সমতার বিশ্ব আর কতদূর

Published : 8 March 2016, 03:35 AM
Updated : 8 March 2016, 03:35 AM

এ বছর নারী দিবসের স্লোগান হল 'প্ল্যানেট ৫০:৫০ বাই ২০৩০; স্টেপ ইট আপ ফর জেন্ডার ইকুয়ালিটি'। তার মানে ২০৩০ সালের মধ্যে নারী পুরুষের সমতাভিত্তিক বিশ্ব গড়ে তোলা। মুখে বলা যত সহজ কাজটা তত নয় তা বলাই বাহুল্য। নারী পুরুষের মধ্যে সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনের কথা বলা হচ্ছে তো বহু যুগ ধরেই।

ম্যারি ওলস্টোনক্রাফটের ১৭৯২ সালে প্রকাশিত 'আ ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উওম্যান' বইটিকে বলা যায় নারীমুক্তির ইশতেহার। ফ্রেডেরিক অ্যাঙ্গেলস তাঁর 'দ্য অরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি'তে দেখিয়েছেন কীভাবে আদিম সাম্যবাদী সমাজে মায়ের ক্ষমতা সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খর্ব হয়েছে।

সমাজ বিবর্তনের ঠিক কোন বিশেষ স্তরে নারী তার ক্ষমতা হারাতে শুরু করে তা সময়ের হিসাবে হয়তো সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে সমাজে সম্পত্তির ধারণার যতই বিকাশ ঘটেছে ততই নারীর স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। নারীর স্বাধীনতা যতই খর্ব হয়েছে ততই তার উপর নির্যাতন ধীরে ধীরে বেড়েছে।

নারীর উপর এই নির্যাতন ও বৈষম্য ঘটেছে সমাজেরই সহায়তায়। দাসতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র এবং পিতৃতন্ত্র সমান্তরালভাবে পরষ্পরকে শক্তি প্রদান করেছে এবং নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা, স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার। নারীর যৌনতার উপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তার সমগ্র সামাজিক জীবনকে মুঠোর ভেতর পুরেছে পুরুষতন্ত্র। এমনকি নারীর স্বাধীন চিন্তা চেতনাও আবদ্ধ করা হয়েছে ঘেরাটোপে। তাকে গৃহবন্দি করে তার মননে ও চেতনে খুব শক্ত করে গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে, এখানেই তোমার স্বর্গ।

গৃহের ভিতর আবদ্ধ থেকে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিযুক্ত থেকে, পুরুষের সেবা করার মধ্যেই রয়েছে তোমার জীবন ধারণের সার্থকতা। নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষের তৃপ্তির জন্য-এমন নির্লজ্জ কথা প্রচারেও পুরুষতন্ত্রের বাঁধেনি।

শিল্প বিপ্লবের পর ধীরে ধীরে নারী বেরিয়ে আসতে শুরু করে সংসারের বেড়াজাল থেকে। তবে নারীর শ্রমের অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার অর্জনের পথ কখনও সহজ হয়নি। ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরাই প্রথম ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে, কারখানার অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে ও মজুরি বৈষম্যের প্রতিবাদে আন্দোলন করেন। সে সময় থেকেই মানবমুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যায় নারীমুক্তির আন্দোলন।

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক তো ক্লারা জেৎকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা জেৎকিন প্রতি বছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন।

নারীর মুক্তির পথে মিশে আছে বহু মানুষের আত্মদান। নারীর ভোটাধিকারের জন্য সাফ্রোজেটদের আন্দোলন, রুশ বিপ্লব, চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সব কিছুই নারীর মুক্তির ধারা বেগবান করেছে।

ভার্জিনিয়া উলফ, সিমোন বোভেয়ার, বেটি ফ্রিডানসহ মানবাধিকার লেখকরা নারীর পরাধীনতার স্বরূপ উদঘাটন করেছেন, মানবসমাজের চিন্তাজগতে নিয়ে এসেছেন বিপ্লব।

ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর উপর নির্যাতন কম হয়নি। কখনও ধর্মের নামে, কখনও সামাজিক প্রথার নামে তার কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছে বারে বারে। গার্গী, মৈত্রেয়ীর মতো শাস্ত্র-বিশেষজ্ঞ নারী যে ভূখণ্ডে ছিলেন সেখানেই পরবর্তীতে নারীর বিদ্যাশিক্ষা পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

পুরুষতন্ত্র পারিবারিক নির্যাতনের মাধ্যমে কীভাবে নারীর কণ্ঠ রোধ করেছিল তা একটি বহুল প্রচলিত কিংবদন্তির মাধ্যমেই বোঝা যায়। লীলাবতী বা খনা ছিলেন প্রাচীন ভারতের এক বিশিষ্ট নারী। বলা হয তিনি ছিলেন সিংহলের রাজকন্যা। তবে তাঁর নামে প্রচলিত বচনগুলো বাংলায় হওয়ায় তাঁকে বাংলার অধিবাসী বলে ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। খনা তাঁর স্বামী এবং শ্বশুরের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী ছিলেন। শ্বশুর জ্যোতিষ বরাহ মিহিরের চেয়ে খনার গণনা বেশি সঠিক ছিল। ফলে শ্বশুরের চেয়ে খনার প্রতিপত্তি বেড়ে যায়।

কিন্তু নারীর এত বাড় সহ্য করা মুশকিল। তাই শশুরের আদেশে স্বামী খনার জিহ্বা কর্তন করে| ফলে রক্তপাতে মৃত্যু হয় খনার। গল্পটি রূপক হিসেবেও খুব শিক্ষণীয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে নারী মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে ভাস্বর হয়ে উঠবে এভাবেই তার কণ্ঠরোধ করবে পুরুষতন্ত্র।

এদেশে গৌরীদান ও রোহিণীদানের নামে বাল্যবিবাহের যাঁতাকলে পিষ্ট করা হয়েছে নারীকে। সতীদাহের নামে নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বিধবার উপর নিয়মকানুনের বোঝা চাপিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তিলে তিলে। পর্দা প্রথার নামে নারীর উপর কী ভয়াবহ নিষ্পেষণ চলেছে তা বেগম রোকেয়ার 'অবরোধবাসিনী' গ্রন্থের পাতায় পাতায় বিধৃত হয়েছে। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সরলা ঘোষাল, নবাব ফয়জুননেসা, বেগম রোকেয়ার মতো মহামানবদের প্রচেষ্টায় এদেশের নারীর জন্য ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হয়েছে জীবনের পথ। পরবর্তীতে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামাল এগিয়ে এসেছেন নির্যাতনের ঘেরাটোপ থেকে নারীকে বাঁচাতে।

একুশ শতকে পৌঁছে আমরা এখন কী দেখছি?

সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীও সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনের সংবাদ হয়ে আসছে তার উপর চলমান বিভিন্ন নির্যাতন। পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবের দিনেও তার উপর হামলা হয়েছে, চলেছে যৌন নির্যাতন।

গ্রিক পুরাণে দেখা যায়, ট্রয়ের রজকুমারী ক্যাসান্ড্রাকে দেবতা অ্যাপোলো বর দিয়েছিলেন ভবিষ্যদ্বাণী করার। বিনিময়ে তিনি শারীরিক সম্পর্ক গড়েন ক্যাসান্ড্রার সঙ্গে। পরবর্তীতে ক্যাসান্ড্রা অ্যাপোলোর পরিবর্তে নিজের পছন্দমতো মানুষকে প্রেমিক হিসেবে নির্বাচন করেন। অ্যাপোলো অভিশাপ দেন ক্যাসান্ড্রা সঠিক ভবিষ্যদ্বাণীই করবে কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করবে না। ট্রয় ধ্বংস, আগামেমননের মৃত্যু এসব কিছুর আগে প্রতিবারই ক্যাসান্ড্রা সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু তাতে ফল হয়নি। কেউ তার কথা শোনেনি।

বিশ্বে নারীর অবস্থা এখন ক্যাসান্ড্রার মতো। নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে, প্রতিবাদ করছে। অথচ তার প্রতিবাদে কেউ কর্ণপাত করছে না। বিশ্বে নারীদের মধ্যে গড়ে প্রতি তিন জনের একজন তার জীবনে ধর্ষণের বা গুরুতর প্রহারের শিকার হয়। নারীর উপর নির্যাতনের বেলায় উন্নত বিশ্ব-অনুন্নত বিশ্ব বলে কিছু নেই। ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশেও বছরে ৭৫,০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এই সেদিন জার্মানির মতো দেশে নববর্ষের উৎসবে নারীর উপর যৌন নির্যাতন হয়েছে।

আফ্রিকার দেশগুলোতে নারী একদিকে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের অঙ্গহানি করা হচ্ছে খৎনার মাধ্যমে যার কারণে অনেক কিশোরী অতিরিক্ত রক্তপাতে মৃত্যুবরণ করছে। এশিয়ার অনেক দেশে অনার কিলিং বা পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে নারীহত্যা বৈধ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অহরহ। এই তো কিছুদন আগে বিশ্বখ্যাত পপতারকা ম্যাডোনা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।

দিল্লিতে মেডিকেল ছাত্রী নির্ভয়ার গণধর্ষণের শিকার হওয়া বিশ্বব্যপী ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। তারপরও দিল্লিতে আরও অনেক ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের রায়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। পাকিস্তানের মুখতারান মাইয়ের উপর গণধর্ষণের ঘটনাও বিশ্বব্যাপী নিন্দিত। সেদেশে নারীর উপর নির্যাতন ও ধর্ষণ চলেছে একের পর এক। আর কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যা, নারীর অধিকার হরণ, তার উপর পারিবারিকভাবে নিপীড়ন নির্যাতন চালানো, এসব তো ঘটছেই অহরহ।

কোথায় নারী নিরাপদ? বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কায়দায় তার উপর চলছে নির্যাতন ও সহিংসতা। জন্ম নেওয়ার আগে ভ্রূণ অবস্থাতে তাকে হত্যা করা হচ্ছে, জন্মের পর অবহেলা করা হচ্ছে, অপুষ্টির শিকার হতে হচ্ছে তাকে, হতে হচ্ছে নানা রকম বৈষম্যের শিকার। কিশোর বয়সে তার অঙ্গহানি করা হচ্ছে। অপ্রাপ্ত বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের হাতে শারিরীক মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, পথে ঘাটে তাকে ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে। পারিবারিক সম্মানরক্ষার নামে তাকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মৃত্যুর মুখে।

অনেক দেশে তাকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়নি; দেওয়া হয়নি অর্থনৈতিক অধিকার। কোথাও তাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, কোথাও বা তাকে যৌনসামগ্রী হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে। নারীর উপর এভাবে যদি নির্যাতন ও সহিংসতা চলতে থাকে তাহলে এক সময় নারীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকবে। এক পর্যায়ে মানবপ্রজাতির বংশধারাই পড়বে হুমকির মুখে।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'নারীর মূল্য' প্রবন্ধে বলেছিলেন জলের মতোই নারীর মূল্য। কোনোদিন যদি জলের অভাব দেখা দেয় তখন জীবনধারণ মুশকিল হয়ে পড়ে। নারীর অভাবে মানবজাতির অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে। তখন বোঝা যাবে নারীর মূল্য।

নারী-পুরুষ সবাইকে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ধৃতরাষ্ট্র যদি দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিবিধান করতেন তবে কুরুক্ষেত্রে আঠার অক্ষৌহিনী মানুষের প্রাণনাশ হত না। নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সকল প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধের এখনই সময়। নইলে কুরুক্ষেত্রের সর্বনাশ এড়ানো সম্ভব হবে না।

ক্যাসান্ড্রার কথায় কর্ণপাত করলে ট্রয় ধ্বংস এড়ানো যেত, আগামেমননও প্রাণ বাঁচাতে পারতেন। সমাজ ও সভ্যতার ধ্বংস এড়াতে হলে তাই এই সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলা প্রয়োজন যেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য নেই। যে সমাজ সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এটি আসলে নারী দিবসের অঙ্গীকার।