রয়োগ করার যন্ত্র বানিয়ে তিনি শত্রুপক্ষকে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। শুধু তাই নয়, একই পদ্ধতিতে তাঁদের ফেলে যাওয়া যুদ্ধাস্ত্রগুলোতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। প্রায় সোয়া দুই সহস্র বছর আগে গ্রিক বৈজ্ঞানিক আর্কিমিডিস আয়নার সাহায্যে সূর্যালোক প্রতিফলিত করে সমুদ্রে শত্রুর যুদ্ধজাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন বলে একটি গল্প প্রচলিত আছে, যদিও এর সত্যতা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। বেগম রোকেয়া বাংলায় লিখিত তাঁর 'সুলতানার স্বপ্ন' বইতে এই যুদ্ধাস্ত্রের বিষদ বর্ণনা দিয়েছেন, যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই।

১৯০৫ সালে তো বটেই এখনো আমাদের সাধারণ জ্ঞানে জানি আলো সবসময় সোজা বা সরল পথে চলে। অধিকাংশ লোকই জানেন না যে ক্ষেত্র-বিশেষে আলোও বাঁকা পথে চলতে পারে। এই ব্যাপারটিকে ইংরেজিতে টোটাল ইন্টার্নাল রিফ্লেকশন অব লাইট, (বাংলায় যাকে 'আলোর সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন' বলা যেতে পারে) বলা হয় (১১)। অর্থাৎ আলো কোনো সোজা বা বাঁকা নলের ভেতরে একবার ঢুকলে তা নলের ভেতরকার মসৃণ দেয়ালে বারবার প্রতিফলিত হয়ে নলের অন্যপ্রান্ত দিয়ে পূর্ণ তেজ নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। সেটি কলেজের বিজ্ঞান ক্লাশে পানির বাঁকা স্রোত বেয়ে আলোর চলার পরীক্ষাটি হাতে-কলমে না শিখলে আলো সম্পর্কে আমার ধারণা আজও সরলরেখার মতোই রয়ে যেত।
বেগম রোকেয়ার বর্ণিত নল বা পাইপটি সোজা বা বাঁকা ছিল কিনা তা আমরা জানিনা। সাধারণ কোনো নলের কোথাও বাঁকা হয়ে থাকলে আলো তাতে বাধাপ্রাপ্ত ও শুষে যাওয়ার ফলে শক্তি হারিয়ে ফেলার কথা। কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত সৌরতাপ দিয়ে তো প্রতিদিনের রান্না সুষ্ঠুমতো হতে পারে না। মনে রাখুন নারীস্থানে কোথাও কোনো খুঁত নেই। কাজেই ধারণা করি তাঁর কাল্পনিক নলটি বাঁকা অথবা সোজা দুইই হতে পারে, এবং তিনি তা জানতেন। কারণ বিদ্যুৎ সোজা বা বাঁকা দুই ধরণের নল বা তার দিয়েই প্রবাহিত হতে পারে, এবং আলো যে বিদ্যুতের মতোই একটি বৈদ্যুতিক-চৌম্বকীয় শক্তি তা তাঁর সময়ে জানা ছিল। বছর কয়েক আগে ১৮৯৫ সালে কলকাতায় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু জনসমক্ষে তা প্রদর্শন করেছিলেন১২। সেই তথ্য বেগম রোকেয়ার মতো তীক্ষ্ণ কৌতূহলী মনের অগোচরে থাকার কথা নয়। কাজেই ছাদের ওপরে নল লাগিয়ে ঘরে আলো নিয়ে আসার ধারণাটি বেগম রোকেয়ার বৈজ্ঞানিক চিন্তা থেকেই যে এসেছিল তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

মাত্র কুড়ি বা তিরিশ বছর আগে অবাক হয়ে আমরা জানতে পারলাম যে টোকিওর একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে আহরিত সূর্যরশ্মি এক ধরনের নলের ভেতর দিয়ে এসে প্রথম তলার অন্ধকার ঘরগুলোকে দিবালোকের ন্যায় আলোকিত করে দিয়েছিল। সেই নলগুলো ছিল ফাইবার অপটিক্স ক্যাবল, যা বাঁকা হলেও আলো বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে বা টোটাল ইন্টার্নাল রিফ্লেক্সন হয়ে বহুদূর চলে যেতে পারে। আজ শুধু আলোই নয়, ফাইবার অপটিক্স ক্যাবল বা নলকে এই কাজে লাগিয়ে আধুনিক পৃথিবীর তাবৎ যোগাযোগ ব্যবস্থা টিকে আছে। পাঠক আরো লক্ষ করুন যে আধুনিককালের অপটিক্যাল ফাইবার নামে নলের ভেতর দিয়ে আলো পাঠিয়ে ডাক্তাররা পেট, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, এবং যেখানে প্রয়োজন সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করে চলেছেন দেহটিকে কাটাছেঁড়া না করেই। এই একই অপটিক্যাল ফাইবার দূরপাল্লার যোগাযোগ এবং লেজার-তাপ বিকীরণ ছাড়াও অসংখ্য বৈজ্ঞানিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আলোর পূর্ণ আভ্যন্তরীণ প্রতিফলন এর সেই সূত্র থেকেই কল্পবৈজ্ঞানিক চিন্তায় তিনি ছাদের ওপরে সংগৃহীত সূর্যালোক কাল্পনিক নল দিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে এসেছিলেন? এই বৈজ্ঞানিক সূত্রটি সম্পর্কে বেগম রোকেয়া ওয়াকেবহাল ছিলেন ছিলেন কি ছিলেন না তা বড় কথা নয়। তিনি যে ভবিষ্যতের জন্য তেমন একটি বৈজ্ঞানিক কল্পনা করতে পেরেছিলেন, তা তাঁর প্রাগ্রসর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানেরই পরিচয় বহন করে।

এখন আসা যাক রান্নায় ব্যবহৃত তাপের কথায়। সেই তাপ দিয়ে রান্না করার জন্য কোনো আগুন যে উৎপন্ন হয় না তা তিনি আমাদের জানিয়েছেন। সিস্টার সারা'র বাড়ির রান্নাঘরে কোনো কয়লা, ধোঁয়া, এবং ময়লার কোনো চিহ্ন তিনি পাননি। 'সেইখানে কয়লা বা আগুনের কোনো চিহ্ন ছিল না'। কিছু পুড়িয়ে আগুন জ্বালানো ব্যতীত রান্না করার অর্থ আমরা বৈদ্যুতিক চুলার কথাই ভাবতে পারি। অথচ ১৮৮৯ সালে ভারতের কলকাতায় প্রথমবারের মতো উৎপাদন কেন্দ্র চালু হলেও ইলেক্ট্রিক চুলার ধারণাও যে ভারতের সাধারণ লোকের কাছে অজ্ঞাত ছিল তা হয়তো হলপ করে বলা যায়। ১৮৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক চুলার একটি মেধাস্বত্বের বা পেটেন্টের কথা জানা গেলেও সেটিকে ব্যবহারোপযোগী করতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরো ৭০ বছর; খোদ আমেরিকাতেই ১৯৩০ এর দশকের আগে বৈদ্যুতিক চুলার বহুল প্রচলন হতে পারেনি১৩। বেগম রোকেয়া ১৯০৫ সালের যে সময় সুলতানা'স ড্রিম রচনা করেন, আমরা ধরে নিতে পারি যে তখনকার পত্রপত্রিকা পড়ে তিনি এধরণের ধোঁয়া-উৎপাদন-বিহীন কোনো চুলার ধারণা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কল্পনার বিস্তৃতি ছিল আরো অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী। তাঁর চুলাটি ছিল সূর্যের আলো থেকে প্রাপ্ত তাপের। সেই চুলাটি কেমন ছিল তা তিনি আমাদের কোনোই ইংগিত দেননি। আমরা শুধু কল্পনাই করে নিতে পারি।

নল বা তারের ভেতর দিয়ে আলো যে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে প্রেরণ করে তাপ উৎপন্ন করা যায় এর একটি বড় উদাহরণ হলো লেজার-রশ্মি। স্বল্পশক্তির আলোকে চুনি পাথর বা রুবি-স্ফটিকের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে উচ্চশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়১১। সেটি ফাইবার ক্যাবেলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করে প্রচণ্ড তাপ হিসেবে শরীরে ক্যান্সার-কোষ ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চলছে১৪। কাজেই সোয়াশ বছর আগে নল দিয়ে পাঠান 'ঘনীভূত সূর্যালোক' দিয়ে রান্না এবং ঘরদোর গরম রাখার ধারণা তখনকার জন্য একটি বাস্তবসম্মত কল্পবিজ্ঞান বলেই স্বীকার করতে হবে।

বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে যে আমাদের চেষ্টা করতে হবে, আজ পৃথিবীর সভ্য ও অনগ্রসর সব দেশের নেতারাই সে বিষয়ে একমত। তাই গ্যাস, তেল বা কাঠ পোড়ানোর বদলে সূর্যরশ্মির শক্তি আহরণের দিকে সবার দৃষ্টি। এই প্রচেষ্টায় সৌরশক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশ থেকেই আজ এগিয়ে। গ্রাম এবং চরাঞ্চলের বাড়িগুলোতে এই সৌরবিদ্যুৎ দ্বারাই ঘর আলোকিত করা এবং বৈদ্যুতিক চুলায়ই রান্নাবান্নার কাজ করা হয়ে থাকে। অথচ যে সোলার প্যানেল এর সাহায্যে সৌরশক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করা হয় তার আদিরূপ প্রথম সোলার সেলটি আবিষ্কার হয় 'সুলতানা'স ড্রিম বই প্রকাশের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে, ১৯৫৪ সালে১৫। আমরা অনায়াসেই ধরে নিতে পারি যে বেগম রোকেয়ার কল্পবিজ্ঞান-প্রসূত রান্নার তাপের বাস্তবিক রূপ বা উৎসই হচ্ছে আজকের সৌরবিদ্যুৎ-চালিত চুলা।

কল্পবিজ্ঞানী বেগম রোকেয়া স্বপ্নে নতুন একটি যন্ত্র বানিয়ে সূর্যালোক ও তাপকে ঘনীভূত করে নলের মাধ্যমে শুধু ঘরের ভেতরেই নিয়ে আসেননি, তিনি এদুটো শক্তিকে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য গুদামজাত করার স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন। লিখেছেন 'তাঁহারা প্রচুর পরিমাণে ঐ (সূর্য)উত্তাপ সংগ্রহ করিয়া রাখিতে এবং ইচ্ছামত যথা তথা বিতরণ করিতে পারেন'। আধুনিক জ্ঞানে আমরা জানি সোলার সেলই বিদ্যুৎ বা সৌরশক্তি ধারণ করে রাখতে পারে। উপরন্তু আমরা ধরে নিতে পারি যে সূর্যশক্তিকে তাঁর গুদামজাত করার যন্ত্রটি আমাদের আধুনিক সোলার সেল ব্যতীত কিছু নয়।
এখন দেখা যাক সময়ের বিচারে মানুষের জ্ঞানে বা আয়ত্তে এগুলোর অবস্থান কোথায় ছিল। ১৮৩৯ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী এডমন্ড বেকেরেল ধাতব ইলোক্ট্রোড দিয়ে একটি ফোটোভোল্টাইক সেল আবিষ্কার করেছিলেন১৫। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন কাগজে-কলমে প্রমাণ করেছিলেন যে 'আলো হচ্ছে শক্তির আধার'। আর ১৯৫৪ সালে আমেরিকার 'বেল ল্যাব'-এ প্রথম ব্যবহারযোগ্য সোলার প্যানেল আবিষ্কৃত হয়েছিল, যা আজকে ব্যবহৃত সোলার প্যানেল থেকে চার গুণ কম নিপুণ ছিল১৫। কাজেই আহরিত এবং 'ঘণীভূত' সূর্যশক্তিকে সংরক্ষণ বা গুদামজাত করার রোকেয়ার দূরদৃষ্টিসপন্ন কল্পনাটি তাঁর সময় থেকে পঞ্চাশ থেকে একশত বছর অগ্রবর্তী ছিল।


সম্প্রতি আমেরিকার ঘরবাড়িতেও সৌরশক্তি আহরণের বিশাল তোড়জোড় চলছে। বছর দুয়েক থেকে কিছুদিন পরপরই বিভিন্ন সৌরশক্তি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে ফোন বা ইমেইল পাই। তারা বিনে পয়সায় আমার বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে এখন থেকে অনেক কম মূল্যে আমাকে বিদ্যুৎ সরবরাহই করবে না, আমার বাড়ির ছাদে উৎপাদিত বাড়তি বিদ্যুৎ অন্য খদ্দেরের কাছেও বিক্রয় করবে। অর্থাৎ সৌরবিদ্যুৎকে এক ধরনের গুদামজাত করবে। কল্পবিজ্ঞানী বেগম রোকেয়া সোয়া'শ বছর আগেই এই ধারণাটি আমদের দিয়ে গেছেন।

বৃষ্টি ও আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ
নারীস্থানের দুটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটির বিজ্ঞান গবেষকরা 'একটি চমৎকার বেলুন আবিষ্কার করে যাহার সহিত অনেকগুলি নল লাগাইয়া দিয়াছিল'। তাঁর লেখা অনুযায়ী বুঝতে পারি এই (মানুষ)-নিয়ন্ত্রিত বেলুনটিকে আকাশে মেঘের স্তরের ওপরে ভাসিয়ে রাখা যেত, এবং ওরা, মানে মহিলা বিজ্ঞানীরা, সেখানকার বায়ুমণ্ডল থেকে যতো খুশি ততো পরিমাণ পানি আহরণ করতে পারত। এভাবে পানি নিষ্কাষণের ফলে মেঘের স্তর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াতে বৃষ্টি এবং ঝড় দুইই বন্ধ হয়ে যায়।

সুলতানা'স ড্রিম' প্রকাশের একশত বছর আগে থেকেই আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাতাস থেকে হালকা হাইড্রোজেন এবং গরম বাতাস-চালিত আকাশে উড়তে পারা বেলুনের প্রচলন ছিল। ভারতের অন্য কোথাও না হলেও খোদ ঢাকা শহরেই ১৮৯২ সালে কেরোসিন ও কাঠ পুড়িয়ে পাওয়া গরম বাতাসের সাহায্যে একটি বেলুন ওড়ানো হয়েছিল বলে জানা যায়১৬। তাতে জিনেট ভান তাসেল নামে এক মার্কিন তরুণী সফলভাবে আকাশ ভ্রমণ করলেও প্যারাসুটের সাহায্যে অবতরণকালে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল১৬। এরপর ১৯৬৩ সালে প্রথম কোনো ভারতীয় বেলুনে আকাশ ভ্রমণ করেছিলেন১৭। অন্যদিকে বৃষ্টির পানি উঁচু দালানের ওপর নির্মিত জলাধারে ধারন করে রাখা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা একটি অতি প্রাচীন পদ্ধতি। রোমান এবং স্পেনে মুসলমান মুরদের রাজত্বকালের এসব নিদর্শনের ভগ্নাবশেষ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এখনো আমরা যেহেতু 'একটা ছাগলের তিনটি মাথা' জাতীয় সংবাদ পড়তেই বেশি আগ্রহী, আজ থেকে সোয়া'শ বছর আগের সাধারণ পাঠকের কাছে এর বেশি কিছু নিশ্চয়ই আশা করতে পারি না। এই পরিবেশে যারা বেলুনে আকাশে বেড়ানো এবং মেঘ থেকে পানি আহরণ করে ধারণ করে রাখার তথ্য জানতেন তাঁদের যে একটি অনুসন্ধিৎসু মন এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের তৃষ্ণা ছিল তা আমরা অনেকটা নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি। বেগম রোকেয়া তেমনই এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এই দুটি জ্ঞানকে একত্র করে কাল্পনিক একটি 'জল-বেলুন' আবিষ্কার করে মেঘ থেকে শুধু পানি আহরণই করলেন না, ঝড়-তুফানও বন্ধ করে দিলেন। লিখেছেন 'আপনি ঐ যে বৃহৎ বেলুন ও তাহাতে সংলগ্ন নল দেখিতে পাইতেছেন, – উহা দ্বারা আমরা যত ইচ্ছা বারিবর্ষণ করিতে পারি। আবশ্যক মত সমস্ত শষ্যক্ষেত্রে জলসেচ করা হয়। আবার জলপ্লাবনেও আমরা ঈশ্বরকৃপায় কষ্টভোগ করি না। ঝঞ্ঝাবাদ ও বজ্রপাতেরও উপদ্রব নাই'। 'এই অদ্ভুত উপায়ে বুদ্ধিমতী লেডি প্রিন্সিপাল প্রাকৃতিক ঝড় বৃষ্টি নিবারণ করিলেন'

উড়ন্ত বেলুনে নল লাগিয়ে মেঘের উপরের স্তর থেকে জল আহরণের কল্পনাটি অবাস্তব বা অতিরঞ্জিত হলেও কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাত ঘটান এবং ঝড় বন্ধ করার ধারণাটি মোটেই অবৈজ্ঞানিক চিন্তা নয়। যে সময়ে তিনি এই পানি আহরণ ও তুফান নিবারণের কল্পবিজ্ঞানের কথা আমাদের বলেছেন এর ২৮ বছর পর, ১৯৩৩ সালে, কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাত ঘটানর একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা আমরা সর্বপ্রথম পাই১৮। বিমানের সাহায্যে মেঘের মাঝে সিলভার আয়োডাইড নামে একজাতীয় লবন ছড়িয়ে কৃত্রিম উপায়ে সত্য সত্যই বৃষ্টিপাত ঘটান হয় আরো তেরো বছর পর, ১৯৪৬ সালে সর্বপ্রথমে। পরবর্তীতে এই লবন ছিটিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটানর সাথে ঝড় ধ্বংস করার কাজও করা হয়। এই উপায়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে বর্ষাকালের স্থায়ীত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল১৮। কাজেই মেঘকে পানিতে পরিণত করার সাথে যে ঝড়-তুফানকে বশে আনা যায় তেমন কল্পনাটি বেগম রোকেয়ার কোনো অলীক কল্পনা ছিল না।

মেঘের উপরের স্তর থেকে নল দিয়ে পানি আহরণ ও জমা করার ব্যপারটির যে বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি তখন ছিল না তা তিনি জানতেন এবং আমাদের তা বুঝিয়ে দিয়েছেন অতি কৌশলে, দুটি বাক্যের মাধ্যমে। তিনি বলছেন, 'কিন্তু নলের ভেতরে পানি কীভাবে জমানো হয় তা আমি বুঝিতে পারি নাই'। আবার লিখছেন 'তিনি তা বর্ণনা করিলেও আমার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে আমি তা বুঝিতে পারি নাই'। এভাবে পানি আহরণের বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি না থাকলেও কল্পবিজ্ঞান লেখক দীপেন ভট্টাচার্যের আধুনিক সংজ্ঞায় 'বৈজ্ঞানিক নীতি বা গঠনকে ভেঙে সেই ভিন্ন জগৎটির অবতারনা' করে 'সুলতানার স্বপ্ন' কল্পবিজ্ঞান হিসেবে ভালোভাবে উতরে গেছে। কারণ তাঁর মতে 'অনেক সময়ই গল্পে আমরা এমন সমস্ত প্রক্রিয়া বর্ণনা করি যা হয়তো ভবিষ্যতেও কখনো বাস্তবায়িত হবে না (যেমন আলোর গতিবেগের বেশিতে বা অন্য একটি মহাবিশ্বে ভ্রমণ), কিন্তু লেখক যদি সেই প্রক্রিয়ার জন্য যুক্তির ভিত্তিতে কোনো নীতি প্রণয়ন করেন তাহলে সেটি (বিজ্ঞানকে ভাঙলেও) বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে'

