মাথা সমুন্নত রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 8 March 2016, 07:35 PM
Updated : 8 March 2016, 07:35 PM

সকাল ৯টায় ২য় বর্ষের সঙ্গে ক্লাস ছিল। সাড়ে আটটায় ছাত্রছাত্রীদের জানালাম, ক্লাসটি আমি এখন নিতে পারব না। পরে তা নেব। নানা শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা নিয়ে কার্জন হল থেকে সুপ্রিম কোর্টের এজলাশে যখন হাজির হয়েছি, তখন ৯টা বাজার অল্প বাকি। সকাল ৯টা ৫ মিনিট। পূর্বনির্ধারিত সময়েই মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিচারকগন বিচার মঞ্চে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলেন। পিনপতন নীরবতা। একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ। কিন্তু আজ বিচার আসনে বসেছেন সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণ বেঞ্চ অর্থাৎ ৯ জন মাননীয় বিচারক। গত কয়েক দিনে মীর কাসেম আলীর আপিল রায় নিয়ে নানা শঙ্কা প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে ৫ মার্চ, ২০১৬ তারিখে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভায় আপিল রায় নিয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতির উপর আস্থা রাখতে পারছেন না বলে মন্ত্রিসভার দুজন পূর্ণ মন্ত্রীর বক্তব্য প্রায় সকল টিভি চ্যানেল প্রচার করে। গভীর শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয় জনমনে। ডালপালা বিস্তৃত নানা গুজবের জন্মও দেয় তা। কী হতে যাচ্ছে দেশে?

এই প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টের আদালতে উপস্থিত সবার মনে প্রশ্ন, কী রায় দিতে যাচ্ছেন পূর্নাঙ্গ আপিল বিভাগ?

মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নির্দেশ করলেন তাঁর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে। বললেন, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ৫ মার্চে একটি আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতি ও সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে যে অশুভ ও অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছেন ও যা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে তাতে "সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকেরা স্তম্ভিত।"

ওই বক্তব্য বিচার প্রশাসনের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ ও সুপ্রিম কোর্টের সম্মান ও মর্যাদা হেয় করার শামিল বিবেচনা করে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে আগামী ১৪ মার্চের মধ্যে আদালত অবমাননা বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা এবং ১৫ মার্চ সকাল ৯টায় সুপ্রিম কোর্টের আদালতে সশরীরে হাজির হতে বললেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি। এরপর পূর্নাঙ্গ আপিল বিভাগ আদালত কক্ষ ত্যাগ করলেন।

বোঝা গেল শুরুতেই কেন আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ বেঞ্চের নয় জন বিচারপতি আদালতে হাজির হয়েছিলেন। সবার মনে এখন প্রশ্ন, মীর কাসেম আলীর আপিল রায় কী হবে? যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালত দেশের দুজন মন্ত্রিকে আদালত অবমাননার জন্য তলব করতে পারেন, সেখানে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক ও হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী বদর বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কি বহাল থাকবে না?

৭১এর জুলাই-আগস্ট মাসে বদর বাহিনী গঠনের পর চট্টগ্রামের হিন্দু মালিকানাধীন 'মহামায়া' ভবন দখল করেছিল মীর কাসেম আলী ও তার বাহিনী। নাম দিয়েছিল ডালিম হোটেল। মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে দেওয়া যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ ছিল, "এটাও প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আলবদরের সদস্যদের পরিচালনা এবং নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজেই। ডালিম হোটেল সত্যিকার অর্থেই একটি ডেথ ফ্যাক্টরি ছিল।"

রায়ে বলা হয়, "কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম, টুনটু সেন ও রঞ্জিত দাসকে হত্যাসহ এখানে (ডালিম হোটেলে) পরিচালিত সব ধরনের অপরাধেই তার (মীর কাসেম) প্রত্যক্ষ মদদ ও উৎসাহ ছিল।"

এই যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম জামায়াতের অর্থ জোগানদাতা রাবেতা আলম আল-ইসলামি নামের এনজিও্এর বাংলাদেশ সমন্বয়ক হয় ১৯৮০ সালে জেনারেল জিয়ার আমলে। এরশাদের আমলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ গঠিত হলে তার প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান হয় এই ব্যক্তি। জামায়াতের মজলিশে শুরার সদস্য হয় ১৯৮৫ সালে। ইবনে সিনা ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য ছিল সে। গ্রেপ্তারের পূর্ব পর্যন্ত ছিল দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। আদালতে আমার পাশে বসা চট্টগ্রামের এক ভদ্রলোক অনেক খেদ নিয়ে বলছিলেন, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক এই যুদ্ধাপরাধী কক্সবাজারের প্রায় অর্ধেক কিনে ফেলেছে। দেশে-বিদেশে টাকা দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে। আদালতে বসে তারপরও আমার মনে হয়েছে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের টাকার কাছে ন্যায়বিচার পরাজিত হবে না।

