নির্বাচনী ব্যত্যয় ও নির্বাচন কমিশন

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 20 June 2016, 09:38 AM
Updated : 20 June 2016, 09:38 AM

substantive democracyএর সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় এর প্রধানতম শর্ত হচ্ছে নির্বাচন 'গ্রহণযোগ্য' হওয়া। কিন্তু নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা যতটা না নির্ভর করে তার 'অবাধ-নিরপেক্ষ' হওয়ার ওপর, 'শান্তিপূর্ণ' হওয়া না-হওয়ার ওপর নির্ভর করে না ততটা। পুস্তকি গণতন্ত্রকে বাস্তবে অর্থপূর্ণ করতে হলে ব্যাপক জনগণের মতামত ও সম্মতি একটি পূর্বশর্ত। কিন্তু তা সম্ভব হতে পারে কেবল নির্বাচন যখন অবাধ-নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তখনই।

তবে এই অঞ্চলের গণতান্ত্রিক আবহে থেকে আমাদের এ-ও মনে রাখা উচিত যে, নির্বাচন 'শান্তিপূর্ণ' হওয়া এবং 'অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য' হওয়া এক কথা নয়। 'অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য' হতে হলে নির্বাচন 'শান্তিপূর্ণ' হওয়াটা শর্ত বটে। কিন্তু নির্বাচন 'শান্তিপূর্ণ' হলেই যে 'অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য' হবে তেমনটি সব সময় সত্য নয়। এই সব নানামুখী শর্তের সংকটে পড়েছে স্থানীয় পর্যায়ে গণপ্রতিনিধি নির্বাচনের সবচেয়ে বড় আয়োজন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন।

এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক কিছুই প্রথমবারের মতো হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক পরিচয় ও মনোনয়নে অনুষ্ঠিত হয়। তবে এটি গৌণ করে যা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে হাজির হতে যাচ্ছে তা হল, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপুলসংখ্যক ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা। স্থানীয় সরকারের এ স্তরে এ ধরনের নজির দেখা যায়নি আগে কখনও। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের এমন ঢেউ বা ধারা কি তবে দেশের সব পর্যায়ের নির্বাচনী ব্যবস্থায় বৈশিষ্ট্য হতে যাচ্ছে কিনা এই প্রশ্ন এখন আলোচনার বিষয়।

এটা সত্য যে, প্রত্যেক কেন্দ্রে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেনি এবং প্রতিটি কেন্দ্র দখলের ও নির্বিচারে সিল মারার ভিডিওচিত্র ধারণ করা যায়নি। মনোনয়নপত্র জমা না দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা, কিংবা প্রত্যাহারের জন্য বাধ্য করার কোনো সচিত্র প্রমাণ উপস্থাপিত হয়নি। মনোনয়ন বাণিজ্যের চাক্ষুষ প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেনি। এর বিপরীতে যেহেতু ভোটদানে ব্যর্থ সব মানুষ নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানানোর মতো ঘটনা ঘটেনি, যেহেতু গণবিচ্ছিন্ন আচমকা গণপ্রতিনিধি বনে যাওয়া ব্যক্তিবর্গকে প্রতিহত করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শত শত প্রার্থীর জয়ী দেখাতে কমিশন সক্ষম হয়েছে, সেহেতু ইসি দাবি করতেই পারে যে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।

যেহেতু হুমকি-ধামকি, মামলা-হামলা দিয়ে গণবিরোধী শক্তিকে অতি সহজেই নির্বাচনী ময়দান থেকে দূরে রাখা গেছে, সেহেতু নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে সরকারের একান্ত আস্থাভাজন হতে সক্ষম হয়েছে এমন দাবি তারা করতেই পারেন। ইউপি নির্বাচনের শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ দেশবাসীকে জানিয়েছেন, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।

এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূল পর্যায়েও মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে প্রথমবারের মতো। এর আগে মনোনয়ন বাণিজ্যের কুপ্রভাব শুধু সংসদ নির্বাচনেই লক্ষ্য করেছি আমরা। বেশ উঁচু স্তরে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্য হয় এবং হয়েছে বলে গুজব রয়েছে। নীতিবিবর্জিত মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণেই আমাদের সংসদ এখন রাজনীতিবিদ নয় বরং ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। এর মাধ্যমে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাত থেকে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে, যাতে বিরাজনীতিকরণও ঘটেছে।

পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, বিষয়টি এখন তৃণমূল পর্যায়ের ইউপি নির্বাচনেও বিস্তৃত হয়েছে।দলের মনোনয়নে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণেই মূলত এমনটি হয়েছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বাণিজ্যের কারণে একদিকে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন কলুষিত হয়েছে, অন্যদিকে তৃণমূলের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানও পায়নি সৎ ও ত্যাগী জনপ্রতিনিধি।

সরকারি দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা মার্কা পেলেই বিজয় নিশ্চিত। এই নিশ্চিত বিজয় অর্জনের জন্য যত টাকাই লাগুক, খরচ করতে রাজি প্রাথীরা এবং করেছেনও। এটাই ছিল এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মনোভাব। আর প্রাণহানি, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ, বহিষ্কার পাল্টা বহিষ্কারের মতো ঘটনা ঘটেছে যে কোনো মূল্যে জয়ী হতে হবে এই ভাবনা থেকেই।

মনোনয়ন নিয়ে তিন স্তরে বাণিজ্য হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে খুশি করেন। কারণ, তৃণমূলের ছজনের সই করা প্রার্থী তালিকা কেন্দ্রে পাঠানোর নিয়ম। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এই স্তরে এলাকা ও ব্যক্তিভেদে ৬ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়েছে। এর পরের স্তরে স্থানীয় সাংসদ ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের খুশি করতে হয়েছে। শুধু চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের বেলায় নয়, মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে সদস্য পদেও। দল মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্যানেলে থাকতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা গুনতে হয়েছে সদস্য প্রার্থীদের।

আওয়ামী লীগের ইউপি নির্বাচন তদারক করেছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একদল কেন্দ্রীয় নেতা। তৃতীয় পর্বের ভোটের পর ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেন, মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ এসেছে। 'ভোট আপনার অধিকার, আপনার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিন' এমন বার্তা দিয়ে টেক্সট মেসেজ পাঠানো হয়েছে ভোটারদের। বাস্তবে এই শর্ত সম্পূর্ণ উপেক্ষা ও নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।

নির্বাচন প্রক্রিয়াটি প্রশাসনিক কারসাজি অথবা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে মুক্ত রাখা, টাকা দিয়ে ভোট কেনা-বেচা, ভীতি ও সাম্প্রদায়িক ভীতি সৃষ্টি না করার মতো লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড বা সকলের জন্য সুযোগ নিশ্চিত করার কথাটি কেবল দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল তথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য নয়, বরং তা ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের জন্য। আদর্শ ব্যবস্থা হচ্ছে নির্বাচন অবাধ-নিরপেক্ষ করতে হলে সমতল খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে দেশের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য।

আমরা জানি নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটার এ দুটি প্রধান চরিত্র। আইনত প্রার্থী হওয়া ও পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারা দু ক্ষেত্রেই সকলের জন্য সুযোগ সমান ও অবারিত থাকতে হবে। প্রত্যেকের জন্য নিশ্চিত করতে হবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ও ভোট প্রদানের সমান সুযোগের নিশ্চয়তা। এবারের নির্বাচনে সে নিশ্চয়তা ছিল না তা বলা অত্যুক্তি হবে না মোটেই।

নির্বাচন কমিশন 'আচরণ বিধি'সহ বহু বিধি-বিধান প্রবর্তন করেছে নির্বাচন প্রক্রিয়া শৃঙ্খলাপূর্ণ রাখার জন্য। একটি সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে কমিশনের অধিকার আছে এসব বিধি-বিধান অনুসরণে সকলকে বাধ্য করার জন্য স্বাধীনভাবে নির্দেশনা প্রদানের। নির্বাচনকালীন সময়ে আইনত রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও কমিশনের নির্দেশনা মেনে চলতে বাধ্য। সরকারও সে ক্ষেত্রে বাধা দিতে পারে না। এ কথা ঠিক যে, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু যেটুকু ক্ষমতা তার হাতে বর্তমানে আছে তার পূর্ণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কমিশনের তেমন দৃঢ় উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যায় না।

কমিশনার আবু হাফিজ নির্বাচন চলাকালীন গণমাধ্যমে বলেছেন, পুলিশের কর্মকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব ইসি নেবে না। পরবর্তীকালে আবার বলেছেন, ভোট কেন্দ্রের বাইরে খুনের দায়ও ইসি নেবে না, সে দায় প্রার্থীদের। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, পুলিশের নির্বাচনী দায়িত্ব কি ইসির এখতিয়ারাধীন নয়? যদি তা হয় তাহলে দায় এড়ানোর সুযোগ কোথায়? পুলিশকে জবাবদিহিতায় আনার দায়িত্ব কার?

যে নির্বাচন কমিশন প্রার্থী ও ভোটারের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, ভোটারের দেওয়া ভোটের ফলাফল রক্ষায় ব্যর্থ, নিজের এখতিয়ারাধীন ব্যক্তিদের কাজে লাগাতে ও জবাবদিহিতায় আনতে ব্যর্থ, সে প্রতিষ্ঠান থাকার প্রয়োজনীয়তা কী? স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা কোথায়?

এই ঘাটতি আছে বলেই বিরোধী পক্ষের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি হয়েছে। যথাযথ পরিবেশটি কায়েম করা বা সুরক্ষার দায়িত্ব অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের। তারা সে ক্ষেত্রে যোগ্যতা বা দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছে কি? উত্তর হল, পারেনি, নিশ্চিতভাবেই।

বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় গণমাধ্যম নির্বাচন কমিশনের অন্যতম সহযোগী শক্তি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত নির্বাচনী অনিয়মগুলো কমিশনের আমলে নেওয়া উচিত। নির্বাচন বিতর্কিত, মানসম্পন্ন না হওয়া এবং ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার যত সব কাজকর্ম আছে তার সবই প্রত্যক্ষ করেছি বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবরের মাধ্যমে। এসব অগ্রহণযোগ্য আইনবিরুদ্ধ কার্যকলাপ দেখেও কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় কমিশনের অসহায়ত্বই প্রকাশ করছে।

বর্তমান সরকার তার 'ভিশন-২০২১' বাস্তবায়নের জন্যে যে আট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তার অন্যতম প্রধান হল, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি। ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত হল, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। নিরপেক্ষ নির্বাচনের অন্যতম পূর্বশর্ত আবার প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্র প্রশস্ততর করণ। ইউপি নির্বাচনে রাজনীতিকে সম্পৃক্তকরণের নীতির মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ উৎসাহিত হবে। তবে শর্ত থাকে যে, সে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে হবে।

'গণভোট' শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হই ১৯৫৮ সালে তখনকার পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর। একটি কালো বাক্স ছিল প্রেসিডেন্ট পদ দখলকারী ব্যক্তির প্রতি আস্থার বিপরীত মত প্রকাশের জন্য। প্রতাপশালীদের কারণে ও ইচ্ছায় সেই কালো বাক্স গণভোটে জিততে পারে না।গণতন্ত্রহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কখনও জেতেনি কোথাও। এ ধরনের গণভোট আর নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হত যে কোনো প্রকারে জয়লাভের চিন্তা থেকে। স্থানীয় ও জাতীয় উভয় নির্বাচনে আমরা এমন হতে দেখেছি বারবার। যা জনগণকে ভোটবিমুখ করে তোলে।

নির্বাচন-বিমুখতা দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য যে কত ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া বয়ে আনতে পারে, তা বিশ্লেষণ করার দরকার পড়ে না। নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক উপলব্ধি থেকেই সম্ভবত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাত্রা বেড়েছে। সব রাজনৈতিক দলই এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এই নির্বাচনমুখী প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্যে অবশ্যই ইতিবাচক।

তবে এই ইতিবাচকতা এগিয়ে নিতে হবে নির্বাচনী পুরোহিত ইলেকশন কমিশনকেই।