আরো কয়েকটি বৈজ্ঞানিক উপাদান
ওপরে উল্লেখিত চারটি প্রধান বৈজ্ঞানিক উপাদান ছাড়াও 'নারীস্থান'-এ আরো কয়েকটি বৈজ্ঞানিক তথ্যের কথা রোকেয়া উল্লেখ করেছেন। আমার ধারণা সেগুলো সেই সময়ের সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে পড়ে না। বইটিতে শুধু বুদ্ধি দিয়ে কীভাবে পুরুষদের পরাজিত করা যাবে তেমন আলোচনায় লেখক প্রশ্ন করছেন 'এমন কী তাদের (পুরুষের) মস্তিষ্কও মেয়েদের থেকে বড় ও ভারী, তাই নয় কি'? (১)। সোয়াশ বছর পরে আজকের দিনেও বিজ্ঞানের ছাত্রদের যদি এই প্রশ্ন করা হয়, আমার বিশ্বাস অধিকাংশই এর সঠিক জবাব দিতে পারবেন না। অথচ এটি পরীক্ষিত সত্য যে পুরুষের মস্তিষ্কের গড় ওজন ও আয়তন মহিলাদের মস্তিষ্কের গড় ওজন ও আয়তনের চেয়ে ১.১ গুণ বেশি। বিজ্ঞান সচেতন বেগম রোকেয়ার কাছে এই সত্যটি অজানা ছিল না১৯

ওপরের প্রশ্নটির উত্তরে সিস্টার সারা বলছেন 'মেয়েদের মস্তিষ্ক পুরুষের চেয়ে কিছুটা দ্রুতগতি সম্পন্ন'। আজ থেকে সোয়াশ বছর পূর্বে এই উক্তিটির বৈজ্ঞানিক সত্যতা কতোটুকু ছিল তা খুঁজে বের করার চেষ্টা আমি করিনি। কিন্তু বর্তমানে এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে 'গ্রে ম্যাটার' নামে মস্তিষ্কের যে অংশটিতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ, স্পর্শ বোঝার ক্ষমতা এবং দেহের পেশী নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, তার পরিমাণ পুরুষ থেকে মহিলাদের বেশি থাকে১৯
আরেক সংলাপে সিস্টার সারা জানাচ্ছেন যে পুরুষরা অপিসে দৈনিক সাত ঘণ্টার পাঁচ ঘণ্টাই বিড়ি-সিগ্রেট ফুঁকে এবং গালগপ্পো করে কাটায় অথচ সিস্টার সারা ঘরের সব কাজ করেও তাঁর (বিজ্ঞান) গবেষণাগারে মাত্র দুই ঘণ্টায়ই সারাদিনের কাজ সম্পন্ন করেন। আজ থেকে দেড়-সোয়াশ বছর আগে এই উক্তিগুলোর বৈজ্ঞানিক বা পরিসংখ্যানগত তথ্য কতোটুকু ছিল তা জানা যায় না। কিন্তু ১৯৯৫ সালের ২৫শে আগস্ট আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তি/নিবন্ধে দেখা যায় যে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে অর্থনীতিতে যুক্ত নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করে২০। ওয়ার্লড ইকনোমিক ফোরাম পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপও এই তথ্যের অনুরনন শোনা যায়২১। আর ২১শে নভেম্বর 'সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং' নামক সংস্থার তথ্য উদ্ধৃতি করে ঢাকার দৈনিক 'প্রথম আলো' পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে যে নারীরা পুরুষদের চেয়ে তিনগুণ বেশি মজুরীবিহীন কাজ করে থাকে২২