স্বল্প বিরতির পর মাননীয় বিচারকগণ প্রবেশ করলেন। ঠিকই মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানি যারা করেছিলেন সেই পাঁচ জনের আপিল বেঞ্চ এবার আসনে বসেছেন। বিপত্তি দেখা দিল শুরুতেই। সম্পূরক কার্যতালিকায় আপিল রায় নেই। মাননীয় প্রধান বিচারপতি উষ্মা করলেন। জানালেন এটা হতে পারে না। সবাই একমত হয়েই আপিল রায়ের দিন ধার্য করেছেন।

কাগজ, ফাইল নিয়ে কতক্ষণ ছুটোছুটি চলল। মীর কাসেম আলীর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আসামিপক্ষের অন্য আইনজীবীগণ আদালত কক্ষ ছেড়ে চলে গেলেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতির কণ্ঠে ও অবয়বে গভীর বিরক্তি, ক্ষোভ ও হতাশা। বললেন, এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে আদালতে আসতে বলুন।

এটর্নি জেনারেল এডভোকেট মাহবুবে আলম নিজেই বেরিয়ে গেলেন আসামিপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে আসতে। কয়েক মিনিটের বিরতির কথা জানিয়ে প্রধান বিচারপতি ও বিচারকগণ কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হলেন। কী হতে যাচ্ছে? আদালত কক্ষ আবার পূর্ণ হয়ে গেছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীগণও ফিরে এসেছেন। বিচারপতি সিনহা জানালেন, কম্পিউটারে সম্পূরক কার্যতালিকা ঠিকই ছিল। কিন্তু ছাপানো কাগজে তা ছিল না। চকিতে মনে পড়ল কাজের এমন অসঙ্গতি ও সমন্বয়হীনতার পূর্ব নজিরগুলোর কথা। এই মামলা থেকে একজন সরকারি প্রসিকিউটারকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা।

শেষ পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পালা শেষ হল। মাননীয় প্রধান বিচারপতি আপিল রায়ের সংক্ষিপ্ত রুপটি পাঠ করে শোনালেন। আপিল নাকচ করে ১১ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমউদ্দিন আহমেদসহ কয়েক জনকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের সর্বোচ্চ সাজার রায়ই বহাল রইল। একই সিদ্ধান্ত হয়েছে ২, ৩, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের সাজার ক্ষেত্রেও। আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে মীর কাসেমকে খালাস দিয়েছে আপিল আদালত, যেখানে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। ৪ ও ৬ নম্বর অভিযোগে সাত বছর করে সাজার রায় থেকেও এই জামায়াত নেতাকে খালাস দিয়েছে।

দুটো বিষয় মনে এল। আপিল রায় নিয়ে গত কয়েক দিনের শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার পর শীর্ষ জামায়াতি যুদ্ধাপরাধী ও বিশাল অর্থ সাম্রাজ্যের এখনও মালিক মীর কাসেম আলীর ফাঁসি বহাল থাকার এই রায় অশান্ত মনে গভীর প্রশান্তি এনে দিল। আনন্দ তো বটেই, কিন্তু মনে হল তার চেয়েও বেশি কিছু আমরা পেয়েছি। সর্বোচ্চ আদালত আবারও প্রমাণ করেছে, রাগ-অনুরাগ ও অর্থ-প্রতিপত্তির উর্ধ্বে থেকে ন্যায়বিচার প্রদানে তারা সক্ষম।

অন্যদিকে আদালত অবমাননার অভিযোগে দুই পূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীকে কারণ দর্শাতে আদালতে তলব করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তার সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখল। অতীতে সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরাচারের দুষ্ট ছোবলে দারুণভাবে ক্ষত-বিক্ষত ও বিবর্ণ বিচার বিভাগ যে বাংলাদেশে স্বাধীন সত্তা নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে, তার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও স্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া গেল দুই মন্ত্রীর প্রতি জারি করা রুল থেকে।

আরেকটি উচ্চতায় আসীন হল বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট।