তনুর মৃত্যু ও রাষ্ট্র-পুরুষ নির্মাণের রাজনীতি

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 4 April 2016, 08:27 AM
Updated : 4 April 2016, 08:27 AM

তনু শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি কবরে। আবারও তার লাশ তোলা হয়েছে কবর থেকে—- ময়না তদন্তের জন্য। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ করেছেন পুনরায় ময়না তদন্তের। তাহলে আগের তদন্তের রিপোর্ট কী হল? ভুল ছিল? চাপের ফলে সত্যরহিত রিপোর্ট ছিল? তদন্তকারী চিকিৎসক কি তাঁর নৈতিকতা হারিয়েছেন? কার চাপে? কিংবা কাকে বাঁচানোর জন্য?

তনুর মৃত্যুতে গল্প গুঞ্জরিত হচ্ছে। কেন? তনু কি বেঁচে আছে? না, বেঁচে নেই। তনু আমাদের মাঝে নেই। চেনা অচেনা কারও মাঝে নেই। তনু ব্যানারে উঠে এসেছে, ফেস্টুনে জায়গা পেয়েছে। পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তাকে নিয়ে বলাবলি হচ্ছে। তনুর বন্ধুরা, বাংলাদেশের বিচারপ্রার্থী নাগরিকরা তনুর নাম উচ্চারণ করছে ক্রোধে, চিৎকারে, বেদনায়, অশ্রুজলে।

মেয়েটি অত বিখ্যাত হতে চায়নি। বাঁচতে চেয়েছিল। সংগ্রাম করছিল। টিউশনি করে ছাত্র পড়িয়ে উপার্জন করে স্বাবলম্বী ছিল। তনু পড়ছিল ইতিহাস নিয়ে। শিল্প-সাহিত্য করত সে। করত নাটকের দল। পারিবারিক কিংবা ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে তনু হিজাব পরত। একজন মানুষের সম্পুর্ণতার আর কী বাকি থাকে?

তনু কি জানত তবু কিছু 'মানুষের'(?) কাছে সে সম্পূর্ণ নয়। মানুষ, না কি 'পুরুষ'? না কি 'জন্তু'? চরম অকর্মণ্য, অশিক্ষিত হয়েও যে বিশেষ শারীরিক গঠনের জন্য নিজেকে ক্ষমতার দুর্গ মনে করে? পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য করার চেষ্টা করে তাদের প্রকৃতিদত্ত বিশেষ গঠন দুর্বল ও ক্ষমতাহীন আখ্যা দিয়ে। এ এক অদ্ভুত অলিখিত সংহিতা পাঠ চলছে হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবীতে, যার নাম 'পুরুষতান্ত্রিকতা'। অশিক্ষিত বর্ণজ্ঞানহীন পুরুষেরাও যেন এই উদ্ভট কালো বইয়ের পণ্ডিত। এই পুরুষতান্ত্রিকতার জোরে শ্রমজীবী বর্ণজ্ঞানহীন রিক্সাচালকও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রিক্সায় বসার আদেশ জানায়। কী উদ্ভট!

এই আজব সমাজ কিংবা পৃথিবীর পুরুষদের কালো হাত তনুর জীবন ও সম্ভ্রম হরণ করেছে, কেড়ে নিয়েছে তার সংগ্রাম। পুরুষতান্ত্রিকতার সমর্থক প্রত্যেক পুরুষই এ জন্য অপরাধী, শুধু নির্দিষ্ট কিছু হত্যাকারী সম্ভ্রম-লুটেরা নয়। পুরুষতান্ত্রিকতার নিত্য প্রচারকরা নারীকে একটি অপরাধী সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে। নারীর পোশাক পরা হয়নি, নারী রাতের বেলা ঘর থেকে বের হল কেন, নারীর রিক্সার হুড ফেলা কেন; ওড়না গলায় পেঁচানো কেন; টি শার্ট-জিনস পরেছে কেন; সিগারেট খেল কেন; মদ খেল কেন; শাহবাগে কেন! এক দীর্ঘ নিয়ন্ত্রণের তালিকা নিয়ে বসে আছে শিক্ষিত অধ্যাপক, সচিব, জেলারেল থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রমজীবী পুরুষ পর্যন্ত।

এদেশের রাষ্ট্র পুরুষ, সচিবালয় পুরুষ, বিশ্ববিদ্যালয় পুরুষ, ক্যান্টনমেন্ট পুরুষ। রাষ্ট্র নিজে এবং তার ছোট সত্তাগুলো পুরুষ। কিছু নারী সেখানে কর্মরত থাকলেও ক্ষমতাকাঠামো তাকে পুরুষতান্ত্রিকতার পুরুষ করে তোলে। সেই নারীরাও পুরুষতান্ত্রিকতার জয়গান গাইতে থাকেন। আক্রান্ত নারীকে দুষতে থাকেন। এ এক গভীর ব্যাধি।

এই গভীর ব্যাধি আরও গভীরতর করে তুলেছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। সন্দেহ নেই যে, এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য নারীকে দাবিয়ে রাখা। নারীকে নিচে রেখে 'ব্যক্তি-পুরুষদের' (male as man) 'রাষ্ট্র-পুরুষ'( state as man) নির্মাণের রাজনীতি, এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। প্রত্যেক পুরুষতান্ত্রিক পুরুষই মূলত ওই মৌলবাদী রাজনীতির সমর্থক, তিনি আপাত অন্য রাজনীতির লোক হলেও। এই রাষ্ট্র-পুরুষ নির্মাণের কল্পনাধারীরাই তনুকে হত্যা করেছে।

তনুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ক্যান্টনমেন্টের নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে। তাই নিরাপত্তা সম্পর্কে আস্থাশীল প্রত্যেক নাগরিকই চমকে উঠেছেন। কীভাবে এটা সম্ভব! ভুলে গেলে চলবে না যে, ক্যান্টনমেন্ট, পুলিশ কিংবা প্রশাসন আমাদের 'রাষ্ট্র-পুরুষ'এর প্রদর্শনযোগ্য মাংসপেশী, যার মাধ্যমে তার পৌরুষ জারি থাকে। আর ব্যক্তি-পুরুষ কিংবা পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো তার সামন্তীয় অহমের জায়গা থেকে নারীর এক ধরনের নিরাপত্তায় বিশ্বাস করে। সেটা নারীকে মানুষ ভেবে কিংবা নাগরিক ভেবে নয়, দুর্বল কিংবা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ভেবে।

ক্যান্টনমেন্টের নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে তনুর হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক সেই অহমে আঘাত লেগেছে। কারণ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে আমাদের রাষ্ট্র-পুরুষের সবচেয়ে নিরাপদ বাহুর নিচে। আর তাই রাষ্ট্র তার আহত অহম চাপা দেওয়ার জন্য তনুর মৃত্যু কেন্দ্র করে 'রশোমন' কাহিনি ফাঁদার চেষ্টা করছে।

অনেকেই মনে করছেন নিরাপত্তা দিতে না পারায় আহত অহমবশত সামরিক বাহিনী এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছে না। আসলে বিষয়টি তা নয়। অহম আহত হয়েছে রাষ্ট্রের। আর আহত অহম চাপা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নেমেছে গোটা রাষ্ট্র। সেখানে সামরিক বাহিনী আলাদা বিষয় নয়।

পুরুষতান্ত্রিকতা আক্রান্ত এই রাষ্ট্রের পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসন, সামরিক বাহিনী যারা রাষ্ট্র-মন্দিরের পূজারী, তারা সবাই মন্দিরের খসে পড়া ইটের দাগ মুছে দেওয়ার চেষ্টারত। এই সমস্ত স্থাপনার শীর্ষ ব্যক্তিরা ঘরে ফিরে নিজের সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হবেন, চেনা মেয়ে তনুর কথা ভেবে বিষণ্ণ হবেন কিংবা অশ্রু বিসর্জন করবেন। কিন্তু মূল ভূমিকার জায়গায় রাষ্ট্রের হয়েই কাজ করবেন।

আকিরা কুরোশাওয়ার 'রশোমন' চলচ্চিত্রটি যারা দেখেছেন তারা জানেন একটি হত্যাকাণ্ড কতভাবে বিভিন্ন জন বিভিন্ন বয়ানে হাজির করেন। শেষ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির আত্মাও একটি বয়ান দেয়। কিন্তু কোন বয়ানটি সঠিক সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাষ্ট্রের একটি স্থায়ী বয়ান আছে এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত-কাঁপানো এই তনু হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্র যে একটি স্থির বয়ানে যাবে না বরঞ্চ বহু বয়ানের একটি 'রশোমন' কাহিনির অবতারণা করবে এটা আঁচ করেই আজ মানুষ মাঠে নেমেছে বিচারের দাবিতে।

বিচারহীনভাবে বিচারের নাম করে যতবার তনুর লাশ কবর থেকে তোলা হবে ততবার বাংলাদেশেরই পোস্টমর্টেম হবে। আমাদের সবচেয়ে গভীর ক্ষতগুলো শরীরে বহন করেই তনু মারা গেছে।

সব কিছুর পরও সুবিচারের উপর আস্থা রাখতে চাই। তনুর হত্যাকাণ্ডের সুবিচার হোক। তনুর মৃত্যুতে যেন কোনো নারী সাহসহীন না হয়ে পড়েন।