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে আজকের যে পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে, তা বন্ধ করার উপায় খুঁজতে বর্তমান বিশ্বের বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনায়কারা দুদিন পরপরই মহাসম্মেলন করে চলেছেন। একইভাবে রোগবালাইমুক্ত এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা আমাদের প্রচুর টাটকা শাকসবজি ও ফল খেতে উৎসাহিত করছেন। গাছপালা লাগিয়ে পৃথিবীকে সবুজায়ন করতে তাঁরা যেসব সুরাহা বা ফর্মুলা দিচ্ছেন, আজ থেকে সোয়াশ বছর আগে বেগম রোকেয়া 'সুলতানা'স ড্রিম'-এ তা প্রয়োগ করে গেছেন। কাঠ বা কয়লা পুড়িয়ে বায়ুদূষণ বন্ধ করতে তাঁর শৌরশক্তি ব্যবহারের কথা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন সিস্টার সারার সাথে 'হাতে হাত রেখে অনেক সময় বৃক্ষ-উদ্যানে (বোটানিক্যাল গার্ডেন) হাঁটতে হাঁটতে গল্প করিতাম'। সুন্দর, মোলায়েম ও সবুজ ঘাসের গালিচার মতো পথে হাঁটতে হাঁটতে এই ঘাস ও ফুলের প্রশংসা করলে সিস্টার সারা উত্তর দিয়েছিলেন 'তোমাদের কলকাতা শহরটি এর চেয়েও সুন্দর হইতে পারিত যদি তোমার দেশবাসী তা চাইত'। এই আলাপে তাঁরা ফলমূল ও ভেষজ বৃক্ষ বাগান বা 'হর্টিকালচারের' প্রয়োজনীয়তার কথাও আলোচনা করেছেন। 'আমাদের মহতী রানী উদ্ভিদবিজ্ঞানের অতিরিক্ত ভক্ত। তাঁর উচ্চাশা হইতেছে দেশটিকে একটি বিশাল বাগানে পরিণত করা'। সিস্টার সারার বাড়িটি ছিল 'সুন্দর একটি হৃদয়াকৃতি বাগানে' যার 'সজ্জা, পরিচ্ছন্নতা ও অলংকরণ ছিল বর্ণনাতীত'। বাড়ি পরিদর্শনকালে তিনি দেখলেন 'রান্নঘরটি একটি সুন্দর সবজি বাগানে অবস্থিত। প্রতিটি লতানো গাছ এবং টোমাটো গাছ নিজেরাই একেকটি অলংকার হিসেবে শোভা পাইতেছিল' এবং রান্নাঘরের 'জানালাগুলি ফুলের বাগান দ্বারা সজ্জিত ছিল'। নারীস্থানের বাসিন্দাদের প্রধান খাদ্য কী জানতে চাইলে উত্তর পেয়েছিলেন, 'ফল'
রোকেয়ার ভাষায় সিস্টার সারা'র 'গোসলখানার ছাদটি খুলিয়া ফেলা যাইত', এবং 'ঝর্ণা-নলের কলটি ঘুরাইয়া যখন খুশি গোসল করিতে পারিত'। এধরনের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ছোটোখাটো উদাহরণ ১৯০৫ সালের আগেও বাংলাভাষায় কোনো কোনো লেখক যদিও দিয়েছেন, সময়ের বিচারে এগুলো কোনো সাধারণ জ্ঞান বলে উড়িয়ে দেয়া হয়তো যায় না।

