অপ্রাসঙ্গিক বিএনপি প্রাসঙ্গিক আওয়ামীবিরোধী ভোট: পর্ব – ২

বিজন সরকার
Published : 23 March 2016, 12:26 PM
Updated : 23 March 2016, 12:26 PM

প্রায়ই একটি পরিসংখ্যানের কথা শোনা যায়। বিশেষ করে দেশের রাজনীতিতে কর্মতৎপর দলগুলির দ্বারা সাধারণ জনগণকে প্রতিনিধিত্বশীলতার প্রশ্নটি যখন সামনে আসে। পরিসংখ্যানটি হল, দেশের মোট ভোটের চৌত্রিশ শতাংশ বিএনপি এবং চার থেকে সাড়ে চার শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে জামায়াতে ইসলামী। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের প্রদত্ত ভোটের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে একটি উপসংহার টানা যায়। সেটি হল, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মোট আটত্রিশ কিংবা সাড়ে আটত্রিশ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগ ও তার সমআদর্শিক দলগুলির মোট ভোটের বিপরীতে কয়েক দশক ধরে দেশের ভোটের রাজনীতিতে একক শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

জাতীয় নির্বাচন এবং বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কথিত উদার রাজনৈতিক দলগুলি প্রায় চল্লিশ থেকে চুয়াল্লিশ শতাংশ ভোটের প্রতিনিধিত্ব করে। বাকি প্রায় বিশ শতাংশ ভোট হল দেশের ক্ষমতা নির্ধারণকারী সুইং ভোট। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে এই সুইং ভোট ব্যাংক কার্যত ক্ষমতায় থাকা দলের বিপক্ষে গিয়েছিল। এই শ্রেণির অধিকাংশ ভোটারের মধ্যে অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি প্রবণতা প্রবলভাবে কাজ করে। এই ভোট ব্যাংক বরাবরই ইস্যু-ভিত্তিক ভোট প্রদান করে থাকে।

এখানেই একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে। প্রশ্নটি হল, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পাওয়া সত্বেও প্রদত্ত মোট ভোটের আটাশ থেকে সাড়ে আটাশ শতাংশ তাদের বিরুদ্ধে পড়েছিল। এই বিবেচনায় যদি বর্তমানে আওয়ামীবিরোধী আটত্রিশ থেকে সাড়ে আটত্রিশ শতাংশ ভোট ব্যাংক থেকে সত্তরের নির্বাচনের আওয়ামীবিরোধী আটাশ থেকে সাড়ে আটাশ শতাংশ ভোট বাদ দেওয়া হয়, বাকি থাকে দশ থেকে সাড়ে দশ শতাংশ। এই দশ থেকে সাড়ে দশ শতাংশ মূলত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে হয়েছে।

১৯৯১ সাল এবং তার পরের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে ভোটের অংশীদারিত্বের চিত্রটি বিশ্লেষণ করলে উপরে উল্লিখিত আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্বশীল ভোট এবং আওয়ামীবিরোধী প্রতিনিধিত্বশীল ভোটের চরিত্র ভালোভাবেই বুঝা যায়।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর ভোট ব্যাংকটির চিত্র খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য মাত্রায় বর্ধিষ্ণু। তাদের রয়েছে মোট ভোট ব্যাংকের চার থেকে সাড়ে চার শতাংশ। তাদের ভোটারদের বড় একটি অংশ কার্যত দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। এসব কারণেই তাদের ভোট বৃদ্ধির হার এবং ভোটারদের মধ্যে আদর্শিক সংহতি অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির তুলনায় বেশি টেকসই।

প্রসঙ্গত, গত থানা পরিষদ নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের অবস্থান কী তার কিছু চিত্র স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়েছিল।

যাহোক, বিএনপি যে এককভাবে চৌত্রিশ থেকে সাড়ে চৌত্রিশ শতাংশ ভোটের প্রতিনিধিত্ব করে, তার মূলে রয়েছে তিনটি মৌলিক উৎস: আওয়ামী-বিরোধিতা, ভারত-বিরোধিতা ও সংখ্যালঘুদের প্রতি দলটির বিরাগভাজন-পূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান। এই তিনটি ইস্যু থেকে আহরিত ভোট বাদ দিলে দলটির নিজস্ব আদর্শের আনুকূল্যে তেমন কোনো ভোট ব্যাংক নেই। সরাসরি বললে, দলটির কথিত জাতীয়তাবাদী চেতনা নামক পণ্যটির ক্রেতার সংখ্যা কম।

বুদ্ধিহীন আচরণ এবং কর্মকাণ্ডের ফলে দলটি আজ বিপন্ন হওয়ার পথে। তারা না পারছে রাস্তায় আন্দোলন করতে, না পারছে জনগণের কাছে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় কৌশলী অবস্থান পরিষ্কার করতে। ওরা মেধা-ভিত্তিক রাজনীতির দ্বার উন্মোচন করছে না। পারছে না ক্ষতিকর অন্ধ মোহ বাদ দিতে। বহু-আদর্শিক গোত্রের প্রতিনিধিত্বের ঈমান রক্ষা করা বা উগ্রবাদী রাজনীতির নেপথ্যের খেলোয়াড় হিসেবে পাওয়া তকমা ঝেড়ে ফেলে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করাও সম্ভব হচ্ছে না দলটির পক্ষে।

বিএনপির পক্ষে প্রাসঙ্গিক পরিবর্তন সার্বিক মূল্যায়নে কার্যত সম্ভব নয়। এটা এ জন্য বলছি যে, পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক কৌশলী উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় আবশ্যক, সেটি বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক চর্চা দিয়ে একেবারেই অসম্ভব। দলটি যে ফলপ্রসূ পরিবর্তনে তেমন আগ্রহী নয় তা সদ্য-অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের এখন ভাগ্য ও আওয়ামী লীগের ঋণাত্মক কর্মকাণ্ডের উপর শতভাগ নির্ভর করতে হচ্ছে।

এ অবস্থায় দল হিসেবে বিএনপি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেও আওয়ামীবিরোধী ভোটের অংশটি বাংলাদেশের আগামী দুই থেকে তিন দশকের রাজনীতির মেরুকরণে বড় ভূমিকা রাখবে। এই ভোট ব্যাংকটি কোনো দিনও আওয়ামী লীগের দিকে মুখ ফেরাবে না। অনেকেই হয়তো এখানে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন এই যুক্তিতে যে, বর্তমানে জামায়াত ও বিএনপির শত শত নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে। ফলে ব্যাখ্যাটি তেমন নির্মোহ নয়। কিন্তু কেন মুখ ফিরাবে না তার ব্যাখ্যা কিছু পরেই দিচ্ছি।

প্রশ্ন হল, বিএনপিকে যদি আরও কয়েকটি টার্ম ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়, তাহলে দলটির প্রতিনিধিত্বশীল ভোট ব্যাংকটির কী হবে? নিজেদের আদর্শিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি নামক প্ল্যাটফর্মের জন্য তারা কি দশকের পর দশক অপেক্ষা করবে? নাকি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রতি সমর্থন দিবে?

চারটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে এই ভোট ব্যাংক ধাবিত হবে।

বিএনপির ক্রমাগত ভুলের ফলে জাতীয় পার্টির মতো একটি ছোট দলে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও প্রথম অংশ বিএনপিতেই থেকে যাবে। তারা যদি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো আগামী জাতীয় নির্বাচনের বাইরে থাকে তাহলে দলটিকে সত্যিকার অর্থেই জাতীয় পার্টির মতো ছোট দলে পরিণত হতে হবে। কারণ, তাদের আদর্শিক নিউক্লিয়াসটির তেমন শক্তি নেই। ইচ্ছা করলেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়া দলটির সেই আদর্শিক নিউক্লিয়াস সাধারণ নেতা-কর্মীদেরকে বছরের পর বছর এককেন্দ্রমুখী রাখতে পারবে না।

শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে যাবে না, এই অবস্থান দলটিকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ফেলেছে। অদূর ভবিষ্যতে তা যে আরও জেঁকে বসবে, তা সহজেই অনুমেয়। বিএনপি যদি মনে করে, দেশের ভিতরকার রাজনৈতিক ইসলামিক শক্তিগুলি ৫ জানুয়ারির আগের প্রেক্ষাপটের মতো সরকারের বিপক্ষে অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে– যা দিন শেষে বিএনপির কোষাগারেই এতদিন জমা হত– এমন চিন্তা হবে দলটির জন্য আরেকটি বড় ধরনের ভুল রাজনৈতিক মূল্যায়ন।

রাজনৈতিক ইসলামিক শক্তিগুলিকে বেশ কৌশলে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এই সরিয়ে নেওয়া তথা ইসলামিক শক্তিগুলির সঙ্গে রফা করার সহজাত প্রবণতা একটি উদীয়মান গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিটি অংশীদারি শ্রেণির সহ-অস্তিত্বের জন্য কতটুকু সহায়ক, সেখানেও একটি ধরনের আদর্শিক প্রশ্ন রয়েছে। এই বিশ্লেষণে এই প্যারামিটার নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়।

আমাদেরকে বুঝতে হবে কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ পরিচালনার কথা বলতে হচ্ছে; কেন এক সময়ের তুখোড় বাম-নেতা ও মানবিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক শিক্ষার কথা বলতে হচ্ছে; কেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সিস্টেমেটিক নির্যাতন সত্বেও অসাম্প্রদায়িক দাবিদার সরকার না দেখার ভান করছে; কেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের চিত্র এবং দেশত্যাগ নিয়ে আলোচনা দেশের সুধী সমাজে এবং জাতীয় রাজনীতিতে করা হচ্ছে না?

এসবের মূলে রয়েছে ক্ষমতার জন্য রাজনৈতিক ইসলামের সংবেদনশীলতার প্রতি ভয়ংকর ধরনের আপোসকামিতা। প্রসঙ্গত, এ ধরনের অপ্রকাশ্য আপোসকামিতা যে বহুমতের জনগোষ্ঠীকে আলো থেকে আঁধারে নিয়ে যায়, তা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের দিকে তাকালে না বুঝার কথা নয়।

যাহোক, রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে আপোসকামিতার মূলে রয়েছে আগামী সাধারণ নির্বাচন। একজন সাধারণ মানুষও বুঝে যে, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জাতীয় নির্বাচনে উন্নয়ন তেমন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। প্রধান ইস্যু ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। বলা যায়, দেশপ্রেমের চেয়ে রাজনীতিতে এখন ধর্ম-প্রেম বড় হয়ে উঠেছে। যে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী জোটের বিপক্ষে ঋণাত্মক সংবেদনশীলতা দেখিয়েছিল, সেই গোষ্ঠী আগামী জাতীয় নির্বাচনে ধনাত্মক সংবেদনশীলতা দেখাবে তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

বিএনপির আরেকটি ক্ষুদ্র অংশ আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যাবে অংশটি নানা কারণে আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। তারা কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার জন্য তা করেনি। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরাট এই অংশ ঐতিহাসিক মূল্যায়নে সুবিধাবাদী। ফলে দলটির যে সকল নেতা-কর্মী নানান প্রতিকূল অবস্থার কারণে কথিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ছেড়ে ক্রমশ অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে বিচ্যুতির রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন, তারা কেবল ব্যক্তি-স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আওয়ামী লীগে যাচ্ছে।

তৃতীয় অংশটি জামায়াতের রাজনীতির ছায়াতলে আদর্শিক শান্তি খোঁজার চেষ্টা করবে। এই অংশ মূলত বিএনপির ভিতরে জামায়াতের অপ্রকাশ্য প্রতিনিধি হিসেবে সক্রিয়। অনুমানযোগ্য, অংশটি বিএনপির মোট সমর্থকের প্রায় বিশ শতাংশের মতো। জামায়াত দ্বারা প্রভাবিত এ অংশ বিএনপির কোষগহ্বরে মূলত উগ্রবাদী চেতনা সন্নিবেশ করে থাকে।

জামায়াত এবং দলটির অঙ্গ সংগঠন থেকে যে সকল নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যাচ্ছে, তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার জন্য যাচ্ছে না। তাদের উদ্দেশ্য, আওয়ামী লীগকে ভিতর থেকেই বিতর্কিত করে তোলা। হচ্ছেও তাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর সাপেক্ষে বেশ জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়।

আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পদে থাকা সত্ত্বেও যখন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়, রামু মন্দির ভাঙ্গার পক্ষে যুক্তিতর্কে লিপ্ত হয় কেউ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চালানো এবং নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়, কট্টর ধর্মীয় আচরণ বাধ্যতামূলক করার তাগিদ দিয়ে অন্যদের আহ্বান করা হয়, তখন এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যারা আওয়ামী লীগের আদর্শিক চেতনার শ্লোগান দিয়ে দলে প্রবেশ করছে তাদের চেতনা একাত্তরের চেতনা থেকে একশ আশি ডিগ্রি উল্টো।

কয়েক বছর আগেও জামায়াত কিংবা শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হবার তথ্য সামাজিকতার ভয়ে কেউ প্রকাশ করত না। এখন দেশের মানুষের মনোভূমিতে ধর্মান্ধতার অবাধ চাষাবাদ চলছে। আগে যারা উদার, অসাম্প্রদায়িক, মুক্তচিন্তক বলে সমাজে চিহ্নিত ছিল, বরং তারাই আজকাল নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করতে এক ধরনের ভয়ে থাকে। আর এভাবেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারটি ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। বাংলাদেশের বহুত্ববাদের পথচলাটি লাইনচ্যুত করার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ মৌলবাদের সঙ্গে আপোস করে প্রগতিশীলতা চলতে পারে না, কোথাও এর পক্ষে নজির নেই।

বিএনপি থেকে বেরিয়ে যাওয়া চতুর্থ অংশটি দেশের ভিতর নব্য ভারত-বিরোধী জাতীয়তাবাদ এবং আরব-জাতীয়তাবাদের উছিলায় দেশের রাজনীতির মূল্যবোধের খুব দ্রুত পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। এই অংশ রাজনৈতিক ইসলামি জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধি হয়ে সরাসরি রাজনীতিতে কিংবা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনবে। ধারণাযোগ্য যে, এটি তুলনামূলক বিচারে বাকি তিনটি অংশের চেয়ে বড়।

প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, যদি রাজনীতির মিরাকলে বিএনপি আগামী এক দশকের মধ্যে দেশের ক্ষমতায় এসে পড়ে, সম্ভাব্য এই চারটি অংশের ভোটারের অধিকাংশ সমর্থন তারাই পাবে। তবে ক্ষমতা থেকে তারা যত দূরে থাকবে, তাদের প্রতি এই অংশগুলির আগ্রহের বিচ্যুতি ততই বেড়ে যাবে।

আওয়ামীবিরোধী এই ভোট ব্যাংক কি কেবল ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভাজিত হওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে? যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পথ উন্মুখ হবে।

বিষয়টি সে রকম নয়। তবে সকল প্যারামিটারে আগামী কয়েক টার্ম আওয়ামী লীগের দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনাই প্রবল।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সময়টিতে হয়তো দেশের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে যাবে। জাতীয় রপ্তানি বাড়বে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাবে, ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়বে, টাইগারদের ক্রিকেট বিশ্বে মাথা উঁচু করে রাখাটা টেকসই হবে। তবে কটু রাজনীতি, আরব জাতীয়তাবাদ এবং ভারতবিরোধী নব্য জাতীয়তাবাদের ধাক্কা একমাত্র প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কতটুকু করতে পারবে সে বিষয়ে প্রবল সন্দেহ রয়েছে।

উগ্র ইসলামি শক্তিগুলির সঙ্গে আপোসহীনতা দেখিয়ে; দলের অভ্যন্তরীন কাঠামোতে, বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে আদর্শ-পরিপন্থী অনুপ্রবেশকারীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করে এবং সমাজে দুর্নীতির মাত্রা কমিয়ে একটি বহুত্বাবদে বিশ্বাসী সমাজ বিনির্মাণ যে ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে সে বিষয়ে কারও ভিন্নমত থাকার কথা নয়।

আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা অবশ্যই বুঝেন যে, বিএনপি বিপন্ন হওয়া মানেই আওয়ামী লীগের সামনে আরেকটি ভয়ঙ্কর শক্তির উত্থান হওয়া। বিএনপি যদি আর কোনো দিন ট্র্যাকে ফিরতে না পারে এর কুফল জাতিকে অবশ্যই দিতে হবে। প্রাকৃতিক নিয়মে সেই শূন্যস্থান পূরণ হবে।

উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ পুঁজি করে ইরানের মতো একটি বড় ধরনের ইসলামি শক্তির উত্থান যদি দেশে ঘটে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। তখন আওয়ামী লীগও রেহাই পাবে না। আয়াতুল্লাহ খামেনিরা ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষককে হত্যা করলেও দ্বিতীয় স্তরে ছিল প্রগতিশীল রাজনীতিবিদেরা। ইরানের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৃদ্ধ আলী দাস্তিকে খামেনিরা অমানবিকভাবে প্রহার করে শহরের বাইরে একটি নির্জন ঘরে বন্দি করে রেখেছিল। তারপর দাস্তির আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায়। যে দিকে তাকাই, সবাই এ দলের আদর্শের সৈনিক। আজকাল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের অভাব নেই। চেতনা-লীগ, শিশু-লীগ, ওলামা-লিগ (একে জামায়াতে ইসলামীর এক্সটেনশান মনে হয়) থেকে শুরু করে আওয়ামী বিশুদ্ধিকরণ লীগ পর্যন্ত। এই সব নব্য লীগেরা যে আওয়ামী লীগের আদর্শের রাজনীতি করে না, দলটি কি তা পঁচাত্তর থেকে শিখেনি?

তাদের মনে রাখা উচিত, টাইটানিক যখন ডুবে যায়, তখন ওটির ধারেকাছে তিনটি জাহাজ ছিল। টাইটানিকের যাত্রীদের রক্ষা করার জন্য একটিকেও পাওয়া যায়নি। বাস্তবতা হল, টাইটানিক ডুবেছিল। সবচেয়ে বিয়োগান্তক বিষয় হল, টাইটানিক একা ডুবেনি।

বহু আদর্শের, বহু বিশ্বাসের, বহু বর্ণের হাজার হাজার মানুষ নিয়ে টাইটানিক ডুবেছিল।