ইতিহাসের স্বর্ণঅধ্যায়ে এক কিংবদন্তী বাঙালির কাহিনি

মোজাম্মেল খানমোজাম্মেল খান
Published : 5 April 2016, 03:58 PM
Updated : 5 April 2016, 03:58 PM

জাতীয় ইতিহাসে দ্বিসহস্র বছরেরও বেশি সময়ে ক্রান্তিলগ্ন এসেছে বহুবার, কিন্তু স্বর্ণঅধ্যায় আসেনি বারবার। এ দুইএর সংমিশ্রণ হয়েছে শুধু একবারই– আর সেটা ঘটেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের ইতিহাসের এটাই একমাত্র গৌরবময় কাহিনি। এ কাহিনির স্মৃতিচারণ তাই ঘটবে বার বার; হয়তো-বা অনাদিকাল ধরে। যতদিন না আর এক গৌরবময় অধ্যায়ের অভ্যুদয় ঘটে, যেটা কি না একে ম্লান করে দেওয়ার শক্তি রাখে।

বাঙালি জাতির চরিত্রে বহু বিভাজন। অনৈক্য আর মতভেদ বাঙালি চরিত্রের রীতি। সে মতভেদ আর বিভাজনময়তার সুযোগে বাংলা শাসিত হয়েছে পরদেশিদের দ্বারা, হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। বাঙালির জাতীয় চরিত্রের চিরন্তন এ রীতির প্রথম ব্যতিক্রম ঘটেছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে– বাঙালির ইতিহাস-উল্টানো একতার মধ্য দিয়ে। আর এ ব্যতিক্রম ঘটানোর অসাধ্য কাজটি সংঘটন করার সিংহভাগ কৃতিত্ব যে মহান বাঙালি সন্তানের প্রাপ্য তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের ইতিহাসের রাখাল রাজা– শেখ মুজিবুর রহমান।

সে মহান পুরুষের সমুদ্রসীমা দেশপ্রেম, সীমাহীন ত্যাগ, অমিত সাহস আর বজ্রকণ্ঠ ('আমি যদি হুকুম দিবার না পারি..') শুধু বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ বাঙালিদেরই নয়, বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানরত বাঙালি সন্তানদের ধমনীতে দেশপ্রেমের বহ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করেছিল। তুচ্ছ করার মতন ব্যতিক্রম ছাড়া, সেদিন বিশ্বের যে যেখানে বাঙালি ছিলেন, সবারই চিন্তা, শক্তি আর শ্রম মিশে গিয়েছিল একই মোহনায়– যে মোহনার নাম ছিল মুক্তিযুদ্ধ।

আজকের এ নিবন্ধের স্বল্পপরিসরে আমি এমন একজন বাঙালির একাত্তরের ভূমিকার কথা কিঞ্চিত উল্লেখ করব যিনি বিশ্বসভায় তাঁর কৃতিত্বের দ্বারা কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁর নাম শুনেননি এমন বাঙালির দেখা মেলা ভার। তিনি ছিলেন প্রকৌশলী ড. ফজলুর রহমান খান। এফ আর খান নামে যিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন শিকাগোর বাসিন্দা এবং স্কিডমোর, ওয়িং এবং মেরিল নামক বিশ্বখ্যাত স্থাপত্য ও প্রকৌশল কোম্পানির অংশীদার ও প্রধান স্থপতি। পরবর্তীতে এক বিশেষ স্ট্রাকচারাল পদ্ধতির উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তৎকালীন বিশ্বের সর্বোচ্চ বিল্ডিং শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ারের নির্মাতা হিসেবে তিনি বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন।

কয়েক বছর আগে কায়রোত মুসলিম বিশ্বকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া ভাষণে মর্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উল্লেখ করেছিলেন, "একজন আমেরিকান মুসলমানই নির্মাণ করেছেন আমাদের দেশের সর্বোচ্চ টাওয়ারটি।"

সে ভাষণে ওবামা যে মুসলমানকে ইঙ্গিত করেছিলেন তিনিই আমাদের কিংবদন্তী, প্রত্যেক বাঙালির গর্ব ড. এফ আর খান।

একাত্তরের ২৬ মার্চ মিলিটারি ক্র্যাকডাউন শুরু হবার পরপরই ড. এফ আর খান যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের অনুভূতি ও শক্তি সংগঠিত করার কাজে নেতৃত্ব প্রদান করেন। বেশ কজন স্বনামধন্য আমেরিকানের সহায়তায় তিনি ইমার্জেন্সি ওয়েলফেয়ার আপিল' নামে একটি ফান্ড গঠন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগও গঠন করেন। নিজের পেশার শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি এ দুটো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।

পাকিস্তানের ওয়াশিংটন দূতাবাসে এবং জাতিসংঘ মিশনে তখন বেশ কজন উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন। এদের মধ্যে জাতিসংঘ মিশনের ভাইস কনসাল এস এ মাহমুদ আলী (বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ২২ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন এস এ করিম ও এনায়েত করিম (যথাক্রমে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরারাষ্ট্র সচিব), আততায়ীর গ্রেনেডে নিহত সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়া এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত।

তাদের সবাই গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করলেও এম এ মুহিত ৩০ জুন দূতাবাস ত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তবে তাঁরা সবাই মিলে একযোগে আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার কথা ভাবছিলেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী সক্রিয় বাঙালিদের ও মুজিবনগর সরকারের তরফ থেকে তাদেরকে অতি শীঘ্র আনুগত্য প্রকাশের জন্য চাপ ও তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল। এ ব্যাপারে কূটনীতিবিদদের অর্থনৈতিক গ্যারান্টি একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে সময় প্রবাসী মুজিবনগর সরকার যদিও কূটনীতিবিদদের ক্ষমতামাফিক মাসোহারা দিতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেটা ছিল অপ্রতুল।

ড. এফ আর খান অতি শীঘ্র যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ মিশন খোলার ব্যাপারে ভীষণভাবে আগ্রহী ছিলেন। সে উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আনুগত্য প্রকাশে আগ্রহী সমস্ত বাঙালি কুটনীতিকের সঙ্গে একযোগে মিলিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত না হওয়া অবধি তাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানোর দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস খোলা হলে তার সমস্ত ব্যয়ভার বহনের প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। সেদিনের পরিস্থিতিতে নিজের মাতৃভূমি এবং তার মানুষের জন্য কতটুকু দরদ থাকলে এমন বিশাল অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব সেটা অনুধাবন করা খুব একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর বিশেষ আমন্ত্রণে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথম সরকারের শাসনে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়।

সত্তরের দশকের প্রথমদিকে সে সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে পড়তে গেলে এ বিশাল হৃদয়ের বাঙালির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনিও আমার মতো ফরিদপুরের অধিবাসী ছিলেন বিধায় আমাকে তিনি একটু বেশি আদর করতেন। ঘটনাক্রমে ড. এফ আর খানের পর আমি প্রথম বাঙালি হিসেবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে ডক্টরেট লাভ করি। আমারও নামের শেষে খান থাকাতে ইঞ্জিনিয়ারং স্কুলের অনেক পুরনো অধ্যাপক জানতে চাইতেন আমরা একই পরিবার থেকে এসেছি কি না। সে সময়ে তিনি Tall Building Design নামে একটা কোর্স পড়াতেন। আমাদের ক্যাম্পাস থেকে আশি মাইল দূরে স্প্রিংফিল্ড শহরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একটি ক্যাম্পাসে। আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংএর ছাত্র না হয়েও ওই বিভাগে অধ্যয়নরত আমার ভারতীয় রুমমেটের সঙ্গে কোর্সটি এটেন্ড করতাম।

তৎকালীন বিশ্বের সর্বোচ্চ বিল্ডিং শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বখ্যাত হওয়ার পর (যেটাকে নিউজ উইক বলেছিল খানের সিয়ার্স টাওয়ার এবং ১৯৭৩ সালের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং আবিস্কার) তিনি আরও কয়েকটি বিখ্যাত বিল্ডিং ডিজাইন করেন যার মধ্যে রয়েছে জন হ্যানকক টাওয়ার এবং জেদ্দার হজ্জ টার্মিনাল।

কেউ যদি ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের ওয়েবসাইট বা উইকিপিডিয়ায় ঢুঁ মারেন তাহলে দেখতে পাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ১৭ জন প্রাক্তন ছাত্র নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সবাইকে ডিঙ্গিয়ে ড. এফ আর খানকে Notable Alumni হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু, তাঁকে 'স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংএর আইনস্টাইন' ও 'বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ বিরল সম্মান আর কোনো বাঙালির ভাগ্যে জুটেছে বলে আমার জানা নেই।

আমাদের তথা বিশ্বের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিিএর চরম দুর্ভাগ্য যে, ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ মাত্র তেপ্পান্ন বছর বয়সে এ কিংবদন্তী মানুষটি আকস্মিকভাবে চিরবিদায় নেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদে মুক্তিযুদ্ধের আর এক প্রবাসী নেতৃত্ব, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে এভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন:

"সাধনার উচ্চতম স্তরে উপনীত এই দেশপ্রেমিক মানুষটির নিরহংকার ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে। দেশ থেকে দূরে সমস্ত জীবন কাটালেও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর এই ভালোবাসার কথা তারা কী করে জানবেন, উপলব্ধি করবেন, এক নির্মম বেদনা তাঁকে যেন অস্থির করে তুলেছিল। আজ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ধন্যবাদের অপেক্ষা করেননি, বিদায় নেবার সুযোগ দেননি। তাঁর কথা লিখতে যেয়ে চোখ দুটি আমার আজ যেমন সজল হয়ে উঠছে, তাঁর অম্লান স্মৃতি যতদিন বেঁচে থাকবে আমাকে এমনি করেই নাড়া দেবে।"