তথ্যপঞ্জী
১। সুলতানা'স ড্রিম, বেগম রোকেয়া, ১৯০৫, দি ইন্ডিয়ান লেডিস ম্যাগাজিন, মাদ্রাজ, ইন্ডিয়া। মূল প্রকাশনাটি বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা অবিকৃতো ভাবে প্রকাশ করে থাকে। Sultana's Dream. (upenn.edu) ২০২০ সালের ১৫ই জুলাইতে নামান (ডাউনলোড)।
২। আবদুল কাদির সম্পাদিতো রোকেয়া-রচনাবলী, দ্বিতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০১৫, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বাংলাদেশ Rokeya Rachanabali : Kadir, Abdul Ed. : Free Download, Borrow, and Streaming : Internet Archive পৃষ্ঠা ১০২) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
৩। নারী প্রগতির একশো বছর রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া, গোলাম মুরশিদ, ২০১৩, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা।
৪। বাংলা বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর আদিপর্ব – মুহিত হাসান, প্রথম আলো, ৩০শে নভেম্বর, ২০১৮, বাংলা বিজ্ঞান কল্পকাহিনির আদিপর্ব (prothomalo.com) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
৫। Editor Eric's The Greatest Literature of All Times – Eric McMillan, ২০২১ What Is Science Fiction? – The Greatest Literature of All Time (editoreric.com) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
৬। Amardeep Singh: Early Bengali Science Fiction (lehigh.edu) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
৭। প্রথম বাংলা তথা ভারতীয় কল্পবিজ্ঞানের সন্ধানে | কল্পবিশ্ব পত্রিকা (kalpabiswa.in) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
৮। লেখকের সাথে অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগতো পত্রালাপ, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২১
৯। ভারতে বিদ্যুৎ খাত (Electricity sector in India), ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২১ উইকিপিডিয়া,
Electricity sector in India – Wikipedia, ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
১০। Wright Brothers: A Promise of Flight Fulfilled (historynet.com), ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
১১। পূর্ণ আভ্যন্তরীণ প্রতিফলন ও লেজারঃ A Laser Output Coupler Using Frustrated Total Internal Reflection (osapublishing.org) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
১২। 'অব্যাক্ত' গ্রন্থের পৃষ্ঠা নম্বর ৪৬-এ 'অদৃশ্য আলোক' প্রবন্ধ সংকলন, জগদীশচন্দ্র বসু, ১৯২০, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা থেকে ২০০৬ সালে পুনোমুদ্রিত।
১৩। বৈদ্যুতিক চুলার ইতিহাসঃ History of Electric Stove – Use Gas Geyser to Pave Way for Rising Power Cuts and Enormous Electricity Bills – syguia6@gmail.com – Gmail (google.com) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
১৪। ফাইবার অপটিক্স দ্বারা ক্যান্সার চিকিৎসাঃ (Review of advanced catheter technologies in radiation oncology brachytherapy procedures (nih.gov)) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
১৫। সোলার সেল এবং প্যানেল এর ইতিহাসঃ This Month in Physics History (aps.org) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
১৬। ঢাকার আকাশে প্রথম বেলুন-ভ্রমণঃ ভানতাসেল:ঢাকার আকাশে প্রথম উড়েছিলেন যিনি | ডিএমপি নিউজ (dmpnews.org) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
১৭। প্রথম ভারতীয়ের বেলুন ভ্রমণঃ (https://www.baileyballoons.co.uk/2013/11/26/indias-first-balloon-flight-remembered-50-years-on/) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
১৮। আবহাওয়া-প্রযুক্তিঃ Weather modification – Wikipedia ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
১৯। মহিলা ও পুরুষের মস্তিষ্কের পার্থক্যঃ Battle of the Brain: Men Vs. Women [Infographic] | Northwestern Medicine ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
২০। মহিলারা পুরুষ থেকে বেশি কাজ করেঃ Women Work More, But are Still Paid Less (ilo.org) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
২১। মহিলারা পুরুষ থেকে অধিক উৎপাদনশীলঃ Women are more productive than men, according to new research | World Economic Forum (weforum.org) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
২২। নারীর অদৃশ্য কাজ, সম্পাদকীয়, (দৈনিক) প্রথম আলো, ৩১শে আগস্ট, ২০২১, ঢাকা, বাংলাদেশ। নারীর অদৃশ্য কাজ (prothomalo.com) ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে সর্বশেষ পঠিত বা নামান (ডাউনলোড)।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ এই প্রবন্ধটি লেখার সময় কল্পবিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্য আমার বিভিন্ন আলোচনা শুনে, পান্ডুলিপিটি পড়ার পর একটি নতুন তথ্য সরবরাহ করে এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন।