মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘বজায়যোগ্য’ (!) শিক্ষকবন্দনা ও মর্যাদার আন্দোলন

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম
Published : 4 Feb 2016, 08:22 AM
Updated : 4 Feb 2016, 08:22 AM

১০ জানুয়ারি, ২০১৬ তারিখ বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলয়নায়তনে একটি সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম। মূল বক্তা ছিলেন জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের বর্তমান পরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. সেলিম জাহান। তিনি অনেক বছর ধরে দেশে থাকেন না, কর্মসূত্রে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান, অথচ তাঁর পুরো বক্তব্যে একটি ইংরেজি শব্দও না বলে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বাংলায় বক্তব্য রেখে গেলেন।

তিনি তাঁর বক্তব্যে 'সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট'এর বাংলা করেছিলেন 'বজায়যোগ্য উন্নয়ন' যাকে আমরা 'টেকসই উন্নয়ন' বলে জানি। তার কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, উন্নয়ন কখনও টেকসই হতে পারে না– এটা লোহা বা এ জাতীয় কোনো বস্তু নয় যা টেকসই হবে।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গত কয়েক মাস ধরে শিক্ষকদের সম্পর্কে একই ধারায় যে বক্তব্য রাখছেন, সে প্রেক্ষিতে আমার এ লেখায় 'বজায়যোগ্য' শব্দটি মনে হল তুলনীয়। ১১ জানুয়ারি, ২০১৬ তারিখেও তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ করেছে। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় যখন দেখি দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন:

"যখন খাবারের টান থাকে, তখন পেটের খাবারের কথা চিন্তা থাকে। সেই পেটের খাবারের চিন্তা আমরা দূর করে দিয়েছি বলে, এখন প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি– এটাই বাঙালির স্বভাব।"

"আর যদি সচিবের মর্যাদাই লাগে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরা সচিব হয়ে যান বা পিএসসিতে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নেন। তাহলে তো আর কোনো সমস্যা থাকে না।"

"তারা কি চান তাদের বয়স চাকরিজীবীদের মতো ৫৯এ নিয়ে আসি। তারা তো এখন ৬৫ বছর বয়সে অবসরে যাচ্ছেন। কথা ধরলে আসলে অনেক কিছুই ধরা যায়।"

প্রধানমন্ত্রীর শেষ বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করি, আসলেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনেক কথাই ধরা যায়। তিনি গত বছর জাতিসংঘ অধিবেশন (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সামিট) থেকে দেশে ফিরে সাংবাদিক সম্মেলনেও শিক্ষকদের নিয়ে একই ভাষায় বিষোদ্গার করেছিলেন যাকে সুবন্দনা বলে গণ্য করা যাবে না। জাতীয় বেতন কাঠামোতে শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমনের প্রেক্ষিতে শিক্ষকরা যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন তার প্রেক্ষিতেই প্রধানমন্ত্রীর এ 'বজায়যোগ্য' (!) শিক্ষকবন্দনা। এ যেন বহমান এক প্রক্রিয়া!

সাধারণত আমরা বন্দনাকে সুবন্দনা হিসেবেই দেখি। প্রধানমন্ত্রীর বন্দনায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও অধ্যাপক রফিকের উদাহরণ ছাড়া আর কারও সুবন্দনা দেখিনি । শিক্ষকতা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় অসঙ্গতি যে নেই তা বলা যাবে না। কীভাবে তা দূর করা যায় তা নিয়ে তিনি দিতে পারতেন সঠিক দিকনির্দেশনা। অর্থমন্ত্রীও শিক্ষকদের সম্পর্কে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেছিলেন। পরে অবশ্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে দুঃখ প্রকাশ করা তো দূরের কথা, অনুতপ্ত হতেও দেখিনি।

বর্তমান সরকারের প্রণীত 'জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০'এ শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্ব (অধ্যায় ২৫) বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:

''আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে।''

একইভাবে বর্তমান সরকারপ্রধানের রাজনৈতিক দলের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে 'শিক্ষা ও মানব উন্নয়ন'এ বলা হয়েছে যে, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বর্তমান শিক্ষানীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে । কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না?

আজকের প্রধানমন্ত্রীর বাবা, বঙ্গবন্ধু তাঁর দু'কন্যাকে এমন দুজন ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন যাদের একজন ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আর একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হয়, কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ যাতে বাধাগ্রস্ত না করে এখানকার শিক্ষার পরিবশে, তার জন্য তিনি ১৯৭৩এর অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি তা ভুলে গেছেন?

১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। ঐ দিন তাঁর উদ্দেশ্যে যে মানপত্র লেখা হয়েছিল যা পরবর্তীতে আজকের প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রদান করেছিল। তিনি সেটি পড়ে চোখের জল ফেলেছেন। ফেলারই কথা। কিন্তু তিনি কি কখনও জানতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কী মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি শিক্ষকদের সম্মান করেন। অথচ যখন মর্যাদা ও বেতন-ভাতা সংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করে আসছিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ ৫ কী ৬ বার প্রধানমন্ত্রী বরাবর পত্র দিয়ে সাক্ষাৎ চাইলেও তিনি একবারও তা দেননি। কেবল শিক্ষকরা যখন পূর্ণ কর্মবিরতিতে গেলেন, তখণ তিনি গণভবনে বিভিন্ন পেশাজীবীদের সন্মানে আয়োজিত পিঠা উৎসবে শিক্ষক নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ক্লাসে ফিরে যাবার আহ্বান ও সমস্যার সমাধানে আশ্বাসবাণীও শুনিয়েছেন তাদের।

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানেই কিন্তু শিক্ষক নেতৃবৃন্দ আন্দোলন স্থগিত করে ক্লাসে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু দাবি বাস্তবায়ন না হলে ৩ ফেব্রুয়ারি সভা করে পরবর্তী কর্মসূচী প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। দাবি আদায়ে কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে সে ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষকরা অবহিত নন। তাছাড়া শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত সকল দাবির যথাযথ বাস্তবায়ন হবে কি না সে বিষয়েও সংশয় রয়েছে।

আজকের প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী (তাঁরা যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না) এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে আসতেন শিক্ষকদের পরামর্শ নিতে। সময় পাল্টেছে। রাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে, এসেছে শিক্ষক রাজনীতিতেও। মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। কিন্তু তিনি কি কখনও নিজেকে জিজ্ঞেস করেছেন কেন তাঁর দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও পৃথিবীর ১০০, ২০০, ৩০০, এমনকি ৫০০ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই? তিনি কি কখনও তাঁর অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন কেন দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটের ১ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ হয় গবেষণা খাতে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আরও কয়েকটি প্রশ্ন জেগেছে মনে:

এক, সরকারের কাছে সরকারি চাকরিজীবীদের (বিশেষ করে সচিবদের) তুলনায় শিক্ষকরা কতটুকু সম্মানীয় বা শ্রদ্ধেয়?

দুই, শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থানই-বা কেমন?

তিন, ভবিষ্যতে পিতামাতারা কি তাদের সন্তানদের শিক্ষকতা পেশায় উৎসাহিত করবেন?

চার, সুশিক্ষা প্রদানে শিক্ষকরা কতটুকু দায়বদ্ধ?

পাঁচ, শিক্ষক সমিতি বা ফেডারেশনের হাতে কি যথার্থ ক্ষমতা রয়েছে?

শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফলে শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে ভালো ও অধিকতর মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় উৎসাহিত করা জরুরি। ১০ জানুয়ারি, ২০১৬ তারিখের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখতে পেলাম, ৬০ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশ গিয়ে আর ফেরেননি। তাদের কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন। কাউকে কাউকে পদচ্যুত করা হয়েছে। তাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেনা রয়েছে যা অচিরেই পরিশোধ করা উচিৎ। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন সেটাই স্বাভাবিক।

তবে আমি বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে দেখতে চাই। যে কারণেই হোক, কিংবা যেভাবেই হোক, এই ৬০ জন মেধাবী শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধরে রাখতে পারেনি। দেশে যদি তাদের আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা, গবেষণা সুবিধা দিতে পারা যেত তাহলে হয়তো তাঁরা বিদেশে থেকে যেতেন না।

এশিয়ার সিঙ্গাপুরে সবচেয়ে যোগ্য গ্রাজুয়েটদের মধ্যে থেকে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়ে থাকে এবং সে সঙ্গে তাদেরকে আকর্ষণীয় বেতনও প্রদান করা হয়। সর্বশেষ কিউএস ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংএ বিশ্বে ১২ ও ১৩ তম স্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুরের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়।

চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও হয়েছে বিস্ময়কর উত্থান। ২০১৩ সালে 'বৈশ্বিক শিক্ষক মর্যাদা সূচক' (গ্লোবাল টিচার্স স্ট্যাটাস ইনডেক্স) নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল লন্ডন থেকে। যেখানে দেখা গিয়েছে বিশ্বের ২১ দেশের মধ্যে চীনেই শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। উচ্চশিক্ষার জন্য চীনে ছিলাম প্রায় সাড়ে চার বছর। দেখেছি সাধারণ মানুষ এমনকি সরকার ও সরকারপ্রধান শিক্ষকদের কীভাবে সম্মান করেনে। চীন সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। সেখানে গবেষণা খাতেও প্রচুর অর্থ বরাদ্দ রয়েছে।

সামাজিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে শিক্ষকের মর্যাদার পাশাপাশি সরকারের একটি গুরুদায়িত্ব হল, সবচেয়ে মেধাবীরা যেন শিক্ষকতা পেশায় ঢুকেন তার জন্য আকর্ষণীয় বেতনের পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনে সর্বাত্মক শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। সে জন্য রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক ও প্রশাসক নিয়োগে প্রভাব বিস্তার বন্ধ করতে হবে।। গবেষণা খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করাও জরুরি।

এ সব কিছুর সত্যিকার প্রতিফলন যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ধারাবাহিকভাবে আসবে, তখনই হবে 'বজায়যোগ্য' সুবন্দনা।